আলেমের বউ পর্ব ২৩

0
661

#আলেমের_বউ (পর্ব- ২৩)
— শেষপর্ব


জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে একটা রুমে আবিষ্কার করলাম।একটা অপরিচিত মহিলা মাথায় মিষ্টি নরম হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।হ্যাঁ মনে পড়েছে জ্ঞান হারানোর আগে আলহামদুলিল্লাহ বলেছিলাম।মনে হয় এখন আমি শশুড় বাড়িতে!কিন্তু আমি কতটা সময় জ্ঞান হীন ছিলাম যে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে নিয়ে এসেছে তা ও বলতে পারবো না কিছুই।
-কেমন লাগছে মা?
-জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো!
-আমি তোমার শাশুড়ি মা।
উঠে উনাকে কদমবুসি করতে যাবো কিন্তু তিনি দিলেন না!
-তুমি এখন অসুস্থ একদম উঠবেনা!
-জ্বী!বলেই আবার চোখের কোণে পানি চলে আসে,,
শাশুড়ি মা—নাজিফা মা কাঁন্না করোনা, আমি ও তো তোমার মা হই,আমি জানি তুমি খুব ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছো।
মায়ের কথাটি শুনে অমনেই আমি ড্যাবড্যাব করে মায়ের দিকে চেয়ে রইলো।
একজন অপরিচিত মহিলা আমার পাশে বসেন আর বললেন,”আরে শুধু মা ই নয় এই মহিলাটি হচ্ছে আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড, দেখবে দু দিনেই তুমি আমার এই মাকে কতোটা ভালোবেসে ফেলবে।আমি তোমার বড় জা মানে বড় ভাবী।
.
.
ভাবীর এই কথাটির মাঝে কতোটা সত্যতা লুকিয়ে ছিলো তা বোধ হয় আমি বুঝতে পেরেছি।আমি জানি না এই সমাজের শাশুড়ি গুলো কখনো মা হতে পারে কিনা। আসলে পৃথিবীতে মায়েরা যে কতোটা স্নেহময়, ও মায়াময়ী হয় তা আমার শাশুড়ি মাকে দেখলেই বুঝা যায়।
পাশের মহিলাটিকে দেখিয়ে শাশুড়ি মা বলল,”সে তোমার মেঝো জা মানে আমার মেঝো ছেলের বউ।তোমার মেঝো ভাবী।সবার সাথে শাশুড়ি মা পরিচয় করিয়ে দিলো।
-আচ্ছা শাশুড়ি মা আমি আপনাকে কী বলে ডাকবো?
-শাশুড়ি মা বলে ডাকবে আর কি!হিহি বোকা মেয়ে।
-আচ্ছা শুধু মা বলে ডাকবো?
-আচ্ছা তোমার যা খুশি তাই ডাকবে!উঠো এখন খেয়ে নিবে!
-ফ্রেশ হয়ে
নামাজ পড়ে নিলাম।
মা নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছেন।ভয়ে গলা দিয়ে খাবার যাচ্ছে না।খিদা নেই বললেই চলে।বাট তবুও মা জোর করে গিলাচ্ছে।বাসায় থাকলে ভূলে ও কেউ আমাকে খাওয়াতে পারতো না।এখন নতুন বউ বলে কথা।আর খিদা নাই তবুও মা খাইয়ে দেওয়াতে হয়তো খেতে পারছি।


বড় ভাবী হাতে ধরে একটা রুমে নিয়ে আসলো।রুমটা সাজানো।বুঝতে বাকি নেই এটা আলেম সাহেব মানে হুজুরের না মানে থুক্কু আমার উনার রুম।


হঠাৎ করে একটা বাচ্চা রুমে ঢুকেই আমাকে বলল, তুমি আবার কাকীমা তাইনা??
আমি বাচ্চাটাকে তুলে বিছানায় বসালাম।তোমার নাম কি বাবু??
বাচ্চা: আমার নাম নাজিফা!
আমি বেশ অবাক হলাম।আবার কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো তখন একজন মহিলা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, এই যে নাজিফা কাকীমাকে বিরক্ত করছো কেনো? তোমার কাকীমা জার্নি করে এসেছে না?
মহিলাটিকে দেখলাম মেঝো জা মানে মেঝো ভাবী।
আমি বললাম,”পিচ্ছিটা তোমার মেয়ে?
মেঝো ভাবী: হ্যাঁ, আর জানি নাম শোনে অবাক হচ্ছো, অবাক হওয়ার কিছু নেই মিলে গেলো আর কী তোমার নামের সাথে।অনেকটা রাত হয়ে গেছে।আসি এখন,চলো নাজিফা।কাকীমা ঘুমাবে।


