ভালোবাসার ফোড়ন ২ পর্ব ১৯

0
990

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৯

আহিয়ান হঠাৎ করেই সামনে এগিয়ে কারো কাছে গেল। আমি তার দিকে তাকতেই সে বিস্ময় চোখে আমার দিকে তাকাল আর আমার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল! সে আর কেউ না ছিল আমার চাচা। তিনি আমাকে দেখে যেমন বিস্ময় হয়ে ছিলেন ঠিক তেমন’ই অবাক। তিনি অবাক চোখে বলে উঠে,

“মা নিহা!

“চাচা!

বলেই দৌড়ে তার কাছে গেলাম। চাচা আমার মাথায় হাত রেখে বলেন,

“তুই এখানে!

“মা কেমন আছে, বাবা’র শরীর কেমন? তুমি ভালো তো?

“আমরা সবাই তো ঠিক আছি কিন্তু তুই এখানে কেন?

“তোমাদের দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল তাই চলে এলাম।

চাচা খানিকক্ষণ আমার দিকেই তাকিয়ে রইল। আমি খেয়াল করলাম শুধু চাচা না আহিয়ান,‌ আকাশ ভাইয়া তারা সবাই অবাক। হঠাৎ চাচা অস্থির হয়ে বলে উঠে,

“তুই এখান থেকে চলে যা।

“কি বলছো এসব চাচা। এতোদিন পর এলাম মা আর বাবা কে একটু দেখতে দিবে না।

“এসব পরে দেখা যাবে তুই এখান থেকে এক্ষুনি চলে যা। কিছুক্ষণ পর’ই ট্রেন ছাড়বে আয় তোকে আমি উঠিয়ে দিচ্ছি!

বলছি তিনি আমার হাত ধরে সামনে আগাতে থাকেন। তখন হঠাৎ করেই আহিয়ান তার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। চাচা তার দিকে তাকায়। আকাশ ভাইয়া বলে উঠে,

“চাচা আপনি কি করছেন, এতো রাতে একটা মেয়েকে একা পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

“আপনি বুঝতে পারছো না বাবা ও এখানে থাকলে অনেক সমস্যা হইবো।

আহিয়ান বলে উঠে,
“কি এমন সমস্যা হবে।

“আপনারা জানেন না কিছু, এখন সময় নেই এতো কিছু বলার।

“জানি না তো জানব। এর যাই হোক না কেন এদেশে আইন আছে। কেউ কিছু করলে আপনারা কেন ছেড়ে দিবেন।

“আমরা গরীব মানুষ বাবা। দিনরাত খাটার পর পরে চারটে ভাত জুটে কপালে। কিন্তু মান সম্মান অনেক আছে আমাদের। আমাদের শুধু এই একটাই মেয়ে। তার জীবন টা নষ্ট হইতে দেবো না আমি।

আকাশ ভাইয়া বলে উঠে,
“আমরাও দেবো না। আমরা সবাই আছি এখানে। দেখো নেবো সবকিছু!

“কিন্তু বাবা!

আকাশ ভাইয়া চাচা’র ঘাড়ে হাত রেখে বলে,
“চাচা আর কথা বাড়িয়েন না। দেখুন নিহা কে, এতো শখ করে এসেছে মা আর বাবা কে দেখবে। এতটুকু ইচ্ছে কি রাখবেন না ওর!

আমি চোখ ভরে উঠছিল। চাচা আমার দিকে তাকাতেই চোখের থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। চাচা আর কিছু বলতে পারলেন না। অবশেষে চাচা আমাকে নিয়ে যেতে রাজি হলেন। সবাই মিলে হাঁটা শুরু করলাম!
কিন্তু আমার চোখের পানি যেন থামছে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি আমি। হঠাৎ করেই আমার সামনে কেউ রুমাল ধরল। তাকিয়ে দেখি আহিয়ান! আমি ঝাপসা ঝাপসা চোখে তার দিকে তাকালাম। উনি বলে উঠেন,

“রুমাল নিতে বলেছি আমাকে দেখতে বলেনি!

“কিন্তু..

