বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব ৮

0
782

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ?
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

০৮.
‘শুনুন’
আদর পেছন ফিরে তাকালো, ‘জি বলুন।’
‘চলুন।’
‘কোথায়?’
‘ওমা! ছাদে।’
‘ওহ…আসছি।’
টিকলি চলে গেলো। আদর খানিকক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। টিকলি যখন এসে বলল ‘শুনুন’। মিনিট খানিকের জন্য তখন আদরের হৃদপিন্ডের পিঞ্জরাস্থিতে ধুকপুক শব্দগুলো বন্ধ হয়ে গেলো। নিঃশ্বাস আটকে গেলো। হারিয়ে ফেলল নদীর কূল। দিশেহারা মন বারবার চাইলো আর একবার…একবার ওইভাবে ডাকুক। একবার না বহুবার…বহুবার ডাকুক।

,

ছাদে একটা উড়না বিছিয়ে দিয়েছে টিকলি। বলেছিলাম, টিকলি বিনয়ী, নম্র-ভদ্র অকারণে কোনো মানুষের সাথে হাঙ্গামা, খারাপ ব্যবহার কিংবা অবহেলা করা তার ধাঁচে নেই। সে খুব সহজে বিনয়ী হয়ে মিশতে পারে মানুষের সাথে। সবার কাছে নম্র, ভদ্র, নরম, সুশীল হলেও একজনের সামনে গেলেই তার মাথা কেনো জানিনা আওলিয়ে যায়। সেই অভদ্র ছেলেটা, যে কিনা কথায় কথায় সুযোগ পেলেই টিকলিকে খোঁচা মেরে শুধু পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট প্রেগন্যান্ট করে। আর তখন টিকলির মাথাও গরম হয়ে যায়।

উড়নার চার মাথায় বসে আছে ওরা চারজন। ফুরফুরে মেজাজি বাতাস। পানির গন্ধ। চাঁদের আলো। সুন্দর সাবলীল পরিবেশটায় যখন সবাই চুপচাপ টায়রা তখন বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ধ্যাত, এভাবে ভালো লাগে নাকি? বরিং…। সবাই চুপ করে আছে।’

আর্দ্র মুখ ভেঙিয়ে বলল, ‘অপরিচিত আমরা সবাই। চুপ করে থাকবো নাতো কি ধেই ধেই করে নাচবো?’

টায়রা নাক ফুলিয়ে বলল, ‘আমি আপনাকে কিছু বলেছি? আপনি এতো কথা বলছেন কেনো? আর অপরিচিত কিন্তু পরিচিত হতে কতক্ষন? এই যে আমি আমার পরিচয় দিচ্ছি। আমি হলাম টায়রা রেজা…।

টায়রার কথা আটকিয়ে দিয়ে আর্দ্র বলল, ‘সরি, আপনার ভুল হয়েছে ওটা হবে টায়ার রেজা।’

টায়রা আঙ্গুল তুলে বলল, ‘আপনি আর একটা কথা বললে আপনাকে মেরে আমি এই পানিতে ভাসিয়ে দেবো।’

‘ও মাগো, ভয় পাইছি।’ মুখে হাত দিয়ে ভঙ্গি করে বলল আর্দ্র।

আদর গম্ভীর মুখে একটা মেকি ধমক দিলো আর্দ্রকে। এরপর বলল, ‘আপনি বলুন টিকলি।’

আদর তাকিয়ে ছিলো টায়রার দিকে কিন্তু নাম বলল টিকলির। সবাই একটু হকচকিয়ে গেলো। টায়রা মুখ ভেটকিয়ে বলে, ‘টিকলি? না ভাইয়া টিকলি তো আমার বোনের নাম। আমার নাম তো টায়রা।’

এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পরে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আদর। ওর মাথায় যে শুধু টিকলি ছাড়া আর কারোর নাম ঘুরতেই চাইছে না। আদরের ভারী রাগ হলো নিজের প্রতি। এই প্রথম সে তার মনের মনিকোঠায় কি চলছে তা ঠাওর করতে পারছে না। টায়রার দিকে তাকিয়ে তোতলানো স্বরে সে বলল,

‘হ্যাঁ, ওই আসলে…এমনি। আমি উনাকেই বলতে চেয়েছি।’

টায়রা বলল, ‘তাহলে তুই আগে বল টিকলি।’

