শেষ পাতায় সামাপ্তি পর্ব ১৩

0
318

#শেষ_পাতায়_সমাপ্তি
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৩

মেঘের আড়ালে সূর্যের লুকোচুরি। জনাকীর্ণ পরিবেশে মাথা ভর্তি যন্ত্রনা কিলবিল করছে। ভেতরের গুমোট ভাব বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে দীর্ঘশ্বাস হয়ে। জীবনটা আজ রক্তশুন্য, ফ্যাকাশে, রংহীন লাগছে। একফোঁটা জলে ভিজে উঠলো কঠিন হৃদয়টি। কঠোরতায় ছেয়ে গেলো সরল মুখশ্রী। ভেতরে ভেতরে আত্ম জেদ হানা দিলো দলবেঁধে। অদূরে বসা মানবীর হাউমাউ কান্নার শব্দ বুকে তীরের মতো বিঁধছে। সাদমান চৈতালির সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেনা। পুলিশ আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই নুরুল হক হাসপাতালে সমুদ্রকে দেখে বাড়ি ফিরলেন। পুলিশের খবর পেয়েই ছুটে আসলেন তিনি। সাদমানকে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। নুরুল হক আপাতত সময় চেয়ে নিলেন কিছুক্ষণ। অবশ্য এর পরিবর্তে ঘু’ষ দিতে হয়েছে।

মায়ের চির নিদ্রায় আচ্ছন্ন মুখে প্রাণ ভরে চুমু খেলো চৈতালি। শেষবার মায়ের কাছে একটু ভালোবাসা চেয়েছিলো। আজ মাকে সেই ভালোবাসা টুকু ফিরিয়ে দিলো। মায়ের ক্ষতবিক্ষত বুকে মাথা রেখে পাগলের মতো কেঁদে যাচ্ছে। শরীরে জামাকাপড়ের ঠিক নেই। বিধ্বস্ত অবস্থায় মাকে জড়িয়ে রেখেছে। পাগলের মতো প্রলাপ করছে,

“মা! মা! তুমি আমাকে রেখে কেনো ঘুমাচ্ছো? আমিও ঘুমাবো তোমার সাথে। তুমি এই পৃথিবীর মানুষগুলোর মতো এত নিষ্ঠুর কিভাবে হলে? আমাকে নর’পশু দের মাঝে ছেড়ে দিয়ে খুব সহজেই ঘুমিয়ে গেলে? এত শান্তির ঘুম কিভাবে ঘুমালে তুমি? একবার ও আমার কথা মনে পড়লো না? এত স্বার্থপর কেনো তুমি?”

শেষের কথাগুলো চিৎকার করে বলে উত্তেজিত হয়ে পড়লো চৈতালি। কয়েকজন তাকে মায়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। চৈতালি উন্মাদ হয়ে গিয়ে মহিলাগুলো কে আ’ঘা’ত করছে। দাপাদাপির মাঝেই তুলতুলে শরীর খানা নিস্তেজ হয়ে এলো। জ্ঞান হারালো চৈতালি। কারো কন্ঠে দীর্ঘশ্বাস, কেউ কেউ আফসোস করছে,

“আহারে! মাইয়াডা বাপ- মা দুইজনই হারাইলো। নদীর একূল ভাঙে ও কূল গড়ে। মাইয়াডা দুই কূলই হারাইলো। দাদাটা ও নাকি নিখোঁজ। আফসোস হইতাছে মাইয়াডার লাইগা।”

যেহেতু চৈতালির দাদা নিখোঁজ। তাই চৈতালিকে নিজের বাড়িতে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন নুরুল হক। মেয়েটার সমস্ত সিকিউরিটি তার নিজের। সবকিছুর জিম্মাদার নুরুল হক। পুলিশ নুরুল হকের কথার ভিত্তিতে চৈতালিকে তাদের বাড়িতে রেখে সাদমানকে নিয়ে রওনা হয় থানায়। যতই সাদমান বলুক সে খু’ন করেনি পুলিশ তো কোনো প্রমাণ ছাড়া তার কথায় বিশ্বাস করবেনা। যেখানে সমুদ্র জবানবন্দি দিয়েছে সাদমানই তাদের দুজনকে আ’ঘা’ত করে চৈতালিকে নিয়ে পালিয়েছে এবং তার কথা অনুযায়ী চৈতালিকে তাদের বাড়িতেই পাওয়া গিয়েছে। সে অনুযায়ী সাদমানকে নিয়ে যাওয়া হলো।

