ভালোবাসার ফোড়ন ২ পর্ব ২০

0
1048

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২০ ( #ভূতনি )

“আহিয়ান..!

আমার আওয়াজ পেয়ে আহিয়ান এক পা সামনে আগালো, আর পেয়ারা টা তার গা ঘেঁষে নিচে পড়ল। তারা সবাই অবাক হয়ে উপরে তাকাল। আমাকে এভাবে গাছে দেখে সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো, শুধু আহিয়ান’ই চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল। সবার এমন চাহনি দেখে আমি খানিকটা অস্বস্তি বোধ করলাম। আকাশ ভাইয়া বলে উঠে,

“নিহা তুমি!

“ভাইয়া আস্তে বলুন!

নাহান ভাইয়া বলে উঠে,
“কেন?

আমি খানিকটা আমতা আমতা করতে থাকি। এর মাঝেই আমার বিচ্ছু বাহিনী সেখানে আসে। ওদের দেখে তারা আরো অবাক হয়। ফুলি বলে উঠে,
“দেখছেন না আপা পেয়ারা গাছে উঠছে,‌জোরে কথা কইলে তো মালিক আইয়া পড়বে।

নদী বলে উঠে,
“তখন আমাগো সবাইরে পিটাইবো, বুঝলেন।

আকাশ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে মিন মিন গলায় বলে,
“তুমি চুরি করতে এসেছো নিহা!

আমি আমতা আমতা করতে থাকি। আহিয়ান বলে উঠে,
“শুধু কি চুরি তার সাথে আমাকেও মারার প্ল্যান করেছে!

“এই এই কি বললেন আপনি!

“বলেছি আমাকে মারার প্ল্যান করেছো তুমি, তাই গাছ থেকে আমার মাথায় পেয়ারা মারছো। পেত্নির মতো গাছে চড়ে আছে তার সাথে আমাকে মানুষ কে মারতেও চাইছে। ভূতনি কোথাকার!

“এই এই একদম বাজে কথা বলবেন না! পেয়ারা’র আঘাতে কোন মানুষ মরে না। যদি মাথায় ডাব ফেলতাম তা অন্য কথা। আর এছাড়াও আপনাকে বাঁচিয়েছি আমি!

আনাফ ভাইয়া বলে উঠে,
“বাহ মারবেও তুমি আর বাঁচাবে ও তুমি!

আহিয়ান দুই হাত বাহু তে গুঁজে বলে,
“ওহ আচ্ছা তাহলে আমার মাথায় ডাব ফেলবে তুমি!

আনমনে বলে উঠি,
“যদি পারতাম তো সত্যি সত্যি ফেলতাম!

উনি একটু জোরে বলে,
“কি বললে তুমি!

আমার বিচ্ছু বাহিনী গুলো তাকে আস্তে করে বলে উঠে,
“আস্তে কথা কন,জোরে কেন কইতাছেন। মালিক তো আইয়া পড়বো!

আহিয়ান বাঁকা হেসে বলে,
“মালিক এসে পড়বে না মালিক তোমার সামনে দাঁড়ানো! আমাদের বাগান এইটা, আর আমাদের বাগানে চুরি করতে এসেছো তোমরা। দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমাদের!

আহিয়ানের কথা শুনে ওরা সবাই ভয় পেয়ে যায় তার সাথে আমিও। একটু শুকনো ঢোক গিলে বলি,
“কি বললেন আপনি!

“যা শুনলে তুমি! এখন নিচে নামো জলদি!

ফুলি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“আপনে কি আমগোরে গাছের লগে বাইধা রাখবেন!

মিলি বলে উঠে,
“আল্লাহর দোহাই লাগে এমন কইরেন না, আমগোরে তাইলে আর ঘরে ঢুকতে দিবো না!

নদী কেদে কেদে বলে উঠে,
“আমাগোরে ঘর থেকে বাইর করে দিবো!

রুবি কিছু না বলে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করে। আমি উপর থেকে সব দেখছি। মেয়ে গুলো ভালোই অভিনয় করতে পারে। তারা একটু অন্যমনস্ক হলেই সব গুলো দৌড়ে পালাবে তারপর ওদের আর পায় কে!