টিকলি নিচু গলায় বলল, ‘কি বলবো?’ এরপর এক মুহুর্ত চুপ থেকে টিকলি সংক্ষেপে বলল, ‘আমার নাম টিকলি রেজা। বাবা মার বড় মেয়ে। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি। থাকি ঢাকার উত্তরায়।’

এরপর টায়রা অনেক আগ্রহ নিয়ে নিজের পরিচয় দিতে চাইলো। যেনো এই পরিচয় দেওয়ার মাঝে খুব মজা। কিন্তু ব্যাঘাত ঘটালো আর্দ্র। সে মুখ দিয়ে ‘চু’ শব্দ করে বলে উঠলো,

‘হইছে, চুপ থাকেন। আরে এগুলো কি পরিচিত হওয়া হলো? এবার গভীর সম্পর্কের দিকে যাওয়া যাক। লেটস গো ইন্টু টু দ্য ডিপ রিলেশনশিপ।’

টিকলি বেসামাল স্থিকর গলায় বলল, ‘সরি? মানে বুঝলাম না ভাইয়া।’

আর্দ্র বলল, ‘ডিপ রিলেশন। মানে ধরো আজকের পর থেকে তোমাদের সাথে আমাদের অনেক ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে উঠবে। বন্ধুর মতোন।’

টায়রা অবহেলার গলায় বলল, ‘ওও..এই কথা।’

আর্দ্র টায়রাকে ভেঙচিয়ে বলল, ‘ওও..এই কথা এটা বললে চলবে না। নাম্বার দেও। ঠিকানা দেও। আমি তোমাদের বাসায় যাবো। তোমার সাথে কথা বলবো। সারাদিন আপু আপু করে পেছনে ঘুরবো। তোমাকে ভারসিটি পৌছে দিবো। মানে, যতরকম সেফটি দেওয়া যায় তোমাকে। এজ লাইক এজ ব্রাদার এন্ড সিস্টার।’

কথাগুলো আর্দ্র টিকলিকে উদ্দেশ্য করে বলল। টিকলি আদর টায়রা কিছুক্ষণ আর্দ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তাকিয়ে থাকার অর্থ, অপরিচিত মানুষকে এতো দরদ দেখানোর মানে কি? সবার তীক্ষ্ণ চাহনির সামনে পরে আর্দ্র বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে গেলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে টিকলি মিস্টি হেসে বলল, ‘ওহ এই কথা। আচ্ছা।’

টিকলি নাম্বার বলতে ধরলো। ওমনি টায়রা গালে হাত দিয়ে ভাবুক গলায় বলল, ‘বুঝলাম না কাহিনিটা। একটু আগে বললেন বন্ধুর মতো হতে চান। এখন আবার ভাই বোন? একচুয়েলি আপনি কোন ডিপ রিলেশনে যেতে চান? বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড?’ টায়রা ভ্রু কুচকে গোয়েন্দা গলায় জিজ্ঞেস করলো।

আর্দ্র মাথায় হাত দিয়ে জোরেসোরে বলল, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ! এতো বড় অপমান?’ এরপর টিকলির দিকে তাকিয়ে ইমোশনাল গলায় বলে,

‘আপু। ওহ না, তুমি তো আমার ছোট। এর আগেও আপু ডেকেছিলাম। হোয়াট এভার, তবুও আপুই ডাকলাম। দেখো, তোমার বোন কিন্তু আমার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি করছে। আমি তোমাকে নিজের বোনের আসনে বসাচ্ছি। আর সে তোমাকে টেনে আমার বউয়ের আসন দিচ্ছে। ছি ছি ছি!’

আর্দ্র লাগামছাড়া। বলেছিলাম, সে একবার বলা শুরু করলে বেশি বলে ফেলে। টিকলি লজ্জায় মাথা নিচু করে বিরবির করলো, ‘দুইটার ক্যারাক্টারই সেম।’

টিকলি মাথা উঁচিয়ে হাসি হাসি মুখ করে আবার বলল, ‘ওর কথায় কান দিবেন না ভাইয়া। আমি নাম্বার আর ঠিকানা দিচ্ছি। আপনি লিখুন।’

আর্দ্র পকেটে হাত দিয়ে কিছু খুঁজলো। অবশেষে খুঁজে না পেয়ে কপাল চাপড়ালো, ‘হায় হায়, ভাইয়া। আমার ফোন তো কেবিনে ফেলে এসেছি। তোমার ফোনটা একটু দেও তো। নাম্বারটা তুলি। পরে আবার আমার ফোনে নিয়ে নিবো।’

