শেষ পাতায় সামাপ্তি পর্ব ১০

0
328

#শেষ_পাতায়_সমাপ্তি
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১০

শক্ত খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে রইলো হাসি। চৈতালি একবার দাদার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। দুজনের চোখাচোখি হতেই হাসলো চৈতালি।
হুমায়ুন কবির ও হাসলেন। বুঝতে পারলেন আজ আরও একটা লা’শ পড়বে। হয়তো তার ধারণার সীমা খুবই কম ছিলো। কে বলতে পারে একটা নয় দু’দুটো লা’শ পড়তে পারে?

ঘরের দরজা বন্ধ করে বাবার সেই বাক্সটি হাতে নিলো চৈতালি। একে একে ছু’রি,রাম’দা বের করে শুধু রাম’দা হাতে নিলো। রাম’দা তে হাত বুলিয়ে ক্ষীণ হাসলো চৈতালি। যে হাসিতে মাধুর্য ছিলোনা। ছিলো পৈশা’চিক তৃপ্তি। রাম’দা খাটের উপর রেখেই ঘর ছেড়ে বের হলো চৈতালি। এনামুল হকের মুখোমুখি বসে পড়লো। হাসি বারবার মেয়েকে বলছে এখান থেকে উঠে ঘরে যেতে। চৈতালি মায়ের কথায় কান দিলোনা।

এনামুল হকের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে পুরো দস্তুর দেখে নিলো একবার। বেশ আয়েশী কন্ঠে বলল,

-“আপনি আমাকে কোথায় নেবেন বলেছিলেন না? আমি যেতে চাই সেখানে।”

অবাক হয়ে তাকালো এনামুল হক। হাসির চোখেমুখে বিষ্ময় আর আ’তঙ্ক বিরাজ করছে। মেয়ে কি বলছে কি?

এনামুল হক কে অবাক হতে দেখে চৈতালি মাথা দুলিয়ে বলল,
-“বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি সত্যিই যেতে চাই। বলুন সেখানে যেতে হলে আমাকে কি কি করতে হবে।”

অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন এনামুল হক। বিদ্রুপ হেসে বলল,

-“মেয়ে দেখছি মায়ের চেয়ে এগিয়ে। তা যেখানে যেতে চাইছো সামলাতে পারবে তো?”

চৈতালি বেশ কৌশলে বলল,

-“এসব ব্যাপারে আমার বেশ কৌতুহল। আমি বোধহয় জেনে গিয়েছি জায়গাটি কোথায়? আর আপনাকে ও সেখান থেকে বের হতে দেখে নিয়েছি। তাই আপনি না নিলে ও আমি ঠিকই যেতে পারবো।”

এনামুল হক বাহবা দিলেন চৈতালিকে।

-“দেখে নিয়েছো? বাহ্! আমি ভাবলাম তোমাদের ওই ছোট্ট মস্তিষ্ক এতটা চাপ নিতে পারবেনা। এখন দেখছি আমার থেকে এক ধাপ এগিয়ে আছো। তুমি আর হাফি ছেলেটা সেদিন দেখেছো আমাকে। তোমাদের সেদিন জমিদার বাড়িতে আগমনের খবরও আমি দারোয়ানের কাছ থেকে পেয়েছি। কিন্তু মামনী তুমি জানলেও কিচ্ছুটি করতে পারবেনা। তোমার মায়ের ধ’র্ষ’ণের ঘটনা জানাজানি হলে মাথার উপর ছাদ থাকবেনা। জানো তো এটা মফস্বল অঞ্চল। এখানের মানুষগুলো পুরোনো ধারা পালন করতে পটু। ভিটে ছাড়া করবে মা মেয়েকে।”

চমকালো চৈতালি। সে ধারণা করতে পারেনি জমিদার বাড়িতেই লুকিয়ে আছে পা’পিষ্ঠ দের পা’পের ঝুলি। সে তো কেবল এনামুল হকের উপর সন্দেহ থেকে কথাটি বলেছে। চৈতালি এনামুল হকের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,

-“আপনি দাদার সাথে একটু যান। এই মুহুর্তে আপনার বিশেষ সত্য জানা প্রয়োজন। যা আপনার অজানা রয়ে গেছে। সাথে কিছু একটা ঘটা ও প্রয়োজন। যেটা আরো আগে ঘটা উচিত ছিলো।”

দাদার দিকে তাকিয়ে চৈতালি ইশারায় বোঝালো তার ল্যাবে এনামুল হককে নিয়ে যেতে। হুমায়ুন কবির নাতনির কাছে ভালো সাজতে এনামুল হককে উঠতে বললেন। চৈতালির কথার মর্মার্থ বুঝলেননা এনামুল হক। উঠে হুমায়ুন কবিরের যাওয়ার পথ অনুসরণ করে ল্যাবে পা বাড়ালো।

