শেষ পাতায় সামাপ্তি পর্ব ২

0
463

#শেষ_পাতায়_সমাপ্তি
#পর্ব_০২
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

-“কি কন বুবু? দীঘিতে আরেকটা লা’শ?”

আনোয়ারের মায়ের আৎকে ওঠা কন্ঠের বিপরীতে রহিমা বানু সম্মতি দিয়ে বললেন,

-“হ গো আনোয়ারের মা। এইডাই তো শুনলাম। ওই লোক নাকি বিশ্বাসই করেনা চন্দ্রা দীঘির কথা। জেদ ধইয়া দীঘিতে নামছে। কিন্তু বাঁইচা ফি’র’তে পারে নাই।”

আনোয়ারের মা আতঙ্কিত চোখে একবার ঘরে তাকালেন। হাঁক ছেড়ে ছেলেমেয়ে তিনজনকে সাবধান করে দিলেন যাতে ভুলেও চন্দ্রা দীঘির পাড় না যায়।

রহিমা বানু বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আরও কয়েক বাড়িতে খবরটা দিতে হবে।

“তিতাসনগর”। শহর থেকে প্রায় দেড়-দুই ঘন্টার পথ। এমন দূরবর্তী স্থানে এই মফস্বল অঞ্চল। তিতাসনগরের একতৃতীয়াংশ মানুষ শিক্ষিত আর বাকিরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বহির্ভূত।
পথঘাট,বিদ্যালয়-কলেজ,হাসপাতাল থেকে শুরু করে সবকিছুতেই উন্নতির ছোঁয়া থাকলেও কিছু কিছু মানুষের মস্তিস্ক আর চিন্তাভাবনার উন্নতি ঘটানো যায়নি। মানুষগুলো কুসংস্কারে ডুবে আছে।

ধারণা করা হয় আজ হতে প্রায় একশত বছর পূর্বের কথা। লোকমুখে রচিত তৎকালীন সময়ের জমিদার ছিলেন
‘জমিদার আলী আহমাদ চৌধুরী’। তৃতীয় স্ত্রীর হাতে প্রা’ণ হারিয়েছিলেন তিনি। স্ত্রী চন্দ্রাবতী ‘জমিদার আলী আহমাদ চৌধুরী’ কে নিজ হস্তে হ’ত্যা করেন। ‘জমিদার আলী আহমাদ চৌধুরী’ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন তার তৃতীয় স্ত্রী চন্দ্রাকে। তাকে ভালোবাসতেন ঠিকই, কিন্তু নারীদেহের লো’ভ ছাড়তে পারেননি। জমিদারিনী চন্দ্রাবতী প্রাণপ্রিয় স্বামীর এমন রূপ মেনে নিতে না পেরে নিজ হস্তে স্বামীকে খু’ন করে এই দীঘিতে ডুব দেন। আর নাকি ফিরে আসেননি। পরপরই দিন কয়েক বাদে বাদে সেই দীঘিতে কয়েকটি লা’শ পাওয়া যায়। সেই থেকে দীঘির নামকরণ করা হয় চন্দ্রা দীঘি। এরপর সব ঠিক থাকলেও বছর ছয়-সাতেক হবে আবারও চন্দ্রা দীঘিতে লা’শ ভেসে ওঠে। তাই কেউ একা একা এই দীঘির পাড়ে যায়না। পানিতে নামাতো দূরের কথা। সেই পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িটিও সরকারের আওতাধীন হয়ে পড়ে রইলো। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ ঘুরতে আসে জমিদার বাড়িতে।