আদর ভ্রু কুচকে চেয়ে কিছুক্ষন বুঝার চেষ্টা করলো ভাইয়ের মতলব। আর্দ্র তাড়া দিলো। আদর পকেট থেকে ফোন বের করে লক খুলে আর্দ্রর হাতে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘অভিনয়ে তুই বড্ড কাঁচা। তুই যা ভাবছিস তেমন কিছুই না। এতো কাহিনী করে মেয়েটার নাম্বার নেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলো না।’

‘নিবো না বলছো?’ আর্দ্র ভ্রু নাচিয়ে ফিসফিস করেই বলল।
‘নাহ, যেহেতু এখন বলে ফেলেছিস। না নিলে খারাপ দেখাবে।’
‘সেটাই।’ ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল আর্দ্র।

টিকলি নাম্বার আর ঠিকানা বলল। আর্দ্র আদরের ফোনে সেভ করে রাখলো। ঠিকানাটা শুনে নিলো।সবশেষে টায়রা আছন্নহারা অমাবশ্যার ন্যায় মুখ করে বলল,

‘আপনি কি সত্যি আমাদের বাসায় আসবেন?’
আর্দ্র কাধ নাচিয়ে বলল, ‘অবশ্যই, বোনকে দেখতে আসবো না?’
টায়রা চোখ মুখ খিচে বলল, ‘না, একদম আসবেন না।’

আর্দ্র টায়রার কথা পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘আমি আমার বোনকে দেখতে যাবো আপনার তাতে কি? আপনি আপনার কাজ করুন। চুপচাপ যেভাবে বসে ছিলেন সেভাবে বসে থাকুন।’

আর্দ্র এবার টিকলির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘তোমরা দুজন দুজনের কত বছরের ছোট বড়?’
টিকলি উত্তর দিলো, ‘এক বছর। আমি বড় আর টায়রা ছোট।’
‘ওহ তার মানে উনি সেকেন্ড ইয়ারে পড়েন?’
‘নাহ, আমরা একই সাথে পড়ি।’
‘ওওও..তাই বুঝি সে তোমার নাম ধরে ডাকে?’

টিকলি টায়রার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে মাথা নাড়ালো। টায়রা টিকলির দিকে গোল গোল চোখ করে তার রাগ জানান দিলো। এরপর কিছু মুহুর্ত কেটে গেলো নিস্তব্ধে। আদর ফোনের স্কিনে একবার দেখে নিলো টিকলির নাম্বার। সবার আড়ালে নাম্বারটা সেভ করে রাখলো ‘টিকটিকি’ দিয়ে। আনমনে একটু হাসলো সে। টায়রার বাঁজ পাখির মতো তীক্ষ্ণ নজরে তা খুব সুন্দর ভাবে ধরা পরলো। সে ভ্রু কুচকে বলল,

‘আপনি হাসছেন কেনো ভাইয়া?’

আদর ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে অবচেতনায় বলল, ‘মিস. টিকটিকি।’

টায়রার ভ্রু জোড়া আরো কুচকিয়ে গেলো। স্বগোতক্তি করলো সে, ‘মিস.টিকটিকি? একটা টিকটিকি কে এতো সম্মান? বাব্বাহ!’

এদিকে আর্দ্র অবাক চোখে তাকিয়েছে। আর টিকলি তার বড় বড় দুটো চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিলো আদরের পানে। চোখে তার তেজের ছিটা। আদর উপরে মুখ তুলল। সবার এই রিয়েকশন দেখে সে থতমত খেয়ে গেলো,

‘আসলে….তেমন কিছুই না। ওই আরকি…আমি আদর করে একজনকে টিকটিকি বলে ডাকি।’

কথাটা শুনে টিকলির গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেলো। ক্ষনিকের জন্য পরে গেলো সে উত্থাল সমুদ্রে। পলকবিহীন চোখে তাকিয়ে রইল ওই শ্যামল মুখপানে। আদর টিকলির দিকে তাকালো এক বিপুল আচ্ছাদন দৃষ্টিতে। কিছুক্ষণ পর টিকলি স্বাভাবিক ভাবে চোখ সরিয়ে নিলো। টায়রা কিছুটা বাচ্চামো গলায় বলল,

‘বাহ! আদর আবার আদরও করতে জানে।’

