শেষ পাতায় সামাপ্তি পর্ব ১১

0
312

#শেষ_পাতায়_সমাপ্তি
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১১

সূর্যের দাপটে উত্তপ্ত পৃথিবী। সকালের মিষ্টি রোদ্দুর বেলা গড়াতেই নিয়ে এলো সহস্র ক্রো’ধ, হিং’স্রতা। এই উত্তাপ গটগট আওয়াজে চলা ফ্যানের বাতাসকে ও পরোয়া করছেনা। খোলা জানালার ফাঁক গলে মৃদু আলো হামাগুড়ি খাচ্ছে রঙিন কার্পেটে। বৈশাখ মাসের মতিগতি বোঝা বড় দায়। এই বৃষ্টি তো এই রোদ্দুর। শরীরটা মেজমেজ করছে। ঘুম ভাঙতেই শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠলো চৈতালি। মা কি করছে দেখতে হবে। রাতে আর দেখা হয়নি। পরিষ্কার হয়ে ঘর ছেড়ে বের হলো।

হাসি আজ আর স্কুলে গেলেন না। শরীর মন দুটোই অসুস্থ। নাস্তার টেবিলে কেমন থম মেরে বসে আছেন। গত দিনের ঘটনা কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছেননা। তার সহজ সরল, শান্ত মেয়েটার এমন রূপ কিছুতেই মস্তিস্ক নিতে চাইছেনা। তিনি এই চৈতালির মাঝে নিজের ছোট্ট প্রাণটা খুঁজে পাচ্ছেন না। ক্রমশ মস্তিস্ক অসাড় হয়ে আসছে।

ঘর ছেড়ে মাকে উদাসীন হয়ে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসলো চৈতালি।

“মা।”

চৈতালির ডাকে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে।
‘হু’ বলে সামনে তাকাতেই চৈতালির মুখশ্রী ফোটে উঠলো।

হাসি মুখ ফিরিয়ে নিলেন। স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হতেই চৈতালি মায়ের হাত চেপে ধরলো।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো চৈতালি। বিমর্ষ কন্ঠে শুধালো,

-“তুমি ছাড়া আমার কে আছে মা? আমার জীবনটাই গেলো পুতুল নাচে। যে যেভাবে পেরেছে সেভাবে ব্যবহার করেছে। এ জীবনে কারো ভালোবাসাই পেলাম না তুমি ছাড়া। বাবা, দাদা, কেউ আপন ছিলো না আমার। সবাই স্বার্থ খুঁজেছে। এখন তুমিও আমায় পর করছো? তবে কার কাছে যাবো আমি? মা, বাঁচার জন্য ওই পশুগুলোকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন ছিলো। আমি জানি আমি অন্যায় করেছি, খুব বড় পা’প করেছি। তবে নিজের ইজ্জত, জীবন বাঁচানো টা ও ফরজ কাজ। তোমার যদি মনে হয় সত্যিই আমি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই তাহলে দূরে ঠেলে দিও না আমায়। বরং গলা টি’পে মেরে ফেলো। তখন আর তোমার মনে কোনো অপরাধবোধ থাকবেনা, কোনো সংশয় থাকবেনা। মা জীবন এত কঠিন কেনো? কেনো আমরা ভালোবাসা পেলাম না কারো? অন্যরা বাবার ভালোবাসা পায়, আমি পেলাম না। অন্যরা স্বামীর ভালোবাসা পায়, অথচ তুমি পেলেনা। কেনো বলতে পারো? এত অভাগী হয়ে কেনো জন্ম হলো আমাদের? বাবা কেনো তোমায় ঠকি’য়েছে? দাদা কেনো আমাকে নিয়ে খেলেছে? আমি যে ভিখারী, ভালোবাসার ভিখারী। আমি ভালোবাসা চাই মা। আমি যে খুব ভালোবাসার কাঙাল। ভালোবাসা পেয়ে বাঁচতে চাই আমি। যদি পৃথিবীতে ভালোবাসা, মায়া এদের অস্তিত্ব না থাকতো? তাহলে আরো আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতাম আমি। এই পৃথিবীটাই তো ভালোবাসায় সৃষ্টি।একটু ভালোবাসা দেবে গো মা? একটু ভালোবাসা। শেষ আবদার টা রাখবে আমার? একজন খু’নির শেষ ইচ্ছে? তারপর নিজ হাতেই নাহয় সমাপ্তি টেনে দিও আমার।”

কথাগুলো বলতে বলতে মায়ের পা জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো চৈতালি। হাসি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেননা। কঠিন হৃদয়টা মুহূর্তেই গলে গেলো। উড়ে গেলো সমস্ত রা’গ, ক্ষোভ, অভিমান। বাঁধ ভাঙা নোনাপানির ধারা বন্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করলেননা। মেয়েকে উঠিয়ে বুকে টেনে নিলেন। পিনপতন নিরবতায় মা মেয়ের কান্নার শব্দ দেয়ালে ঝংকার তুলছে। দু’হাতে আঁজলা করে মেয়ের মুখ তুলে চুমুতে ভরিয়ে তুললেন হাসি। চোখের পাতায় ঠোঁট জোড়া চেপে শুষে নিলেন মেয়ের সমস্ত দুঃখ, অভিযোগ। এ নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কেউ কারো নয়। মেয়েটার যে তিনি ছাড়া আর কেউ রইলোনা।

