শেষ পাতায় সামাপ্তি পর্ব ১২

0
333

#শেষ_পাতায়_সমাপ্তি
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১২

কত শত পরিচিত মুখ এই প’তি’তা পল্লিতে দেখে সকৌতুকে হাসলো সাদমান। নর্দমার কি’ট গুলোর বেশিরভাগের ঘরেই বউ আছে। তবুও যৌ’ন লাল’সা মেটাতে এই প’তি’তা পল্লিতেই নিজেদেরকে সঁপে দিচ্ছে। সবাই মুখ টিপে হাসছে সাদমানকে দেখে। একজন তো বলেই দিলো,

-“বাবুসাহেব এর শুদ্ধ ভাই টা ও শেষমেষ নিজেকে নারীর কাছে সমর্পণ করতে এলো।”

রনির বড়চাচা হো হো করে হেসে উঠলেন। পূনরায় মেয়েদেরকে হাঁক ছেড়ে ডেকে বললেন,

-“তাড়াতাড়ি রমণী সাজাও। ভাতিজা আমার অপেক্ষা করা পছন্দ করেনা।”

মুখ খুললো সাদমান। ফিচেল হেসে নাক সিটকালো। কন্ঠে দাম্ভিকতার ছোঁয়া।

-“সাদমান আরবের রুচি এতটা নোং’রা হয়ে যায়নি। এসব দেহ বিলানো নারীর প্রতি তার লো’ভ নেই। এমন লো’ভ রাস্তার কুকুরদের থাকে। আমি শুধু দেখতে আসলাম ব্যবসায়ীদের ব্যবসা কেমন চলে?”

রনির চাচা আলতাফ খান অপমানিত বোধ করলেন। বেয়া’দব ছেলেপেলে। এদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। কার সাথে কিভাবে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয় তা এদের জানার কথাও না। তাকে কিনা রাস্তার কুকুরের সাথে তুলনা করছে? এখনই ক্ষো’ভ প্রকাশ করলে চলবেনা। আপাতত রা’গ দমিয়ে রাখলেন। কৌশলে যদি বাগে আনা যায় তাতে ক্ষতি কী? সরু চোখে তাকিয়ে হাসলো আলতাফ। সুর টেনে বলল,

-“ব্যবসায় যোগ দেয়ার ইচ্ছে আছে নাকি? তোমার পছন্দ লো ক্লাস হবেনা সেটা আমি জানি। তোমার ভাই এর ই প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রমণী লাগে। তাও আবার যেনো তেনো নয়। যারা নিজ থেকে সঙ্গ দেয়ার চেষ্টা করে তাদের পছন্দ নয়। এই জোর করে গ্রামের আনাচকানাচে থেকে তুলে এনে তৃষ্ণা মেটায় আরকি। তার পছন্দের লেভেল হাই। যাকে একবার বাবুসাহেব ওরফে তোমার ভাই সমুদ্র স্পর্শ করে তাকে দ্বিতীয়বার কেউ স্পর্শ করার সুযোগ পায়না। তৃষ্ণা মিটলেই আলবিদা। সেখানে তার ভাই হয়ে তোমার পছন্দ লো ক্লাস হয় কিভাবে?”

ওই পশুটা তার ভাই ভাবতেই সাদমানের এক বি’শ্রী অনুভূতি হলো। সাদমান বলল,

-“যদি এখানে পুলিশ আসে?”

হো হো করে হেসে উঠলেন আলতাফ। যেনো সাদমান বড় মজার কথা বললো। আরে পুলিশ তো নিজ থেকেই রোজ এখানে আসে। তাকে আবার নেমন্তন্ন করে ডেকে আনার কি দরকার? অবশ্য সবকিছুতেই তাদের হাত আছে।

সাদমান কথা বাড়ালোনা। সবগুলোই দলবেঁধে আছে বুঝতে পারলো। বাড়িতে চৈতালিকে রেখে এসেছে। জমিদার বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার পূর্বে বলে আসলো,