আহিয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে,
“চুরি করার সময় মনে ছিল না।

মিলি বলে উঠে,
“এবারের মতো মাফ কইরা দেন! জীবনে প্রথম বার চুরি করতে আইছি।

আমি বির বির করে বলি,
“ডাহা মিথ্যে কথা!

“চুপচাপ এখানে দাঁড়াও, একজন ও পালাবে না। আর যদি তোমরা পালাও তাহলে তোমাদের আফা কে গাছের সাথেই বেঁধে রাখবো। আর এই যে তুমি ভূতনি! নামছো না কেন এখনো, নাকি গাছেই ঘর বানিয়ে থাকবে বলে ভেবে রেখেছো!

আমি বলে উঠি,
“নামছি নামছি!

বলেই গাছ থেকে পেয়ারা গুলো ছুঁড়ে নিচে মারলাম। ওরা সেসব কুড়িয়ে উঠালো। আমি গাছ থেকে নামতে থাকি। অতঃপর আহিয়ানের সামনে এসে দাঁড়াই। আহিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। আহিয়ান বলে উঠে,

“এতো বড় মেয়ে হয়ে এই পিচ্চি দের সাথে এসেছো পেয়ারা চুরি করতে, লজ্জা করে না তোমার!

মাথা উঁচু করে উনার দিকে তাকাই, মনে মনে বলি,
“আসছে লজ্জা করে না বলতে, লজ্জা কেন করবে। চুরি বিদ্যা তো মহাবিদ্যা! আর বিদ্যা শিখতে বুঝি লজ্জা লাগে।

ফুলি বলে উঠে,
“আমগোরে পিচ্চি কেন বলছেন, আমগোরে দেখতে কি পিচ্চি মনে হয়।

আহিয়ান বলে উঠে,
“না পিচ্চি না, তোমরা হলে ভূতের সাথে থাকা পেত্নি গুলা!

ফুলি মুখ ফুলিয়ে থাকে। আমি উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকি। উনি বলে উঠেন,

“তোমার চাচা কে ডাক দেবো!

“( আমি মাথা নেড়ে না বলি )

“এতো বড় মেয়ে হয়ে চুরি করছো!

উনার কথা শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। কিছুই বলছি না। হঠাৎ উনি ধমক মেরে বলে উঠে,

“কি হলো!

উনার ধমকে কেঁপে উঠলাম আমি। আকাশ ভাইয়া বলে উঠে,

“আহিয়ান ছাড় এবার, ওরা প্রচুর ভয় পেয়েছে!

বলেই আকাশ ভাইয়া হেসে উঠে। আহিয়ান বলে উঠে,
“যাও এখন বাসায় যাও!

“চাচা কে কিছু বলবেন না তো।

“সেটা তোমাকে বলবো না আমি

আমি আর উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। কারন উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করাই মানে কপাল চাপড়ানো। কোন লাভ’ই হবে না। শুধু পাড়বে একগাদা জ্ঞান শুনাতে। ধুর! এখন তো মনে হচ্ছে পেয়ারা টা মাথায় পড়লেই বেশ ভালো হতো!

হঠাৎ উনিই আবার বলে উঠে,
“যাও বাসায় যাও!

উনার কথায় বাধ্য মেয়ের মতো সবাইকে নিয়ে চলে যেতে নিই। অতঃপর আবারো ফিরে আসি আর সবার হাতে একটা একটা করে পেয়ারা দেই। আকাশ ভাইয়া এক গাল হেসে আমার হাত থেকে পেয়েরা টা নেয়। আহিয়ান কে দেবার আগে জিজ্ঞেস করি,

“খাবেন!

“না!

“তাহলে আর আপনাকে দিয়ে অপচয় করে লাভ নেই।

“কি বললে!

“কিছু না টা টা..

বলেই আমি দূর! আমার সাথে সাথে পিচ্চি গুলোই দৌড়! এক দৌড়ে আমরা বাগানের বাইরে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সবাই হাঁপাতে থাকি। ফুলি বলে উঠে,

“আফা এই লোক টা কেডা গো!

