ভালোবাসার ফোড়ন ২ শেষ পর্ব

0
1422

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#শেষ_পর্ব

উনি বলে উঠেন,

“শালা তোরা যাবি এখান থেকে!

“যাচ্ছি যাচ্ছি!
বলেই তারা তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে চলে গেল। আমি তাদের চলে যাবার আওয়াজ পেলাম। উনি আমাকে জরিয়ে ধরে বলেন,

“কি হয়েছে?

উনাকে একটা ধাক্কা মেরে বলি,

“ছাড়ুন আমাকে! কি হচ্ছিল এসব? ভাইয়ারা এখানে ছিল আর তাদের মাঝে আপনি আমাকে এভাবে ছি ছি ছি কিসব হয়ে গেল।

“কিছুই তো হলো না, আর এভাবেই তো ছাদ পুরো অন্ধকার ছিল তাহলে কে দেখবে! একটু বেশিই ভাবো তুমি!

“হ্যাঁ এখন তো বলবেন, দোষ ঢাকতে হবে না।

“তুমি এখনো যেচে আমার সাথে ঝগড়া করতে চাইছো।

“কি বললেন আপনি, আমি! আমি যেচে আপনার সাথে ঝগড়া করতে চাইছি।

“তা না হলে কি? কোন কারন ছাড়াই ঝগড়া করছো।

“মানে, কি বলতে চান আপনি, এটা কোন কারন না। এতো বড় কান্ড করে বলছেন কোন কারন না।

উনি আমার বাহু ধরে হুট করে টান দিয়ে বলেন,
“কোন মেয়েকে প্রপোজ করার পর সে যে এভাবে ঝগড়া করে এটা জানলে আমি..

“কি কখনো প্রপোজ করতেন না এটাই তো!

হুট করেই উনি আমার কোমরে হাত দেন। উনার হাতের উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে আমি লাফিয়ে উঠি। কিছুক্ষণ’র জন্য নিস্তব্ধ হয়ে যাই আমি। উনি আমার কানের কাছে তখন ফিসফিসিয়ে বলেন,

“এভাবে ধরে রাখতাম তাহলে চুপ হয়ে যেত!

আমি ভ্রু কুঁচকে উনার দিকে তাকাই যদিও তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাকে অনুভব করেই তার লাগে হালকা ভাবে একটা চড় মেরে বলি,

“আর আমার উচিত ছিল যে আমাকে এতো কষ্ট দেবার পর প্রপোজ করেছে তাকে একটা চড় মারা।

উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। সম্ভবত গালে হাত দিয়েছেন। মিন মিন স্বরে বলে উঠেন,

“তুমি আমায় চড় মারলে!

“আস্তেই মেরেছি, আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে না দিতো একটা ঠাঁটিয়ে তখন বুঝতেন।

“বউ কে প্রপোজ করার পর যদি জানতাম এমন চড় খেতে হয় তাহলে আর..

“প্রপোজ করতেন না তাই তো। কিন্তু কি করবো বলুন ভূতনি বউ তো তাই এমনটা করা লাগে।
বলেই আমি খিলখিলিয়ে হাসলাম। আকাশ আবারো চমকে উঠলো। গর্জন করল! বৃষ্টি শুরু হবে মনে হচ্ছে। আকাশ চমকানোর কারনে উনার স্নিগ্ধ মুখখানি দেখার সৌভাগ্য হলো আমার! এই কিছু সেকেন্ডে দু’জন দু’জনকে খুব যত্ন করে দেখছিলাম। চোখ ফিরানো যাচ্ছিল না কারো থেকে। উনি বলে উঠেন,

“তুমি জানো আজ এই ছাদ কেন অন্ধকার!

“কারন আঁধারে সেটাও দেখা যায় যা শত আলোর মাঝেও দেখা যায় না।

“তাহলে তুমি কি দেখছো?

আমি হেসে বলি,
“আমার অপ্রকাশিত ভালোবাসার প্রকাশ্য মুহূর্ত!

