ভালোবাসার ফোড়ন ২ পর্ব ৬০

0
1000

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৬০

মেঝেতে বসে চোখ বন্ধ খাটে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম। কারো ঘরে আসার শব্দ পেলাম। আমি জানি এটা আহিয়ান তবুও চোখ মেলে তাকালাম। আহিয়ান শীতল চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার চোখ ভিজে একাকার। আহিয়ান আমার এসে বসল।‌ আমি হাত পা গুটিয়ে বসলাম। উনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে যেতেই উনি সেটা মুছে দিলেন। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি উনার সাথে কোন কথা বলবো না। কোনমতেই না।

হুট করেই আমাকে কোলে তুলে নিলেন উনি। এমন কিছু হওয়াতে ভয় পেয়ে গেলাম।‌ আমি উনার গলা জরিয়ে ধরলাম। অতঃপর মনে পড়তেই গলা ছেড়ে দিলাম। উনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আমাকে ফেলে দিতে নিলেন। আমি ভয়ে উনার গলা জরিয়ে ধরলাম।‌ উনি মিটিমিটি হাসলেন। কেন হাসছেন উনি, এভাবে হাসার কারন কি?

আমাকে নিয়ে ঘরে চলে এলেন উনি।‌ বিছানার এক কোনে এসে আমাকে রাখলেন। আমি শুয়ে পড়লাম। উনি আবারো হাসলেন কিন্তু কিছু বললেন না। ঘরের বাতি বন্ধ করলেন তবে তার কোনের ল্যাম্পশ্যাডের বাতি টা এখনো জ্বলছে। উনি এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আমি এদিকে ঘুরে উনার মুখ দেখতে পেয়েই আবারো ঘুরে ওপাশে গেলাম। উনি বলে উঠেন,

“ভূতনি তুমি কি কথা বলবে না!

আমি কিছুই বললাম না। কেন জানি মনে সেই মেয়েটার কথা কানে বাজছে যাকে উনি বলেছেন ভালোবাসেন। আমার করা আজকের কাজটা একদম ঠিক হয় নি। উনি তো আর আমাকে ভালোবাসেন না। নিজের ভালোবাসার কথা বলে আমি বোকামি করেছি। উনার কাছে এখন নিজেকে ছোট বলে মনে হচ্ছে। একদম’ই ঠিক হয় নি, আবেগে বশিভূত হয়ে এমন একটা কাজ করার। হঠাৎ এর মাঝেই উনি বলে উঠেন,

“তুমি ভুল করেছ? তোমার আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমার কথাটা শোনার দরকার ছিল।

আমি এখনো নিশ্চুপ, শুধু একটু নড়েচড়ে উঠলাম। উনি আবারো বলে উঠেন,

“আমি কাকে ভালোবাসি সেটা কি তুমি জানতে চাও না!

উনার কথায় আমি উঠে বসলাম। তখনকার সেই স্বপ্নের কথা মনে পড়ল। স্বপ্নতে আমার স্পষ্ট মনে আছে উনি বলেছেন উনি আমায় ভালোবাসেন। তাহলে এটাই কি সত্যি! আমি উনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠি,

“বলুন!

উনি পাশ ফিরিয়ে আলো নিভিয়ে বলে,
“রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো এখন আর শোনার দরকার নেই। আমার ঘুম পাচ্ছে!

বলেই উনি ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি ইচ্ছে করেই শুয়ে রইলেন বুঝতে পারলাম না। অনেক ডেকেছি আমি কিন্তু উনি সাড়া দেন নি! কিছু বুঝতে না পেরে আমিও শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম আসলো না। আজ সারাদিন শুধু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়েছি।কিছু একটা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম। কাকে নিয়ে ভাববো। উনাকে নিয়েই ভাবতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম আজকে উনার আর আমার কথা। কি করলাম আমি আজ।‌ ভাবতেই আমার শরীর শিউরে উঠছে!
.
ভোরের দিকে আমার চোখে ঘুম ঘুম ভাব আসতে লাগল। আর আমি ঘুমিয়ে ও গেলাম।‌ কিন্তু সেই ঘুম ভেঙেও গেল। ঘুমের মাঝে মনে হলো কেউ আমার কপালে চুমু খেল। আমার মাথায় হাত বোলাল। কিন্তু চোখ মেলতেই কাউকেই পাশে দেখতে পেলাম না। পাশ ফিরিয়ে উনাকেও দেখলাম না। আমি উঠে ওয়াশরুম এর দিকে গেলাম। না সেখানে নেই উনি। কি মনে হতেই বেলকনির কাছে গেলাম। দেখি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন আমি।

সামনে তাকিয়ে দেখি ফুরফুরে বাতাস বয়ে যাচ্ছে।‌ গতকাল পুরো রাতেই বৃষ্টি হয়েছিল কারণ এখন পুরো আকাশ পরিষ্কার! বৈশাখের দিন গুলো এমন’ই হয়।‌ দিন রাত শুধু বৃষ্টি হতেই থাকে। মাঝে মাঝে দেখা যায় টানা ৩ ৪ দিন ধরে বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে! কেন জানি মনে হলো এখন আকাশ পরিষ্কার হলেও আবারো তা মেঘে ঢাকা পরে যাবে। প্রকৃতি আবারো মেতে উঠবে বৃষ্টিবিলাসে!

