শেষ পাতায় সামাপ্তি পর্ব ১৬

0
374

#শেষ_পাতায়_সমাপ্তি
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৬

হসপিটালের সাদা বেডে বিভিন্ন রোগ নিয়ে শুয়ে আছে শত শত রোগী। ফিনাইল এর তীব্র গন্ধে ভেতরটা উগলে আসছে। কারো প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রনায় তীব্র আহাজারি। বুকে চাপড় দিয়ে কেঁদে যাচ্ছে পরিবারের লোকজন। মেয়েটার লা’শ সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ডাক্তার রা সমবেদনা জানাচ্ছে। সমুদ্রের ঠোঁটে কিছু জয়ের হাসি, তৃপ্তির হাসি। একজন নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল ডঃ হিসেবে সমুদ্র দুদিনের মাথায় হসপিটালে জয়েন করেছে। লা’শটি পোস্টমর্টেম করার সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। পোস্টমর্টেম বেশিরভাগ সময় ডাঃ সমুদ্র কিংবা ডঃ সমীর কর্মকার করে থাকেন। আজ ডঃ সমীরের উপর দায়িত্ব পড়লো। যেহেতু দুদিন আগে ডঃ সমুদ্র বুকে আ’ঘা’ত পেয়েছেন তাই ডঃ সমীরের উপর দায়িত্ব দেওয়া হলো। সমুদ্র নিজ থেকেই ডঃ সমীরের কাছ থেকে নিজের ঘাড়ে দায়িত্ব নিয়ে নিলো।
ওয়ার্ডবয় সব ব্যবস্থা করে নিলো। আর আধাঘন্টা পরই ডঃ সমুদ্র পোস্টমর্টেম রুমে প্রবেশ করবেন।

পোস্টমর্টেম রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখা। ওয়ার্ডবয় রফিক দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। পোস্টমর্টেম রুমের দরজা ঠেলে সমুদ্র বেরিয়ে আসলো। শরীরটা একেবারে চাঙ্গা হয়ে আছে। নারীদের শরীরের ঘ্রাণ তাকে বড্ড টানে। হসপিটালে যতগুলো অল্প বয়সি, অবিবাহিত মেয়ে মারা যায়? এদের মধ্যে যাকে মনে ধরে তার লা’শের সাথেই যৌ’ন’স’ঙ্গ’মে লিপ্ত হয় সমুদ্র। আজ ও তার ব্যতীক্রম হলোনা। ডঃ সমীরের বলা কথাটি মনে করে বাঁকা হাসলো সমুদ্র। ওয়ার্ডবয় রফিকের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে সমুদ্র আফসোসের সুরে বলল,

-“উপস! ডঃ সমীর আপনি ধরতেই পারলেন না মেয়েদের নন-ভার্জিন হওয়ার রহস্য।”

যথা সময়ে মেয়েটির পোস্টমর্টেম করা হলো। অধিকাংশ মেয়েদের মতো এই মেয়েটার রিপোর্টে ও নন-ভার্জিন আসলো। ডঃ সমীর এটা দেখে চিন্তিত হয়ে এ বিষয়ে কথা বলতে সমুদ্রের কাছে গেলেন। সমুদ্র ব্যাপারটাকে তুচ্ছ করে হেলায় উড়িয়ে দিলো। নিশ্চয়ই এরা বয়ফ্রেন্ডের সাথে রাত কাটিয়েছে।

—————

চারদিকে রটে গেলো নুরুল হক চৈতালি মেয়েটাকে ভ’য় দেখিয়ে তার খু’নি ছেলের জামিন করিয়ে নিয়েছে। দেখতে দেখতে ভোটের দিন ঘনিয়ে আসলো। দিনশেষে যখন ভোট গননা করা হলো তখন দেখা গেলো নুরুল হক মাত্র অল্প কয়েকটা ভোট পেয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আফজাল খান পাস করে গেছেন। আকস্মিক চাপ নিতে না পেরে নুরুল হকের বুকে ব্যথাটা হু হু করে বেড়ে গেলো। নির্বাচনের পুরোটা সময় সাদমান বাবার সাথে ছিলো। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। ভোটের আগে মোটামুটি অনেকগুলো ভোট নিশ্চিত করা ছিলো। তাহলে কি সেই মানুষগুলো পল্টি মেরেছে? বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলো সাদমান।