দুজনের ঘোর ভাঙলো। আর্দ্র আবারো টায়রার উত্তরের পরীপেক্ষিতে বাঁকা উত্তর দিলো, ‘কেনো জানবে না? যার নামই আদর সেই তো আরো বেশি বেশি আদর করতে জানবে নাকি? আমার ভাইয়াও বেশি বেশি আদর করতে পারে। তার বউ অনেক হ্যাপি। আদর ভাইয়ার কাছ থেকে শুধু আদরই পাবে।’

কেশে উঠলো আদর। মুখে হাত দিয়ে সে যে কাশছে থামার নামই নেই। এই সময়ে যে এমন একটা বেক্কল কথা আর্দ্র বলবে তা আদরের ধারণাতেও ছিলো না। আদর দাঁত কটমট করলো। সত্যি ছেলেটা বলতে শুরু করলে আর ব্রেক কষে না। টিকলি সন্তপর্ণে লুকিয়ে চুরিয়ে হাসলো। টায়রা ফুসে উঠে বলল, ‘আপনার সমস্যা কি? আমি কিছু বললেই আপনার উত্তর দিতে হবে, যত্তসব।’

আর্দ্র আবারো একটা ত্যাড়া কথা বলার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলো। কিন্তু ভাইয়ের চোখ রাঙানি দেখে সে থেমে গিয়ে মেয়েদের মতো গাল ফুলিয়ে বসে থাকলো। এরপর আবারো কিছুক্ষণ নিরবতা। একটুপর টায়রা হাসি হাসি গলায় আদরকে বলল,

‘জানেন ভাইয়া টিকলি না অনেক সুন্দর গান পারে।’

টিকলি চোখ বড় বড় করে চিমটি কাটলো টায়রার হাতে। আদর বলল, ‘তাই? তাহলে তো তোমার বোনের কাছ থেকে একটা গান আমদের পাওনা।’

টিকলি জোরপূর্বক হেসে টায়রার হাতে দ্বিতীয় চিমটিটা কেটে দিলো। টায়রা ‘উহ’ শব্দ করে উঠলো। আর্দ্র রিকুয়েষ্ট করলো অনেক, ‘প্লিজ আপু। না করোনা। একটা গান গাও। জাস্ট একটা। যা খুশি গাও।’

টিকলি অসহায় চোখে একবার সবার দিকে তাকালো। আর্দ্র টায়রা হাসি মুখে বসে ছিলো। টিকলি তাকাতেই আদর মৃদুমন্দ হাসলো। টিকলি চোখ বন্ধ করলো। বন্ধ চোখের পাতায় সব গানের প্রতিচ্ছবি হাওয়া। শুধু একটা গানেরই কিছু সুর গলা দিয়ে তখন বেরিয়ে এলো। কিন্নর কণ্ঠে বন্ধ চোখের পাতার এক অপরূপা সুন্দরী গেয়ে উঠলো,

“তোর সাথে সারা নিশি ভিজবো জোসনায়,
চাঁদের আলো পরবে ঝরে তোর মুখটায় (ii)

মিলেমিশে দুজনে চল, এক হয়ে…যাই।
আদরে আদরে, অন্তরে অন্তরে…
মিশে রব দুজনায় (ii)”

মুগ্ধ হয়ে টিকলির সুরেলা কণ্ঠময় গান শুনছিলো সবাই। টিকলির সাথে তাল মিলিয়ে সবাই চোখ বন্ধ করে গান শুনছিলো। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে আদরের চোখজোড়া টপাস করে খুলে গেলো। চোখে তার একরাশ অবাকতা। আদর! তার নাম গানে? টিকলি এই গানই কেনো গাইলো? খুঁজে খুজেঁ এই গানই কেনো? টিকলি কি ইচ্ছাকৃত ভাবে গাইলো নাকি হয়ে গেছে?

টিকলি জানেনা কেনো সে এই গানটাই গাইলো। সে শুধু জানে এই মুহুর্তে তার মস্তিষ্কে অন্যকোনো গান ধরা দিচ্ছে না। টিকলি গাইতে থাকলো,

“তোর সাথে ভিজবো অঝোর বৃষ্টিতে,
রংধনু খুঁজবো তোর অবুঝ দৃষ্টিতে,
মিলেমিশে দুজনে চল, এক হয়ে যাই,
আদরে আদরে অন্তরে অন্তরে
মিশে রব দুজনায়(ii)

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here