আলেমের বউ পর্ব ১১+১২

0
442

#আলেমের_বউ (পর্ব-১১+১২)


অবশেষে জায়গা হলো টঙ্গি রেল ইস্টেশন!
নিয়তি কে না মেনে নেয়?আজ আরিফুর রহমান ও মেনে নিলেন!তিনি একা নয় কত মানুষ আছে যাদের থাকার মত কোন বাড়ি-ঘর নেই!এই ইস্টেশনটাই শুধু তাদের ঠিকানা!
গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়েন এক পাশে!পাশের লোকটি ডেকে বলেন,কইতে আইলেন দাদা?
-নাজিফার বাবা খুব ক্লান্ত সুরে বললেন,”জ্বী চাঁদপুর থেকে!
-বাড়ি ছাইরা ক্যারে আইলেন এনে?
-কাজের খোঁজে!
-ওহ!

কেউ আর কোনো কথা বলল না!চুপ হয়ে রইলো!



নাজিফার বাবা এপাশ ওপাশ করছেন শুধু
কিন্তু চোখের পাতায় ঘুম নেই!
নাজিফার সাথে কথা হয়নি আজ সারাদিন!কেমন আছে মেয়েটা!ভাবীরা খেতে দিয়েছে কি মেয়েটাকে নাকি মিথ্যা বলছে?নাজিফা তো আমাকে ছাড়া খায়না!হাজারো প্রশ্ন উঁকি দেয় মনের মাঝে!ফোনটা বের করে দেখেন
রাত এগারোটা বাজে,
একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে অনেক গুলো কল।হয়তো মিসিডকল ছিল।তাই বুঝতে পারেন নি!কল রিপ্লাই করবেন, দেখেন সেই টাকা ও যে ফোনে নেই!নাজিফা হয়তো কারো ফোন থেকে কল গুলো দিয়েছে!
উঠে গেলেন আরিফুর রহমান
ইস্টেশনের পাশের দোকান থেকে দশ টাকা ঢুকালেন ফোনে।পাঁচ টাকা পকেটে রেখে,বার বার কল আসা নাম্বারটায়!রিপ্লাই কল দেন তিনি!
সাথে সাথেই ফোন তুলে নাজিফা!
-আসসালামু আলাইকুম
বাবা কেমন আছো?সারাদিন কোথায় ছিলে?কত ফোন দিলাম!ধরলা না কেন?

একদমে নাজিফা এত গুলো প্রশ্ন করে বসলো!

আরিফুর রহমান হেসে দিয়ে বললেন!

ওয়ালাইকুমুস সালাম।আমার জন্য চিন্তা করছিলি বুঝি?
বাবা ভালো আছি!খেয়েছিস?


নাজিফা খায়নি বাবার টেনশনে এ…মিথ্যা ও বলে না,এখন খাবো!তুমি খেয়েছো?
-আরিফুর রহমান চোখের পানি আটকে মুখ চেপে নাজিফাকে উওর দিলেন,হ্যাঁ রে মামুনি খেয়েছি!তুই খেয়ে ঘুৃমিয়ে যা!
-হ্যাঁ খাবো!সারাদিন একবার ও আমাকে মনে পড়ে নি বুঝি?
-কেন মনে পড়বে না মামুনি?তুই যে আমার মনের ভিতরেই আছিস!
-তাহলে ঢাকা পৌঁছালে একটা কলে কেন দিলে না?কতটা টেনশন হয়েছিলো জানো তুমি?
-কল দেইনি মানে,তুর বড়মার ফোনে কল দিছি!তুকে বলে নি?
-না তো!বললে কী এত টেনশন করতাম?
-যাক বাদ দেয়!অনেক রাত হলো,ঘুমা!
-আচ্ছা!

নাজিফার আচ্ছা শব্দ টা আরিফুর রহমান শুনলেন,ফোনের লাইন তখনি কেটে গেলো!নাজিফা কাটেনি!টাকা শেষ হয়ে গেছে তাই কেটে গেলো!


ফজরের আজানের সুর শুনা যায় ইস্টেশনের মসজিদ থেকে!উঠে গিয়ে নামাজ পড়ে নিলেন আরিফুর রহমান!