“গোমরামুখো দেখেছিস কখনো।

“এইডা আবার কি জিনিস।

“কিছু না। চল এখন বাসায় যাওয়া যাক! নাহলে আম্মু আর ঘরে ঢুকতে দেবে না।

“তারা যদি তোমার চাচা রে সত্যি সত্যি সব কিছু কইয়া দেয়। তহন..

“মনে হচ্ছে না বলবে। আকাশ ভাইয়া খুব ভালো তিনি বলতে দিবেন না। আর চাচা জানলেও আম্মু কে কিছু বলবে না।

“তাইলে তো ঠিক আছে। খালা না জানলে আর কোন সমস্যা নাই। হেই তো মেইন লিডার!

ফুলির কথায় সবাই হেসে দিলাম। মিলি আমার হাতে পেয়ারা দিয়ে বলে,
“আফা খাইয়া দেখো খুব মিষ্টি খেতে!

আমি পেয়ারা টা হাতে নিয়ে বলি,
“চুরি করা জিনিস খেতে সবসময়ই মিষ্টি হয়, আফসোস উনি এটা খেলেন না।

“এই উনি টা কে গো আফা!

ফুলি বলে উঠে,
“ওই গোমরামুখো টা তাই না আফা।

“ঠিক বলছিস। এক নাম্বারের যা তা।

“এই যা তা আবার কি।

“জানি না। তবে মনে হয় অনেক খারাপ কিছু। কারন উনাকে দেখলে আমার শুধু এইটাই মাথায় আসে।

নদী বলে উঠে,
“আফা কে যেনো আইতাছে!

নদীর কথায় আমরা সবাই উড়না দিয়ে মুখ ঢেকে নিলাম। একজন লোক আসছিল। তাকে আমি চিনি এই গ্রামের’ই সে। সে আমাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আমরা সবাই মাথা নিচু করে দৌড়ে চলে এলাম সেখান থেকে।
.
বাসায় আসার পর মার কাছে অনেক বকা শুনলাম। তবে ভালোই লাগছিল আজ এতো দিন পর মা আমাকে বকা ঝকা করল‌। তবে ভালো লাগছিল বলেই হয়তো অনেক বকল। এক পর্যায়ে বাবা থামাল তাকে। আমাকে এবারের মতো সেই বাঁচিয়ে নিল!

দুপুরে সবাই মিলে খেতে বসেছি। ভালোই লাগছে এতোদিন পর সবাই একসাথে খেতে বসেছি। মা আজ লাল শাক দিয়ে চিংড়ি মাছ দিয়ে রান্না করেছে, আর ইলিশ মাছের ঝোল করেছে। গরম গরম ভাতের সাথে মা আমাকে একটা ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে বলেন,

“তোর জন্য ভেজে রেখেছি! আগে এটা দিয়ে খা।

কথাটা শুনে খুব ভালো রাখল। কতোদিন পর মা আমাকে আদর করে খাওয়াচ্ছে। ইলিশ মাছ দিয়ে খেতে না খেতেই মা আমার পাতে শাক আর চিংড়ি মাছ দিয়ে রান্না করা তরকারি দিল। আমি চিংড়ি মাছের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ করেই মনে পড়ল এই চিংড়ি মাছের জন্য সেদিন মুন্নি আপুর কাছে কতো কথা শুনলাম। কতো কটু কথা বলল আমায় সে। এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মা আমার মাথায় হাত রেখে বলে,

“ভাতের থালা নিয়ে বসে আছিস যে।

বাবা বলে উঠেন,
“ওকে আরেকটু ভাত দাও!

“না বাবা আর নেবো না আমি।

চাচা বলে উঠেন,
“খেয়ে নে মা। ওখানে একা একা কি খেয়ে থাকিস তুই কে জানে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করিস তো।

“হুম চাচা করি তো!

“তা ভালো, খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করবি বুঝলি!

“হুম!

