শেষ পাতায় সামাপ্তি পর্ব ৭

0
276

#শেষ_পাতায়_সমাপ্তি
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৭

বদ্ধ ঘরের প্রতিটি আনাচকানাচে তিক্ততায় ভরা। বিষা’দ পূর্ণ রাত,তারকা বিহীন আকাশ। দূর থেকে আলোর খুঁটি থেকে হলদেটে আলো হামাগুড়ি দিচ্ছে রঙিন কার্পেটে। একের পর এক অব’হেলার স্মৃতি স্মরণে আসতেই ক্ষি’প্ত হয়ে উঠলো মস্তিস্ক। দিকবিদিকশুন্য হয়ে নিজের শরীরে আ’ঘা’ত করলো চৈতালি। একের পর এক খা’ম’চি, কাম’ড়ের দাগে র’ক্তা’ক্ত করছে পুরো দেহ। উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ কিছুতেই থামছেনা। গলগলিয়ে নোনাধারা কপোল ভিজিয়ে দিচ্ছে। ছোপ ছোপ র’ক্তের দাগ শরীরে সুস্পষ্ট। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পানির গ্লাস তুলে ছুঁ’ড়ে মা’রলো দেয়ালে। ঝনঝন শব্দে অসংখ্য টুকরোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো।

শব্দ উৎস লক্ষ করে হাসি ছুটে আসলেন মেয়ের ঘরে। চৈতালিকে নিচে এলোমেলো হয়ে বসে থাকতে দেখেই দৌঁড়ে গিয়ে তার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরলো। চৈতালি হাত পা ছোঁ’ড়াছু’ড়ি করছে। হাসি আরেকটু শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে অস্থির কন্ঠে হুমায়ুন কবির কে ডাকলেন।

-“বাবা, বাবা শুনছেন? একটু তাড়াতাড়ি চৈতালির ঘরে আসুন। আমার মেয়েটা কেমন জানি করছে। বাবা, ও বাবা।”

বাবা মা’রা যাওয়ার পর থেকেই মেয়েটার মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। হুটহাট রে’গে গিয়ে নিজেকে আ’ঘা’ত করে। ওর দাদা যেহুতু মানসিক রোগের চিকিৎসক তাই চৈতালির ব্যাপারটা ওর দাদাই দেখে আসছেন।

হুমায়ুন কবির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসলেন। চৈতালিকে শান্ত করতে একটা ইনজেকশন পুশ করে দিলেন। কিছুক্ষণ জোর’জবরদ’স্তির করে নিমিষেই শান্ত হয়ে গেলো। ঘুমিয়ে পড়লো মায়ের বুকে।

হুমায়ুন কবির ঘর ছেড়ে বের হওয়ার পূর্বে বলে গেলেন,

-“চৈতালীকে খাটে শুইয়ে দাও।”

হাসি আত’ঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের মুখের দিকে। তার বেঁচে থাকার এই একটাই সম্বল, তার মেয়েটি। ওর কিছু হয়ে গেলে নিঃশেষ হয়ে যাবেন তিনি। তার আদুরে মেয়েটা কি আর কখনো সুস্থ হবে না? কথাটি ভাবতেই বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো। সন্তর্পণে মেয়েকে শুইয়ে দিয়ে ললাটে বেশ গভীর এক চুমু খেলেন। ফ্লোরের কাঁচ পরিষ্কার করে বেরিয়ে গেলেন।

হুমায়ুন কবিরের চোরা চোখের দৃষ্টি ধরতে পারলেননা হাসি। আজ ও রাতের খাবারের সাথে চৈতালির খাবারে কৌশলে ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছেন। যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে চৈতালি নিজেকে আ’ঘা’ত করেছে।

—————————————————

ময়নাতদন্তের কাজ শেষ করে সমুদ্র ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। শক্তপোক্ত,পেটানো,ক্লান্ত শরীটা ভর ছেড়ে দিলো। ঘর্মাক্ত দেহখানি এসির বাতাসে শীতল হয়ে উঠলো। সমস্ত ঘর্ম বিন্দু শুষে নিলো কৃত্রিম এসির হাওয়া। মুদিত নেত্রে যখন নিজেকে ধাতস্থ করতে ব্যস্ত তখনই আগমন ঘটলো ডঃ সমীর কর্মকার এর।

সমুদ্রের অনুমতি পেতেই ভদ্রতা সহিত হাসলেন লোকটি।

-“আপনার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ করতে এসেছি ডঃ সমুদ্র।”

সমুদ্র সোজা হয়ে বসলো। নিজের গুরুগম্ভীর ভাব বজায় রেখেই বলল,

-“কোন বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছেন?”

