শেষ পাতায় সামাপ্তি পর্ব ১৪.

0
304

#শেষ_পাতায়_সমাপ্তি
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৪

পাখি দুদিন বাড়ি ছিলোনা। তাই চৈতালির খবর তার অজানা রয়ে যায়। বাড়ি ফিরতেই ছুটে আসে প্রিয় বান্ধবীকে একপলক দেখতে। হাফি, পরান সেদিন ও দাফন কার্যে ছিলো। আজও এসেছে পাখির সাথে। সাদমানকে নিয়ে চৈতালির সিদ্ধান্ত শুনে তিনজনই ক্ষে’পে গেলো। মায়ের খু’নিকে এত সহজে ছেড়ে দেবে চৈতালি এটা যেনো তারা তিনজনই মেনে নিতে পারছেনা। হাফি মেজাজ দেখিয়ে বলল,

-“তুই যদি ওই খু’নি টাকে ছাড়িয়ে আনিস তবে কসম করে বলছি ওকে আমি নিজ হাতে জ্যান্ত ফুঁ’তে ফেলবো।”

পরান, পাখি দুজনই হাফির দলে যোগ দিলো। চৈতালি তার নিজ সিদ্ধান্তে অনড়। সে কিছুতেই টলতে চায় না। হুট করেই পাখির নজর পড়লো চৈতালি মাথায়। আৎকে ওঠে চুলের এই করুণ দশা দেখে। পাখি হাত দিয়ে চুল ছুঁয়ে দিতেই আরেক দফা চমকে ওঠে। ওর হাতে চুল উঠে এসেছে। পাখির চমকিত মুখ দেখে হাসলো চৈতালি। পাখি কৌতুহল হয়ে প্রশ্ন করলো,

-“তোর চুলের এই অবস্থা কেনো?”

চৈতালি সম্পূর্ণ কথাটা চেপে গেলো। চেপে গেলো কিভাবে দিনের পর দিন সে ঠকে এসেছে। এখন আর বাঁচার ইচ্ছে টা ও নেই। তাই তো কাউকে মুখ ফোটে বলছেনা আমার চিকিৎসা দরকার। কথার মাঝপথে নুরুল হক এসে তাড়া দিলেন থানায় যাওয়ার জন্য। চৈতালি উঠে দাঁড়ালো। তাকে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকতে দেখে পাখি, পরান, হাফি তিনজনই রাগ করে বেরিয়ে গেলো। পরান রা’গে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

-“ঐ শা’লা কে মেরেই ফেলবো আমি। একে তো এতগুলো বছর মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে এসেছে। এখন তার মাকে খু’ন করে একেবারে নিঃশেষ করে দিয়েছে ওকে।”

সাদমানের উপর থেকে খু’নের সমস্ত অভিযোগ তুলে নেয়াতে পুলিশ চৈতালিকে কিছুক্ষণ জেরা করে,

-“আপনি কি স্ব ইচ্ছাতে সমস্ত অভিযোগ তুলে নিলেন? নাকি আপনাকে জোর করা হয়েছে।”

চৈতালি স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলো,

-“আমাকে কোনো রকম জোর করা হয়নি। আমি নিজ থেকেই অভিযোগ তুলে নিলাম।”

পুলিশ আবার ও বলল,

-“দেখুন আপনাকে ভ’য় দেখানো হলে আমাদেরকে বলতে পারেন। আপনার সিকিউরিটির ব্যবস্থা আমরা নেবো। মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে একজন খু’নিকে শাস্তি পাওয়া থেকে আটকাবেন না।”

চৈতালি চোয়াল শক্ত করে শান্ত কন্ঠে জবাব দিলো,

-“আমাকে কেউ জোর করেনি, আর না ভ’য় দেখানো হয়েছে। আপনারা জামিনের ব্যবস্থা করুন।”

পুলিশ জহুরি নজরে পরোখ করছে চৈতালিকে। এতে চরম বিরক্ত হলো চৈতালি। তরতর করে রা’গের তোপ বেড়ে চললো। দাঁতে দাঁত কামড়ে নিজেকে সামলে নিলো। ‘সাদমানকে জামিন দেওয়া হয়েছে আর জামিনের ব্যবস্থা করেছে চৈতালি’ কথাটি কর্ণগোচর হতেই বিস্মিত হয় সাদমান। চৈতালি তার জামিন করিয়েছে? ভালোবাসে বলেই কি মায়ের খু’নিকে এভাবে ছেড়ে দিলো?