উনার কোন চিন্তা ভাবনা নেই শুধু সামনেই তাকিয়ে আছেন।‌ আমি তাকিয়ে আছি উনার দিকে।‌ সিগারেট খাওয়া শেষ করে তাকালেন আমার দিকে। আমি শীতল চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি হেঁটে আমার কাছে এলেন। আমি বলে উঠি,

“আপনি বলবেন না কে সে, যাকে আপনি ভালোবাসেন!

উনি আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমার দিকে আগাতে লাগলেন। আমি সেখানেই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার এতো কাছে এসে উনি হঠাৎ করেই উনার এক হাত আমার কোমরে রাখলেন। আমি এবার যেন জমে যাচ্ছিলাম। চোখ বড় বড় করে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি ঠিক কি করতে চলেছেন। উনি আমার দিকে এগিয়ে এসছেন। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি।‌ উনি আমার আরো কাছে আসছেন।‌ আমি চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ করেই উনি আমার কানের কাছে এসে বলেন,

“কাকে ভালোবাসি এটা সময় হলেই বলবো!

বলেই উনি আমাকে ছেড়ে ঘরে চলে গেলেন। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুই হাত বাহুতে গুজলাম। কি ভাবছিলাম আর কি বলে গেলেন উনি!
.
খাবার টেবিলের যে পাশে আমি বসে আছি তার উল্টো পাশে উনি।‌ আজ আমার পাশে না বসে বিপরীত দিকে বসেছেন।‌ ইচ্ছে করেই বসেছেন। এখন আর আমাকে ভালো লাগছে না। ভালো লাগবে কেন, যাকে ভালোবাসে তাকেই তো ভালোলাগবে!
এসব বির বির খেতে লাগলাম। উনি জুসের গ্লাস টা হাতে নিয়ে বলে উঠেন,

“আজ আমি আপুদের বাসায় যাবে না।

“কেন?

“আমার কাজ আছে তাই।

বির বির করে বলি,
“জানি তো কি কাজ, নির্ঘাত ওই মেয়েটার সাথে দেখা করতে যাবে।

“বির বির কি করছো?

“কিছু না, আপনি না গেলে আমি একা যাবো কি করে?

“যেও না, বাইরে যাবার সময় ইতিদের বাসায় দিয়ে আসবো পরে আমি আসার সময় নিয়ে আসবো।

“আপনি বাড়িতে ফিরবেন কখন?

“ঠিক নেই রাত হতে পারে!
বলেই উঠে গেলেন। আমি জুসের গ্লাস টা হাতে নিয়ে ভাবছি উনার পিছু করলে কেমন হয়!
.
অতঃপর উনি আর আমি বের হলাম। বরাবর উনিই আমার গাড়ির দরজা খুলে দেন কিন্তু আজ তা করলেন না। নিজেই আগে গিয়ে বসে পড়লেন গাড়িতে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

আমি গাড়ির বাইরে থেকে উনাকে দেখছি। উনি ইশারা করে বলেন গাড়ির ভিতরে আসতে। কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে গাড়িতে বসলাম। রাগে আমার শরীর জ্বলছে। কেন জানি মনে হচ্ছে আজ উনি আমায় পাত্তা দিচ্ছেন না। আমার’ই ভুল হয়েছে উনাকে ভালোবাসার কথাটা বলা। মোটেও উচিত হয় নি। বলেই এখন ফেসে গেছি।

আমি সিটে আরাম করে বসে উপরের আয়নার দিকে তাকালাম। উনাকে দেখা যাচ্ছে আয়নাতে।‌ খুব সুন্দর লাগছে উনাকে। উনি মনে হয়ে একটু বেশিই সুন্দর! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, বেশি সুন্দর বলেই আজ এই অবস্থা! সবসময় দেখি মেয়েরা উনার চারপাশে ঘুরঘুর করে। আমার ধারনা ছিল উনার জীবনে হয়তো আমি’ই আছি।‌ কিন্তু না আরো কেউ আছে। যদি এমন না হতো তাহলে গতকাল রাতেই উনি আমাকে ভালোবাসে এটা বলতেন। কিন্তু উনি তা বলেন নি। ছেড়ে দিয়েছেন আমায়…
.
গাড়ি এসে থামল ইতিদের বাড়িতে কিন্তু সেখানে আমার ভাবনা নেই। আমি তাকিয়ে আছি উনার দিকে। উনি আমার সামনে চুটকি বাজিয়ে বলেন,

“ভূতনি!

আমার বোধ হলো। উনি বলেন,
“কার ভাবনায় ডুবে আছে!

গলার স্বর নিচু করে বলি,
“আপনার!

“কি বললে?