আকাশে সরু চাঁদ। আকাশে,বাতাসে নিস্তব্ধতা, শিথিলতা। পুলের নিচে নোংরা কালো পানির ধারা বহমান। এই কালো পানির মতো তার জীবনটা ও কালো,ময়লাযুক্ত। সিগারেটে সুখটান দিয়ে ও কেমন তেঁতো স্বাদ মিলছে। আগের মতো স্বাদ পাচ্ছেনা। পুরনো ক্ষ’ত গুলো তরতাজা হয়ে উঠছে। নতুন উদ্যমে কিছু একটা হারানোর তীব্র যন্ত্রণা পিষ্ট করছে। নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভ’য় গ্রাস করছে চারদিক থেকে। অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে সাদমান। মনের ভাষাটা আজ নিজেই পড়তে পারছেনা। আপন মানুষগুলোর এমন বীভৎস রূপ টানছে না তাকে। গত দুদিন কতটা যন্ত্রনায় কেটেছে প্রহর। পৃথিবী থেকে ‘বিশ্বাস’ নামক শব্দটার বিলুপ্তি ঘটছে ক্ষণে ক্ষণে। নিচ থেকে নোংরা কালো পানি গুলো যেনো বলছে,

-“তুমি একা,বড্ড একা। কেউ নেই তোমার। এই দুনিয়া স্বার্থলোভী দের, পাপি’ষ্ঠদের, নিষ্ঠু’রতম লোকেদের। মানুষ আজন্ম মুখোশধারী। কেউ ভালো হওয়ার মুখোশ পড়ে থাকে, কেউ বা খারাপ হওয়ার। মানুষ তোমাকে ব্যবহার করবে, আবার অবহেলায় পায়ের তলায় পি’ষে ফেলবে। আমাকে দেখো। নর্দমা বলে, নোংরা বলে কেউ আমার সাথ দেয় না। অথচ আমাকে নোং’রা কিন্তু এই মানুষগুলোই বানিয়েছে। এখনো ব্যবহার করছে, আজন্ম করে যাবে। আমি নিজ থেকে নোং’রা হইনি।”

রোমাঞ্চকর শিহরণ বয়ে গেলো শিরদাঁড়া বেয়ে। সাদমান বালুচরে আটকে পড়া পথিকের মতো তলিয়ে যাচ্ছে অতল গহবরে। কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় আকুপাকু করছে মন। অজানা ব্যথায় হাহাকার করে উঠছে। পুলের উপর বোজা চোখে বসে রইলো সাদমান।

আগমন ঘটলো কোনো এক অজানা আগন্তুকের। কারো উপস্থিতি টের পেতেই চোখজোড়া সামনে নিবদ্ধ করলো। আগন্তুকের আগমনের কারণ উদ্ধার করতে পেরে আনন্দ পেলো সাদমান, বড়ই আনন্দ পেলো। এক অলৌকিক জোর এসে ভর করলো মনে।
এখানেই কারো সমাপ্তি ঘটিয়ে পা বাড়ালো নতুন গন্তব্যে। আজই জানা হয়ে গেলো কিছু অজানা সত্যি। ‘তিতাসনগর’ এর কালো রাতের সত্যি।

হাসপাতালের কাজ শেষে রাত করেই বাড়ি ফিরলো সমুদ্র। সময় নিয়ে নিজেকে তৈরি করে নিলো। সবার অগোচরে পা বাড়ালো সামনে। চৈতালির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো সমুদ্র। মেয়েটাকে দেখার লোভ সামলাতে পারে না সে। প্রতিদিন একপলক না দেখলে ভালো ঘুম হয়না তার। ফোনের স্ক্রিনে দেখে নিলো সময়। সময়ের কাঁ’টা এগারোর কোটায়। বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে দরজায় কংকর নিক্ষেপ করলো। নিশ্চয়ই শব্দ পেয়ে চৈতালির ঘুম ভাঙবে, উঠে আসবে বারান্দায়। পেছন ঘুরে অপেক্ষায় পায়চারি করছে সমুদ্র। মিনিট দুয়েক যেতেই পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেলো। ভারী অবাক হলো সমুদ্র। চৈতালি বাইরে বেরিয়ে এসেছে? পেছন ঘুরতেই তার সমস্ত ভাবনা বদলে গেলো।
কুঁচকে যাওয়া কপালে চেয়ে রইলো খানিকটা সময়। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করলো,

-“তুই এখানে কি করছিস?”