হঠাৎ করেই উনি আমার কাছে এসে আমার গালে হাত রেখে তার উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া দিলেন আমার ঠোঁটে! আমি উনার ঘাড়ে দু হাত রাখলাম। কিছু সেকেন্ডে’র মধ্যেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল আমার গালে। আমি উনাকে ছেড়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। বৃষ্টির এবার জোরে পড়তে লাগালো। আমি আকাশের থেকে মুখ সরিয়ে উনার দিকে মুখ করলাম। উনি আমার কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমাকে উনার কাছে টানলেন। উনার ভিজে ঠোঁটের ছোঁয়া দিলেন আমার কপালের মাঝখানে। আমি চোখ বন্ধ করে সেই সময়ের অনুভূতি উপভোগ করছিলাম। কেন জানি তখন খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছিল নিজেকে।

খানিকক্ষণ দুজনে একসাথে ভিজলাম বৃষ্টিতে। উনি আর আমি বৃষ্টিতে খুব লাফালাফি করলাম। নিজেকে সেদিন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। উনি আমার দু হাত ধরে বলেন,

“অনেক ভিজেছ এখন চলো নাহলে জ্বর আসবো।

আমি মাথা নেড়ে উনার হাত ধরে হাঁটতে লাগলাম। দুজনেই পুরো কাকভেজা। উনি আমাকে হুট করেই কোলে তুলে নিলেন। আমি উনার গলা জরিয়ে ছিলাম। মোমবাতি’র আলোয় দেখছিলাম উনাকে।
আমাকে এনে থামলেন ঘরের দরজার সামনে। নিচে নামিয়ে বলেন দরজা খুলতে। আমি দরজা খুলে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম। এটা যেন একটা ফুলের বাগান। উনি আমার ধরে ঘরে নিয়ে এলেন। পুরো ঘর’ই বিভিন্ন রকমের ফুল দিয়ে সাজানো। হারিকেন দিয়ে চারদিক আলোকিত। এই আঁধারের মাঝে ছোট এই আলো টুকু যেন অনেককিছু। উনি একটা তোয়ালে এনে আমার শরীরে রেখে বলেন,

“চেঞ্জ করে নাও!

বলেই রুম থেকে বের হতে যাচ্ছিলেন। আমি চট করে উনার হাত ধরলাম।উনি আমার দিকে তাকাতেই তাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলাম। উনি আমার কোমরে হাত রেখে বলেন,

“তুমি আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছ!

আমি ফিসফিসিয়ে বলি,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি!

উনি হেসে বলেন,
“আমিও তোমাকে ভালোবাসি ভূতনি!

বলেই আমার কোমর খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরেন।
?
?
.
আজকের ভোরের আলোয় আমার নতুন দিনের সূচনা ঘটল। বাইরে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। আমি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি গুটিসুটি মেলে উনার বুকের সাথে মিশে আছি। উনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।আমি আমার হাত উনার গালে রাখলাম। না উনি উঠলেন না। কোনমতে উনার আবদ্ধ থেকে বেরিয়ে এলাম। শাড়িল আঁচল ঠিক করে বেলকনির পর্দা সরাতেই একরাশ আলো এসে ঢুকল ঘরের ভিতর। আলো পড়তেই উনি উপর হয়ে শুয়ে পড়লেন। উনার উদোম পিঠটা দেখতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম আমি। দ্রুত সেখান থেকে সরে গিয়ে শাওয়ার নিতে চলে গেলাম।

গোসল করে এসে আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল মুছতে লাগলাম। উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন। আমি উনার দিকে একটু ঝুঁকে উনার কপালে আলতো করে একটা চুমু খেলাম। একটু নড়েচড়ে উঠলেন কিন্তু ঘুম ভাঙল না। নিচে এসে উনার জন্য চা বানাতে লাগলাম। অতঃপর চা বানিয়ে উপরে নিয়ে গেলাম। মহারাজ এখনো ঘুমে বেহুঁশ। আমি চা পাশের টেবিলে রেখে উনাকে উঠানোর বন্দোবস্ত করতে লাগলাম। কিভাবে উঠাবো তাকে?

টেবিলে কলমটা দেখে হঠাৎ করেই একটা বুদ্ধি এলো। আমি সেটা নিয়ে বিছানার উপাশে গিয়ে উনার মুখের কাছে কিছু আঁকতে নিলাম। কিন্তু যখন’ই কলম টা উনার মুখের কাছে নিয়েছি ওমনি উনি আমার হাত ধরে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।‌ আমি চুপ হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি বলে উঠেন,

“কি করতে যাচ্ছিলে!

“কিছু না।

“মিথ্যে বলছো।

“না একদম না, আমি সবসময় মিথ্যে বলি না।

উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলেন,
“ওহ্ আচ্ছা!

আমি ছাড়া পেয়ে বলে উঠি,
“কিন্তু এখন বলেছিলাম। আমি আপনার মুখে একটা বাঁদর আঁকতে চেয়েছিলাম। গোমরামুখো বাদর!