“কিছু না।

“ইতিদের বাসার সামনে এসে পড়েছি।

“ওহ আচ্ছা!

অতঃপর গাড়ি থেকে নামলাম। গাড়ির দরজা বন্ধ করে বলি,
“আপনি কখন আসবেন।

“ঠিক নেই, দেরি হতে পারে।

অতঃপর উনি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলেন। আমি উনার গাড়ি চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম। খুব তাড়ায় ছিলেন উনি। উনার পিছনে যাওয়ার মত পাল্টে ইতির বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
.
ইতি’র ঘরে আসতেই ইতি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,

“কিরে ফেরত এলি যে!

আমি কাঁধের ব্যাগ টা নিয়ে ওর দিকে ছুড়লাম। ইতি ব্যাগ টা ধরে বলে,
“নিহা!

আমি ধপ ধপ করে হেঁটে বিছনায় শুয়ে পড়ি। বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকি। ইতি এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“কিরে মন খারাপ।

“কথা বলিস না।

“কি হয়েছে সেটা বল? গতকাল’ই তো বাসায় গেলি এখন যে চলে এলি।

“আসি নি নিয়ে এসেছে।

“কে?

“উনি!

“ভাইয়া এখানে দিয়ে গেছে।

“বলেছে কোন কাজে যাচ্ছে, যাওয়ার সময় তোর বাসা থেকে আমাকে নিয়ে যাবে।

“ওহ তো এতে মন খারাপের কি আছে! ভালোই তো হলো, আমি আর তুই আজ সারাদিন গল্প করব।

আমি চট করে উঠে বসে পড়ি। শান্ত গলায় দ্রুত বলি,
“উনি একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন।

“মেয়ে মানে কোন মেয়ে?

“ওই মেয়ে যাকে উনি ভালোবাসেন।

“কি বলছিস এসব!

আমি ইতির কোলে মাথা রেখে বলি,
“উনি আমাকে ভালোবাসেন না ইতি,‌ অন্য কোন মেয়েকে ভালোবাসেন। আজ তার সাথেই দেখা করতে যাচ্ছেন।

মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,
“তোকে এসব কে বলল ভাইয়া!

“বলে নি আমি জানি।

“হ্যাঁ কচু জানিস।

“আমি যা জানি তুই তা জানিস না ইতি। গতকাল রাতে উনাকে ভালোবাসি কথাটা বলেছিলাম..

“কি সত্যি! বাহ এই তো আমার বান্ধবীর মতো কাজ। তা ভাইয়া কি বলল।

“কি আর বলবে, সঙ সেজে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুই বলে নি।

“কিছুই বলে নি।

“না বলে নি। শুধু রাতে ঘুমানোর সময় বলেছে উনি কোন মেয়ে কে ভালোবাসেন।

“সেটা তো তুইও হতে পারিস।

“যদি আমি হই, তাহলে আমাকে বলা উচিত না, যে নিহা আমি তোমাকে ভালোবাসি!

“বলে নি বলবে!

“না আর বলবে না। ইতি আমার মনে হচ্ছে আমি উনাকে হারিয়ে ফেলব।

“তুই বেশি ভাবছিস। গরমে তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।‌ বোস আমি তোর জন্য ঠান্ডা শরবত নিয়ে আসছি!
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো,‌ গৌধুলিও হয়ে গেল।‌ প্রকৃতি তার রং বদলালো, পাখিরা তাদের নীড়ে ফিরে গেল।‌ শুধু আমিই বাকি রয়ে গেলাম। সব কিছু শান্ত, স্থির, নিস্তব্ধ! আকাশ মেঘে ঢাকা যাচ্ছে। চারদিক আঁধারে ডুব দিল। ওদের সাথে নিজেকেও আঁধারের ভেতর নিয়ে গেলাম। এতো সময় পেরিয়ে গেল কিন্তু উনি এখনো এলেন না এমনকি একটা কলও করলেন না। অথচ উনার কল’র আশায় উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছি আমি।

ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবছি নিজেই একটা কল করি। অতঃপর আবারো ফোন টা রেখে দিলাম। কেন কল করব আমি। আমার কি দায় পড়েছে। আমি ভালোবাসি বলেই কি উনার সবকিছু মেনে নিব। দায় কি আমার একার উনার কি নেই। বিয়ে তো উনি আমাকে করেছেন তাও জোর করে। তাহলে এখানে আমার দোষ কোথায়? আমি তো আর বলি নি আমাকে বিয়ে করতে, বলিনি আমায় এতো কেয়ার করতে, এতোটা আগলে রাখতে। বলি নি আমাকে গুরুত্ব দিতে, অন্ধকার রাস্তায় আমার হাত খানা শক্ত করে ধরতে, সবসময় আমার পাশে দাঁড়াতে। তবুও উনি এসব করেছেন। এখন যখন বললাম আমায় ভালোবাসুন ওমনি উনি পিছিয়ে গেলেন…

হঠাৎ করেই ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠলো। আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি উনার নাম ভেসে উঠলো। দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই..

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here