-“খুব শীঘ্রই ধ্বং’স নেমে আসবে তোমাদের পা’পের সাম্রাজ্যে।”

সাদমান যেতেই আলতাফ চোয়াল শক্ত করে ফেললো। সমুদ্রকে কল দিয়ে ও পেলোনা। এনামুল হকের কাল থেকেই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এরা সব কিছু তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
প্রথম এই ব্যবসায় তার আর এনামুল হকের শেয়ার ছিলো। একদিন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ঝোপের আড়ালে কারো অবয়ব দেখতে পেয়ে চুপিসারে সেখানে গিয়ে পৌঁছালো আলতাফ। সমুদ্র ফোনে অশ্লী’ল ভিডিও দেখছে। ঘাড়ে কারো হাত পড়তেই চমকে ওঠে সমুদ্র। থরথর করে কেঁপে ওঠে পুরো শরীর। আলতাফ মৃদু হেসে বলল,

-“এভাবে আর কত অন্যের টা দেখবে? নিজে কে ও তো সুযোগ দিতে হবে।”

সমুদ্র বুঝলেনা কথাটা। আলতাফ সমুদ্রকে নিয়ে জমিদার বাড়িতে ঢুকলেন। প্রথমবার সেখানে রাত্রি যাপনে সমুদ্র ভ’য় পেলে ও ধীরে ধীরে ভ’য় কে’টে গিয়ে তার পছন্দ হয়ে উঠলো উচ্চ পর্যায়ের। কয়েক বছর যেতেই ব্যবসায়ে সে ও যোগ দিলো। এদিকে পড়ালেখা চালিয়ে গিয়ে পরিবারে, সমাজে ভালো ছেলের খেতাব অর্জন করলো।

বাড়ি ফেরার পথে সেই পুলের উপর দিয়েই ফিরতে হলো সাদমানকে। অধর কোনে দুর্বোধ্য হাসি। সমুদ্র লোক পাঠিয়েছে সাদমানকে মা’রার জন্য। গতদিন যখন সমুদ্র জিজ্ঞেস করেছিলো চৈতালি কে ভালোবাসে কি’না। সাদমানের চোখের ভাষা পড়তে খুব একটা অসুবিধে হলোনা সমুদ্রের। সে বুঝে গিয়েছিলো চৈতালির জন্য সাদমানের মনে কিছুতো একটা আছে। সেই মুহূর্তে অনু চলে আসায় আর কথা এগোতে পারলোনা। অগত্যা দু’ভাই কে খেতে যেতে হলো।

সেই রেশ ধরে সমুদ্র সাদমানকে মা’রার জন্য লোক পাঠিয়েছিলো। সেই ঘটনা মনে পড়তেই তাচ্ছিল্য হাসলো সাদমান।
সাদমান আজ যখন চোখ বন্ধ করে পুলের উপর বসেছিলো। তখনই আগমন ঘটে এক আগন্তুকের। পিঠ পিছে ছু’রি বসাতে গিয়েও ব্যর্থ হলো সেই লোক। তার আগেই সাদমান সতর্ক হয়ে গেলো।
সাদমান দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলো,

-“কে পাঠিয়েছে তোকে?”

লোকটি কিছুতেই স্বীকার করতে চাইলোনা তাকে কে পাঠিয়েছে।
সাদমান ছু’রি ধরলো তার গলায়। লোকটি হো হো করে হেসে উঠলো।

-“আমাকে মে’রে ফেললে ও বলবোনা। আমরা বে’ই’মা’নি করতে শিখিনি।”

সাদমান নিজ ভঙ্গিতে হেসে উঠলো। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকাতে হয়। লোকটির গলা থেকে ছু’রি সরিয়ে কপাল চুলকে বলল,

-“পরিবার আছে নিশ্চয়ই। তোর না হয় জীবনের মায়া নেই। কিন্তু পরিবার পরিজন?”

সাদমান ভ্রু বাঁকাতেই ঢোক গিললো লোকটি। নিজের কথা ভাবেনি ঠিক। কিন্তু তার পরিবার?