“ভূতনি তোমাকে তো..

বলেই তেড়ে আসলেন আমার দিকে। আমি কোনমতে সেখান থেকে দৌড়ে পালালাম। অনেকক্ষণ ছোটাছুটির পর উনি আমাকে ধরে ফেলেন। আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে বলেন,

“বলো এখন কি করব তোমাকে!

“এখন টি টাইম। এক কাপ চা খেয়ে উদ্ধার করুন।

উনি হেসে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলেন। আমি এসে দাঁড়ালাম বেলকনিতে! কিছুক্ষণ পর উনি বের হয়ে এলেন। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ টা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি কিঞ্চিত হেসে উনার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে আকাশ দেখতে লাগলাম। গাছের পাতা এখনো ভিজে, আকাশ পরিষ্কার। গতকাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। ভোরের এই রাস্তা এখন একদম নিরব। পাখির আওয়াজ কিছুটা শোনা যাচ্ছে। দুজনেই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। চা এখন একদম গরম নেই কিন্তু একদম ঠান্ডাও না। মাঝামাঝি আছে। উনি এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন। আমি চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উনার হাত ধরে বলি,

“চলুন না একটু হেঁটে আসি!

“আচ্ছা গোসল করে আসি তারপর!

বলেই আমার মাথায় হাত রাখলেন। অতঃপর চলে গেলেন গোসল করতে। আমি ততোক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ করছি। কেন জানি আজকের সকাল টা খুব সুন্দর! মনে হচ্ছে আমি কিছু পেয়েছি। নতুন করে আবারো জীবন শুরু করেছি। আচ্ছা মানুষের ভালোবাসা পূর্ণতা পেলে বুঝি এমন অনুভূতি হয়!
.
খানিকক্ষণ বাদেই উনি বের হলেন। অতঃপর দুজনেই বের হলাম হাঁটতে। সারারাত বৃষ্টি হবার কারনে রাস্তা টা ভিজে ভিজে। উনি আমার হাত শক্ত করে ধরে হেটে যাচ্ছেন। আমি হাঁটছি পাশাপাশি। হয়তো এভাবেই দু’জনে হাতে হাত রেখে সারাজীবন পার করে দেবো। আমি উনার গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। অতঃপর উনার হাতটা জরিয়ে ধরে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম। আমি মাথা উঁচু করে উনার দিকে তাকালাম। হ্যাঁ উনিই সেই মানুষ যার দিকে তাকিয়ে আমি আমার বাকিটা জীবন অনেক আনন্দ পার করে দেব। আমাকে সুখী রাখবেন উনি!
.
৮ মাস পর….

আহিয়ান থার্মোমিটারটা আমার মুখে জোর করে ঢুকিয়ে দিয়ে বসে আছে। তার পরনে গাঢ় নীল রঙের একটা স্যুট! অফিসে গিয়েছিল বেচারা। সকালে আমি বমি করে মাথা ঘুরে পড়ে গেছি শুনে দৌড়ে চলে এসেছে। ইয়ান বাবা টা আমার পাশে হাত ধরে বসে আছে। তার কোলে চুপটি করে বসে আছে পিকু!

আহিয়ান আমার মুখ থেকে থার্মোমিটার বের করে চেক করে বলে,

“শরীরের তাপমাত্রা তো ঠিক’ই আছে তোমার! তাহলে..

বলেই আমার কপালে হাত দিলেন। আমি উনার হাত সরিয়ে দিয়ে বলি,

“আমিও বলছি আমার জ্বর আসে নি।

“তাহলে সকাল থেকে অসুস্থ কেন তুমি। মা ফোন করে বলল তুমি নাকি বমি করেছ, মাথা ঘুরে পড়ে গেছ। আচ্ছা সকালে কি খাও নি।

আমি কিছু বলতে নেবো তার আগে উনিই বলেন,

“না। আমার সাথেই তো খেলে তাহলে। আচ্ছা রাতে…

আমি আবারো কিছু বলতে যাবো তখন’ই আবারো উনি বলেন,

“না। রাতে তো তোমাকে আমিই খাইয়ে দিলাম।

তখন ইয়ান বলে উঠে,
“হ্যাঁ আমাকেও তো খাইয়ে দিয়েছ!

“হ্যাঁ তাই তো। তাহলে তোমার শরীর হঠাৎ করে খারাপ করল কিভাবে?

“আমাকে কিছু বলতে দিলো তো আমি বলবো নাহ!

