শেষ পাতায় সামাপ্তি পর্ব ৪

0
324

#শেষ_পাতায়_সমাপ্তি
#পর্ব_০৪(বোনাস)
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

বৃষ্টিমনা সন্ধ্যায় এলো হওয়া বইছে মাতাল। শুনসান,ফাঁকা, নিরিবিলি রাস্তা। জনাকীর্ণ হীন স্তব্ধ পরিবেশ। হুড তোলা রিকশায় পাশাপাশি যদি প্রিয় মানুষটি থাকে তবে ভালোলাগার মাত্রা অত্যাধিক বেড়ে যায়। থম ধরা এই মেঘাচ্ছন্ন শিথিল পরিবেশে বৃষ্টি পড়ার ধারা পূর্বের তুলনায় প্রায় অনেকটাই কমে এসেছে। চলমান রিকশা আর বাতাসের বেগে কিছু বৃষ্টি কণা তীর্যক বেগে এসে আলতো ছুঁয়ে দিচ্ছে চোয়াল। কোমর থেকে পা অব্দি পাতলা প্লাস্টিকে আবৃত।
সাদমান ফোনে কারও সাথে সু-উচ্চ কন্ঠে হাঁক ছাড়তে ব্যস্ত, তার পাশে একজোড়া কৃষ্ণ আঁখি তাকে দেখে তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত। মনে সুপ্ত অনুভূতির ফোয়ারা,ভালোলাগার মৃদু আলোড়ন। কৃষ্ণ নেত্রপল্লব যেনো বলছে,

-“থেমে যাক, সময়টা এখানেই থেমে যাক। তারে দেখি, আরেকটু প্রাণ ভরে দেখি।”

অন্ধকার রাস্তায় রিকশা তার আপন গতিতেই চলছে।

হুট করে চৈতালি সাদমানের ডান বাহু আঁকড়ে ধরে।

-“আমি পরে ফোন দিচ্ছি” বলে চৈতালির হাতের দিকে ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকায় সাদমান। বোঝাই যাচ্ছে সে প্রচন্ড বিরক্ত।”

সাদমানের দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিলো চৈতালি। ঝট করে সাদমানের বাহু ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। কিছুক্ষণ ইতিউতি করে বলল,

-“আসলে রিকশা খাদে পড়ায় টাল সামলাতে পারিনি । তাই আপনার হাত ধরে বসেছি।”

চৈতালির গোলগাল করুণ চাহনি উপেক্ষা করে সাদমান সামনে তাকিয়ে রিকশাচালককে উদ্দেশ্য করে বলল,” দেখে রিকশা চালাবেন তো, চাচা?”

রিকশাচালক রিকশার প্যাডেল ঘুরাতে ঘুরাতেই জবাব দিলেন,

-” চাইরদিক আন্ধার হইয়া আছে বাজান। হের উপর বৃষ্টি, ভাঙা রাস্তা। না চাইতেও রিকশা খাদে পড়বো। আমার তো কিছু করার নাই বাজান। এই বৃষ্টিতে বাইর হইতাম না। আফনেই তো জোর কইরা নিয়া আইলেন।”

রিকশাচালকের কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলোনা সাদমান। বিরক্তিতে তিক্ত হয়ে বলল,

-“রিকশা থামান।”

রিকশাচালক দ্বিরুক্তি না করে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই রিকশা থামালো। জীবিকার দায়ে ঝড়, বৃষ্টি,প্রখর রোদ সবই উপেক্ষা করতে হয় তাদের। নইলে যে পেটে একটা দানাপানি ও পড়বেনা। না খেয়ে পরিবার নিয়ে ম’র’তে হবে।
সাদমান ভাড়া মিটিয়ে বলল,

-” উনাকে উনার বাসার সামনে নামিয়ে দিবেন।”

একটিবার ও চৈতালির দিকে ফিরে তাকালোনা সাদমান। কিছুক্ষণের মাঝেই কাঁক ভেজা হয়ে গেলো। হাঁটা ধরলো তার গন্তব্যে। মেয়েটার এতটা কাছাকাছি আসা তার ভালো লাগছেনা। মোটে ও না।