সেই কখন থেকে বসে আছি একা রুমে তবু ও বরের কোন খোঁজ নেই।মনে মনে ভাবছি মোহরানার এক অংশ ও মাফ করবোনা
পুরো মোহরানা আদায় করবো।
আচ্ছা অচেনা বরটা দেখতে কেমন হবে আর কেমন হবে মনের দিক থেকে, কি জানি।
এতোক্ষনে উনি ঘরে ঢুকলো।আমি কারো উপস্তিতি বুঝতে পারলাম।আমি উনাকে সালাম দিলাম তার আগেই উনি সালাম দিয়ে খাটের উপর বসেই আমার হাতে মোহরানার টাকা গুলি দিলো।
কারণ তিনি ভালো করেই জানে মোহরানা হলো স্ত্রীর হক
আমি মোহরের টাকা গুলি হাতে নিলাম।
উনি বললেন,” ইসলামে নারীদের মর্যাদা সর্বোচ্চ প্রদান করা হয়েছে।আর তাই যৌতুক নেয়াকে হারাম করা হয়েছে এবং মোহরানাকে হালাল করে দিয়েছে।
মোহরানা কনেদের ক্রয়ের টাকা নয়, এটা স্বামীর পক্ষ থেকে ফরজ উপহার যা স্ত্রীর অধিকার।
যৌতুক নেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “তোমরা নিজেদের মধ্যে একজন অপরজনের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।মানুষের ধন সম্পদের কিছু অংশ জেনে শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকগনের নিকট পেশ করো না।” [সুরা বাকারাঃ-১৮৮]
যৌতুক হলো অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদের উপর হস্তক্ষেপ করা, কোন রকম চুক্তিবদ্ধ না হয়ে অথবা চাপ প্রয়োগ ব্যাতীত কনে পক্ষ যদি স্বতঃস্ফুর্ত চিত্তে পাত্র পক্ষকে কোন কিছু দেয় তবে তা উপহার হিসেবে গন্য হবে।
আর যদি কেউ অজ্ঞাতবশত যৌতুক নিয়ে থাকে তাহলে জানার সাথে সাথে শশুড়কে তা ফিরিয়ে দিয়ে তওবা করতে হবে।
আমার মনে মনে উনাকে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জেগে উঠতে লাগল একটু একটু করে।
তিনি আবার বলতে লাগল, মোহরানা দেয়া সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা নারীগনকে তাদের মোহরানা বা একটি নির্দিষ্ট উপহার দিবে।যদি তারা সন্তুষ্টচিত্তে মোহরানার কিছু অংশ ছেড়ে
তবে তা সাচ্ছন্দে ভোগ করবে।” [সুরা নিসাঃ-৪]
অর্থ্যাৎ স্ত্রীরা যদি নিজের ইচ্ছায় মন থেকে কিছু মোহরানা মাফ করে দেয় তবে তা স্বামী গ্রহন করতে পারবে।কিন্তু স্ত্রীকে জোর করে মোহরানা মাফ করিয়ে নেয়ার বিধান নেই।স্বামীকে মন থেকে মোহরানা আদায়ের নিয়ত করে খুশি মনে মোহরানা দিতে হবে।অন্যথায় মোহরানা আদায় হবেনা।
রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে কোন ব্যাক্তি কোন মহিলাকে কম বা বেশী মোহরের বিনিময়ে বিয়ে করেছে।মনে মনে তার হক আদায়ের নিয়ত রাখেনি।তাকে ধোকা দিয়েছে।অতঃপর তার হক আদায় না করে মারা গিয়েছে, সে ব্যাক্তি কেয়ামতের দিন ব্যাবিচারী বা যেনাকার হয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে।” [ত্বাবারনী সঃ তারগীবঃ ১৮০৭]
অতএব আমি তোমাকে মোহরানার নিয়্যাত করেই মোহরানা দিলাম।
তাছাড়া মোহরানা হিসেবে জমিজমা, গরু ছাগল, ভেড়া, ব্যবহার্য জিনিস পত্র ইত্যাদি দেয়া যায়।
“আর স্ত্রীদের একজনকে দিয়েছে স্তুপিকৃত সম্পদ।” [সুরা নিসা, ২০]
এবার আমি বললাম,আপনার মোহরের পরিমানের অর্ধেক অংশ কমিয়ে দিলাম।এবং এর অর্ধেক মোহর হিসেবে নিলাম।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “বিবাহের পর উভয় পক্ষের সম্মতিতে পূর্ব নির্ধারিত মোহরের হ্রাস বা বৃদ্ধি উভয়ই জায়েজ।” [সুরা নিসাঃ-৭৮]
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“সে নারী বরকতের মাঝে রয়েছে যাকে প্রস্তাব দেয়া সহজ ও যার মোহরানা অল্প।” [মাসনাদ আহমদ; হাসান সানাদে]
উনি আবার বলল, আর আমি তোমাকে খুশি মনে মোহর দিয়েছি।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর তোমরা নারীদের মোহরানা স্ততঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রদান করবে।” [সুরা নিসাঃ-৪]


