শেষ পাতায় সামাপ্তি পর্ব ৯

0
330

#শেষ_পাতায়_সমাপ্তি
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৯

নিস্তব্ধ,শীতল পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলো হু হু কান্নার শব্দে। পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া। প্রতিটি কান্নার সুর কেমন বিষাদে মোড়ানো। কারো বুক পুড়ে যাওয়া গন্ধে বি’ষাক্ত লাগছে চারিপাশ। করুণ কান্নার শব্দ কারো হৃদয় নাড়িয়ে দিচ্ছে তো কারো হৃদয় তিক্ত করছে। আহাজারিতে মাটি চাপড়াতে লাগলো লুনার মা।
মেজ মেয়েটা এভাবে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো? চন্দ্রা দীঘিটি যেন ‘তিতাসনগর’ এর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। লুনার নাম নিয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন। আজ সকাল দশটার সময় লুনার লা’শ পাওয়া গিয়েছে চন্দ্রা দীঘিতে। রাতে খাবার খেয়েই ঘুমিয়েছে। সকালে মেয়েকে ডাকতে গিয়ে লুনার মা দেখলেন বিছানা ফাঁকা। ভেবেছিলেন হয়তো বাথরুমেই আছে। সময় গড়িয়ে গেলো মেয়েকে ডেকেও কোনো সাড়া পেলেননা। ঘন্টা দু’য়েক যাওয়ার পরই লুনার বাবা আর ভাইয়েরা মিলে তাকে খোঁজা শুরু করে। চন্দ্রা দীঘিতে মেয়ের তুলতুলে নরম দেহ ভেসে উঠতে দেখে ধপ করে বসে পড়েন লুনার বাবা।

কলেজ যাওয়ার পথে লুনার খবর শুনেই চার বন্ধু লুনার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। মোমের মতো শরীর নিথর হয়ে পড়ে আছে। পরান, হাফি দূরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। ফাহিম ও উপস্থিত আছে। ভালোবাসা হারানোর বেদনা সেই বুঝে যার ভালোবাসা হারিয়ে যায়। চোখমুখ লাল হয়ে আছে ফাহিমের, লোক প্রশ্নের কারণে কাঁদতে পারছেনা। তার চোখ কাঁদছেনা ঠিকই তবে ভেতরটা কাঁদছে। পাখি আর চৈতালি লুনার লা’শ ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ছোটবেলা থেকে একসাথে এতগুলো বছর কাটিয়ে এসেছে। অনার্স তৃতীয় বর্ষে এসে পাঁচজন থেকে একজন খাঁচা ছেড়ে পালিয়ে গেলো?

গ্রামেরই একজন বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন,

-“এমন কাইন্দা কাইটা মাইয়াডার পাপ বাড়াইতাছো ক্যান? সইরা বস। হায়াত শেষ, দুনিয়া ছাইড়া চইলা গেছে। কি দরকার আছিলো চন্দ্রা দীঘির ধারে যাওনের?”

লুনার মৃ’ত দেহ ছেড়ে দূরে বসলো চৈতালি। একটু দূরে বসে থাকা লুনার মাকে জড়িয়ে ধরলো। চৈতালি আর পাখিকে পেয়ে কলিজা জ্বলে উঠলো। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন লুনার মা।

-“আমার মাইয়ার কি দোষ আছিলো? ওই চন্দ্রার ক্যান নজর পড়লো আমার মাইয়ার উপর?”

-“আপনি শান্ত হন আন্টি। আপনি এভাবে ভেঙে পড়লে বাঁকি সন্তানদের কে দেখবে?”

চৈতালির কথায় লুনার মা আরো আহাজারি শুরু করলেন,

-“মা গো আমার রঙের টুকরা টা এমনে দুনিয়া ছাইড়া গেলো গা? এই শোক আমি ক্যামনে সামলাই?”

গোসলের জন্য যখন লুনার নিথর,নিশ্চুপ দেহটা তুলতে দুজনকে ডাকলো। চৈতালি উঠে গেলো। এতক্ষণ যাবত খেয়াল না করলেও এখন বেশ মনযোগ সহকারে চৈতালি খেয়াল করলো লুনার শরীরে অসংখ্য আঁচ’ড় কা’টা দাগ। কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়তেই পায়ের কাছে ধরা মহিলা ধমক দিলেন চৈতালিকে।

-“এই মাইয়া, এমনে খাড়াইয়া আছো ক্যান? পা চালাও।”

লুনার দেহে চোখ রেখেই চৈতালি বিজ্ঞদের মতো প্রশ্ন করে বসলো,

-“সত্যিই কি লুনা দীঘিতে ডুবে ম’রে’ছে, নাকি কোনো নর’পশুর খাদ্য হয়েছে?”

চৈতালির কথায় উপস্থিত সবাই চুপ করে ওর কথায় মনযোগ দিলো।
একজন মহিলা বলে উঠলো,

-“ও মাইয়া, তোমার এমন মনে হইতাছে ক্যান?”