রাত্রিবেলা হসপিটাল থেকে ফিরে সমুদ্র বাবাকে দেখতে গেলো। দু-হাতে দুটো কফির মগ। একটা বাবার দিকে বাড়িয়ে অপরটিতে নিজ চুমুক বসালো।

-“শুনলাম ছোট ছেলেকে বিয়ে করাচ্ছো? কার অনুমতি নিয়েছো? যে মেয়েটার সাথে বিয়ে দিচ্ছো সে আমার হবু স্ত্রী।”

নুরুল হক ভেবেছিলেন ভোটে হেরে যাওয়ায় সমুদ্র বুঝি সান্তনা দিতে এসেছে। কিন্তু না। কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না। নুরুল হক চেয়াল শক্ত রেখেই বললেন,

-“যারা বিয়ে করবে তাদের দুজনের মত পেলেই হলো। তোমার মতামতে কিছু যায় আসেনা।”

সমুদ্র হাসলো। শব্দ করে কফি মগে চুমুক দিয়ে বলল,

-“যায় আসবে কি আসবেনা সেটা নাহয় পরেই দেখা যাবে। একটা কাজ করো, ঘুমিয়ে পড়ো। তোমার জন্য এখন একটা লম্বা ঘুম প্রয়োজন।”

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে কুটিল হাসলো সমুদ্র।
-“আজকের পর আর এই ঘুম ভাঙবেনা।”

সমুদ্রের দেয়া কফি পান করেই ঘুমিয়ে পড়লেন নুরুল হক।

সকাল সকাল নুরুল হকের বাড়িতে কান্নার ঢল নামলো। ভোটে হেরে যাওয়ার শোক সামলাতে না পেরে নুরুল হক হার্ট অ্যাটাক করে মা’রা গেছেন বলে ধারনা করা হয়। স্বয়ং তার ছেলে সমুদ্র চেকআপ করে জানিয়েছে বাবার মৃ’ত্যুর কারণ।

সবদিকের শোক কাটিয়ে উঠতেই সাদমান জানালো চৈতালিকে সে বিয়ে করতে চায়। সাথে করে কাজি নিয়ে এসেছে। ফাহমিদা স্বামী শোকে পাথর হয়ে গেছেন। স্বামীর মৃ’ত্যুর পূর্বে তার মুখ থেকে বড় ছেলের অবিশ্বাস্য কুকীর্তি সম্পর্কে জেনে নিয়েছেন। মা হওয়া যেখানে গর্ভের ব্যাপার সেখানে ফাহমিদার মনে হচ্ছে তিনি এই ছেলে গর্ভে ধারণ করে কলঙ্কিত হয়েছেন। সাদমানকে আর বাঁধা দিলেন না তিনি।
বিয়ের কথা শুনে প্রচন্ড অবাক হয়েছিলো চৈতালি। তাহলে সত্যিই কি সাদমান তার ইচ্ছে পূরণ করছে?

দুজনের মতের ভিত্তিতে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। সমুদ্র হসপিটালে আছে। বিয়ের খবর তার কান পর্যন্ত পৌঁছে ও গেছে। অতিরিক্ত রা’গে চেয়ারে লা’থি দিয়ে চেয়ার উল্টে ফেললো। অশ্রাব্য গা’লি’গা’লাজ করলো সাদমানকে।

পড়ন্ত বিকেলে সূর্যে তার রক্তিমা আভা ছড়িছে দিনের সমাপ্তি টানছে। আপন করে নিচ্ছে রাত। আকাশের সাথে সাথে আরক্তিম হলো চৈতালির ফুলো গাল দুটো। প্রশান্তি, ভ’য়, লজ্জা তাকে আঁকড়ে ধরেছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সে সাদমানের অর্ধাঙ্গিনী। মানুষটা এখন তার।