চৈতালি উদাসীন হয়ে চেপে বসলো রিকশায়। সাদমান যে তার থেকে দূরে যাওয়ার জন্যই রিকশা থেকে নেমে গিয়েছে তা আর বুঝতে বাকি রইলোনা। এমনটা হবে জানলে চৈতালি রিকশা থেকে পড়ে গেলেও ওর হাত ধরতোনা। এমন বৃষ্টির দিনে ভেজা ক্ষতি’কর। নিশ্চয়ই জ্বর আসবে, হাড় কাঁপানো জ্বর। ভাবতেই বক্ষস্থলে চিনচিনে ব্যথার আভাস পেলো। সামনে ধূ ধূ অন্ধকার।

অন্ধকারের পথ ধরে হাসপাতালে এসে পৌঁছালো সাদমান। নিজ উদ্যোগে খোঁজ চালিয়ে ও কোনো হদিস পেলোনা মেয়েটির। হসপিটাল কর্তৃপক্ষকে কয়েকটা গা’লি দিয়ে ছুটলো সমুদ্রের চেম্বারে।
দরজায় পথ আটকে দাঁড়ালো সমুদ্রের ব্যক্তিগত সহকারী।

-“স্যার এখন রোগী দেখছেন। পরে আসবেন।”

সাদমান ভ্রু কুটি করে তাকালো ছেলেটির দিকে। পরক্ষণেই ছেলেটিকে দরজা থেকে হটিয়ে গটগট পায়ে চেম্বারে ঢুকে পড়লো। তনয় ছেলেটি নিজেকে সামলে নিয়ে সাদমানের পিছু পিছু ঢুকলো।

সমুদ্র রোগী দেখছিলো। হুট করেই অ’স’ভ্যের মতো সাদমানকে ঢুকে পড়তে দেখে পেছনে দাঁড়ানো তনয় এর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো।
তনয় আকুতি করে বলে উঠলো,

“স্যার আমি ঢুকতে দিইনি। আমাকে ধা’ক্কা দিয়ে উনি ঢুকে পড়েছেন।”

সাদমান টেবিলে সজোরে আঘাত করে বলল,

-“ও দিকে না তাকিয়ে আমার কথা মন দিয়ে শোনো ভাই। কেমন ডক্টর তোমরা? যে সামান্য একটি মেয়ের খোঁজ জানোনা। হসপিটাল থেকে সে হাওয়ায় উড়ে গেলো?”

সমুদ্র রোগীর দিকে তাকিয়ে বিনীত স্বরে বলল,

“পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।”

সাদমানের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো সমুদ্র। সাথে সাদমান ও পা বাড়ালো। একটা নিরিবিলি বদ্ধ জায়গায় বসে সমুদ্র প্রথমেই বলল,

“তোর অ’ভ’দ্র ব্যবহারের জন্য কোন একদিন তুই আমার হাতের মা’র খেয়ে ম’রে যাবি। কার সামনে কিভাবে কথা বলতে হয় অন্তত সেই ভদ্রতা টুকু আয়ত্ত করার চেষ্টা করিস।”

সাদমান বেপ’রোয়া ভাবে হাসলো। দৃঢ় কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

“মেয়েটা কোথায়?”

-“কিছুক্ষণ পূর্বেই আমি জানতে পেরেছি মেয়েটি নিখোঁজ। আমরা খোঁজ চালিয়েও কোনো তথ্য পাইনি।কি ব্যাপার বলতো,কি কান্ড ঘটিয়েছিস মেয়েটার সাথে?” ভ্রু নাচিয়ে বলল সমুদ্র।

সমুদ্রের প্রশ্নের উত্তরে ঘৃ’ণ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাম্ভিক স্বরে বলল সাদমান,

“সাদমান আরবের রুচি এতটা নিম্ন মানের নয়।”
মেয়েটাকে কিছু প্রশ্ন করার ছিলো, এতটুকুই। দুজন পুরুষ মেয়েটিকে নিয়ে চন্দ্রা দীঘির দিকে অগ্রসর হওয়ার পথেই আমার উপর দৃষ্টি পড়তেই মেয়েটিকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলো। কাছে গিয়ে মেয়েটির অবস্থা দেখে মনে হয়েছিলো মৃ’ত। কিন্তু নাহ্! নার্ভ তখনও সচল ছিলো। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর এখন নিখোঁজ। মেয়ের অবস্থা এতটাই করুণ ছিলো যে নিজ থেকে হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা।