সাদমান আরেকটু জোর দিতেই লোকটি দ্বিধা না করে বলে ফেললো সমুদ্রের নাম। এতদিন সমুদ্রকে সন্দেহ করে তার পেছনে লোক লাগিয়েছিলো সাদমান। দুটো দিন সাদমান নিখোঁজ ছিলো সেই সময়টা ও সমুদ্রের খোঁজের পেছনে লাগিয়েছে, অন্য কোনো কাজে নয়। সেদিনই সমুদ্রের উপর সন্দেহ হয়েছিলো যেদিন হাসপাতালে ভর্তি করানো মেয়েটিকে খুঁজতে গিয়েছিলো সাদমান।

‘ম’রে’ছে শা’লির ঘরের শা’লি’ সমুদ্রের ফোনে বলা কথাটি সাদমানের কান এড়ায়নি। নিশ্চিয়ই মেয়েটা সমুদ্রের কু’কর্মের ব্যাপারে জেনেছিলো বলে মেয়েটাকে সরিয়ে দিলো পথ থেকে।

সাদমান তাকে মা’র’তে আসা লোকটিকে ছেড়ে দেওয়ার পূর্বে জেনে নিলো সমুদ্রের ব্যাপারে সে কিছু জানে কিনা? সত্য না বললে তার পরিবার ঝুঁকিতে থাকবে বলে হু’মকি দিলো সাদমান।

লোকটি ভ’য়ে ভ’য়ে বলে দিলো জমিদার বাড়ির কথা।

-“আমি নিজেও সেখানে যাই। সেই থেকেই বাবুসাহেব মানে সমুদ্র সাহেব আমাকে তার কাজে রেখেছেন।”

যতটুকু জানা প্রয়োজন জেনে নিলো সাদমান। ছেড়ে দিলো লোকটিকে। সমাপ্তি টানলো ভাই-ভাইয়ের সম্পর্কের। পা বাড়ালো চৈতালির বাড়ির উদ্দেশ্য। আ’ঘা’ত করলো সমুদ্রকে।

কয়েক ঘন্টা আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা পূনরায় মনে করে চোয়াল শক্ত করে বাড়ির পথে হাঁটা দিলো সাদমান।

—————————

হাসির পক্ষে সমুদ্রকে ঘরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিলোনা। তাই ঘর থেকে ফাস্টএইড বক্স নিয়ে এসে কোনো রকম ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিলো সমুদ্রের বুকে। ব্যথানাশক ওষুধ খাইয়ে বিল্ডিং এর দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বসালো। কিছুটা সময় পর সমুদ্র ধাতস্থ হতেই কিছুদূর সাদমানের ফেলে যাওয়া ছু’রির দিকে নজর পড়লো। মনে মনে বিরাট এক ছ’ক কষে ফেললো সে। পা লম্বা করে পা দিয়ে ছু’রি টি টেনে নিলো। হাসি অবাক হয়ে বলল,

-“তুমি ছু’রি দিয়ে কি করবে? আগে নিজে ঠিক হও। আমার মেয়েটাকে ওই সন্ত্রা’সীর হাত থেকে ফিরিয়ে আনো।”

সমুদ্র নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দিলো,

-“তাকে ফিরিয়ে আনবো। বড্ড প্রয়োজন যে তাকে। আপনি একটু পাশে বসবেন আন্টি?”

হাসি খানিকটা এগিয়ে গেলো সমুদ্রের কাছে।
সমুদ্র হেসে ফেললো।

-“সরি! আন্টি, আপনাকে বিদায় নিতে হচ্ছে।”

সমুদ্রের কথায় হকচকিয়ে গেলো হাসি।

-“মানে?”

হাসিকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলোনা সমুদ্র। বুকে ছু’রি চালিয়ে দিলো। একই জায়গায় সাত-আট বার আ’ঘা’ত করে তবেই ক্ষান্ত হলো। প্রাণ হারিয়ে অবহেলায় পড়ে রইলো হাসির নিথর দেহ। সমুদ্র ব্যান্ডেজ খুলে পকেট থেকে ফোন বের করে ডঃ সমীর কর্মকারের নাম্বারে কল দিলো। রিসিভ হতেই সমুদ্র জানালো তার বাড়িতে খবর দিয়ে ইমিডিয়েট চৈতালির বাড়ি এম্বুলেন্স পাঠাতে। ঠিকানা দিয়ে দিলো। ডঃ সমীর কি হয়েছে জানতে চাইলে সমুদ্র জানালো তার ভাই তার হবু শাশুড়ীকে খু’ন করে তাকেও খু’ন করার উদ্দেশ্যে আঘাত করে তার হবু স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গেছে।

ডঃ সমীর আর কিছুই জানতে চাইলোনা। এই মুহূর্তে যা করার প্রয়োজন সেটাই করলো। এম্বুলেন্স নিয়ে চৈতালির বাড়িতে পৌঁছে গেলো। পুলিশকে সবটা জানিয়ে তবেই সে ক্ষান্ত হলো।

—————————

রক্তিমা আভা ছড়িয়ে পূর্বাকাশে উদিত হলো তেজি সূর্য। গাছের ডালে ডালে বাতাসের ছড়াছড়ি। ভোরের এই বাতাস কোনো সুসংবাদ নিয়ে আসেনি। নিয়ে এলো এক বিদ’ঘুটে, বিষাদময় সংবাদ। বিষা’ক্ত গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো আকাশে বাতাসে।
ঘুম ভাঙতেই নিজেকে আলাদা এক জগতে আবিষ্কার করলো চৈতালি। এ ঘরটা তার নয়,তবে কার? চুপচাপ সিলিং এ চোখ রেখে ধাতস্থ করলো নিজেকে। চোখ থেকে ঘুমের রেশ পুরোপুরি কে’টে যেতেই উঠে বসলো। দরজার কাছে গিয়ে বুঝলো বাইরে থেকে লক করা। তাই বারান্দায় পা বাড়ালো। এবার চৈতালির বোধগম্য হলো এটা সাদমানের ঘর। যেখান থেকে একটু দূরে তার বারান্দা স্পষ্ট দেখাচ্ছে। মনে প্রশ্ন উঁকি দিলো সে এখানে কেনো? কে নিয়ে এসেছে? আচ্ছা সে তো সাদমানের ঘরে, তবে কি সাদমান নিয়ে এসেছে? চোখেমুখে উৎফুল্ল ভাব। কিছু সময় গড়িয়ে যেতেই দরজা খোলার শব্দে সম্বিত ফিরে চৈতালির। ঘরে সাদমান প্রবেশ করেছে। চৈতালি তার মুখোমুখি দাঁড়ালো।
সাদমান’ই আগে মুখ খুললো,

-“এখন থেকে আপনি এখানেই থাকবেন। এটাই আপনার ঘর।”

চৈতালি বিষ্মিত কন্ঠে শুধালো,

-“এ ঘরে থাকবো আমি? কিন্তু কেনো?”

বাইরে থেকে হট্টগোলের শব্দে চৈতালির প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলোনা। বেরিয়ে গেলো সাদমান। পিছু পিছু চৈতালি ও বের হলো দেখতে। দরজার আড়াল হয়ে দাঁড়ালো চৈতালি। তাকে এখানে দেখে অনেকেই অনেক প্রশ্ন জুড়ে দেবে। যার উত্তর তার নিজেরই জানা নেই। সাদমানের মা-বোন কে ও বাইরে দেখা গেলো। পুলিশ এসেছে। গ্রামে গঞ্জে বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে পড়লো ‘তিতাসনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হাসিকে খু’ন করে তার মেয়েকে অপহরণ করেছে সাদমান’।

চৈতালি নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছেনা তার মা আর নেই। শক্ত পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দরজার পাশে। প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে গেলো সে। তার কানে আর কোনো শব্দই পৌঁছাচ্ছে না। সাদমান একবার অসহায় নজরে আড়ালে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা চৈতালির দিকে তাকালো।

#চলবে………

( । ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here