হালকা গলা ঝেড়ে পেছনে এসে দাঁড়ালো সাদমান। চৈতালি ঝট করে দাঁড়িয়ে গেলো। সাদমানের চোখে চোখ পড়তেই আড়ষ্টতায় মাথানিচু করে নিলো। লজ্জাবতী গাছের পাতার মতো নুইয়ে পড়ছে। আজ তার এতো লজ্জা কোথা থেকে এলো জানা নেই।

সাদমান চৈতালির মাথায় হাত রেখে ম্লান হাসলো।
লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-“আপনার চাওয়া আমি পূর্ণ করলাম। আশা করি আপনি আমার কথা রাখবেন।”

চৈতালি চট করে মাথা তুলে তাকালো। আবেগে জর্জরিত হয়ে সাদমানের ডান হাতের পিঠে চুমু খেলো।

সাদমান হাত সরিয়ে নিলো। বিব্রতকর কন্ঠে শুধালো,

-“আপনাকে আমি ভালোবাসতে পারিনি। আমার কাছে করা আপনার শেষ আবদার টা আমি পূরণ করলাম। জানিনা আমি কখনো আপনাকে মনে জায়গা দিতে পারবো কিনা? তবে আমার দিক থেকে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আপনার যাতে কোনো অসুবিধা নাহয়।”

সাদমান হাত সরিয়ে নেওয়ায় চৈতালি খানিকটা লজ্জা পেলো। ঘোরের বসে কি করে বসলো সে এটা? সে নাহয় মানুষটাকে ভালোবাসে। কিন্তু মানুষটা যে পুরোপুরি তার নয়। এই মানুষটার দেওয়া ব্যথাগুলো তার। মাথানিচু করে সাদমানের কথায় সম্মতি দিলো চৈতালি।

“আসি” বলে সাদমান বেরিয়ে যেতেই চোখ তুলে তাকালো চৈতালি। মাথায় ওড়না টেনে একবার পা বাড়ালো বাড়ির বাইরে। মাকে খুশির খবরটা দিয়ে আসা প্রয়োজন। যদিও মা বেঁচে থাকলে খুশি হতেন না চৈতালির বিয়ের কথা শুনে। তবুও মায়ের জানা উচিত।

আজকাল অনুও কেমন মন মরা হয়ে থাকে। বাবা- মা হারানোর যন্ত্রনা তারাই বোঝে যাদের বাবা মা নেই। আমরা দূর থেকে তাদেরকে সমবেদনা জানাতে পারি আর কিছু নয়। তাদের মনের ঘরে প্রবেশ করে দুঃখ গুলো ভাগ করে নিতে পারিনা। এই দুঃখ গুলো একান্তই নিজের হয়। যাকে বলে ব্যক্তিগত সম্পদ।

রাত বাড়লো কিন্তু সাদমান বাড়ি ফিরলোনা। সমুদ্র বাড়িতে থাকলে চৈতালি ঘর থেকেই বের হয়না। উঁকি দিয়ে দেখলো বসার ঘরে সমুদ্রকে দেখা যাচ্ছে। পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। তাই আর বেরুলো না চৈতালি।
হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো সাদমানের সাথেরই একটা ছেলে। নাম টিটু। তার দুচোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু বর্ষণ হচ্ছে। সে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে ফাহমিদাকে জানালো,

-“আম্মা, আম্মা সাদমান ভাই এক্সি’ডেন্ট করেছে। পাশের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার রা চেকআপ করে বললেন ভাই আর বেঁচে নেই।”

আকস্মিক খবরে ঘরের দরজাতেই পড়ে যেতে নিলেন ফাহমিদা। অনু মাকে কোনোমতে ঝাপটে ধরলো। সমুদ্র উত্তেজিত হওয়ার ভান করে বলল,

-“কি বলছিস কি তুই? আমার ভাই, আমার ভাই আর নেই?”

নাক টেনে চোখ মোছার ভান করলো সমুদ্র। একে বলে কুমিরের কান্না।

চৈতালি ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। এটাই কি তার নিয়তি? কপালে কি একটুখানি সুখ লেখা নেই? শেষ পর্যন্ত স্বামীর ভালোবাসাটা ও তার ভাগ্যে জুটলোনা।

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here