হাসি চৈতালির দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে বললেন,

-“তুই কি করতে চাইছিস বল তো? তুই বুঝতে পারছিস না এ দুনিয়ার মানুষগুলো কতটা খা’রা’প। ওরা তোর ক্ষ’তি করে দেবে। তার আগেই আমি তোকে সমুদ্রের হাতে তুলে দিতে চাই।”

চৈতালি মাকে সরিয়ে বাবার ঘর থেকে রাম’দা হাতে নিলো। হাসি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। অস্থির গলায় বলল,

-“এটা তোর হাতে কেনো? ফেলে দে ওটা।”

চৈতালির হাসি হাসি চোয়াল মুহূর্তেই কঠিন রূপ ধারণ করলো।তেজি কন্ঠ বলে উঠলো,

-“এই দুনিয়ায় টিকতে হলে হরিনীবাচ্চা নয়, বাঘিনী হতে হবে মা। বাঘ কখনো বাঘিনীকে থাবা মারেনা। হরিণীকে থাবা মারে।”

লম্বা লম্বা পা ফেলে ল্যাবে ঢুকে পড়লো চৈতালি। পেছন পেছন হাসি ও গেলো। চৈতালি এনামুল হকের পেছনে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

-“আপনি কি জানেন আমার বাবা আর খালা কে আমিই মে’রেছি। কোনো বিদেশ ভ্রমন হয়নি তাদের। আর না এক্সি’ডেন্ট হয়েছে।”

পিলে চমকে উঠলো এনামুল হক এর। চৈতালির হাতে রাম’দা দেখে ভ’য়ে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা শ্রোত বয়ে গেলো। ক্রমাগত ঢোক গিলে হাসার চেষ্টা করলো। কিছু কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা করে বলল,

-“ক কি বলছো মামনী? মজা করছো তাইনা? হাত থেকে ওটা ফেলে দাও।”বলেই চৈতালির হাত মুচড়ে ধরতে গেলো। এক কো’পে এনামুল হকের হাত আলাদা করে দিলো চৈতালি। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“সেদিনই যদি জানতাম আমার মায়ের ধ’র্ষ’ক তুমি তবে দুটো নয় সেদিন বাবা খালার সাথে আরো একটি লা’শ পড়তো। আর সেই লা’শ টা হতো তোমার। আফসোস এতবছরে ও তোমার কন্ঠ আমি চিনতে পারিনি। আমার মা টা ও না তোমার নামটা বলেনি। আমি এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম। আজ তোমার জীবনের ইতি টানলাম।”

হাতের যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে এনামুল হক আকুতি মিনতি করে বললেন,

-“মা, মা গো। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি ভালো হয়ে যাবো মা।”

এনামুল হকের কপালের মাঝ থেকে রাম’দা দিয়ে লম্বা টানে দু’ভাগ করে ফেললো দেহ। র’ক্ত সিটকে ভরে গেলো চৈতালির চোয়াল। নিথর দেহখানি হুমায়ুন কবির এসিডে ছুঁ’ড়ে ফেললেন। এনামুল হকের কঙ্কাল ভেসে উঠতেই র’ক্ত মাখা চোয়ালে দাঁত বের করে হাসলো চৈতালি। ঘাড় কাত করে দাদার দিকে তাকালো। কর্কশ কন্ঠে বলল,

-“আমাকে হিং’স্র বানিয়েছো তুমি। নিজ স্বার্থে আমার মস্তিস্ক নিয়ে খেলেছো। এই ল্যাব থেকেই তো শুরু করেছো তোমার কু’টিল পরিকল্পনা, এখান থেকেই প্রথম ঔষধ তৈরি করেছো। আজ এখানেই তোমার সমাপ্তি টানবো আমি।”

হুমায়ুন কবির এসিডের কুয়োর পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। তাকে কিছু বলতে না দিয়েই ধা’ক্কায় ফেলে দিলো চৈতালি। হুমায়ুন কবিরের কঙ্কাল ভেসে উঠতে আবার ও হাসলো চৈতালি।

হাসির শরীর থরথর করে কাঁপছে। ক্রমাগত বিড়বিড় করে বলে চলেছে,

-“এ আমার মেয়ে নয়, এ আমার মেয়ে নয়, এ কোনো মানুষের র’ক্ত চোষা মানুষখেকো নারী।”

