বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব ৭

0
804

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ?
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

০৭.
লঞ্চের এই পেছনের দিকটায় মানুষের আনাগোনা কম। ভারী বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে আর্দ্র ও টায়রার তীব্র নিঃশ্বাস। প্রকান্ড তেজি শ্বাস প্রশ্বাসেই যেনো দুজনা দুজনকে জ্বলসে দিবে। টিকলি এগিয়ে এসে বলল,

‘কি হয়েছে?’

টায়রা সাথে সাথে ফুসে উঠে বলল, ‘কি হয়নি সেটা বল। এটাই সেই বেয়াদব ছেলে। হাওয়াই মিঠাই নিতে গিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করেছে।’

আর্দ্র বড় বড় চোখ করে লাফিয়ে উঠলো। আদর ভ্রু কুচকে তাকাতেই আর্দ্র কপট স্বরে বলল, ‘মিথ্যা কথা ভাইয়া। এই চাপাবাজ মেয়ে আগে আমার সাথে ঝগড়া করেছে। আপনি তো দেখা যায় চাপাবাজের সাথে মিথ্যাবাদীও।’

টায়রা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে নালিশ ঠুকার মতো টিকলির কাছে বলল, ‘দেখলি? এই বেয়াদব ছেলে আমাকে চাপাবাজ সাথে মিথ্যাবাদীও বলছে। ওকে তো আমি….’

টায়রা ছুট লাগায় আর্দ্রর দিকে। উদ্দেশ্য আজ মারামারি, কাটাকাটি, রক্তারক্তির গাঙ ভাসিয়ে দেওয়া। টিকলি ঝাপটে কোমড় জড়িয়ে ধরে টায়রাকে আটকালো। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর ধমকের সুরে বলল,

‘কি হচ্ছে টা কি? সব জায়গায় পাগলামি করিস কেনো?’

আর্দ্র বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আদর গরম চোখে তাকালো। সাথে সাথে চুপসে গেলো সে।

টিকলির দিকে এক পলক রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে টায়রা হনহন করে চলে গেলো। অসহায় মুখে টিকলি তাকিয়ে থাকলো বোনের যাওয়ার পানে। আদর ইশারায় আর্দ্রকে যেতে বলে। আর্দ্র বাধ্য ছেলের মতো থমথমে মুখে অন্যপাশে চলে যায়।

গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে আদর টিকলির পেছনে দাঁড়ালো। টিকলি তখন মন খারাপ করে উঁকিঝুঁকি করে দেখছিলো টায়রা কোথায় গেলো? আদর মাথাকে একটু নিচে নামিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, ‘মন খারাপ হলো?’

টিকলি চমকে তাকালো। উড়ে আসা ছোট ছোট চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে জোরপূর্বক মিস্টি হেসে বলল, ‘নাহ।’
‘কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে ভীষন বিষন্ন আপনি।’
‘নাহ আমি আসলেই এমনি। সবসময় এরকমই থাকি।’
‘ওহ।’

আদর আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না এই মুহুর্তে। অস্বস্থিতে জর্জরিত হয়ে উঠলো টিকলির মন-প্রাণ। সে একটু এলোমেলো গলায় বলল, ‘এখন আসি তবে। আসলে টায়রা কোথায় গেলো দেখতে হবে। মেয়েটা আবার প্রচন্ড বদমেজাজি।’

আদর হালকা হেসে বলল, ‘টায়রা কি ওই মেয়েটার নাম? সে কি আপনার বোন হয়?’

‘জি।’

‘আপনারা কি টুইন? কিন্তু চেহারার তো তেমন মিল নেই।’

হেসে দিয়ে টিকলি বলে, ‘নাহ। ও আমার চেয়ে এক বছরের ছোট। কিন্তু আমরা একসাথেই থাকি এবং একইসাথে পড়ি। আমাদের আবার গলায় গলায় ভাব।’

আদর হাসলো। অবাক বিষয়! হাসির কোনো কারণই ছিলো না তবুও অযথা হাসছে সে। ভারি আশ্চর্য তো! বলতে নেই, এই মুহুর্তে আদরের চোখে চারিপাশ রঙিন লাগছে। এই রাতের বেলায়ও দিনের লালচে-সোনালির আলো খুঁজে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, গাছে শত ফুল ফুটেছে। নতুন পাতা এসেছে। বসন্তের কোকিল ডাকছে। কিন্তু এখন তো গ্রীষ্মকাল। কালবৈশাখী ঝড়ের দিন। তাহলে?

টিকলি বলল, ‘আসি তবে।’

টিকলি চলে যেতে নেয়। সে বুঝতে পারলো না ক্ষনিকের জন্য তার অন্তরের ভেতর কি হয়েছিলো? কেনো এই লোকটাকে এতো কৈফিয়ত দিলো এবং হাসিমুখে এতো কথা বলল? লোকটা তো নিতান্তই একদম অপরিচিত তাই না? টিকলি চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আরেক পা বাড়ালেই আদর তড়িঘড়ি করে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

‘বলছিলাম যে, বোনের নামটা তো বললেন কিন্তু নিজের নাম?’