রাতে ভাত না খাওয়াতে খুব ক্ষুদা পায় আরিফুর রহমানের!কিন্তু পকেটে মাত্র পাঁচ টাকা!না চাইতে নিরব অশ্রু চলে আসে চোখে!দুইটা নারকেল এর বিস্কুট চার টাকায় কিনে নেন!এক টাকা পকেটে রাখেন!
দুইটা বিস্কুট খেয়ে আর সাথে পানি প্রান করে দিনটা শুরু করলেন!নাজিফাকে ফোন করে খোঁজ নেবেন সেই টাকা ও ফোনে নেই!
কাজ খুঁজার উদ্দেশ্য ছুটে চলেন নাজিফার বাবা!


অনেক খুঁজলেন কিন্তু কোনো কাজ খুঁজে পেলেন না!ক্ষুদায় আবার ও ফিরে আসেন টঙ্গি ইস্টেশন!



না খেয়ে থাকা প্রচন্ড ক্ষুদার সময় তা যে কতটা কষ্টের আর যন্রণা দায়ক তা শুধু সে মানুষটাই বুঝতে পারে যে এমন করে দিন/রাত কাটিয়েছে!
যে মানুষ আপনাকে বলবে,আপনার কষ্ট বুঝে!সে ভয়াবহ মিথ্যে বলছে।কেউ আপনাকে ১ ফোঁটাও ততক্ষণ পর্যন্ত বুঝবেনা,যতক্ষন পর্যন্ত সে নিজে আপনার মত একই পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে।লেপের নিচে শুয়ে কেউ যদি বলে,সে শীতের রাতের ঠান্ডা পানিতে গোসল করার অনুভূতি বুঝে।সে আসলেই মিথ্যেবাদী।
তাকে সত্যিকার ভাবে আপনাকে বুঝতে হলে হাতে ধরে টেনে নিয়ে ঠান্ডা পানির পুকুরের মাঝে চুবানো দরকার।


চলবে,
লিখা:শারমিন সুলতানা সালমা।

#আলেমের_বউ (পর্ব-১২)


রেল ইস্টেশনের সামনেই নজর পড়লো এক অপরিচিত ব্যক্তির!
-আরে তুই আরিফুর রহমান না?(অপরিচিত ব্যক্তি)
-জ্বী!আপনাকে তো চিনলাম না!
-আরে আমি মাহমুদ তালুকদার।তোর বড় খালার ছেলে আমি!
-ওহ আচ্ছা চিনতে পারছি!এখানে কেন তুমি?
-এক্টু কাজ ছিলো!আমি তো সৌদি আরবে ছিলাম অনেক বছর!ছেলে-মেয়ে বউ কে নিয়েই ছিলাম।বাংলাদেশে আসলাম এক বছর হবে,এখন টঙ্গিতেই আছি!তোর কী খবর বল?
-আর কী খবর বলবো ভাই!
-কেন কী হয়েছে?
-ছোটকালে বাবা-মাকে হারিয়ে ভাই আর ভাবীদের কাছে বড় হলাম!
-তা তো জানি মায়ের মুখে শুনলাম!তারপর কী হলো?
-বিয়ে করলাম!একটা মেয়ে হয়েছিলো!
-মাশাআল্লাহ্!মেয়ে তো রহমত!নাম কী রাখলি?
-নাজিফা!
-বাহ্ সুন্দর নাম!
-হ্যাঁ ভাই বারি মিষ্টি মেয়ে আমার কিন্তু বড়ই হতভাগা!
-কেন হতভাগা?
-নাজিফার পরে নাজিফার একটা ভাই ও হয়েছিলো!তখন নাজিফার মা মারা যায়!
-আহ্,বলিস কী?ছেলে কই এখন, নাম কী?
-নাম নুসাইর!খুব মিষ্টি হয়েছিলো!সাড়ে আট মাসের মাথায় হয়েছিলো বলে পরিপূর্ণ হয় নি!তাই এক মাসের মত পর্যবেক্ষণ যন্রে রাখে!তারপর নাজিফা তাকে বড় করে তুলে!
-মাশাআল্লাহ্!এখন কোথায় তারা!
-নাজিফা আছে বাড়িতেই আর নুসাইর,,,,
-কোথায় নুসাইর?
-তার মায়ের পাশে শুয়ে আছে!
-আরে আরিফ কী বলিস,ছোট ছেলে সেখানে কেন?
-হ্যাঁ ভাই!নুসাইর ও চলে গেছে ছেড়ে!
-বলিস কী?ক্যামন করে এমন হলো?
-রাস্তা পার হতে গিয়ে,মাঝ রাস্তায় নুসাইর জুতা ফেলে আসে,ফিরে আবার জুতার জন্য যায় তখনি একটা বাস এসে নুসাইকে চাপা দেয়!চলে গেলো নুসাইর আমাদের ছেড়ে!



