শেষ পাতায় সামাপ্তি পর্ব ৮

0
290

#শেষ_পাতায়_সমাপ্তি
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৮

-“বউ মা তুমি এভাবে আমার নাতনিকে বিয়ে দিতে পারোনা। ওর মতামত আমার মতামত জানার প্রয়োজন মনে করছো না তুমি? আমার নাতনির ভালোমন্দ চিন্তা করার জন্য এখনো আমি বেঁচে আছি।”

হুমায়ুন কবিরের কথায় হাসি হাত জোড় করে বললেন,

-“ধন্যবাদ বাবা। অনেক ভালোমন্দ চিন্তা করেছেন আমার আর আমার মেয়ের জন্য। দয়া করা আর চিন্তা করবেন না।”

বেশ অবাক হলেন হুমায়ুন কবির। কেননা হাসি কখনো তার সাথে এমন উঁচু বাক্য করেনি। বেশ থমথমে গলায় বললেন,

-“তোমার আজকের ব্যবহারে আমি বেশ হতাশ হলাম বউমা।”

তাচ্ছিল্য হাসলো হাসি। তীক্ষ্ণ চোখের আগুনে যেন ভ’ষ্ম করে দেবে হুমায়ুন কবিরকে।

-“আমার মেয়ের জন্য যে কেমন ভালোমন্দ চিন্তা করেন সেটা আমার জানা হয়ে গেছে অনেক আগেই। নিজ স্বা’র্থে ব্যবহার করছেন আমার সহজ সরল মেয়েটাকে। সুস্থ মেয়েটিকে দিনদিন অসুস্থ করে তুলছিলেন? আচ্ছা বাবা, আপনার বিবেকে বাঁধলো না নিজের নাতনিকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে?”

চমকে উঠলেন হুমায়ুন কবির। বুলি হারিয়ে গেলো তার। গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে গমগমে স্বরে বলে উঠলেন,

-“কি বলতে চাইছো তুমি? আমি নিজের নাতনি কে কেনো ব্যবহার করতে যাবো?”

-“বাবা, দয়া করে আর মি’থ্যে বলবেননা। আমি চাইনা চৈতালির মনে আপনার জন্য খা’রা’প ধারণা জন্মাক। আপনি দিনের পর দিন আমার মেয়েটার খাবারে ঔষধ মিশিয়ে তাকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করছেন। ভাগ্যিস আমি সেদিন আপনার লুকিয়ে চুরিয়ে খাবারে ঔষধ মেশানো দেখে নিয়েছি।”

হুমায়ুন কবির যেনো শক্তি পেলেন। ভেতরটা এবার তরতাজা হয়ে উঠলো। রাগত স্বরে বললেন,

-“তুমি আমাকে সন্দেহ করছো? আমি চৈতালির খাবারে কোনো উল্টাপাল্টা ঔষধ মেশাই নি। যেটা ওর শরীরের জন্য প্রয়োজন সেটাই দিয়েছি।”

হাসি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,

-“তাই বুঝি লুকিয়ে চু’রিয়ে ঔষধ দিয়েছিলেন? আপনার উপর সন্দেহ দূর করতেই আমি সেদিন খাবার সরিয়ে রেখেছিলাম। এই খাবার ডঃ রাজনের হাতেই পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছি। আপনি?ছিঃ বাবা।”

হুমায়ুন কবিরের গলা উঁচু করে কথা বলতে গেলেই থামিয়ে দিলো হাসি।

-“আর একটা কথা ও বলবেন না বাবা। নয়তো পরিণাম হিসেবে এই বয়সে জে’ল এর ঘানি টানতে হবে। সাথে নিজের সম্মান,খ্যাতি সব ধুলোয় মিশে যাবে।”

আর কথা বলার পথ খোলা রইলোনা। চুপ মেরে গেলেন হুমায়ুন কবির। হাসি বেরিয়ে আসলো।
মায়ের পায়ের শব্দ শুনেই আড়াল থেকে সরে গেলো চৈতালি। এলোমেলো পায়ে এলোমেলো ভাবনা মাথায় নিয়েই ঘরে ঢুকলো। দাদা এমন করতে পারে ভাবতে ও ঘৃ’ণা হচ্ছে। এত বছর যাবত তাকে মানসিক চিকিৎসার কথা বলে উল্টো মানসিক রোগী বানিয়ে দিচ্ছে?
আর ভাবতে পারলোনা চৈতালি। তার সাথেই কেনো এমন হয়? প্রিয় মানুষগুলো কেনো তাকে ঠ’কিয়ে যায়, দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়।

চৈতালি বাবাকে খুব ভালোবাসতো। প্রায়ই দেখতো মায়ের সাথে বাবার কথা কা’টা’কা’টি হচ্ছে। চৈতালির অবুঝ মন ভাবতো বাবা বুঝি রাজ’নৈতি’ক ঝামে’লা সামলাতে না পেরে মায়ের সাথে ঝ’গ’ড়া করতো।