হাসির দাফন কার্য শেষ করে যে যার বাড়ি ফিরলো। চৈতালির জ্ঞান ফিরেছে তারও অনেক পরে। মায়ের কথা মনে পড়তেই উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে বেরিয়ে গেলো। অনু এসে ঝাপটে ধরলো চৈতালিকে। একা চৈতালির সাথে না পারায় মাকে ডাক দিলো। ফাহমিদা এসে ঘরে ঢুকিয়ে নিলো চৈতালিকে। চৈতালি এলোপাতাড়ি জিনিসপত্র ছোড়া’ছুঁড়ি করছে। নিজের চুল খামছে হাত সামনে আনতেই ফাহমিদা চমকে উঠলেন। আঙ্গুলে প্যাঁচিয়ে চুলগুলো উঠে এসেছে। ফাহমিদা মেয়েকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে দরজা চাপিয়ে দিলেন। চৈতালি খানিকক্ষণ পর ছোড়া’ছুঁড়ি থামিয়ে দিয়ে গুনগুন শব্দে কাঁদলো চৈতালি। চৈতালির গুনগুনিয়ে কান্নার শব্দ শুনে ফাহমিদার মোটেও চৈতালিকে সুস্থ মানুষ মনে হলোনা। ভ’য়ে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা শ্রোত বয়ে গেলো। নুরুল হক থানায় আছেন। বাড়িতে তারা মা মেয়ে আর চৈতালি ছাড়া কেউ নেই।

চৈতালি ঘর ছেড়ে আবার ও বেরিয়ে গেলো। ফাহমিদা বাঁধা দিয়ে ও কূল করতে পারলেন না। চৈতালি নিস্তেজ কন্ঠে জবাব দিলো,

-“ফিরবো আমি।”

ধীর পায়ে নিজের বাড়ির দিকে অগ্রসর হলো। দরজা ঠেলে একপলক পুরো বাড়িতে নজর বুলিয়ে নিলো। মায়ের ঘরে গিয়ে তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো। চোখেমুখে কাঠিন্য ভাব। বাবা মা’রা যাওয়ার পর থেকেই মা ভিন্ন ঘরে থাকতো। চৈতালি মায়ের ঘর ছেড়ে বাবার ঘরে ঢুকলো। সযত্নে গুছিয়ে রাখা বাক্সটি হাতে নিয়ে হাসলো। হঠাৎ আয়নায় চোখ পড়তেই নিজের বি’শ্রী রূপ নজরে পড়লো। এমনিতে ও চুল তেমন একটা ঘন নয়। চুল পড়া অনেক আগ থেকেই হচ্ছে। ইদানীং হাত দিলেই চুল সব উঠে আসে। কিছুদিনের ব্যবধানে চুল শুন্য মাথা নিয়ে ঘুরতে হবে।
বাক্স হাতে নিয়েই সাদমানের বাড়ি ফিরলো চৈতালি।

ফাহমিদা চৈতালিকে রাতের খাবার খাওয়াতে পারলেন না। সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারলেননা “বাক্সতে কি আছে?”

নিদ্রাহীন রাত্রি কাটিয়ে ফজরের নাময আদায় করে
মায়ের কবরের কাছে এসে বসলো চৈতালি। বাড়ির সামনে পূর্ব পাশের জায়গাটিতে কবর দেয়া হয়েছে হাসিকে। এক মগ পানি এনে মায়ের নতুন কবর ভিজিয়ে দিলো। চোখের পানি ছেড়ে কবর জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। মায়ের কবরের উপরই শুয়ে রইলো চৈতালি। সূর্য যখন চোখ মেলে তাকালো সাথে বেলা বাড়লো। চৈতালি কাঁদা মাটি শরীরে নিয়েই সাদমানের বাড়ি ফিরলো। মনে মনে সে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

সমুদ্র হাসপাতালের সাদা বেডে শুয়ে মনের সুখে স্যুপ খাচ্ছে। কথায় আছেনা, “পাগলা সাঁকো নাড়াবিনা, তোর সাঁকো তে তুই ই পড়বি”। সাদমানকে তারই বিছানো ফাঁদে ফেলে চরম সুখ সুখ অনুভব করছে সমুদ্র। ভাইটার জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে। একেতো জেলে পঁচে ম’র’বে তার উপর তার চরম ভালোবাসা দেওয়া প্রেমিকার ঘৃ’ণা ও সহ্য করতে হবে। মাঝখান থেকে সে একমুঠো সুখ কুড়িয়ে নেবে। এমনিতেও যে রাতেই ইচ্ছে হয় সুখের সন্ধ্যানে বেরিয়ে পড়ে সমুদ্র। অন্যকেউ সেই সুখের অংশীদার হওয়ার আগেই কেচ্ছা খ’ত’ম। বাঁকানো ঠোঁটজোড়ায় একচিলতে হাসি দেখে কতশত তৃষ্ণার্ত প্রেমিকা উন্মাদনায় ভোগে সে খবর কি সমুদ্র রাখে? আত্ম তৃষ্ণা মেটাতেই ব্যস্ত সে।