বেহায়াপনা করা আদরের ধাতে নেই। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে সে আজ তাই করছে। তার সব নিয়ম নিমিষেই উল্টেপাল্টে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে তার আত্মসম্মানের গন্ডি। টিকলি পেছন ফিরে তাকিয়ে একটু অবাক করা গলায় বলল, ‘আমার নাম?’

‘জি।’
‘আমার নাম টিকলি। টিকলি রেজা।’
আদর হেসে একটু দুষ্টুমির স্বরে বলল, ‘কি? টিকটিকি?’

চট করে আদরের দিকে তাকালো টিকলি। আজ পর্যন্ত কেউ কক্ষনো তার নামের বিকৃত রূপ বের করেনি। আর এই ছেলে কিনা মিনিট দশেকের মতো কথা বলার মধ্যে নাম বিকৃতি করে ফেলল। টিকলির ভারী রাগ হলো। থমথমে গলায় সে প্রশ্ন করলো,

‘আপনার নাম কী?’

আদর গর্বের সহীত বলল, ‘আদর খান।’

টিকলি একটু ভাবলো। আদর! কিন্তু নাহ…আদরের কোনো বিকৃতি নাম সে খুঁজে পেলো না। আর একটু ভাবার পর সে এক দারুন নাম উদঘাটন করলো। এরপর আদরের মতোই রসিকতার সুরে বলল,

‘কিহ..বাদর? বাদর খান? বাদরদের আবার খান বংশও আছে বুঝি?’

ঠিক জায়গায় গোল দিয়ে দিয়েছে। মেয়েটা নিতান্তই ভীষণ চালাক। আদরের হাসিহাসি মুখটা মিলিয়ে গেলো। গম্ভীর মুখে সে বলল, ‘ডোন্ট কল মি বাদর, মাই নেম ইজ আদর।’

টিকলি ফিক করে হেসে দিয়ে আদরের মতো করেই গম্ভীর স্বরে বলল, ‘দেন ইউ অলসো ডোন্ট কল মি টিকটিকি, মাই নেম ইজ টিকলি।’

আদর মাথা চুলকে হাসলো। বলল, ‘ছাদে যাবেন?
‘ছাদে?’
‘হুম।’
টিকলি একটু চিন্তা করে বলল, ‘যাওয়া যায়। কিন্তু টায়রাকে ছাড়া…। দাড়ান, আমি টায়রাকে ডেকে আনছি।’

_____________________________

লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়েছিল টায়রা। অপ্রত্যাশিত ভাবে সেই ছাদেই উপস্থিত হলো আর্দ্র। ঠান্ডা বাতাসে খোলা আকাশের নিচে মন ভালো করার জন্য এসেছিলো সে। কিন্তু এসে দেখলো এই চাপাবাজ মেয়ে এখানেও উপস্থিত। তেজে আর্দ্রর মুখখানা লাল রঙা হয়ে উঠলো। উল্টো পা বাড়ালো চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এক কদম হেটেই ভাবলো, ‘থাক একটু জ্বালাই। আফটার অল আমার আগে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে চলে এসেছিলো। তার শোধ তুলতে হবেনা?’

,

টায়রার মনটাতে তখন বিষন্নতার সুর। এখন বুঝি বিষাদ সময়। তাই উজ্জ্বল সারাদিন প্যাক প্যাক করা বাঁচাল টায়রার মনে উদাসীনতা। হঠাৎই এই বিষাক্ত বাতাসকে ছাপিয়ে কানের কাছে কেউ টেনে টেনে বলে উঠলো,

‘মিস. চাপাবাজ।’

টায়রা একটু চমকে উঠলো কিন্তু বুঝতে পারলো আগুন্তকের কণ্ঠধ্বনি। উল্টো ঘুরে গরম গলায় শুধু বলল,

‘বেয়াদব!’

আর্দ্র মুখটাকে একটু পাংশুটে বানালো। এরপর হাসিহাসি মুখ করে আবারো বলল, ‘নাম কী?’

‘নাম দিয়ে কাম কী?’ টায়রার অকপট উত্তর।

নদীর জলরাশির দিকে তাকিয়ে আর্দ্র বলে, ‘নাহ তেমন কোনো কাজ নেই। নাম না বললেও সমস্যা নেই। আমি মিস.চাপাবাজ বলেই নাহয় ডাকবো।’

পরাজিত গলায় তেজ টেনে টায়রা বলল, ‘টায়রা রেজা।’

শুনতে পায়নি এমন ভান করে আর্দ্র বলে,

‘কি কি কি? টায়ার রেজা? কোন টায়ার? বাসের না ট্রাকের? ছে ছে ছে! আপনার বাবা মা আর নাম পায়নি শেষে কিনা টায়ার? আমাকে বললেও তো আমি আপনার একটা সুন্দর নাম রেখে দিতে পারতাম। সমস্যা নেই মিস. চাপাবাজ এই টায়ার নামের থেকে ঢের বেশি ভালো এবং সুন্দর। আপনি মনে দুঃখ রাখবেন না মিস. চাপাবাজ। ‘ আর্দ্র বলল অনেকটা দুঃখের সাগরের দুঃখীরাজ হয়ে।