ডঃ সমীর ললাটে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলল,

-“আমি যে বিষয়ে কথা বলতে এসেছি সেটা সম্পর্কে হাসপাতাল কমিটির কেউই এখনো কিছু টের পায়নি। আচ্ছা, ডঃ সমুদ্র আপনি কি একটা বিষয় খেয়াল করেছেন? আমাদের হাসপাতালে যেসব মেয়েরা আসে, ধরুন যারা মা’রা গেছে তাদের অধিকাংশের ময়নাতদন্তের রিপোর্টেই কিন্তু দেখা যায় তারা নন-ভার্জিন। অথচ তাদেরকে যখন ভর্তি করানো হয় তখন কিন্তু রিসিপশনে অবিবাহিত বলেই ভর্তি করানো হয়।”

সমুদ্রের কপালেও সূক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ। ডান ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

-“সবগুলো অবিবাহিত মেয়ের ক্ষেত্রেই কি এমন হচ্ছে?”

ডঃ সমীর কর্মকার সময় না নিয়েই উত্তর দিলেন।

-“নাহ, সব গুলো মেয়ে নয়। অধিকাংশ মেয়ে বলেছি আমি।”

-“হতে পারে তাদের অ’বৈধ কোনো সম্পর্ক ছিলো। ধরুন, যদি সবগুলো মেয়ের ক্ষেত্রেই এমন হতো তবে আমরা ধারণা করতাম যে নিশ্চয়ই এখানে কোনো একটা ঘাপলা আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি অন্যকোনো ভাবনায় মন দিতে পারছিনা।”

ডঃ সমীর সায় জানালেন সমুদ্রের কথায়। সমুদ্রকে মাথা চেপে বসে থাকতে দেখে বললেন,

-“আপনি ঠিক আছেন, ডঃ?” মাথা ধরেছে? কফি পাঠাতে বলবো?”

ডঃ সমীরের কথায় সমুদ্র সায় জানাতেই ডঃ সমীর বেরিয়ে গেলেন।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই সমুদ্র ডঃ সমীরের বলা কথাগুলো ভাবলো আরও একবার।
———————

নুরুল হক নানা ছলেবলে কৌশলে ফাহমিদাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, বাচ্চাটা আমাদের প্রয়োজন নেই। তিনটা সন্তান তো আছেই। এই বাচ্চাকে রাখলে লোকমুখে আরও ক’টু কথা শুনতে হবে। কিন্তু আজ বাড়ি ফিরেই কেমন নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন মানুষটি। ফাহমিদা যখন স্বামীর এমন শান্ত ভাব দেখলেন। চিন্তিত দেখলো তাকে। নুরুল হকের ঘাড়ে হাত রেখে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

-“কি হয়েছে আপনার?”

নুরুল হক লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বললেন,

-“কিছু না। ইলেকশনের ব্যাপার নিয়ে একটু ঝা’মে’লায় আছি। তুমি চিন্তা না করে ঘুমিয়ে পড়ো। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে বাচ্চা সুস্থ থাকবেনা।”

চমকে উঠলেন ফাহমিদা। নুরুল হক এই কথা বলেছেন?
অথচ এতদিন এই মানুষটা বাচ্চাটাকে ন’ষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন।

ফাহমিদা আর ঘাঁটালেন না। শুয়ে পড়তে বললেন নুরুল হককে।

হাসি যখন কাঁচা সবুজ রঙের তরমুজটি কা’ট’লেন, ভেতরে লাল টকটকে বর্ণ দেখা গেলো। চৈতালি উৎসুক হয়ে বসে রইলো তরমুজের স্বাদ নেয়ার জন্য। এক টুকরো মুখে দিতেই হতাশ হলো।

হাসি মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-“খেতে ভালোনা? মুখ এমন করে আছিস কেনো?”

চৈতালি মুখের তরমুজ টুকু হজম করে বলল,

-“মিষ্টি নেই। অথচ রং দেখে আমি ভাবলাম খেতে কতই না সুস্বাদু হবে।”

হাসি চৈতালির চোখে চোখ রেখে বললেন,

-“আমাদের আশেপাশে ও এমন অনেক লোক আছে। যাদের চালচলন দেখেই আমরা মুগ্ধ হই। অথচ সেসব মানুষ মুখোশ পরে দিনের পর দিন আমাদের ঠকিয়ে যায়। অথচ আমরা একটু ও টের পাইনা। যেদিন টের পাই সেদিন হাতে আর কিছুই করার থাকেনা।”

মায়ের কথা মনযোগ দিয়ে শুনলো চৈতালি। তারপর ভাবলো তার বাবা ও তো এমন মুখোশ ধারী ছিলেন। অথচ মা টের ও পেলোনা। যখন টের পেলো তখন কিছুই করার ছিলোনা।

————————————

মাসখানেক হলো অনুকে পড়াচ্ছে চৈতালি। এর মাঝে সাদমানের সাথে দেখা হলেও কথা বলেনি চৈতালি। প্রচুর অভিমান হলো নির্দ’য় লোকটির উপর। কিসের এতো অহং’কার তার? একটু হৃদয়ে স্থানই তো চেয়েছিলো সে। আর কিছু তো চায়নি।
ইদানীং সমুদ্রের সাথেও দেখা হচ্ছে। দেখা হলেই তার বেশ’রম দৃষ্টিজোড়ায় বন্দী হতে হচ্ছে।