অতঃপর আবারো সবাই মিলে খাওয়া শুরু করলাম। বিকেল বেলায় ফুলি কাঁথা নিয়ে এসে হাজির। সে কাঁথা সেলাই করবে আমাকেও তার সাথে করতে হবে। আমিও বসে পড়লাম।
কাথা সেলাই করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। গ্রামে সন্ধ্যে হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে যায়। শহরে তো বড় বড় ল্যাম্পপোস্ট আছে। তারা শহরের অন্ধকার দূর করে আলোকিত করে কিন্তু গ্রামে সেই ব্যবস্থা নেই।

ফুলির বাসাও আমাদের বাসা থেকে অনেক দূরে। আমি হারিকেন টা নিয়ে ফুলি কে এগিয়ে দিতে উঠে গেলাম। মা তখন বাবা’র কাছে ছিল তাই আমি একাই গেলাম। ফুলি কে অনেক খানি এগিয়ে দেবার পর এক একা আসতে লাগলাম।

আহিয়ান দের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়ি থেকে আলো এসে রাস্তায় পড়ছে। বাড়িটা কে দেখতে এখন বেশ লাগছে। আমাদের এখানে কারেন্ট আছে, সেটা সবার বাড়িতে বাড়িতে! কিন্তু এখানে প্রায়ই লোডশেডিং হয়, আজও তাই হলো। হুট করেই লোডশেডিং হয়ে গেল।

লোডশেডিং হবার কারনে চারদিক আরো অন্ধকার হয়ে গেল। কি মনে করে হ্যারিকেন নিয়ে ঢুকলাম আহিয়ান দের বাড়িতে। চাচা’র কাছ থেকে শুনেছিলাম আহিয়ান নাকি আজ তাদের এতিম খানা ঘুরে দেখেছিল। কয়েকদিন পরই মিলাদ হবে সেখানে। এর সাথে এতিম খানা সংস্কার করবে সে। উদ্যোগ টা বেশ ভালো।

দাড়োয়ান আমাকে চিনতো তাই সদর দরজা খুলে দিলেন। ওদের বাড়ির সামনে বিশাল জায়গা জুড়ে উঠোন। এখানে বড় বড় গাছ লাগানো,‌ কিছু ফুলের গাছও আছে। ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছি আমি। বসার ব্যবস্থা ও আছে দেখছি। দেখলাম একটা ছোট টেবিলের উপর চায়ের কাপ রাখা। ধারনা করলাম তারা হয়তো এতোক্ষণ এইখানেই বসে ছিল। আমি হারিকেন টা মুখের সামনে নিয়ে হাঁটা ধরলাম বাড়ির ভিতরের দিকে।

একটু হাটতেই দেখলাম নাহান ভাইয়া কে। তার হাতে ফোন ছিল। ফোন টিপছিলেন। সেই আলোতেই চিনলাম তাকে। আমি তাকে ডাকতে যাবো এর আগেই তিনি আমার দিকে ঘুরলেন। আমি তাকে দেখে একটা মুচকি হাসি দিলাম। আচমকা তিনি আমাকে দেখে ভূত বলে চেঁচিয়ে উঠলো। তার চেচানোতে আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। তার আওয়াজে আনাফ ভাইয়া, আকাশ ভাইয়া আর আহিয়ান ছুটে এলো। সবার হাতেই ফোন। প্রথমে আনাফ ভাইয়া আমাকে দেখে ভূত বলে চেঁচিয়ে উঠলো। তিনি দৌড়ে গিয়ে আহিয়ানের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। নাহান ভাইয়া ও সেটাই করলেন। উনি দুজনের এমন কান্ড তে বেশ বিরক্ত। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে তাদের কান্ড দেখছি। আমাকে দেখতে কি ভূতের মতো লাগে নাকি। আজব!

হঠাৎ আকাশ ভাইয়া বলে উঠে,
“নিহা নাকি!

আকাশ ভাইয়া’র কথায় আহিয়ান আমার দিকে তাকাল। তিনি আমাকে দেখে চেঁচামেচি করলেন না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমিও হারিকেন’র আলোতে দেখছিলাম তাকে। অতঃপর!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here