বাবা যেদিন ছোট খালাকে বিয়ে করে নিয়ে আসে সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো চৈতালি। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার চোখজোড়া জলে টইটম্বুর।
ইসলামে দুই বোনের একঘরে বিয়ে দেওয়া জায়েজ নেই। এটা জানার পর বাবা, মাকে ডিভোর্স দিয়ে খালাকে নিয়ে সংসার করার সিদ্ধান্ত নেন। চৈতালির বাবা রাজ’নীতি’বিদ ছিলেন।
সেদিন হাসি চুপটি করে মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছিলো। টু শব্দ টুকু করেননি। নিজের বোন আর প্রিয় মানুষ এর কাছ থেকে প্র’তা’রি’ত হয়ে আর কি বা বলার থাকতে পারে।
তবুও চৈতালির বাবা দমে যায় নি। হাসিকে বিভিন্নভাবে হেন’স্তা করে চৈতালিকে বাধ্য করে তার কাছে নিয়ে আসে।
হাসি যখন লুকিয়ে মেয়েকে দেখতে আসতো তখন চৈতালির বাবা আর খালা মিলে কু’বুদ্ধি আঁটে। চৈতালির বাবার সাথে খুবই জ’ঘ’ন্য লোকেদের ওঠাবসা।

সাদা রঙের স্কুল ড্রেস পরা কিশোরী হেলতে দুলতে বাড়িতে ঢুকলো। আজ দুই বিষয়ের ক্লাস হয়নি। তার আগেই ছুটি হয়ে গিয়েছে। বাবার ঘরের পাশ দিয়ে নিজের ঘরে যাওয়ার সময়ই চৈতালি থমকে দাঁড়ালো।
ভেতর থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। বাবা, খালা আর অন্যজনকে চেনে না চৈতালি। অজ্ঞাত লোকটি বিশ্রী সুরে বলল,

-“আমি ভাবিনি আপনি আমায় এমন একটা সুযোগ করে দেবেন। মহিলা মানুষের এমন তেজ থাকতে নেই। দিয়েছি আজ ডানা ভে”ঙে। কতবার যে আকুতি করে ইজ্জত ভিক্ষা চাইলো। মনটা পৈ’শা’চিক আনন্দে তৃপ্ত হয়ে গেলো। আহা্!”

চৈতালির বাবা আর খালাও বেশ উচ্চস্বরে হাসলেন। চৈতালি আর একমুহুর্ত ও দাঁড়ালো না। ব্যাগ ফেলেই দৌঁড়ালো মায়ের কাছে।

বাসায় ঢুকে সোজা মায়ের ঘরে গেলো চৈতালি। হাসি মোটেও কাঁদেনি, একদমই হাউমাউ করে কাঁদেনি। এক টুকরো কাপড় বুকে জড়িয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় পাথর হয়ে বসে ছিলো। একজন দশম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে নিশ্চিয়ই এতটা অবুজ নয়? কি হয়েছিলো মায়ের সাথে ভাবতেই বুকটা কেঁপে ওঠে। ধীরে ধীরে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। কিন্তু হাসি নির্বিকার রইলো। সেদিন থেকেই হাসি নামক নারীর অধর থেকে হাসি সরে গিয়েছিলো।

সেদিন মায়ের মুখ দেখে চৈতালি পারেনি নিজেকে আটকাতে। ক্ষণিকের জন্য হিং’স্র হয়ে উঠেছিলো। মাকে রেখেই উঠে দাঁড়ালো। ওভাবেই বাড়ি এসে পৌঁছালো। খালা চৈতালিকে দেখে ধ’ম’কে জিজ্ঞেস করলো,

-“স্কুল কখন ছুটি হয়েছে? এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”

চৈতালি রা’গে ফুঁসতে ফুঁসতে একদলা থুতু ছুঁ’ড়ে মা’র’লো তার খালার গালে।

খালার চিৎকারে বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে চৈতালির গালে চ’ড় বসিয়ে দিলো। চৈতালি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ধীর পায়ে বাবার ঘরে ঢুকেই দরজা আটকে দিলো। র’ক্তজবার মতো টুকটুকে লাল চোখের বর্ণ। চৈতালির বাবা আর খালা কিছুই বুঝলেননা। কিছুক্ষণ পরই চৈতালি দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো।
প্রথমে খালার বুকে এলোপাতাড়ি ছু’রি দিয়ে আ’ঘা’ত করতেই বাবা ছুটে আসলো। খালাকে ছেড়ে এবার বাবার বুকে আ’ঘা’ত করলো চৈতালি। হঠাৎ আক্রমণে চৈতালির বাবা কিছুই করতে পারলেননা। ধপ করে পড়ে গেলেন। সাদা স্কুল ড্রেসে র’ক্তে মাখামাখি। চোখেমুখে ফোঁটা ফোঁটা র’ক্ত।