সাদমানের বলা কথায় সমুদ্রকে চিন্তিত দেখালো। “তিতাসনগর” একেবারে রসাতলে চলে যাচ্ছে। এত এত রহস্য ঘিরে আছে ওই দীঘিতে। দীঘি তো মাত্র মাঝখানের একটা সিঁড়ি। এই রহস্যের উৎপত্তি আর শেষ কোথায়?

সমুদ্রকে মেয়েটির খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে উঠে পড়লো সাদমান।
সাদমান যাওয়ার পরপরই সমুদ্র কানে ফোন তুললো। কোনো একটা নাম্বারে ডায়াল করে চোয়াল শক্ত করে বলল,

“ম’রে’ছে শা’লি’র ঘরের শা’লি?”
……….
—————

সোনা রাঙা রোদ্দুরে ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে হাফিদুল। একবার তেজস্বী সূর্যের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বিরক্তি ঝেড়ে নিলো। সে যতবারই সূর্যকে শুনিয়ে শুনিয়ে আর্জি জানাক না কেনো, সূর্য তাকে কাঁচকলা দেখিয়ে আরেকটুখানি উত্তাপ ঢেলে দেয়।
“সে বোঝাতে চায় আমি তোমাদের মানুষদের মতো কৃ’প’ণ নই। তোমাদের জন্য নিজের সর্বস্ব ঢেলে দিতে মোটেও কা’র্প’ণ্য করিনা।”
তাই হাফিদুল এখন আর শুনিয়ে শুনিয়ে আর্জি জানায় না।
রাস্তা পেরিয়ে কলেজের ভেতর প্রবেশ করলো। নিজেদের ডিপার্টমেন্টের সামনে যেতেই উপর থেকে একদলা থুতু এসে তার নতুন,চকচকে আয়রন করা শার্টে পড়লো।
থুতুমাখা শার্টে একপাল তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে উপরে তাকালো। চট করে একটি নারী মূর্তি সরে দাঁড়ালো। হাফিদুলের আর দেখা হলোনা সে নারীটি কে?

-“কিরে হাফি! মুখের এমন বিদঘুটে দশা বানিয়ে রেখেছিস কেনো?”

চৈতালির প্রশ্নে হাফিদুল থুতুমাখানো ব্যক্তিকে কয়েকটা গা’লি দিলো। সবটা খুলে বলতেই বন্ধুমহলের সবাই কিটকিটেয়ে হেসে উঠলো।

রা’গ হলো হাফিদুল। সকাল সাতটা থেকে একাদশ শ্রেণির একজন ছাত্রকে রসায়ন পড়ায়।
আজ ছেলেটা না পড়ে শুধু মিটিমিটি হাসছিলো।
ভ্রু কুঁচকে কারণ জিজ্ঞেস করতেই যা শুনলো, হাফিদুলের মাথায় র’ক্ত উঠে গেলো।
স্টিলের স্কেল দিয়ে পি’টি’য়ে মনের ঝাঁজ মিটিয়ে নিয়েছে।

ছেলেটি মিটিমিটি হেসে বলল,

-“ছেলেরা কেনো মেয়েদের ঠোঁটে এতটা আসক্ত তার কারণ উদঘাটন করে ফেলেছি স্যার। আমি রসায়ন ২য় পত্র বইয়ের শেষের দিকে দেখেছি লিপস্টিক তৈরিতে অ্যাল’কো’হল ব্যবহার করা হয়। যার কারণে ছেলেদের নে’শা ধরে যায়।”

এই বে’য়া’দ’ব ছেলের শিক্ষকের সামনে এমন বে’য়া’দবি দেখে ব্যাপারটা ঠিক হজম হলোনা হাফিদুলের। তাই ইচ্ছে মতো মে’রে’ছে। এখন আবার কলেজে পা রাখতে না রাখতেই তার চকচকে শার্টে থুতু ফেলেছে কেউ। থুতু মাখা অংশ নাকের কাছে নিয়ে নাক কুঁচকে ‘উঁহু’ করে বলল,