ঝলমলে পরিবেশের রেশ কাটিয়ে হুট করে ঘন কৃষ্ণ আবর দখল করে নিলো অন্তরিক্ষ। চারিপাশে মৃদু আঁধার নামিয়ে মাঝেমাঝে দু’একটা নাম না জানি পাখির আনাগোনা। হু হু শীতল বাতাসের ঝাপটানি।
চমকে ওঠা বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ,মেঘের তীব্র গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠছে আকাশ। দ্বার খোলা জানালার শৌখিন কারুকার্যে বেষ্টিত পর্দাগুলো বাতাসের তালে তালে দুলে চলেছে।
তন্দ্রাঘোর কাটিয়ে উঠেছে মানবী। তৈলাক্ত মুখে ফোলা চোখজোড়া আর ললাটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্রন দৃশ্যমান। শান্ত চাহনি জানালা ভেদ করে অদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আজ আর কলেজের গেট মাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করা হয়নি। তপ্তশ্বাসের সমাপ্তি ঘটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো চৈতালি। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো খোলা বারান্দায়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বেগ বাড়িয়ে কর্ণধারে তরঙ্গিত হচ্ছে মেঘের ঝুমঝুম কান্নার শব্দ। দু’একফোঁটা বৃষ্টি কণা এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে শান্ত,কোমল চাহনির মুখশ্রী। সাথে সাথে মানবীর আখিঁপল্লব একত্রিত হয়ে এলো। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো ঝুম বৃষ্টির ক্ষীণ জলধারা। চোখের পর্দায় ভেসে উঠলো কিছু মর্মা’ন্তিক ঘটনা।

“প্রতিদিনের ন্যায় কলেজের উদ্দেশ্য বের হলো চৈতালি। কিছুদূর এসে রাস্তায় ভীর ভাট্টা দেখে আপনা আপনি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হয়। সামনে এগিয়ে ভীড় ঠেলে দেখার চেষ্টা করে কি হয়েছে?”

সামনে মাথা কা’টা একটা পরিচিত লা’শ দেখেই আৎকে ওঠে চৈতালি। গতকালই চন্দ্রা দীঘিতে একটা লা’শ পাওয়া গিয়েছে। আজ সরাসরি চোখের সামনে কা’টা’ছেঁ’ড়া আরও একটি লা’শ। র’ক্ত স্রোতে পুরো রাস্তা রঙিন হয়ে আছে।
কা’টা লাশের দিকে তাকাতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো চৈতালির। শরীরে মৃদু কম্পন সৃষ্টি হয়। চারিপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। রুদ্ধশ্বাস করা অবস্থা। এই মুহুর্তে সে অনুভূতি প্রকাশে ব্যর্থ। এই বুঝি চৈতালি মৃ’ত্যুর কোলে ঢলে পড়বে?

কয়েকজনের স্পষ্টবানী কানে আসছে।
“রাজ’নীতি করলে এমনই হয়। এদের জীবনের মায়া নেই। ক্ষমতার লোভে একে অপরের প্রাণ কে’ড়ে নেয়। আফসোস হচ্ছে, উঠতি বয়সের ছেলে। এভাবে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করলো।”

চৈতালির গা গুলিয়ে উঠছে। চোখের সামনের এমন বিভৎস দৃশ্য সে আর নিতে পরছেনা। থরথর করে শরীর কেঁপে উঠলো। হুট করেই তাকে আগলে নিতে একটা শক্তপোক্ত হাত তার কব্জি চেপে ভীড় থেকে বের করে আনলো।

-“চৈতি, আপনি ঠিক আছেন তো? আসুন আমি বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি।”

রাশভারী ধাঁচের পুরুষালী কন্ঠস্বর কর্ণগোছর হতেই মুদে আসা চোখের পল্লব জোর করে খুলে মানুষটিকে দেখার চেষ্টা করে। সামনে দন্ডায়মান ব্যক্তিকে দেখে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে চৈতালি। নিভু নিভু দৃষ্টি ফেলে ভাবে উনি কিভাবে এতটা স্বাভাবিক আছেন? উনি কি মৃ’ত লা’শটি দেখেন নি? দেখলে এই মুহুর্তে সমুদ্রের স্বাভাবিক থাকার কথা নয়, একদমই নয়।

সমুদ্র যেনে এক ঝলকেই বুঝে গেলো চৈতালির অভিব্যক্তি।

“মাথায় এতটা চাপ নেবেন না চৈতি।” বলেই দুর্বোধ্য হাসলো সমুদ্র।

ততক্ষণে চৈতালি ঢলে পড়লো। সমুদ্র লা’শটির দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত রইলো। তার অভিব্যক্তিতে দুশ্চিন্তা, ভ’য়, উৎ’কন্ঠা, স্বজন হারানোর যন্ত্র’ণা,অস্থিরতা কিছুই স্পষ্ট নয়। মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

“খু’ন টা করেছে কে?”