তিনি বললেন, এবার কি আমার স্ত্রীর মুখ দর্শন করতে পারি?
আমি মাথা নেড়ে জবাব দিলাম।তিনি আমার মুখ থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিলেন, মাশাআল্লাহ!
-এযেনো জান্নাতের হুর।জীবনে প্রথম তোমাকে দেখলাম।
কথাটা শুনে খটকা লাগল আমার।মাথাটা তুলে উনার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম।সেই নাত শরীফ গাওয়া উনি।ভাইয়ার ফোনে যার পিক দেখেছিলাম।
হালকা বাতাসে তার ঝলমলে চুল উড়ছে।নীল রং এর পাঞ্জাবিতে আজ তাকে বেশি সুন্দর লাগছে?ইচ্ছা করছে রুমের সব আয়না ঝনঝন করে ভাঙতে। এমন যদি হয় আয়নায় নিজেকে দেখে নার্সিসাসের মত আত্মপ্রেমে মুগ্ধ হয়ে আত্মাহুতি দেয় হায় মাবুদ কী হবে আমার!উনি আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল, “ভ্যাবলার মত তাকিয়ে আছো কেন?
-চোখ তুলে একটাবার আমি নিজের দিকে তাকালাম আমি ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম।জগতে সুন্দর গায়ের রঙ,হৃদয় কাড়া
হাসি সব বরাদ্দ থাকা উচিত কেবল নারীর জন্য,ভুল করে বিধাতা দু একজন পুরুষকে দিয়ে ফেলেছেন।তার মাঝে এই আলেম সাহেবকে ও।উনি
আমার দিকে চোখ রেখে বলল,”কিছু বলবে নাকি?
-না মানে আমতা আমতা করছিলাম।আমি তো আপার যোগ্য নই।আমি জেনারেল পড়ুয়া একটা মেয়ে।ইসলামিক জ্ঞান অ আ কিছু নেই বললেই হয়।
-শুনো পৃথিবীতে কেউ কারো যোগ্য নয়,যোগ্যতা অর্জন করে নিতে হয়।ইনশাআল্লাহ আমার বিশ্বাস তুমি পারবে।
আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া তোমাকে পেয়ে।
-শুকরিয়া।

উনি আবার ও বললেন,”কেউ একজন বলেছিলো “তুমি যদি হও হযরত আলী (রাঃ) এর মতো ঈমানজাগরনী, তবেই তুমি পাবে ফাতেমা (রাঃ) এর মতো জীবন সঙ্গিনী”!
চলো দুরাকাত শোকরানা নামায পড়ে আমাদের দাম্পত্য জীবন শুরু করি।আমি মাথা নাড়ালাম।
আমি মুচকি হেসে ওয়াশ রুম থেকে ওজু করে আসলাম।
দু’জনে দু’রাকাত নামায পড়ে ইহকালীন ও পরকালীন সুখ শান্তি কামনা করলাম।


তিনি স্টিলের আলমারি
খুব জোরে খুলেন কিছু খুঁজছেন।আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম।আমি প্রায় খাটের তলায় চলে গেছি ভয়ে।তিনি কিছুটা বিরক্তি ভাব নিয়ে—তুমি খাটের তলায় গেছো কেন????
আমি মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগলাম।
—- আজিব তো তুমি, এতো কাঁদছো কেন?আমি কোনো উওর দিলাম না।ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে।
তিনি আবার ও বলেন মানুষ তো সামান্য কথা ও বলে তুমি তো তাও বলো না।
বোবা নাকি? না, না বোবা হলে তো কবুল বলতে পারতে না।একটু আগে ও তো সুন্দর ভাবে কথা বলেছো।এখন কী হলো?
উনার এই কথাগুলো শুনে আমি খাটের তলা থেকে বের হয়ে চিকুন স্বরে বলতে লাগলাম—- আসলে আমি স্টিলের আলমারির শব্দ একদম সহ্য করতে পারিনা।উনি হেসে দিলেন আর বললেন,”
—- এটা আবার কেমন কথা,,, কিন্তু কেন??
—- ইয়ে মানে বাজ পড়ার শব্দের মতো মনে হয়।
— এর জন্য খাটের তলে!!!!!!হু হা হা
উনার কথা আর হাসি শুনে আমি কিঞ্চিত লজ্জা পেয়ে মুখটাকে নিচু করে ফেললাম।
তিনি ব্যাপারটি বুঝতে পেরে একটু মুচকি হেসে—- আরে ব্যাপার না কালকেই আমি আলমারি চেঞ্জ করে ফেলবো।



শুরু হলো আলেমের বউ এর নতুন জীবন।
.
.
.
.
সর্ব শেষ আমার প্রিয় একজন ব্যক্তির অসাধারন একটি উক্তি দিয়ে শেষ করলাম আলেমের বউ।

“তুমি যা খুঁজছো সেটা আসলেই তোমাকে খুঁজছে”মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী।


(সমাপ্ত)
লিখা:শাঁরঁমিঁনঁ সুঁলঁতাঁনাঁ সাঁলঁমাঁ
বি.দ্র.গল্পটা কাল্পনিক তাই কোনো আলেমের নাম দিতে পারলাম না।আন্তরিক ভাবে দুঃখিত দোয়া করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here