“কি বলবে তুমি!

“আমি একদম ঠিক আছি। কিছুই হয়নি আমার। শুধু একটু ক্লান্ত লাগছিল আর কিছু না।

এর মাঝেই মা’র প্রবেশ ঘটল। মা এগিয়ে এসে আমাকে লেবুর শরবত দিয়ে বলে,

“এটা খেয়ে নাও ভালো লাগবে!

আমি মা’র হাত থেকে শরবত নিয়ে খেতে লাগলাম। মা আহিয়ান কে জিজ্ঞেস করল,

“আহি তো কে বললাম না ডাক্তার কে কল করতে।

“করেছি, আসছে!

“আধ ঘন্টা ধরে শুনেই যাচ্ছি আসছে। কখন আসবে।

আমি বলে উঠি,
“মা এসবের কোন দরকার নেই। আমি একদম ঠিক আছি। একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবো।

“নিহা! তুমি বরং একটু শুয়ে থাকো। আর আহি তুই গিয়ে দেখ ডাক্তার আর কত দূর!

অতঃপর উনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ বাদেই ডাক্তার এলেন। একজন মহিলা ডাক্তার। তিনি আসার পর সবাই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আহিয়ান ইয়ান কে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

ডাক্তার আমাকে চেকআপ করার পর মা ঘরে ঘরে এলেন। আমি চুপচাপ বসে আছি। ডাক্তার এর মুখ হাসিহাসি। ডাক্তার মা’র দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন,

“তা আন্টি মিষ্টি খাওয়াবেন কবে।

“মিষ্টি কেন খাওয়াতে বলছো মা!

“আহ দাদি হচ্ছেন এই খুশিতে কি মিষ্টি খাওয়াবেন না!

“কি! সত্যি, নিহা!

মা আমার দিকে তাকালেন। আমি হেসে মাথা নিচু করে ফেলি। মা এসে আমার মাথায় হাত বোলান। ডাক্তার ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ইয়ান আর উনি ঘরে আসেন। ইয়ানের হাতে আইসক্রিম’র বাটি। সে বাটি নিয়ে আমার কাছে এসে বলে,

“ভূতনি আম্মু আইসক্রিম খাও!

আহিয়ান ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মা হেসে বলেন,
“আমি এক্ষুনি আসছি!

বলেই ইয়ান কে নিয়ে চলে যান। আহিয়ান আমার পাশে এসে বলে,
“ব্যাপার কি বলো তো সবাই এতো হাসছে কেন?

“আপনার কি মনে হয়?

“মনে হবার কি আছে। তুমি অসুস্থ আর আমাকে কেউ কিছু বলছে না।‌ ব্যাপারটা কি বলো তো!

আমি উনার গালে হাত দিয়ে মুখটা আমার দিকে ঘুরিয়ে উনার টাই ধরে নিজের কাছে এনে কানে কানে বলি,
“আপনার ছোট্ট অরনি আসছে!

বলেই উনার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য উনার দিকে তাকায়। উনার ঠোঁটের কোনে স্নিগ্ধ হাসি। উনি মাথা নেড়ে বলেন,
“সত্যি!

আমি দুবার মাথা নাড়ি। উনি হেসে আমার গালে হাত রাখেন। আমার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলেন,

“তোমাকে ধন্যবাদ বলব না,‌ বলব ভালোবাসি!

সেদিন আমি উনার দিকে তাকিয়ে হেসে ছিলাম। আমি দেখেছিলাম উনার চোখে আমার জন্য থাকা সেই সূক্ষ্ম ভালোবাসা, সূক্ষ্ম অনুভূতি! আজ ৬ বছর পরও সেই ভালোবাসা কমে নি। এখনো আমি রাতে না খেলে উনি ঘুম থেকে উঠিয়ে আমাকে খাইয়ে দেন। সকালে একসাথে খাবার না খেয়ে বাইরে বের হন না। মাঝে মাঝে রাতে আমাকে নিয়ে হাঁটতে বের হন। বাইকে চড়ে ঘুরিয়ে আনেন। টং বসে চা খান, রাস্তার কিনারায় দাড়িয়ে আইসক্রিম! এখনো ঠিক ততোটা খেয়াল রাখে যা আগে রাখতেন। প্রতি সপ্তাহিক ছুটিতে ঘুরতে বের হন আমাদের নিয়ে। হ্যাঁ আমাদের সাথে থাকে আমাদের সেই অরনি। আহিয়ানের চোখের মনি। ঠিক যতোটা একজন স্বামী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তেমনি একজন বাবা হিসেবেও। তবে এখনো উনার সেই আগের ভাব টুকু আছে। আর তা হলো গোমরামুখো!