চৈতালি এগিয়ে আসার আগেই জ্ঞান হারালো হাসি। মা ছিমছাম গড়নের বলে কোলে তুলে নিতে বেশ একটা অসুবিধা হয়নি চৈতালির। হাসিকে তার ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলো চৈতালি। ল্যাবে গিয়ে দরজা লক করে নিজের ঘরে ফিরলো। গোসল সেরে লম্বা ঘুমের প্রস্তুতি নিলো। মাথাটা টনটন করে উঠছে। হয়তো কয়েকদিন যাবত ঔষধ পড়ে না বলেই এমন হচ্ছে।

—————————

আজ আর অনুকে পড়াতে আসেনি চৈতালি।
অন্ধকারে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে দুটি পুরুষ অবয়ব। দুজনের মাঝখানে প্রায় দু-হাত দূরত্ব। দমকা হাওয়ায় নেচে উঠছে গাছের ডালপালা। আকাশ জুড়ে কৃষ্ণ আবরের ভেলা। দূর থেকে বেওয়ারিশ কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। বাড়ির সামনের মেহগনি গাছটায় বসে পেঁচা ডেকে চলেছে। সাদমান কালসিটে ঠোঁট জোড়ার ফাঁকে সিগারেট চেপে অনবরত ধোঁয়া উন্মুক্ত করছে বাতাসে। সমুদ্র বেশ বিরক্ত সাদমানের অতিরিক্ত মাত্রায় সিগারেট খাওয়া নিয়ে। কিছুসময় বিরক্তির নজরে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলো সমুদ্র। প্রশ্ন করার জন্য উদ্যত হলো।

সমুদ্রের সরল প্রশ্ন,

-“গত দুদিন কোথায় ছিলি?”

সাদমানের বেপ’রোয়া স্বভাব কোনোদিন শোধরাবার নয়। আজন্ম সে ত্যাড়া উত্তর দিয়ে এসেছে। যথারীতি আজও ত্যাড়া উত্তর দিলো,

-“বিয়ে করে সংসার পেতেছি। বউ বাচ্চাকে ও তো সময় দেয়া লাগে। না জানি তাদের উপর আবার কোন জন্তুর কু’নজর লাগে।”

বিরক্ত হলো সমুদ্র। চোখমুখ কুঁচকে বিরক্তি স্বরে বলল,

-“তুই কি কখনো ঠিকঠাক উত্তর দিবি না? আমি তোকে কিছু প্রশ্ন করবো তার সত্য উত্তর দিবি। নয়তো চ’ড় খাবি আমার হাতে।”

সাদমানকে দেখে মোটেই মনে হচ্ছে না সে সমুদ্রের কথায় সিরিয়াস। তবুও সমুদ্র নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

-“চৈতী কে ভালোবাসিস? আমি জানি সে তোকে ভালোবাসে।”

সমুদ্রের চোখে চোখ রাখলো সাদমান। কিঞ্চিত হেসে বলল,

-“চোখ দুটো কি বলছে? কি মনে হয় তোমার?”

সমুদ্রের অধর কোনে হাসির রেখা ফোটে উঠলো।

অনু হন্তদন্ত হয়ে ছাদে পা রাখলো। হাঁপিয়ে যাওয়া গলায় বলল,

-“ভাইয়া চলো, মা তোমাদের দুজনকে খেতে ডাকছে।”

“চল খেতে চল” বলে সাদমানকে নিয়ে নিচে নামলো সমুদ্র।

নুরুল হক’কে বেশ থমথমে দেখা গেলো। এতে সাদমানের কোনো ভাবাবেগ নেই। সে নিজের মতো খেতে ব্যস্ত। খাবারের এক পর্যায়ে নুরুল হক সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে গমগমে স্বরে বললেন,

-“খাওয়া শেষে আমার ঘরে এসো একবার। কথা আছে তোমার সাথে।”

সমুদ্র বাবার কথায় সম্মতি জানালো। সাদমান খাবার শেষে গোছানো বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে পড়লো। কিছু একটা মনে করতেই তার অধর কোনে বক্র হাসির দেখা মিললো।

ধীর পায়ে বাবা-মায়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো সমুদ্র। বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই ঘরে ঢুকলো। নুরুল হক সমুদ্রকে বারান্দায় আসতে ইশারা করে নিজেও গেলেন। ফাহমিদা শুয়ে আছেন তবে ঘুমান নি। বাবা ছেলে কি কথা বলছে উনার জানা নেই। সমুদ্র বারান্দার দরজায় দাঁড়ানো বলে দেখা যাচ্ছে সে হাসছে। ফাহমিদা মাথা ঘামালেন না।

-“ঘুমিয়ে পড়ো বাবা। বাকি কথা পরে হবে।” বলেই সমুদ্র বেরিয়ে পড়লো।
নুরুল হকের চোখে ক্রো’ধ, নিজের প্রতি ঘৃ’ণা। বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে রইলেন। আর ঘরে ফেরেন নি।

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here