ঠোঁট এলিয়ে হাসলো সাদমান। এই হাসি জ্বালা ধরিয়ে দিলো সমুদ্রের শরীরে। পকেট থেকে ছোট্ট ধারালো ছু’রি বের করে হাত বুলিয়ে নিলো সাদমান। সমুদ্রের ভাবভঙ্গি প্রকাশ পাওয়ার আগেই বুকে আ’ঘা’ত করলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সমুদ্র। এই আ’ঘা’তে মৃ’ত্যু হবেনা নিশ্চিত সাদমান। বুকে হাত চেপে মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে উঠলো সমুদ্র। তখনই দরজা খুলে আগমন ঘটলো হাসির। আজ চৈতালির পাশে ওর ঘরেই ঘুমিয়েছেন। চৈতালির খাবারে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছেন। মেয়েটার জন্য ঘুম প্রয়োজন। ছোট্ট মাথায় এতটা চাপ নিতে গেলে মেয়েটা ম’রে যাবে। এমনিতেও ডাক্তার দেখাতে হবে ওকে। হুমায়ুন কবিরের এপ্লাই করা ঔষধ বন্ধ। এই ঔষধ যেমন মস্তিস্কের ক্ষ’তি করে তেমনি বন্ধ করে দিলে খুব শীঘ্রই মৃ’ত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় মানুষ। তাই এখন থেকেই চিকিৎসা প্রয়োজন চৈতালির। বারান্দার দরজায় ঢিল পড়ার শব্দে ঘুম হালকা হয়ে যায় হাসির। বেরিয়ে আসতেই উপস্থিত ঘটনা দেখে আৎকে ওঠেন। দৌঁড়ে গিয়ে সমুদ্রের পাশে বসেন। সাদমান হাসিকে তোয়াক্কা না করে ঘরে ঢুকে পড়ে। চৈতালির ঘরে ঢুকে সোজা কোলে তুলে নেয়। চৈতালিকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই হাসি উঠে এসে বাঁধা দিলো। ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন,

-“আমার মেয়েকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো তুমি? কোথাও নেবেনা। নিজের ভাই কে কিভাবে আ’ঘা’ত করলে তুমি?”

সাদমান লম্বা শ্বাস ফেলে একহাতে কাঁধে তুলে নেয় চৈতালিকে। অপর হাতে হাসিকে দূরে ঠেলে বেরিয়ে আসে। তার ঠোঁটের কোনে বক্র হাসি। গালের গভীর কা’টা দাগের ক্ষ’ত অনেকটাই শুকিয়ে এসেছে। হাসিতে এলিয়ে গেলো কা’টা দাগ। চৈতালি যদি জেগে থাকতো তবে আবারও মুগ্ধ হতো এক ছন্নছাড়া বেয়া’দব প্রেমিকের হাসিতে।

হাসি আবারও দৌড়ে সমুদ্রের পাশে গিয়ে বসলো।
-“বাবা তুমি ঠিক আছো? আমার মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছে ওই সন্ত্রা’সী। কি করবো আমি?”

চৈতালিকে নিয়ে সোজা বাড়িতে ঢুকলো সাদমান। নিজের ঘরে শুইয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিলো। পা বাড়ালো জমিদার বাড়ির আঙ্গিনায়। দারোয়ান সাদমানকে ঢুকতে দিতে চাইলোনা। সাদমান ফিসফিসিয়ে বলল,

-“খদ্দের আমি। ভেতরে যেতে দাও।”

দারোয়ান সরে দাঁড়ালো। আবারও ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো সাদমান। জমিদার বাড়ির মূল ফটকে পা রেখে দরজায় করাঘাত করলো। ক্যাচক্যাচ শব্দে দরজা খুলে উঁকি দিলো এক রমণী।

সাদমান আবার ও হাসলো। মেয়েটি সরে জায়গা করে দিলো। ভেতরে কত কত পরিচিত মুখ, কত কত খদ্দের। অশালীন পোশাকে জড়াজড়ি করছে মেয়েরা। এক পরিচিত কন্ঠস্বরে শব্দ হলো। মেয়েদেরকে বলছে,

-“সাজাও রমণী। আপ্যায়নে কমতি যেনো না থাকে।”
সেই ব্যক্তিটি সাদমানের দিকে তাকিয়ে সকৌতুকে হাসলো।

মেয়েরা উঁকি দিয়ে সাদমানকে গিলছে আর একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। কেউ কেউ লজ্জায় লাল হচ্ছে।

জমিদার বাড়িতে ভূতের ভ’য়ের নাম করে চলছে দেহ ব্য’বসা। সূর্যের আড়ালে কালোরাত হারিয়ে যায়। দিনের আলোয় জমিদার বাড়ি দর্শনীয় স্থান আর রাতের আধারে কা’ম’না পূর্ণের স্থান হয়ে ওঠে। তালাবদ্ধ ঘরের আড়ালে চলমান ঘটনা দৃষ্টিগোচর হয়না পর্যটকদের।

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here