————————————

ফাহমিদা তার বাউ’ন্ডুলে স্বভাবের ছোট ছেলের অগোছালো, নোংরা ঘরটি মানুষ করতে ব্যস্ত। ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে বকে যাচ্ছেন ছেলেকে। বড়ছেলে আর ছোট ছেলের মধ্যে বিস্তর ফারাক। সমুদ্র যেমন পরিপাটি,গোছালো ধাঁচের ছেলে সাদমান ঠিক তার বিপরীত। সব কিছুতেই সাদমান আর সমুদ্রের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করা যাবে। এমনকি গায়ের রংটা পর্যন্ত তাদের ভিন্ন। শুধু চেহারায় মিল পাওয়া যায়।

শিষ বাজাতে বাজাতে ঘরে ঢুকলো সাদমান। মা কে খেয়াল না করেই শরীরের ভেজা চুপচুপে শার্ট ছাড়িয়ে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো।
ফাহমিদা চোখ গরম করে তাকিয়ে রইলেন। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলেন,

-“তোর এই স্বভাব কোনোদিন পাল্টাবে না,না? এমন নোংরা চালচলন দেখলে কোনো বাবা মেয়ে বিয়ে দেবে তোর কাছে?”

কানে ভেসে আসা শব্দ উৎসের খোঁজে পেছন ঘুরতেই মায়ের জ্বলন্ত চোখজোড়া নজরে পড়লো। খুব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে মাকে টেনে খাটে বসালো।
নিজে ফ্লোরে বসে হালকা ঝুঁকে মায়ের পেটে দৃষ্টি বুলিয়ে সকৌতুকে শুধালো,

-“কিরে, তুই ছেলে হবি নাকি মেয়ে? আচ্ছা ছেলে হলে কার মতো হবি? বড় ভাইয়ের মতো অতি ভদ্র, নাকি ছোটভাই এর মতো বি’গ’ড়ে যাওয়া বাউ’ন্ডুলে স্বভাবের?”

ফাহমিদা ছেলের মাথায় চাটি মেরে হেসে উঠলেন।
“তোর স্বভাব কখনো ঠিক হবেনা। অ’স’ভ্য ছেলে।”

সাদমান শব্দহীন হাসলো। মায়ের হাতে শার্ট তুলে দিয়ে বলল,” অনুকে বলবে আমার শার্ট ভালো করে ধুয়ে দিতে। তুমি আবার ধুতে যেও না। খবরদার ওই লিপিকে দিয়ে ধোয়ানো তো আরও আগেই না।”

ফাহমিদা ঘর গুছিয়ে বের হলেন। মেয়েকে ডেকে দিয়ে আদেশের সুরে বললেন,

-“তোর ভাইয়ার শার্ট ভালো করে ধুয়ে আয়রন করে রাখবি।”

অনু নাকমুখ কুঁচকে নিলো।

-“আমি পারবোনা। তুমিই পরিষ্কার করো।”

ফাহমিদা চোখ গরম করে বললেন,

-“তোর দুই ভাই এর কড়া নিষেধ। আমি যাতে কোনো কাজে হাত না ছোঁয়াই।”

অনু শার্ট হাতে নিয়ে গমগমে স্বরে বলল,

“সেই তো, এই বাচ্চা সব ল’ন্ড’ভ’ন্ড করে দিয়েছে। সব নিয়ম পাল্টে দিচ্ছে। আমার বন্ধু-বান্ধব সবাই হাসাহাসি করছে। এটাকে ন’ষ্ট কেনো করে ফেলছো না?”