“মনে হয় এক মাস যাবত ব্রাশ করেনা। বি’ষা’ক্ত গন্ধযুক্ত থুতু।”

হুট করে লুনা বলে উঠলো,

“এই কাল সবাই মিলে জমিদার বাড়ি যাবি? কাল তো ছুটির দিন। সবাই মিলে ঘুরে আসি।”

লুনার কথায় সবাই সম্মতি জানালো। যথারীতি ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরলো চৈতালি। গোসল সেরে খাবার শেষ করে মায়ের ঘরে উঁকি দিলো।

হাসি একজন প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষিকা। স্কুলের কার্যক্রম শেষে মেয়ের দেখাশোনা এসব নিয়ে দিন পার করছেন। চৈতালি মাথা আরেকটু বাড়িয়ে দেখলো হাসি চৈতালির বাবার ছবি দেখে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছেন। এই দৃশ্য দেখে চৈতালির মন ছোট হয়ে গেলো। গুটিগুটি পায়ে মায়ের কোলে এসে মাথা রাখলো।
হাসি চমকে উঠলেন। ছবিটা তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিয়ে চোখ মুছে নিলেন। মেয়ের সামনে কখনোই নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করতে চান না। তবে মেয়েটা ও যে ভেঙে পড়বে।

মায়ের ভাবনা বুঝতে পেরে ক্ষীণ হাসলো চৈতালি।
পর মূহুর্তেই অভিব্যক্তি বদলে নিলো। দুচোখ ভরে নামলো কান্নার ঢল।

ভাঙা গলায় বলল,

“বাবা কেনো এভাবে পর করে দিলো আমাদের। কি দোষ ছিলো। কেনো আমাদের জন্য বেঁচে গেলোনা।”

হাসি নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে সেও যে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। কাজের বাহানা দিয়ে উঠে পড়লেন চৈতালির পাশ থেকে।
চৈতালি ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে দিলো।

ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো আলমারির দিকে। আলমারির কপাট খুলে একেবারে কোনার দিক থেকে একটা র’ক্ত মাখানো সাদা স্কুল ড্রেস বের করলো। কান্নায় জর্জরিত মুখের বদলে ঠোঁটের কোনে দেখা দিলো বক্র হাসি।
মানসপটে ভেসে উঠলো বাবার র’ক্তা’ক্ত দেহ। পাশেই ছু’রি হাতে নিয়ে অগ্নিশর্মা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া চৈতালি।
ভাবনার ঘোর কাটিয়ে চৈতালি ক্রু’দ্ধ স্বরে বলল,

“তোমার মতো সব পা’পি’ষ্ঠ দের বি’না’স ঘটবে। বেই’মান, পা’পিষ্ঠ দের পৃথিবীর বুকে থাকার অধিকার নেই।”
——————
অত্যন্ত নিখুঁতভাবে হাতে থাকা টেস্টটিউব পর্যবেক্ষণ করছেন হুমায়ুন কবির। ধীরে ধীরে নিজের সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মানুষের মস্তিস্ক নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা বহুবছর আগ থেকে করে চলেছেন। কিন্তু এই রিসার্চে সফল হতে হলে প্রয়োজন ছিলো একটি সুপ্ত মস্তিষ্ক। যার উপর প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ঔষধ প্রয়োগ করা যাবে। এর ফলে মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে পঞ্চাশ শতাংশের ও বেশি। তাই তো তিনি বেচে নিলেন নিজের নাতনি চৈতালিকে। হুমায়ুন কবির অনেকটা সফলতার দোরগোড়ায়। চৈতালিকে অনেকটাই নিজের আয়ত্তে নিয়ে এসেছেন। একবার যদি সফল হতে পারেন তবে দেশে-বিদেশে তার নাম,যশ,খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে।
নিজ স্বা’র্থে ছেলের মৃ’ত্যু রহস্য টা ও চাপা দিয়ে দিলেন।

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here