শেষ পাতায় সামাপ্তি পর্ব ৫

0
281

#শেষ_পাতায়_সমাপ্তি
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৫

তিমির রজনী। মৃদুমন্দ হাওয়ায় শীতল দেহ। চাঁদ শুন্য আকাশে টিমটিমে তারার মেলা। রাস্তার মোড়ে ল্যাম্পপোস্টের হরিদ্রাভ আলোর দীপ্তি।
নুরুল হক পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে থানায় গেলেন একবার। পুলিশকে সম্মানি দিয়ে বেরিয়ে এলেন। আপাতত ইলেকশনের আগ অব্দি র’নির খু’ন নিয়ে সাদমানকে এরেস্ট করবেনা পুলিশ। ইলেকশনে একবার জিতে গেলেই বাকিটা পরে সামলে নেবেন।

হসপিটালের কাজ সেরে সমুদ্র বের হলো। উদ্দেশ্য অনাথ আশ্রমে যাওয়া। নিজের আয়ের একটি অংশ সমুদ্র অনাথ আশ্রমে দান করে। যেখানে আঠার বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের থাকা-খাওয়া সব দায়িত্ব নেওয়া হয়।
আশ্রমের গেইট দিয়ে প্রবেশ করতেই আশ্রমের ম্যানেজার ব্যস্ত হয়ে গেলেন সমুদ্রের আপ্যায়নে। এই মানুষটা মাস শেষ হলেই মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে যায়।
বাচ্চারা সবাই রাতের খাবার খেতে বসেছে। সমুদ্রকে দেখে সবাই খুশিতে উচ্ছ্বাসিত হয়ে পড়লো। জোর করলো সমুদ্রকে খেতে বসতে। সমুদ্র না করেনি। বাচ্চাদের পাশে পা ভাঁজ করে বসে পড়েছে। আশ্রমের কর্মরত মানুষগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখছে সমুদ্রকে। কতটা নিরহংকার মানুষটি। বাচ্চাদের সাথে সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরলো সমুদ্র। মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে সোজা চলে গেলো নিজের ঘরে। ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখতে পেলো মা টেবিলে তার জন্য খাবার বাড়ছেন।

এক পর্যায়ে মা মুখ খুললেন।

-“চাকরি করছিস। এবার অন্তত বিয়ে শাদি কর। আমি আর কত সংসার সামলাবো?”

সমুদ্র হাসলো। লোকমা মুখে তুলে বলল,

-“সময় হলে ঠিকই জানাবো বিয়ের কথা।”

ফাহমিদা হতাশ হলেন। আর কবে সময় হবে তোর? ছোট ছেলেটাকেও তো বিয়ে দিতে হবে। ওর বেপ’রোয়া স্বভাব সুতোয় টেনে ধরতে হবে।

সমুদ্রের নির্লিপ্ত জবাব,

-“ওকেই না হয় আগে বিয়ে করিয়ে দাও।”

ফাহমিদা আশ্চর্য হয়ে বললেন,

“এটা কেমন কথা? বড় ভাইকে রেখে ছোট ভাই বিয়ে করবে?”

সমুদ্র খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালো।
-“আর কিছুদিন যাক তখন নাহয় বিয়ের ব্যাপারে ভাবা যাবে।”

বারান্দার গ্রিলে একহাত রেখে অন্যহাত পকেটে গুঁজে রাখলো সমুদ্র। দৃষ্টি চৈতালির বারান্দায়। এতরাত পর্যন্ত মেয়েটা নিশ্চয়ই জেগে থাকবেনা। জেগে থাকলে নিশ্চিয়ই আলো জ্বালানো থাকতো। বারান্দা থেকে সরে শরীর টানটান করে দাঁড়ালো সমুদ্র। ঠোঁটের কোনে লেগে আছে অদম্য এক তৃপ্ত হাসি।

———————————

রংবেরঙের বাতি, সাজসজ্জা। বিশাল বড় এক রুমে নারী কন্ঠ ধ্বনিত হলো। এই সাম্রাজ্যের প্রধান নারী।

-“আজ বাবুসাহেব আসবেন। দীপালি মেয়েটাকে গোসল করিয়ে তৈরি করে রেখো। অপরিষ্কার,নোং’রা কোনো কিছুই বাবুসাহেবের পছন্দ নয়।”

মেয়েগুলো একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কেউ কেউ আফসোস করছে।
“ইস এই বাবুসাহেবের চোখ কেনো আমাদের উপর পড়েনা।”

রিনা মেয়েটি তাচ্ছিল্য করে বলল,”তার প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রমণী লাগে। তাও যেই সেই রমণী নয়। একেবারে সুন্দরী রমণী। তবে তোদের উপর যে চোখ পড়েনি এতেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর।”

প্রথম মেয়েটি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“কেনো?”