কিছু বলার আগেই আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তিনি হেঁটে চলে গেলেন সামনে। আমি রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছলাম। বাইরে এসে দেখি একটা বড় মাইক্রো গাড়ি। চাচা নিয়ে এসেছিল আহিয়ান দের নেবার জন্য। ড্রাইভার ছিল গাড়িতে! আমরা সবাই সেই গাড়িতেই বসলাম। কিন্তু এখনো আমার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার না। চাচা কেন এখানে? উনি তো এমন ধরনের কোন কাজ করে না।

গাড়ি চলছে নিজ গতিতে,‌ একটু হেলেদুলে বলা যেতে পারে। গ্রামের রাস্তা ওতোটা ভালো না। আহিয়ান ছিল ড্রাইভার এর সাথে সামনের ছিটে, তার পরের সিটে নাহান আর আনাফ ভাইয়া, অতঃপর আমি, চাচা আর আকাশ ভাইয়া! আহিয়ান চাচা কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“রহিম চাচা’র পরিবার কেমন আছে চাচা!

“ভালোই আছে।

আকাশ ভাইয়া বলে উঠে,
“রহিম চাচা হঠাৎ কিভাবে মারা গেল।

“জানি না বাবা, সন্ধ্যায় আমাদের সবার সাথে চা খেল‌, কথা বলল তারপর বাসায় গিয়ে খাইয়া দাইয়া ঘুমাইলো। মাঝরাতে নাকি হঠাৎ কইরা বুকে ব্যাথা উঠল। আর মানুষটা মইরা গেল। খুব ভালা মানুষ ছিল গো!

নাহান ভাইয়া বলে উঠে,
“হ্যাঁ অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আমাদের সাথে অনেক হাসি তামাশা করত বরাবর।

আনাফ ভাইয়া বলে উঠে,
“তার হঠাৎ মৃত্যুতে অনেকটা অবাক হয়েছি আমরা সবাই!

আকাশ ভাইয়া বলে উঠে,
“তখন পরিক্ষা চলছিল বলে আসতে পারি নি। তবে শুনলাম আন্টি নাকি লোক পাঠিয়েছিল।

“হ্যাঁ ম্যাডাম লোক পাঠাইছিল। তারা রহিমের কাম দিলো আমার ঘাড়ে । এছাড়া তার পরিবারের সব খরচ নিলেন। জানো তো রহিমের দুইটা সেয়ানা মাইয়া আছে। আল্লাহ যদি এখন ভালোয় ভালোয় এই দুই মাইয়ারে একটা ব্যবস্থা করে।

আহিয়ান বলে উঠে,
“চিন্তা করবেন না চাচা। আমরা দেখে রাখবো। তা আপনার কাজ কর্মে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো।

“প্রথম প্রথম একটু হইতো, কখনো করি নাই তো। এখন সব বুঝপার পারছি। আমি কিন্তু খুব পাইছিলাম গো বাবা তাই কামটা প্রথম নিতে চাইনি।

“এখন ভয় কমেছে!

“কি করমু বাবা, পেটের দায় যে বড় দায়। এর মাঝে ভয় ডর সব পানির মতো মিশে যায়! একলা মানুষ তবুও কতো কিছু ভাবতে হয় কও! কিন্তু এখন একা না নিহা’র মা বাপ দু’জনেই থাকে আমার লগে।

বলেই আমার দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত দিলেন। আমি মাথা নিচু করে রইলাম। সবার কথাবার্তা আমি কিছুটা হলেও বুঝলাম। তারা যার কথা বলছিল রহিম চাচা তিনি আগে আহিয়ানদের বাড়ি দেখাশোনা করতো এখানে। তিনি মারা যাবার পর এই কাজ এখন আমার চাচা’র উপর।
.
অতঃপর গাড়ি থামল এক জমিদার বাড়ির সামনে। বাড়িটা সত্যি’ই বেশ বড়।‌ এখন রাতের মাঝে এটা একটা ভূতের বাড়ির মতো লাগছে। চাচা তাদের নিয়ে বাড়িতে গেলেন। আমিও গেলাম তাদের পিছু পিছু! বাড়িটা ভেতর থেকে পুরোটাই রাজকিয় একটা অবস্থা। বাড়িটা অবশ্য আমি দূর থেকেই কয়েকবার গেছিলাম কিন্তু কখনো ভিতরে আসি নি। আজ’ই এলাম প্রথম।

বাড়ির প্রত্যেকটা জিনিস অনেক যত্ন করে রাখা হয়েছে। চাচা তাদের সব কিছু দেখাতে লাগল। বাড়ির সব কাজের লোকদের সব কিছু বলে এলো। বার বার করে বলল যেনো তাদের কোন অসুবিধা না হয়। অতঃপর আমাকে নিয়ে বের হলেন। বের হবার সময় আহিয়ান একবার জিজ্ঞেস করল,

“এতো রাত করে যাবেন,‌ এখানেই থাকুন।

“না বাবা আমার বাড়ি এই কাছেই ১০ মিনিট লাগবো যাইতে।

“আমি যাবো আপনাদের সাথে।

“না বাবা যেতে পারবো। আপনি গেলে রাস্তা হারাইয়া ফেলবেন তখন আবার আরেক সমস্যা!