নুরুল হকের চেহারার অবস্থা খুব একটা ভালো না। মনের অবস্থা তারচেয়ে ও করুণ। কিভাবে সাদমানকে ছাড়িয়ে নেবেন সেই চিন্তায় তার চোখে ঘুম নেই। ছেলেটা যেমনই হোক তার নিজেরই তো ছেলে। তাছাড়া সাদমান মিথ্যে বলার মতো ছেলে নয়। যে অন্যায় সে করবে তা বুক ফুলিয়ে বলবে হ্যাঁ! একাজ আমিই করেছি। আজকাল সমুদ্রের উপর থেকে মন উঠে গেছে তার। বাবার কথার মূল্য দিতে চায়না। তার উপরি স্বভাব যতটা ভদ্র, নম্র ভেতরটা ঠিক ততটা স্বচ্ছ নয়। নর্দমার নোং’রা পানি চেয়েও কালো, কুচকুচে কালো তার অন্তর। নুরুল হকের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান ছিলো সমুদ্র। তার গায়ের রং, বলিষ্ঠ দেহ, পড়ালেখা,ব্যক্তিত্ব সবকিছুতেই সন্তুষ্ট ছিলেন নুরুল হক। অথচ ছেলের কুকর্মের কথা যেদিন জানতে পারলেন সেদিনই নিস্তেজ হয়ে পড়েন তিনি। এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও সে গলা উঁচু করে কথা বলেছে। নিজের হাতে কোনো প্রমাণ না থাকায় কিছুই করতে পারছেননা নুরুল হক। নয়তো কবেই সমুদ্রকে জেলের ঘা’নি টানতে হতো। নুরুল হকের ভেতর থেকে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

কর্দমাক্ত হয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো চৈতালি। ফাহমিদা চৈতালিকে কিছু না বলে অনুকে পাঠালেন চৈতালির বাড়ি থেকে তার জন্য একটা জামা নিয়ে আসতে। তাই করলো অনু। নুরুল হক খাবার টেবিলে বসে আছেন ঠিকই কিন্তু গলা দিয়ে খাবার নামছেনা। তিনি একজন খারাপ মানুষ। বড় ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করতে পেরে তার ভেতরটা আত্মগরিমায় ফুলে উঠতো। অথচ আজ ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। ঘৃ’ণায় জর্জরিত বুকটা আজ ধি’ক্কার জানাচ্ছে তাকে। তার শুদ্ধ ছেলে শুদ্ধ নেই। সে দুনিয়ার নিকৃষ্টতম পুরুষ হয়ে আছে।

সবাইকে খাবার দিয়ে ফাহমিদা একবার হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। নুরুল হক বাঁধা দিতে গিয়েও দিলেন না। মানুষটির মনের অবস্থা ভালো নেই। এক ছেলে জে’ল এ আরেক ছেলে হাসপাতালের বিছানায় সয্যাশয়ী। বড়ছেলের কর্মের ইতিহাস হয়তো সহ্য করতে পারবেনা ফাহমিদা। তাই নুরুল হক আর বাঁধা দিলেন না। কিন্তু কতকাল সত্য চাপা দিয়ে রাখবেন?

ঝুমঝুমিয়ে সন্ধ্যা নামলো ধরনীর বুকে। সূর্য লুকোলো মেঘের আড়ালে। ধরা পড়লো একফালি রূপোলি আলো। রূপ বাড়লো আকাশের। লজ্জায় আরক্তিম আভা ছড়িয়ে বিদায় দিলো দিবা, বরণ করলো তিমির রাত্রি। কালই সমুদ্রকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা যাবে। নুরুল হক দিনের প্রায় পুরোটাই উকিলের পেছনে ছুটেছেন। কিভাবে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনবেন। অনু আর ফাহমিদা গিয়েও সাদমানের সাথে দেখা করে আসলো। সাদমানের ঠোঁটের কোনে ম্লান হাসি। একবার অনুকে জিজ্ঞেস করলো “চৈতালি কেমন আছেন?”।

অনু চৈতালির অবস্থার বর্ণনা করতেই সাদমান আৎকে ওঠে। গলায় শব্দ আটকে আসে। তার জন্যই হয়তো মেয়েটার এই করুণ দশা। মেয়েটা তাকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসে গেলো। তার বিনিময়ে দুঃখ ছাড়া কিছুই দেয়নি সে। তার ভুলের কারণেই হয়তো আজ চৈতালি মা হা’রা। তীব্র এক অপরাধ বোধ তাকে কুটকুট করে খাচ্ছে।

নুরুল হক রাতে বাসায় ফিরতেই চৈতালি তার মুখোমুখি দাড়ালো। নুরুল হক খানিকটা ভড়কে গেলেন। নিজেকে ধাতস্থ করে জবাব দিলেন,

” কিছু বলবে?”

চৈতালি চুপ করে রইলো। তার দু’চোখ নুরুল হকের চোয়ালে বিচরণ করছে। আপনজনের বেদনায় একদিনেই মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। চৈতালি চোখের দৃষ্টি স্থির রেখে ঢিমে স্বরে উত্তর দিলো,

-“আমি সাদমানের উপর থেকে সমস্ত অভিযোগ তুলে নিতে চাই। কাল আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।”

চৈতালির কথায় ভারী চমকালেন নুরুল হক। সত্যিই চৈতালি সাদমানের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ তুলে নেবে? কিন্তু এতে চৈতালির লাভ টা কোথায়?

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here