রিনা কথা এড়িয়ে তাড়া দিলো দীপালিকে তৈরি করতে।
দীপালি চোখের জ্বলে চোখমুখের বেহাল অবস্থা করে ফেলেছে। প্রতিনিয়ত চিৎকার করে বলছে,
“আমাকে ছেড়ে দাও। মুক্তি দাও এখান থেকে।”
কি করেছি আমি? আমাকে কেনো এখানে নিয়ে এসেছো। আমি চলে যাবো অনেকদূর?

দীপালির চিৎকারে রিনা তার গালে সপাটে চ’ড় বসিয়ে দিলো। পুরোপুরি কান্না না থামলেও কিছুটা দমে গেছে দীপালি।

সুবাসিত শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে গোসল করিয়ে দিলো দীপালিকে। কমলা রঙা পাতলা শাড়ি দিয়ে আবৃত করলো দেহ। এটাকে আবৃত বলা চলেনা। দেহের বিভিন্ন জায়গা স্পষ্ট দৃশ্যমান। দীপালি বারবার শাড়ি দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। পেট,পিঠ,ঘাড়ের অনেকাংশ ফুটে উঠেছে আকর্ষণীয়ভাবে। নির্দিষ্ট ঘরে দীপালিকে রেখেই সবাই বেরিয়ে আসলো।
টকটকে ফর্সা মেয়েটির নিজের দিকে তাকাতেও ঘৃ’ণা লাগছে। নিজেকে কেমন বি’শ্রী দেখাচ্ছে।

অবশেষে প্রবেশ দ্বার দিয়ে আগমন ঘটলো সেই আগন্তুকের। আশেপাশে না তাকিয়ে সোজা চলে গেলো আত্মতৃষ্ণা মেটাতে।

দরজা খুলে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো এক চোখ ধাধানো সুন্দরী রমণী। হেঁচকি তোলার তালে তালে ছোট্ট শরীর মৃদু কেঁপে কেঁপে উঠছে। টকটকে লাল নাকের ডগায় মৃদু কম্পন হচ্ছে।
দীপালির ফর্সা উদরে চোখ পড়তেই পুরুষত্ব জেগে উঠলো আগন্তুকের। পা থেকে মাথা অব্দি আগাগোড়া একবার পরোখ করে বি’শ্রীভাবে হাসলো। নরম, তুলতুলে, কোমল উদরে বলিষ্ঠ হাতে চাপ প্রয়োগ করতেই দিপালি ভ’য়ে সিটিয়ে গেলো। আগন্তুকের চেহারা দেখে আৎকে উঠলো দীপালি।
দীপালির এমন কাজে ক্ষুব্ধ হলো বাবুসাহেব। অতিরিক্ত রাগে খামছে ধরলো কোমর। দীপালির বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এই মানুষটা কিভাবে হতে পারে? কিন্তু এতো সত্যি। চোখের দেখা তো মিথ্যে হতে পারেনা। দীপালি চিৎকার করে বলল,

-“আমাকে ছোঁবেন না। নোং’রা লোক।”
আমি কিন্তু, আমি কিন্তু, এই বলে এদিক ওদিক তাকিয়ে দীপালি বলল, “মে’রে দেবো আপনাকে।”

আগন্তুক বাঁকা হাসলো। চোয়াল শক্ত করে চ’ড় দিয়ে খাটে ফেলে দিলো দীপালিকে। হাত পা বেঁধে মুখে কাপড় বেঁধে দিলো। কাজের সময় এতসব টালবাহানা পছন্দ নয়। কতবড় স্পর্ধা তাকে আ’ঘা’ত করার কথা বলে? নোং’রা বলে? জ্বলন্ত নেত্রে তাকিয়ে হিং’স্র জন্তুর মতো খুবলে খেলো দীপালিকে। ফর্সা দেহে অগণিত হিং’স্রতার চিহ্ন।