“সাবধানে যান তাহলে,আর হ্যাঁ আমাকে আপনি না বলে তুমি বলুন।

“আচ্ছা বাবা তুমি যা বলো। আমি আবার কাল সকালে আসমু।

“খুব সকালে আসবেন না, কেউই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠবে না।

“আইচ্ছা বাবা গেলাম আমি!

অতঃপর আমি আর চাচা বেড়িয়ে গেলাম।‌ রাস্তা খুটখুটে অন্ধকার! চাচা’র হাতে একটা হারিকেন! সেটা দিয়েই দু’জনে আসছি রাস্তা দিয়ে। আসার সময় অনেক গল্প করলাম দুজনে। অতঃপর বাড়িতে আসার পর চাচা মা কে ডাক দিলেন। মা এসে আমাকে দেখে হতবুদ্ধি’র মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি দৌড়ে গিয়ে মা কে জরিয়ে ধরলাম। মা আমাকে দেখে যত খুশি হলেন তার চেয়ে বেশি ভয় পেলেন। এরপর কি হবে এটা ভেবেই তিনি ভয় পাচ্ছেন!

বাবা’র সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখি তিনি ঘুমিয়ে আছেন। আমি আর ডাকলাম না তাকে। দু”চোখ ভরে দেখলাম তাকে। অতঃপর চলে এলাম মার কাছে। দুজনেই সারারাত বসে বসে কথা বললাম। চাচাও জিজ্ঞেস করল আহিয়ান কে আমি কিভাবে চিনি। আমি তাদের দুজনকেই সব বললাম!
.
কথা বলতে বলতে মায়ের কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল দেখি সূর্য তখন উদয় হবে। আমি উঠে গেলাম ঘুম থেকে। গোসল করে এসে বসলাম নাস্তা বানাতে। সবার জন্য গরম গরম রুটি বানালাম।‌ আর গতকালের কিছু সবজি ছিল সেগুলো গরম করলাম। ততোক্ষণে মা উঠে গেছেন। তিনি উঠে উঠোন ঝাড়ু দিতে লাগলেন।

আমাদের বাড়ি পুরোটাই মাটির তৈরি, তার উপর টিনের চালা। এখানে ঘর মোট ৩ টা। আর একটা গোয়াল ঘর যেখানে আমাদের দুইটা গরু থাকে। যদিও সেগুলো আমাদের না চাচা’র! আমাদের গুলো হয়তো ভাবীর কাছে। তিনি রেখে দিয়েছেন। বাড়িটা বেশ বড় না তবে থাকার মতোই। বাড়ির গা ঘেঁষে একটা বড় আম গাছ। রাতের বেলায় এটা যত ভয়ানক লাগছিল তখন সেটা ততোটাই সুন্দর!

মা গরুদের খাবার দিয়ে গেল। এর মাঝেই বাবা উঠে গেল। বাবা আমাকে দেখে প্রথমে অনেক অবাক হলেন। অতঃপর অনেক খুশি হলেন। খুশিতে বাবা কেঁদে ফেললেন। মা’র কাছে শুনেছি তারা এখানে আসার পর নাকি মা কাজ করত। কিন্তু এখন আর করে না, চাচা করতে দেন না। মা বাবা দুজনকেই নাস্তা খেতে দিলাম। এতোদিন পর বাবা নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন আমায়। আমিও বসে বসে খেলাম। আমার চাচা এখনো ঘুমাচ্ছেন। আমার চাচা কিন্তু অনেক ঘুম কাতুরে। প্রচুর ঘুমাতে পারেন তিনি। ভালোই হলো আহিয়ান তাকে বলল একটু দেরি করে যেতে আমি নিশ্চিত তিনি দেরি করেই উঠবেন ঘুম থেকে!