মাহমুদ তালুকদার কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেন!
তবুও খালাতো ভাইকে শান্তনা দেন!আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্য করেন!
-মাহমুদ ভাই খালাআম্মা আছে এখন?
-হ্যাঁ আছে!
-তো ছেলে মেয়ে কয়জন?
-আমার তো চারজন তারা!ছেলে দুই জন মেয়ে দুই জন!বড় ছেলে শাহপরান হাসান!সৌদি আরবে আছে!হাফেজ শেষ করেছে!এখন হাদিস এর উপর পড়ছে!আসবে কিছু দিনের মাঝে!
-আর বাকী তারা?
-হ্যাঁ তারপর মেয়ে রাবেয়া ইসলাম!মাদ্রাসার পাশাপাশি ভার্সিটিতে অনার্স করছে!তারপর ছোট মেয়ে মাহমুদা!সে ক্লাস ওয়ানে পড়ে টঙ্গি ক্যাডেট মাদ্রাসায়!তারপর সবার ছোট ছেলে তারেক রহমান!পাঁচ বছর বয়স হবে আর কী!
-মাশাআল্লাহ্!
-হ্যাঁ এখন বাসায় চল!



আরিফুর রহমান ও রাজি হয়ে যায়।খালাতো ভাইয়ের সাথে তাদের বাসায় চলে আসেন!টঙ্গি সরকারি কলেজের পাশে বাসা!


তিনতলায় বাসা!আরিফুর রহমান আজ কয়েক দিন না খেয়ে শরীরের মাঝে শক্তি পাচ্ছেন না সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার!তবুও যে উঠতে হবে!অনেক কষ্টে উপরে আসলেন!
কলিং বেল বাজাতেই একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা দরজা খুলে দিলো!দরজা খুলেই বাচ্চাটি বললে উঠে,”আসসালামু আলাইকুম!
-আরিফুর রহমান উওর দিলেন,”ওয়ালাইকুমুস সালাম!
মাহমুদ তালুকদার বাচ্চাটিকে দেখিয়ে বললেন,”আমার ছোট ছেলে! নাম তারেক রহমান।
একটা রুমে ঢুকে আরিফুর রহমানকে ডাকলেন,”আয়,রুমে আয়!এই যে এই দিকে ওয়াশ রুম!যা হাত মুখ ধুয়ে নেয়!আমি তোর ভাবীকে বলে খাবার রেডি করছি!


কুলসুমা!কুলসুমা?(মাহমুদ তালুকদার এর বউ)
-হ্যাঁ বলো!
-আমার আম্মার বোনের ছেলে!নাম আরিফুর রহমান!গ্রাম থেকে এসেছে!তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো!
-হ্যাঁ করছি,তুমি তাকে নিয়ে বসো!
-আচ্ছা!


রাবেয়া মা কই তুই?(কুলসুমা)
-বলো আম্মু?(রাবেয়া)
-তোর একটা আঙ্কেল আসছে গ্রাম থেকে!তাকে খেতে দিতে হবে!আম্মুকে কাজে সাহায্য করবি আয় তাড়াতাড়ি!
-আচ্ছা আম্মু!


খাওয়া শুরু করার আগে নাজিফার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে!কিন্তু ফোনে টাকা নেই!মাহমুদ ভাইকে বলে তার ফোন থেকে নাজিফার সাথে কথা বলে তারপর আরিফুর রহমান খাওয়া শুরু করেন!



খাওয়া শেষ করে আরিফুর রহমান বিশ্রাম নেন!আরিফুর রহমান তারপর একটা কাজের কথা বলল মাহমুদ তালুকদারকে!
-আরে আরিফ টেনশন করিস না!ভাইয়ে আছি তো!
মাহমুদ তালুকদার তার জুতার দোকানে তাকে কাজে নিযুক্ত করে দেন!
আরিফুর রহমান আলাদা বাসা নিতে চাইলে মাহমুদ তালুকদার না করে দেয় আর নাজিফাকে নিয়ে আসার কথা বলে!

বারো দিনরে মাঝে নাজিফাকে নিয়ে আসেন ঢাকাতে আর তিন দিন বাকি নাজিফার এডমিশনের রেজাল্ট দিতে!


নতুন পরিবারের মাঝে এসে নাজিফা তেমন চুপ থাকতে পারলো না!কারণ নুসাইরের সমান হবে তারেক রহমান।
-মাহমুদ মামার বউ কুলসুমা বলল,”নাজিফা বেশি আদর করো না!মাথার চুলে ছেড়ে নেবে!
-নাজিফা মুচকি হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলো সে রাজি!