চৈতালি আঙ্গুল দিয়ে লুনার শরীরে সুস্পষ্ট দাগ গুলো ইঙ্গিত করলো। ওই মহিলা আবার ও বললেন,

-“যারা যারা দীঘিতে ডুইবা মর’ছে তাগো সবার শইলে এমন দাগ আছিলো। চন্দ্রাবতীর আত্মা এমন ভাবে আঁ’চড় কা’ইটা মা’রছে সবাইরে।”

চৈতালি অবাক হয়ে বলল,

-“আপনাদের কথায় আশ্চর্য না হয়ে পারছিনা। চন্দ্রাবতী এসে লুনাকে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে মে’রে ফেলেছে? আবার আঁ’চড় ও কে’টেছে?”

-“এই মাইয়া কি কইবা খোলসা কইরা কও?”

চৈতালি দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলো,

-“আমি এটাই বলতে চাইছি যে লুনা ডুবে মা’রা যায়নি। কারণ লুনা চন্দ্রা দীঘি খুব ভ’য় পেতো। দিনের বেলায় আমাদের সাথেও দীঘির পাশ দিয়ে যেতো না। তাহলে এই রাতের বেলা একা একা কেনো যাবে? তারউপর শরীরের দাগ গুলোই বলে দিচ্ছে ও কোনো মানুষরূপী জানো’য়ারের শিকার। শুধু লুনা নয় বাকি মেয়েরাও এই দলের অন্তর্ভুক্ত।”

চৈতালির কথাগুলো সবার টনক নাড়িয়ে দিলো। তবুও অনেকেই এখনো বিশ্বাস করে যাচ্ছেন লুনাকে চন্দ্রাবতী এসে ডুবিয়ে মে’রেছে। খুবই হাস্যকর কথা। যেখানে একটা মানুষের অস্তিত্বই নেই সেই মানুষটা কিভাবে অন্য মানুষ মা’রতে পারে? এনামুল হক পর্দার বাইরে থেকে চৈতালিকে ধমকে উঠে বলল,

-“আজেবাজে কথা না বলে লা’শ বের করো। তাড়াতাড়ি মাটি দিতে হবে।”

এতক্ষণ যাবত একটা ভারী লা’শ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় বেশ ক’ষ্ট হয়েছে। দ্রুত গোসল খানায় নিয়ে যাওয়া হলো লুনাকে।
লুনার মা চৈতালিকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলো,

-“সত্যি কইরা কওনা মা! আমার মাইয়ারে কেডায় মা’র’ছে।”

চৈতালি উনাকে শান্ত করতে বলল,

-“সেটা তো জানিনা আন্টি, তবে আমি নিশ্চিত যে লুনা একা একা দীঘির পাড় যাবেনা।”

এনামুল হক বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে বেশ ফাল পাড়ছেন। তার কথা হচ্ছে চৈতালি অযথাই সবার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করছে। এই মেয়ের সাথে কার কি শত্রুতা থাকতে পারে?

চৈতালি তাচ্ছিল্য হেসে বলল,

জীবন যুদ্ধে আমরা সবাই খুব নিখুঁত অভিনেতা। চলচ্চিত্রে যেমন নায়ক নায়িকা নিজের আসল ব্যক্তিত্ব বিলীন করে একটা নকল চরিত্রে নিজেকে আবৃত করে? তেমনি আমাদের সমাজের মানুষগুলো ও মুখোশের আড়ালে নিজের আসল ব্যক্তিত্বকে আড়াল করে রাখে।

সব কিছু পাশ ফেলে বিদায় জানানো হলো লুনাকে। একে একে সবাই চলে গেলো। চৈতালি আর পাখি আসার সময় লুনার মা আরেক দফা কান্নাকাটি করলেন।

চৈতালি আর পাখিকে পরান আর হাফি বাড়ি পৌঁছে দিলো।
মেয়ের চোখেমুখের করুণ অবস্থা দেখে হাসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। লুনা’র বাড়িতে হওয়া সব কথাই হাসির কানে এসেছে। মেয়েটা এখনো হয়তো মায়ের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা ভুলতে পারেনি। তাই বান্ধবীর মৃ’ত্যুতে সবার দিকে আঙ্গুল তুলছে। এই গ্রামে খা’রা’প মানুষের অভাব নেই। কে বা কারা লুনার সাথে একাজ করেছে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায়না। একবার যদি গ্রামের মানুষের মস্তিস্কে কুসংস্কার ঢুকানো যায় তবে সেটা বের করা কঠিন হয়ে পড়ে।