ফাহমিদা মেয়ের গালে স’পা’টে চ’ড় বসিয়ে দিলেন। অনু টলটলে চোখে শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ছুটলো।

রাতে আর বাসায় ফেরেনি সাদমান। ফাহমিদাকে চিন্তিত দেখালেও নুরুল হক নির্লিপ্ত রইলেন। যখন সময় হবে বা মন চাইবে তখন আপনা আপনি বাড়িতেই ফিরবে বলে ধারনা করেন নুরুল হক।

——————

বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠু’কে উদাস মনে চৈতালি চেয়ে রইলো স্বল্প দূরত্বে থাকা সামনাসামনি বিল্ডিং এ। একবার, যদি একবার ওই সর্ব’নাশা মানবের দেখা মিলতো। আজ মা টিউশনে যেতে দিলেন না। অসুস্থতার বাহানা দিয়ে একপ্রকার হু’ম’কি দিয়েই ঘরে আটকে রাখলেন চৈতালিকে। যার দরুন দেখা হলেনা প্রেমিক পুরুষকে। চোখজোড়া তৃষ্ণার্থ, কাউকে না দেখার যন্ত্রনায় অস্থির হৃদয় ধুকপুক ধুকপুক করে উঠছে। সেই যে বিকেলে বৃষ্টির সময় এখানে এসে দাঁড়িয়েছিলো, এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। চৈতালি ঘরে ফেরেনি। এই বুঝি তার প্রেমপুরুষের দেখা মিলবে। কিন্তু হায় আফসোস! মিললো না দেখা।
এপার বারান্দায় দাঁড়ানো চৈতালির খবর নেই। ওপারে কেউ একজন তাকে নজর বন্দী করে রেখেছে সেই কখন থেকে।

হসপিটাল থেকে ফিরেই যথারীতি নিত্যদিনের অভ্যেসের খাতিরে সমুদ্র এসে দাঁড়ালো তার অতি প্রিয় বারান্দায়। এই বারান্দা তার খুব প্রিয়। হুট করেই কোনো এক ঝলসানো বিকেলে সমুদ্রের মনে একটুখানি প্রেমের জন্ম হয়েছিলো।
এতকাল ধরে দেখে আসা কিশোরীর প্রতি যে অনুভূতি জন্মায়নি সেই অনুভূতি হুট করে এসেই কোনো এক বিকেলে ধরা দিলো হৃদয় কুটিরে।
এমন এক সুঠাম দেহি বলিষ্ঠ পুরুষের মনে বসবাস এক তুলতুলে নরম মনের রমনীর। কথাটি ভাবতেই কা’টা’কা’টা চেহারার উজ্জ্বলতা হাসির দমকে তিরতির করে বেড়ে ওঠে সমুদ্রের।

হুট করে চৈতালির এক নিষিদ্ধ ইচ্ছে হলো। আচ্ছা! সে কি একবার চন্দ্রা দীঘিতে যাবে? কি রহস্য আছে ওই দীঘিতে? আচ্ছা জমিদার আর তার স্ত্রীর কাহিনী কি সম্পূর্ণই মানুষের মন গড়া? নাকি এর পেছনে সত্যিই কোনো রহস্য রয়েছে?
ভীতু মনা চৈতালির মস্তিষ্ক হঠাৎই সচল হয়ে উঠলো।

জমিদারিনী চন্দ্রাবতীর মৃ’ত্যু’র সাথে কেনো সব মৃ’ত্যু’র যোগসূত্র তৈরি করছে গ্রামবাসী?
যদি কেনো যোগসূত্র থেকেও থাকে তবে মাঝখানের সময়টাতে কেনো কেউ ম’রে নি? বিগত ছয়-সাত বছর যাবত চৈতালি দেখে আসছে এই দীঘিতে নারী পুরুষকে প্রা’ণ হারাতে। এর আগে কেনো কেউ ম’রে নি? এই সকল প্রশ্নের উত্তর কার কাছে পাবে? কে দিতে পারবে এসকল প্রশ্নের উত্তর?
চৈতালির মন কৌতুহলী হয়ে উঠলো। এই কৌতুহল না আবার তাকে চরম বি’প’দের মুখে ঠেলে দেয়।

#চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here