বাসায় ফেরার সময় চৈতালি সাদমানের সাথে ফিরলোনা। জামিনের ব্যবস্থা করেই সে বাড়ি ফিরলো। নুরুল হক সব ঝামেলা চুকিয়ে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। চৈতালি বাড়ি ফিরেই দেখলো সমুদ্র হাসপাতাল থেকে বাড়িতে চলে এসেছে। ফাহমিদা ছেলেকে বসিয়ে ভালোমন্দ খাওয়াচ্ছে। সাদমানের জামিনের কথা শুনেই সমুদ্র ভেতরে ভেতরে জ্বলে উঠলো। এত ভালোবাসা? কই তার জন্য তো ভালোবাসার ছিটেফোঁটা ও নেই। এভাবে গুটির চাল ঘুরিয়ে তার সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে দিলো চৈতালি? এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। খুব শীঘ্রই নতুন ছক কষতে হবে। আপাতত চৈতালির সাথে শান্ত থাকতে হবে। কাঁ’টা দিয়ে কাঁ’টা না তুলে কুড়াল দিয়ে কো’প মা’র’তে হবে। খাওয়া শেষ করেই সমুদ্র চৈতালিকে থাকতে দেওয়া ঘরে ঢুকলো। ঝিমিয়ে বসে থাকা চৈতালির পাশে বসলো। মিথ্যের ঘোরে আচ্ছন্ন করার চেষ্টায় খুবই করুণ গলায় বলল,

-“আমি বুঝতে পারছি চৈতি, আপনার মনের অবস্থা খুবই করুণ। যাকে ভালোবেসেছিলেন সেই সবচেয়ে বড় প্রতা’রণা করলো আপনার সাথে? মায়ের খু’নিকে কিভাবে ছেড়ে দিচ্ছেন? আমি চাই আপনি নিজ হাতে কঠিন মৃ’ত্যু দিন তাকে।”

চৈতালি চোখ তুলে তাকালো সমুদ্রের পানে। সমুদ্র চোখে আশ্বাস দিলো। চৈতালি ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।

-“তাকে ম’র’তে হবে। আমার হাতেই তার মৃ’ত্যু হবে। আমি ছেড়ে দেবোনা আমার মায়ের খু’নিকে।”

চৈতালির অগোচরে কুটিল হাসলো সমুদ্র।

-“ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। আমি আসছি। বুকে ব্যথাটা প্রচন্ড বেড়েছে।”

বুকে হাত ঘষতে ঘষতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো সমুদ্র। আলতাফ খানের কলে সম্বিত ফেরে সমুদ্রের।

-“হ্যালো!”

-“আজ একবার তোমার আসা প্রয়োজন। এনামুল হকের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।”

সময় মতো চলে আসবো বলে সমুদ্র লাইন কে’টে দিলো।

সাদমান আর সেই রাতে বাড়ি ফিরলোনা। সে লোক লাগিয়ে রেখেছে সমুদ্রের পেছনে। সমুদ্র কি করছে না করছে, কখন কোথায় যাচ্ছে সব খবর রাখছে সাদমান। চৈতালি অভিযোগ তুলে নিলেও এখনো তার মায়ের খু’নি সাদমানকেই ভেবে যাচ্ছে। এটা নিশ্চিত সাদমান। তাই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার মতো তথ্য জোগাড় করা ব্যতীত চৈতালির সামনে যাবেনা।

—————————————

প্রকৃতির কোল ঘেষে গা ছমছমে অন্ধকার, নিরবতা। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। স্বল্প হলদেটে আলোর মোমবাতি মৃদু আলো ছড়িয়েছে ছোট্ট ঘরটিতে। সময় বলছে এখন মধ্যরাত। জ্যোৎস্না হীন রাতের মতো নিজের জীবনটা ও আলোহীন, অন্ধকারাচ্ছন ঠেকছে চৈতালির কাছে। দু’চোখে ঘুম নেই। মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে। তাইতো বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে বারান্দায়।
শব্দহীন পায়ে চৈতালির ঘরে প্রবেশ করলো সাদমান। সে খুব ভালো করেই জানে চৈতালি ঘুমিয়ে নেই। হয়তো মায়ের কথা মনে করে বিষন্ন মনটাকে আরেকটু বিষিয়ে তুলছে। আরেকটু খানি ক্রোধ জন্ম নিয়েছে তার প্রতি। সময় এসে গেছে সত্যি জানার। দোষ না করেও কতদিন এই বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরবে?