আমার সংসার জীবন উনার সাথে আজ আট বছরের বেশি হবে। তবে এই কয়েকটা বছরের একেকটা দিন উনার সাথে কাটানো আমার‌ স্মৃতি আমার মনের মাঝে বিরাজ করে।
কাঁথা সেলাই করছিলাম হঠাৎ করেই সুচটা হাতে ফুটে গেল। আমি আউচ করে উঠলাম। রক্ত বের হচ্ছে। কখন হলো টের পেলাম না। আমার পাশেই উনি বসে অফিসের ফাইল দেখছিলেন। আমার আওয়াজ শুনে আমার দিকে ফিরলেন। হাতের দিকে তাকিয়ে বলেন,

“দেখে শুনে কাজ করতে পারো না।

আমি এক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। উনার চোখে সাদা রঙের চিকন ফ্রেমের চশমা! বেশ মানাচ্ছে তাকে। মনে হচ্ছে আজ নতুন করে আবারো উনার প্রেমে পড়বো। উনি আমার মাথায় টোকা দিয়ে বলেন,

“ভূতনি!

আমার মেজাজ গেল বিগড়ে। বলে উঠি,
“এই রাখুন তো ভূতনি। এই আপনার জন্য আমার মেয়ে আমাকে আম্মু না ডেকে আহিয়ানের ভূতনি বউ ডাকে। ( উনি উঠে গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসে আমার হাতে হাতে ঔষধ লাগাচ্ছে। আমি হাত সরিয়ে বলে উঠি ) এই রাখুন তো আপনার ঢং।

উনি আমার হাত ধরে টেনে আবারো ঔষধ লাগান। আমি বলে উঠি,
“এতোটাও কাটে নি। এতো ঢং দেখানোর কিছু নেই।

আমার কথায় উনার মুখে কিঞ্চিত হাসি দেখলাম। বলে উঠেন,
“তুমি কি ভেবেছ, বাংলা সিরিয়ালের মতো আমি তোমার রক্ত চুষবো!

“তা তো হবে না জানি। তবে আপনি যে আমার হাড় মাংস সব জ্বালিয়ে খান এটা বুঝি। তা কোথায় জানি ছিলাম আমি!

“অরনি..!

“হ্যাঁ! আপনার আদরে বাঁদর হওয়া মেয়ে। বাপ যেমন মেয়েও হয়েছি ঠিক তেমন। বাঁদরের মেয়ে বাদর।

“বাঁদরের বউ ভূতনি!

“এই একদম মজা করবেন না বললাম! আপনি জানেন আজ সকালে ও কি করেছে!

“কি করেছে?

“স্কুলে গিয়ে সবার সামনে আমাকে আহিয়ানের ভূতনি বউ বলছ ডেকেছ! বাচ্চাদের গার্জিয়ান আর বাচ্চারা হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বলি.. ঘরে তো মা বলে ডাকে না তাই বলে কি বাইরেও এই কথা বলবে।‌আমার মান সম্মান এভাবে খাবে। ইয়ান কে দেখুন। আমার লক্ষী বাবাটা। ঘরে আর যাই ডাকুক না কেন বাইরে ঠিক’ই আম্মু ডাকে।

“অরনি কে বলে দিও তাহলেই তো হয়ে যাবে

“আহ কি সুন্দর কথা। এই ৮ বছরে যার বাপকে ঠিক করতে পারলাম না তার মেয়ে কে নাকি আমি ঠিক করব। এই রেহাই দিন তো আমায়!

“তা তুমি এই কাঁথা কার জন্য সেলাই করছো।

“কার আবার আপনার বাঁদর মেয়ে। শীত তো আসছে, কাঁথা ছাড়া কি উনার ঘুম আসবে না। দেখতেন কেমন আদরে স্বরে বলে আম্মু আমাকে একটা কাঁথা সেলাই করে দিও। তাতে সুন্দর সুন্দর ফুল আকবা ঠিক আছে!

“তাহলে ওটা কার জন্য!

আমি আবারো কাথা সেলাই করতে করতে বলি,
“এটা হলো আমার বাবা টার। ওর টা শেষ অরনি টা আর একটু আছে।

“আচ্ছা সকালে করো, অনেক রাত হয়েছে এখন ঘুমাও!

“তা করে হবে। আপনার মেয়ে এই এলো বলে। এসেই বলবে..