সন্ধ্যায় নাজিফার কাছে পড়তে বসে মাহমুদা আর তারেক রহমান!
-নাজিফা আপু আজ থেকে তুমি আমাকে পড়াবে!রাবেয়া আপু অনেক মারে তার কাছে পড়বোনা!(মাহমুদা)
-আমি ও তোমার কাছে পড়বো,!
এই মাহমুদা আপু আমাকে মারে!(তারেক)
ঠাস করে একটা তাপ্পর লাগিয়ে দিয়ে মাহমুদা তারেকের গালে
ঐ আমি তোকে মারি?

-নাজিফা হাসে মাত্র মারলো তার পর আবার প্রশ্ন করে?!
দুইজনকে চুপ করিয়ে পড়ার কথা শুরু করলো!
-নাজিফা আপু আমাকে গরু সম্পর্কে পাঁচটি পয়েন্ট বলে দাও!(মাহমুদা)
-আমি ও গরু সম্পর্কে শিখবো!(তারেক)
-নাজিফা হেসে দিয়ে বলল,”আচ্ছা ঠিক আছে!
প্রথম পয়েন্ট গরু আমাদের গৃহপালিত পশু!বুঝেছো দুইজনে?
-দুইজনের সুরের সাথে উওর বুঝেছি!

পয়েন্ট দুই গরু থেকে আমরা দুধ পাই!দুধে তো ছয়টি ভিটামিন রয়েছে জানতো তাইনা?
-না আপু!(মাহমুদা)
-না মানে?
-মানে আপু ছয়টা ভিটামিন না একটা ভিটামিন!
-নাজিফা হেসে দিয়ে বলল,”কেন ছয়টা নয় একটা?
-আরে আপু বুঝোনা!দুধ তো পানির মত তাই একটা!!
দূরের থেকে রাবেয়া আপু সব শুনছিলো আর বলে উঠে,দেখছো নাজিফা তারা কেমন পন্ডিত?জালিয়ে তোমাকে তেজপাতা করবে বলেই আপু চলে গেলো!


-মাহমুদা ভুল বলছো তুমি!ছয়টা ভিটামিন থাকে তুমি আরো এক্টু বড় হলে বুঝতে পারবে!
পয়েন্ট তিনে আসো গরুর চামড়া থেকে জুতা এবং ব্যাগ তৈরি হয়!বুঝেছো?
-আমি তাহলে গরুর চামড়া পায়ে দেই,ওয়াক থু!চামড়া যা গন্ধ!(তারেক)
-একমদ সরাসরি চামড়া না তারেক!চামড়া পরিষ্কার করা হয় মেডিসিন দিয়ে!তখন আর তেমন গন্ধ থাকেনা!বড় হলে বুঝতে পারবে!
পয়েন্ট চারে আসো গরুর গোবর থেকে সার উৎপন্ন কর হয়!
পয়েন্ট পাঁচ গরুর গোবর থেকে গ্যাস ও উৎপন্ন করা যায়!

বুঝেছো?
-হ্যাঁ আপু!(দুইজনের উওর)

-এক কথায় বলা যায় গরু আমাদের উপকারি পশু তাই না?

-হ্যাঁ আপু ঠিক বলেছো!
-আচ্ছা তাহলে এখন আমাকে পয়েন্ট গুলোর থেকে একটি প্রশ্নের উওর দাও!
-আচ্ছা আপু বলো!


-বলতো গরু আমাদের কী দেয়?
-মাহমুদা আর তারেক সুর তুলে উওর দিলো গরু আমাদের গুতা দেয়!!!!!!!!?
উওর শুনে নাজিফা জ্ঞান হারানোর মত হলো?!
তাদের নাজিফা এমন কোনো পয়েন্ট পড়ায় নি বা একবার ও বলেনি!তাহলে এমন উওর কেমন করে দিলো!

এডমিশন রেজাল্ট দিলে নাজিফা ঠিক করে নেয় যে
ভিকারুন্নিসায় পড়বে!
কিন্তু দূরে বলে তা বাদ দিয়ে দেয়।
রাবেয়া আপু টঙ্গি সরকারি কলেজের কথা বললে!নাজিফা না বলে দেয়!
নাজিফা ভর্তি হয় উত্তরা মডেল কলেজ।ক্লাস শুরু হবে পহেলা জুলাই!


চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here