হুমায়ুন কবির এসব দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন। নিজের ছেলের এই দশা দেখে দিকবিদিকশুন্য হয়ে কি করবেন ভেবে পেলেননা। চৈতালি এতক্ষণ যাবত সাহস দেখাতে পারলেও র’ক্তের স্রোত দেখে ভ’য় পেলো। অতিরিক্ত ভ’য়ে ঢ’লে পড়লো ফ্লোরে।

হুমায়ুন কবির খুব ঠান্ডা মাথায় ভাবলেন। পরক্ষণেই অর্ধমৃত লা’শ দুটোকে টেনে নিয়ে গেলেন নিজের ল্যাবে। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে এসিড নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। দুজনকেই ছুঁ’ড়ে মারলেন এসিডে। মুহুর্তেই শরীর দুটো ঝলসে গিয়ে কঙ্কাল দেখা দিলো।

এবার চৈতালিকে বানালেন নিজের টোপ। খু’নের কথা ধামাচাপা দিতে হুমায়ুন কবির সেদিন সবাইকে মি’থ্যে বলেছিলো। কথা গুলো এমন ছিলো,

চৈতালির বাবা আর খালা বিদেশ ভ্রমনে গিয়েছে। একমাস পর তিনি নিজেই আবার সবাইকে জানিয়েছেন বিদেশে তারা এক্সিডেন্ট করে মা’রা গিয়েছেন।
হাসি আজও জানেনা তার বোন আর স্বামীর মৃ’ত্যু রহস্য।

রনির খু’নের পেছনে অন্য কেউ নয় বরং চৈতালি নিজেই আছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্পর্শকাতর স্থানে হাত গলিয়ে উত্য’ক্ত করেছিলো তাকে। এখনো মনে পড়ে সেই বি’শ্রী অনুভূতির কথা। গা গুলিয়ে ওঠে। মায়ের ঘটনার পর থেকে কোনো মানুষরূপী ধ’র্ষ’ক কে তার সহ্য হয়না। সেদিন রাতেই দাদার ল্যাব থেকে বেহুঁশ হওয়ার ইনজেকশন নিয়েছিলো। রনির নাম্বার জোগার করে তাকে কল দিয়ে বটতলায় আসতে বললো। উত্তেজনায় কিলবিল করে উঠলো রনির মন।
চৈতালিকে আসতে দেখে ক্রুর হাসলো রনি।

-“দিনের বেলা লজ্জা পাও। আর রাতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে এসেছো?”

চৈতালি মৃদু হেসে রনির ঘাড়ে হাত রাখলো। কৌশলে ইনজেকশন পুশ করে দিলো। ঘাড়ে সূক্ষ্ম ব্যথা টের পেতেই রনি গা’লি দিলো।

-“এই মা***** ঘাড়ে কি করেছিস? শা*লি এক্ষুনি তোর এমন অবস্থা করবো যে ম’র’ণ ছাড়া সামনে আর কোনো পথ খোলা পাবিনা।”
কথাগুলো বলার কিছুসময় পরই জ্ঞান হারালো রনি। চৈতালির হিং’স্র চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো। গ্লাবস পড়া হাতে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে নিলো। কিছুটা দূরে রেখে আসা বাবার তলো’য়ার দ্বারা খন্ডিত করলো রনির দেহ। রাস্তায় কা’টা লা’শ ফেলে এসে চুপিচুপি ঘরে ঢুকেই গোসল সেরে ঘুমিয়ে পড়লো। সকাল সকাল এক নিষ্পাপ মুখশ্রী নিয়ে জেগে উঠলো।

হুমায়ুন কবির চৈতালির ঘরে খালি ইনজেকশনের শিশি পেয়েই টের পেয়েছিলেন চৈতালির ব্যাপারে। এতে বেশ মাথা ঘামালেন না। এই ভেবে খুশি হলেন যে চৈতালির মস্তিষ্ক প্রায় তার নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। কয়েকমাস যাবত এই ঔষধ শরীর প্রবেশ না করলে চৈতালির মৃ’ত্যু হতে পারে।

অতীতের ঘর পেরিয়ে বর্তমানে পা রাখলো চৈতালি। দুনিয়া বড় অদ্ভুত। মানুষগুলো নিজ স্বা’র্থে একের পর এক পা’প করে যাচ্ছে। অথচ উপযুক্ত শা’স্তি পাচ্ছেনা। চৈতালি জানে তার শা’স্তি স্বরূপ মৃ’ত্যু অপেক্ষা করছে। তবুও সে স্বপ্ন দেখে বাঁচার, ভালোবাসার।

হাসি চৈতালির মতের তোয়াক্কা না করেই বিয়ের ব্যবস্থা করে চলেছেন। সমুদ্র ডাক্তার। মেয়ের চিকিৎসা নিয়েও কোনো ঝা’মেলায় পড়তে হবেনা। যদিও সমুদ্র মানসিক ডাক্তার নয় তবুও ভরসা করে মেয়েকে তার হাতে তুলে দিতে চাচ্ছেন।

#চলবে……

(আজ গঠনমূলক মন্তব্য চাইছি। হ্যাপি রিডিং।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here