সাদমনা শব্দহীন পায়ে প্রবেশ করলে ও চৈতালি তার পেছনে কাউকে টের পেলো। ঘাবড়ালো না সে। এখন আর ভ’য় হয় না তার। পেছন ঘুরেই সাদমানকে আবিষ্কার করলো। মুহূর্তেই ধপধপ করে মাথার নিউরন গুলো লাফিয়ে ওঠে। চিড়বিড় করা রা’গ এসে হানা দেয় মস্তিস্কে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গলা চেপে ধরলো সাদমানের। কাশতে কাশতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো সাদমান। চৈতালির চোখে আগুনের ফুলকি। ক্রোধে গর্জন করে উঠলো,

-“এই সময়টার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি। আমার নিজ হাতে, এই দু’হাতে প্রাণ নেবো আপনার। আপনি আমার মায়ের খু’নি।”

সাদমান অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো।

চৈতালি তাচ্ছিল্য হেসে ঘৃ’ণিত কন্ঠে বলল,

“কাকে দেখাচ্ছেন অসহায় চোখজোড়া? এই চোখজোড়া তুলে ফেলতে পারলেন না? কেনো ভালোবাসলাম আপনাকে? নিজের সবটুকু বিশ্বাস, ভরসা, প্রেম, ভালোবাসা কেনো অপাত্রে দান করলাম? কেনো আমার জন্ম হলো? ঠকে যাওয়ার জন্য? আল্লাহর কাছে আমার চাওয়া গুলোর সাথে আরো একটি চাওয়া যোগ হলো। পৃথিবীতে এমন চৈতালিদের জন্ম না হোক। যারা ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার রাখেনা। ভালোবাসাই যদি নাই বা পেলাম তবে আমাদের জন্মের স্বার্থকতা কোথায়? আমাকে ভালোবাসতে পারলেন না, তাহলে আমাকে ভালোবাসার মানুষটাকে কেনো মা’র’লেন?
ভালোবেসেছি তো আপনাকে আমি। জানেনতো আপনার প্রতি আমার বড্ড অভিমান জমেছিলো। কিন্তু বিশ্বাস করুন সেই অভিমানটা এখন আর নেই, ছিটে ফোঁটাও নেই। এখন আমার মনে যা আছে তা হলো আকাশ সম ঘৃ’ণা, আর ক্রোধ।”

বাক্স থেকে রাম’দা বের করে একবার ধারালো চোখে চেয়ে নিলো। সাদমান কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই সাদমানের গলায় রাম’দা চেপে ধরলো চৈতালি। হিড়হিড় কন্ঠে বলল,

-“চুপ! একটা কথাও না। নয়তো দেহ থেকে মাথা আলাদা হতে সময় লাগবেনা।”

চৈতালিকে সুস্থ স্বাভাবিক লাগছেনা। সাদমান সাবধানে মাথাটা পিছিয়ে নিয়ে চৈতালির হাত থেকে রাম’দা কে’ড়ে নিলো।
চৈতালি জলন্ত নেত্রে ভস্ম করে দিচ্ছে সাদমানকে।

-“আপনি ভুল ধারণা নিয়ে আছেন। আমি আপনার মাকে মা’রিনি। কে মে’রেছে সেটার প্রমাণ ও পেয়ে যাবেন। চলুন আমার সাথে।”

চৈতালির হাত টেনে সাবধানে দরজার দিকে পা বাড়ালো সাদমান। চৈতালি চেঁচিয়ে উঠতেই সাদমান তার মুখ চেপে ধরে।

-“হিসসস! আওয়াজ করবেন না। আসুন আমার সাথে।”

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here