একটু একটু শীত পড়েছে, তার সাথে কুয়াশা। আমি বাবা’র পাশে বসে তার হাত পায়ে সরিষার তেল দিয়ে মালিশ করে দিচ্ছি। মা গেছেন রান্না বসানোর জন্য কাঠ জোগাড় করতে। কিছুক্ষণ পর মা এসেই চেঁচিয়ে কথা বলতে লাগলেন। চাচা কে উঠানোর জন্য’ই এভাবে কথা বলছে। তার এমন কান্ড দেখে আমি আর বাবা হাসতে লাগলাম!

কিন্তু বলতে হবে এটা কাজে দিয়েছে, কিছুক্ষণ’র মধ্যেই চাচা ঘুম থেকে উঠে গেছেন। উঠেই কানে হাত দিয়ে বসে রইলেন। আমি আর বাবা জোরে জোরে হাসতে লাগলাম!

চাচা হাত মুখ ধুয়ে আসার পর তাকে নাস্তা দিলাম খেতে। চাচা খেতে খেতে বললেন,

“তা মা কোন সমস্যা হচ্ছে না তো! সেখানে ভালো আছিস!

“হ্যাঁ চাচা অনেক ভালো আছি। একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলে তোমাদের ও নিয়ে যাবো ওখানে।

মা বলে উঠেন,
“আমাদের আর যাওয়া, এখন এই গ্রাম’ই আমাদের একমাত্র থাকার জায়গা, মরলে এই গ্রামের মাটিতেই মরতে হবে রে মা।

“হয়েছে মা রাখো তো। পরের টা পরে দেখা যাবে। চাচা তুমি কি এখন বাইরে যাবে।

“কেন তুই যাবি নাকি।

“হ্যাঁ কতোদিন ধরে গ্রাম টা দেখি না, আজ বেড়াতে যাবো গ্রামে!

মা বলে উঠে,
“কোথাও যাওয়া লাগবে না। আমি ফুলিদের বলে দিয়েছি আসতে। ওরা আসলে এখানেই বসে গল্প করবি। এক পা বাড়ির বাইরে যাতে না যায় বুঝলি!

আমি খুশিতে হেলেদুলে মাথা নাড়ায়। ফুলি’রা আসবে তার মানে আজ সারাদিন আমি বাড়িতেই থাকবো না। তাদের সাথেই ঘুরবো।‌ ফুলিরা হলো আমার পিচ্চি বাহিনী। আমার থেকে অনেক ছোট তারা। ফুলিরা বলতে ফুলি,‌ মিলি, নদী আর রুবি! এরা চার জন হলো আমার সব অকাজের সাক্ষী! হি হি হি!
.
সূর্য তখন মাথায় উঠে গেছে। ফুলি ওরা সবাই চলে এসেছে। আমাকে দেখে পুরো বাড়ি মাথায় নিলো ওরা। সবাই এসে জড়িয়ে ধরল আমায়। গল্প করতে বসে পড়লাম সবাই। মা আমাদের সবাইকে বসে শাক বাছতে দিয়ে বাইরে গেছে। মায়ের কড়া আদেশ বাড়ির বাইরে যাতে পা না রাখি। তিনি যেতেই, আমি বাবা কে বলে ওদের নিয়ে পালিয়ে এলাম। অতঃপর বনে বাদারে ঘুরতে লাগলাম।

আমাদের গ্রামে বাগানের অভাব ছিল না। মুখ উড়না দিয়ে ঢেকে ৫ জন ঘুরতে লাগলাম। হঠাৎ করেই একটা পেয়ারা গাছ চোখে পড়ল আমাদের। মিষ্টি মিষ্টি পেয়ারা গুলো গাছের ডালে ঝুলছে!
কে গাছে উঠবে এটা নিয়ে তর্ক লেগে গেলো। এই সুযোগ টা আমিই নিলাম। চুপি চুপি উঠে গেলাম পেয়ারা গাছে। ধরতে গেলে আমরা চুরি করছি! এর মাঝেই কারো আসার শব্দ পেলাম। আমাকে গাছে রেখে বাকি সবাই লুকিয়ে পরল। আমি তখন সবে কয়েকটা পেয়ারা হাতে নিয়েছি। দেখতে দেখতে তারা গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। আমি তাকিয়ে দেখি আহিয়ান! তাকে দেখেই চমকে উঠলাম আর তখন আমার হাত থেকে ফসকে একটা পেয়ারা পড়ে গেল। আমি বলে উঠি,

“আহিয়ান!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here