তখনি দরজার বাইরে থেকে কার্টুন আঁকা নাইট ড্রেস পড়া মেয়েটা বলে উঠে,

“আহিয়ানের ভূতনি বউ আমার কাঁথা কোথায়? আমি ঘুমাবো নাহ!

“এসে পড়েছে!

আহিয়ান এসে অরনি’র সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে,
“আমার প্রিন্সেস মামনি! ঘুমায় নি এখনো।

“দেখো না আব্বু আম্মু কে সেই কখন থেকে বলেছি কাঁথা বানিয়ে দিতে এখনো বানায় নি। দাঁড়াও তো..

বলেই বিছানায় উঠে গেল। ইয়ানের কাঁথা টা হাতে নিয়ে বলে,
“এই তো কাঁথা, তুমি এটা আমাকে দেও নি কেন?

“এটা তোমার না আমার বাবা টার। তোমার টা এইতো বাকি।

“তোমার মেয়ে আমি নাকি ওই ভাল্লুক টা!

“একদম আমার বাবা টাকে পঁচা পঁচা কথা বলব না।

“ভাল্লুক’র মতো এতো মোটা হলে আমি কি বলবো।

“বেশি কথা বলছো। আমাকে আম্মু তো তুমি বলো না, বলে আমার বাবাটা। তাই ওকেই আগে দেবো।

“আব্বু তুমি শুনলে!

“শুনেছি মামনি, থাক না তোমার টা এখুনি হয়ে যাবে। এমনেতেও আমার মামনি অনেক সুইট। ওর কাঁথা পরে বানালে যা আগে বানালেও তা।

“আমার ভালো আব্বু!

“হ্যাঁ এভাবেই মেয়ের মাথা টা খেয়েছে!

আহিয়ান অরনি কে কোলে করে নিচে নামাল। আর্বিভাব হলো ইয়ানের। তার হাতে একটা খাতা। সে এসে আহিয়ানের কাছে বলল অরনি তার আঁকা ছবি নষ্ট করে দিয়েছে! অরনি আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

“বেশ করেছি, তুমি কেন আমার থেকে বেশি পাবে।

আহিয়ান বলে উঠে,
“তাই বলে তুমি এই পঁচা কাজ করবে। এটা কি ঠিক অরনি!

অরনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
“সরি আব্বু!

“ইয়ান কে সরি বলো।

“সরি ভাল্লুক!

“আহি! দেখেছ ও আমাকে ভাল্লুক বলছে!

“মামনি!

“ভাল্লুক কে ভাল্লুক’ই বলব! ভাল্লুক ভাল্লুক ভাল্লুক!

“অরনি!

বলেই সে অরনি কে ধরতে তার পিছনে গেল। অরনিও দৌড়। দুজনে পুরো ঘর জুরে দৌড়াদৌড়ি আবার জিনিসপত্র এলোমেলো করছে। আহিয়ান কোনমতে তার ফাইল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে তার চারদিকে ঘুরছে। আহিয়ান তাদের থামানোর চেষ্টা করছে। আর দর্শক হচ্ছি আমি যে কিনা খাটে বসে এসব দেখছি। ভালোই লাগছে এভাবে তাদের কান্ডকারখানা দেখতে।

ভালোবাসা! যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে ভালোবাসা কি তাহলে আমি এদের তিন জনকে দেখিয়ে বলব এই হলো ভালোবাসা! আমার চিরসুখের স্থান। কেউ একজন বলে ছিল আঁধারের পরেই আলোর আগমন। এখন যদি বলি আমার অতীত আমার আঁধার তাহলে বলবো আহিয়ান হলো সেই আলো আনার প্রতিক! আমার সেই ভালোবাসা যে কিনা আমাকে আঁধার থেকে আলোতে নিয়ে এলো। আমাকে এতো সুন্দর একটা এতো সুখি একটা জীবন উপহার দেওয়ার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ বলব না, বলব আমি আপনাকে ভালোবাসি!

#সমাপ্ত

( অবশেষে এই গল্পটার সমাপ্তি ঘটল। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ এতো দিন ধৈর্য্য সহকারে গল্পটা পড়ার জন্য। আশা করব সবাই আজ ছোট করে হলেও একটা কমেন্ট করে বলবেন কেমন লেগেছে। ভালোমন্দ সবকিছু বলবে। ভালোলাগা টা মেনে নিবো আর খারাপ লাগা টা মনে রাখব যাতে পরিবর্তিতে এমন না হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here