ব্যথায় ছটফট করে ওঠা দীপালির গোঙানির শব্দ কর্ণধারে পৌঁছাতেই যেনো এক পৈশাচিক আনন্দ পেলো পি’চা’শ লোকটি। মেয়েটির চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অঢেল জলধারা।
নিজের কামনা কার্যসিদ্ধি সম্পন্ন করে শাড়ির আঁচল গলায় পেঁচিয়ে ধরলো দীপালির। মুহূর্তেই ছটফট করতে করতে বিদায় নিলো দীপালি। জিহবা বেরিয়ে ঝুলে পড়লো।

আগন্তুক ঘাড় বাঁকা করে ঘাম ঝেড়ে নিলো। নিজের জামাকাপড় ঠিক করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আয়নার ভেতর দিয়েই পেছনে পড়ে থাকা দীপালির নিথর দেহে চোখ বুলিয়ে হিড়হিড় করে বলল,

-“মুক্তি দিলাম তোমায়। আমার ছোঁয়া নিয়েই তুমি বিদায় নিলে। কতটা ভাগ্যবতী হলে বাবুসাহেবের বিছানায় আসতে পেরেছো। দেখো, আমার আগে কেউ তোমাকে ছুঁতে পারেনি। বাবুসাহেব বাসি জিনিসে মুখ দেয়না। আবার আমার পরেও কেউ তোমায় ছুঁতে পারবেনা। আমার ছোঁয়া মুছে দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। বাবুসাহেব যেই জিনিসে হাত দেয় সেটাতে আগে পরে ভাগ বসানোর অধিকার কারও নেই। যে একবার বাবুসাহেবের ছোঁয়া পায় তাকে দ্বিতীয় কোনো পুরুষ ছুঁতে পারেনা। সেই রাস্তা বাবুসাহেব খোলা রাখেনা। যেমনটা তোমার ক্ষেত্রে ঘটেছে। মুক্তি দিয়ে দিয়েছি।”

আগন্তুক ঘর ছেড়ে বেরিয়ে দুজন ছেলেকে আদেশ দিয়ে গেলো দীপালি মেয়েটিকে চন্দ্রা দীঘিতে ছুঁড়ে ফেলে আসতে। আগন্তুক চাইলেই পারতো ছু’রির আ’ঘা’তে দীপালির শরীর ঝাঁ’জরা করে দিতে। কিন্তু এই কাজে গ্রামবাসীর মনে যে কুসংস্কারের দেয়াল সৃষ্টি করেছে সেই দেয়াল সরে যাবে। বোকা মানুষগুলো বুঝে যাবে মৃ’ত্যুগুলো অকস্মাৎ নয়, খু’ন। সাত বছর যাবত যেই কুসংস্কার সৃষ্টি করেছে তা এত সহজে শেষ করে দেয়া যায়না।

সেদিন দীঘিতে ডুবে লোকটি মা’রা গেছে ঠিকই। তবে আগন্তুক তার সাথে চা পানের সময় কৌশলে কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছিলো। লোকটি মাঝখানে গিয়ে আর শক্তি পেলোনা তীরে আসার। গ্রামবাসীর মনে কুসংস্কারের দেয়ালটা আরেকটু পাকাপোক্ত হলো।

————————

ঘুম ভাঙলো তবে সূর্যের। টিমটিমে চোখে তাকালো চারিপাশে। মিষ্টি রোদ্দুরের প্রভা ছড়ালো প্রশস্ত ধরার বুকে। সকালের কোমল রোদ্দুর বেলা বাড়ানোর সাথে সাথেই তার উত্তাপ বাড়িয়ে রু’ষ্ট করবে প্রসন্ন মন।
সকাল সকাল এক দারুণ সংবাদ মিললো চৈতালির জন্য। সাদমানের ছোট বোনকে পড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। চৈতালি এমন লো’ভ’তুর অফার হাত ছাড়া করলোনা। মানুষটিকে দেখার আরও একটা সুযোগ মিললো তবে। খোশ মেজাজে নাস্তা সেরে নিলো।
হাফিকে একটা কল দিয়ে জানিয়ে দিলো জমিদার বাড়িতে ঘুরতে যাওয়ার সময়। সবাই যাতে তাদের বাসায় চলে আসে। একসাথেই এখান থেকে বের হবে।