অনুকে পড়িয়ে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো চৈতালি।

পাশ থেকে ভারী কন্ঠস্বর শোনা গেলো।

-“বিয়ের জন্য প্রস্তুত থাকুন চৈতালি। বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব যাচ্ছে।”

চৈতালি বুঝলো কার কথা বলা হচ্ছে। পেছন ঘুরে তাকিয়ে বেশ কড়া কন্ঠেই সাদমানকে কথা শোনাতে উদ্যত হলো।

-“আমার ব্যাপার নিয়ে আপনার মাথা না ঘামালেও চলবে।”

সাদমান ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালো চৈতালির দিকে।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েই বলল,

-“আপনি ঠিক কি চান বলুনতো, চৈতালি? আপনি একবার চাইছেন আমি মাথা ঘামাই আবার চাইছেন মাথা না ঘামাই। আসলে আপনি কি চাইছেন?”

-“আপনার মনে আমার নিয়ন্ত্রণ চাইছি। আপনার পুরো জীবনটাই একটা উপন্যাসের বই। আমি শুধু সেই উপন্যাসের একটি মাত্র পাতা হতে চাই। শেষ পাতা। সমাপ্তিটা যেনো আমাতেই ঘটে।” সাদমানের চোখে চোখ রেখে বলল চৈতালি।

চৈতালির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো সাদমান।
-“এত এত আবেগ, অনুভূতি আমার জন্য ন’ষ্ট না করে জমিয়ে রাখুন। ভবিষ্যতে হয়তো কাজে লাগবে। আর হ্যাঁ প্রস্তুত থাকবেন বিয়ের জন্য।”

সাদমান দাঁড়ালোনা। পা বাড়ালো তার গন্তব্যে।
পেছন থেকে চৈতালি গলার স্বর উঁচিয়ে বলল,

-“আমি কোনো ষোড়শী কিশোরী নই!যে আপনি আমার অনুভূতিকে আবেগ বলে তুচ্ছ করবেন। বেয়া’দব লোক একট।”

রা’গে গজগজ করতে করতেই বাসায় ফিরলো চৈতালি।

——————————————

ক্লাসের ঝা’মেলা শেষ করে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠলো। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।
মধ্যাহ্নে সূর্যের তোপ একটু বেশিই থাকে। মাথার উপর খাড়াভাবে কিরণ দিয়ে যাচ্ছে। ওড়নায় ঘাম মুছে পা টেনে চলেছে চৈতালি। একটা রিকশা পেতেই উঠে পড়লো। গোসল,খাওয়াদাওয়া শেষে একটু বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজনে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো চৈতালি।

হাসি প্রবেশ করলেন ঘরে। চৈতালি মাকে দেখে উঠে বসলো।

-“কিছু বলবে মা?”

চৈতালির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন হাসি। কিছুক্ষণ চুপ থেকেই বললেন,

-“কিছু কথা বলতে এসেছি। সব মেয়েদেরকেই বিয়ে করে পরের ঘরে যেতে হয়। তোমার ক্ষেত্রে ও ব্যতিক্রম নয়। সামনের বাসার নুরুল হকের বড় ছেলে সমুদ্রের জন্য তারা তোমাকে চাইতে এসেছে। ছেলেটা শিক্ষিত, ভদ্র। তোমার পড়ালেখার কোনো ক্ষতি হবেনা। তাছাড়া তুমি আমার চোখের সামনেই থাকছো, যখন ইচ্ছে হবে মা মেয়ে দুজন দুজনকে দেখতে পাবো। ছেলেটাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। তোমার ও একটা পছন্দের ব্যাপার আছে। ছেলেটা ছোট ভাইয়ের মতো বেয়া’দব নয়।”

-“আমার যে বেয়া’দব টাকেই পছন্দ,মা।”

চৈতালির কথায় চমকে উঠলেন হাসি। মেয়েটা কি বলছে? এমন সুপাত্র রেখে কিনা তার মেয়ে একটা অস’ভ্য, অ’ভদ্র, বেয়া’দব ছেলেকে পছন্দ করছে? যার কোনো ভবিষ্যত নেই। ছন্নছাড়া টাইপের ছেলে তাকে কিনা মেয়ে মন দিয়ে বসে আছে?

-“তোমাকে আমি পড়ালেখা করাচ্ছি কি জন্য? নিজের ভালো একজন পা’গ’লে ও বুঝে। আর তোমার যথেষ্ট জ্ঞান আছে। তুমি খুব ভালো করেই জানো সাদমান ছেলেটাকে আমার মোটেও পছন্দ নয়।”

#চলবে…..
(রি-চেইক করা হয়নি। হ্যাপি রিডিং।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here