————————

লুনার মৃ’ত্যুর চারদিনের দিন সবাই কলেজের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। এলাকার আঁকাবাঁকা পাকা রাস্তাগুলোতে ভাঙ্গন ধরেছে। রিকশায় চলাচলে কোনো আরাম নেই। বরং হাড় মাংস চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রতিবার ইলেকশনের পূর্বে জনপ্রতিনিধিরা বড় বড় ভাষণ দেয়। অথচ ভোটে জয়যুক্ত হওয়ার পর তারা হ্যালির ধূমকেতুর মতো হারিয়ে যায়। যাকে ৭৫-৭৬ বছর অন্তর অন্তর দেখা যায়। তেমনি জনপ্রতিনিধি দের ও তাদের প্রয়োজনের সময় দেখা যায়।
সরু পথ ধরে কথা বলতে বলতেই হাঁটছিলো চার বন্ধু। চায়ের দোকানে লুনার বাবাকে দেখে সেদিকে গেলো ওরা। মানুষটির থলথলে শরীরের চামড়া কেমন মলিন হয়ে আছে। উদাস নয়নে তাকিয়ে আছেন চায়ের কাপে। লুনার বাবার সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করে চৈতালি,হাফি,পরান,পাখি উনাকে পরামর্শ দিলেন পুলিশ কেস করতে। লুনার সাথে খা’রা’প কিছু হয়েছে। তবে পুলিশের পেছনে প্রচুর টাকা ঢালতে হবে। এরা যেদিকে টাকার গন্ধ পায় শুঁকতে শুঁকতে সেদিকেই চলে যায়।

দোকানে উপস্থিত ছিলেন এনামুল হক। অত্যধিক রা’গে ফেটে পড়ছেন তিনি। চোখমুখের অবস্থা অত্যন্ত রুষ্ট।

————————————

দুদিন যাবত সাদমানের দেখা নেই। কোনো একটা কাজ নিয়ে সে ব্যস্ত। মানুষটাকে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠলেও চৈতালি নিজেকে কঠিন করে নিলো। ঠিক করলো আর নিজের আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দেবে না। উচ্ছন্নে যাক ওই ব’দ লোক। তাতে ওর যায় আসেনা, কিচ্ছু যায় আসেনা।
মন বলছে সত্যিই কি যায় আসেনা?

চিন্তা ভাবনাগুলো ভেতরে রেখে মস্তিষ্কের দ্বার আটকে দিলো চৈতালি। বাসায় ফিরে বসার ঘরে পা রাখতেই মায়ের শক্ত চোয়াল দৃষ্টিগোচর হলো। সোফায় উল্টো হয়ে বসে আছে কেউ। তার ব্যঙ্গাত্মক কথা শুনে র’ক্ত ছলকে উঠলো চৈতালির। মাথার ভেতর দপদপ করে জ্বলে উঠলো অগ্নিশিখা।

-“তোমার মেয়েটা খুব বাড় বেড়েছে। মেয়ের লাগাম টেনে ধরো। নয়তো মায়ের মতো অবস্থা হবে। তোমার ভাগ্য অতি উত্তম বলে এখনো মানুষের মধ্যে জানাজানি হয়নি তারা একই সমাজে একজন ধ’র্ষি’তার সাথে জীবনযাপন করছে। মেয়েকে বুঝিয়ে নিও যাতে বেশি লাফালাফি না করে। নয়তো প’তি’তা পল্লিতে কয়েকশ জনের খাবার বানিয়ে দেবো। তোমার মেয়েটা ও কিন্তু তোমার মতোই হয়েছে। আমি আজও ভুলতে পারিনা সেই দিনটির কথা। তোমার শরীরের মাদকতার নেশা আমাকে দিনদিন মাতাল করে দিচ্ছে। আরও এক রাত দেবে নাকি আমাকে?” বলেই হাসির আপাতমস্তক বি’শ্রী নজরে দেখে কুৎসিত হাসলো এনামুল হক।

সজোরে গালে চ’ড় বসিয়ে দিলো হাসি। এনামুল হক রাগলেন না। বরং বেহা’য়ার মতো বিকৃত হেসে বলল,

-“তোমার সব ছোঁয়াই ভালো লাগে।”

চৈতালির শরীর থরথর করে কাঁপছে। অতিরিক্ত রাগে মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়লো। র’ক্তজবার মতো রঙিন হয়ে উঠলো চোখের শুভ্র অংশ। গলার হাড় গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দারুণ ভাবে। এই মানুষটাই তার মায়ের ইজ্জত হরণকারী? সেদিন দু’চারটে কথা শুনতে পেলেও চৈতালি ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি মানুষটা কে। আজ যেহেতু শিকার নিজেই ধরা দিয়েছে তবে শুভ কাজে দেরি কিসের?
ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো চৈতালি। তাকে দেখতে পেয়েই এনামুল হক বি’শ্রী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

-“মামনী যে উপস্থিত।”

চৈতালি বাক্যব্যয় করলোনা। সোজা বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো। দরজা বন্ধ করার পূর্বে মাথা বাড়িয়ে হাসিকে বলল,

-“মা, চাচার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করো। আমি আসছি আপ্যায়ন করতে।”

কিটকিটিয়ে হেসে উঠলেন এনামুল হক।
-“বসি তবে। মামনীর কথা তো ফেলতে পারিনা। যাও হাসি নাস্তা পানির ব্যবস্থা করো।”

হাসি ঘৃ’ন্য দৃষ্টি ফেলে একদলা থুতু ফেললো।
হুমায়ুন কবির দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখে চলেছেন। সে মনে মনে নতুন ছক কষতে ব্যস্ত।

#চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here