নুরুল হক জনগণের খোঁজ খবর নেয়ার উদ্দেশ্যে বের হলেন। সাথে আছে কনিষ্ঠ পুত্র সাদমান এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা। ঘুরে ঘুরে এসে থামলো চৈতালিদের বাসার সামনে। আগে আগে হাঁটছেন নুরুল হক পেছনে সাদমান।
নুরুল হক হাসিমুখে হাসি আর হুমায়ুন কবিরের সাথে কথা বলে সবার খোঁজ খবর নিলেন। হাসি তীক্ষ্ণ নজরে দেখছে সাদমানকে। কিভাবে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। ভদ্রতা বলতে কিছুই নেই। বেয়া’দব ছেলে।

হাসি যে মনে মনে সাদমানকে দেখে বিরক্ত সেটা বেশ টের পাচ্ছে সাদমান। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বেশ রয়েসয়ে বসলো।

চৈতালি পর্দার আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখছে তার প্রেমিকপুরুষ কে।

-“যেকোনো সমস্যা তে আমাকে জানাবেন ভাবি। ভাই থাকলেও জনগনের সেবায় নিয়োজিত থাকতো। সেই কাজটা না হয় আমিই করি। আসি চাচা, বলেই উঠে দাঁড়ালেন নুরুল হক।

যাওয়ার আগে সাদমান সোফার কুশনের নিচে একটা প্যাকেট রেখে পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা চৈতালিকে ইশারা করলো।

চলে গেলো সাদমান। দাদা উঠে নিজের ঘরে গেলেন। হাসি সোফার কুশন ঠিক করতে যাবে তার আগেই চৈতালি দৌঁড়ে এসে মায়ের হাত ধরে বলল,

-“তুমি যাও, আমি গুছিয়ে নিচ্ছি।”

হাসি অন্যকাজে চলে গেলেন।
বৈঠকখানা খালি হতেই চৈতালি প্যাকেটটি হাতে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেলো।

ঝটপট প্যাকেট খুলতেই তার চোখ চড়কগাছ।

একটি টকটকে র’ক্তরাঙা আলতার শিশি, লাল-সফেদ মিশ্রণে দুমুঠো চুড়ি। সাথে একটি হরিদ্রাভ চিরকুট।

মানুষটার মনে বুঝি প্রেম জেগেছে? তবে স্বার্থক সে। অবশেষে পাথরে ফুল ফুটলো তবে। চৈতালি চিরকুট টি আলাদা করেই রেখে দিলো। এত এত চমক সে একসাথে হজম করতে পারবেনা। চিরকুটের লিখা নাহয় পরে একসময় পড়া যাবে। শান্তির ঘুম হবে আজ। ফুরফুরে হয়ে গেলো অন্তরিন্দ্রিয়। ডানা ঝাপটালো শত প্রজাপতি।

বন্ধুদের সাথে বের হলো চৈতালি। পথেই শোনা গেলো চন্দ্রা দীঘিতে আরও একটি লা’শ। এখন আর কেউ বিষ্মিত হয়না। চন্দ্রা দীঘিতে লা’শ পাওয়া এ যেনো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
জমিদার বাড়িতে চৈতালিরা পাঁচ বন্ধু ছাড়া ও আরও অনেকেই এসেছে। ঘুরে ঘুরে সব দেখতে গিয়ে পাঁচজন পাঁচ দিকে সিটকে গেলো। চৈতালি ঘুরতে ঘুরতে একটা ঘরে গিয়ে দাঁড়ালো। বিভিন্ন বই পুস্তক অবিন্যস্ত ভাবে পড়ে আছে তাকের ভাঁজে। বইয়ের স্তুপে ধুলোর আস্তরণ। ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে সজোরে দরজাটি আটকে গেলো। চমকে উঠলো চৈতালি।

#চলবে…….

(।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here