‘আপনি কিন্তু….। আপনাকে আজ আমি মেরেই ফেলবো।’ ফুসে উঠে কথাটা বলেই টায়রা এক অবাক কাজ করে বসলো। আর্দ্রর গলা চেপে ধরলো। আর্দ্র ভঙ্গি করে জিহবা বের করে বলল, ‘আহ! মরে গেলাম আমি।’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার একদম ই ব্যথা লাগছিলো না।

টায়রার হাত দুটো নিজ গলা থেকে সরিয়ে চেপে ধরলো আর্দ্র। তারপর টায়রার মুখে ফু দিলো। মুখের বাতাসে টায়রার বড় কপালে পরে থাকা কিছু ছোট ছোট চুল উড়ন্ত পাখির ন্যায় উড়ে গেলো। খানিক বেসামাল অস্বস্থিকর পরিস্থিতিতে পরে টায়রা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে দাড়ালো। আর্দ্রও একটু সংকীর্ণতা বোধ করলো। বেশ কিছুক্ষণ বাদে টায়রা প্রশ্ন করলো,

‘আপনার নাম কী?’

আর্দ্র বুক ফুলিয়ে বলল, ‘আর্দ্র খান। সুন্দর না নামটা?’

টায়রা আর্দ্রর মতোই দুষ্টুমির ছলে দাঁত কপাটি বের করে বলল,

‘কিহ.. ভাদ্র? কোন ভাদ্র? বাংলা মাসের ভাদ্র? ভাদ্রও বুঝি কারোর নাম হয়? আপনার বাবা-মা এই পৃথিবীতে আর নাম খুঁজে পায়নি? শেষে কিনা বাংলা মাসের নাম রেখে দিয়েছে? কি লজ্জা কি লজ্জা! বাইরে মুখ দেখান কীভাবে আপনি? আপনার জায়গায় আমি হলে গলায় কলসি বেধে মরে যেতাম। যাই হোক, দুঃখ করবেন না। বেয়াদব নামটা এই ভাদ্রর নামের থেকে ঢের বেশি ভালো এবং সুন্দর। ইশশ…আপনার জন্য কষ্টে আমার বুকটা পেখম তুলে নাচছে।’

নাক ফুলিয়ে আর্দ্র বলল, ‘আমার নামটা কীভাবে ভাদ্র হয়? ভাদ্র তে তো রেফ নেই। আর গলায় কলসি বাধলেই মানুষ মরে যায় বুঝি? আর আপনি কি আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন?’

টায়রা অবাক গলায় বলল, ‘ওমা! কোথায় আপনার কথা আপনাকে ফিরিয়ে দিলাম? একে বলে টিট ফর ট্যাট। কিছুই তো জানেন না দেখছি।’

আর্দ্র অপমানিত বোধ করলো। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আপনার সাথে তর্ক করা আমার কর্ম নয়। আপনি সত্যি চাপাবাজ। দি গ্রেট চাপাবাজ টায়ার। আর এতো বড় একজন গুণী মানুষের কাছে আমি তো ক্ষুদ্র এক বালুকণা। এতোবড় চাপাবাজ নারীর কাছে আমি অবলা, নগন্য।’

টায়রা আড়চোখে তাকিয়ে বলল,

‘অবলা মেয়েদের বলে। আর আপনি আমাকে কি বললেন? আমি দি গ্রেট চাপাবাজ টায়ার? বলি আপনার কি কানের সমস্যা আছে? হাওয়াই মিঠাইওয়ালার কাছে গিয়েও আমি আগে হাওয়াই মিঠাই চাইলাম। কিন্তু আপনি শুনলেন না। উল্টে বললেন আপনি আগে এসেছেন। এখন আবার আমার সুন্দর টায়রা নামটাকে বারবার টায়ার টায়ার বলছেন।’

টায়রার কথায় পাত্তা না দিয়ে চিন্তিত মুখে আর্দ্র বলল, ‘আচ্ছা তাহলে ছেলেদের কি বলে? অবলা থেকে অবল?’

তখনি ছাদে প্রবেশ ঘটলো টিকলির। সারা লঞ্চ খুঁজেও যখন সে টায়রাকে পেলো না তখন খুঁজতে খুঁজতে চলে এলো এই লঞ্চের ছাদে। টায়রা আর আর্দ্রকে দেখে টিকলি হাঁপ ছাড়া গলায় বলল,

‘থ্যাঙ্ক গড, তোমরা এখানে আছো। তোমাদের খুঁজতে খুঁজতে আমার পা ব্যথা হয়ে গেছে।’

টায়রা টিকলির কাছে এগিয়ে গিয়ে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠেস মারা গলায় বলল,

‘বাতাসে আর্দ্রতা কী কম তাই নারে টিকলি! শীত শীত লাগছে। কি করে আবার এই আর্দ্র ফিরিয়ে আনা যায়রে?’

টিকলি টায়রার কপালে চাপড় দিয়ে বলল, ‘গাধা, শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকে আর তুই এই জৈষ্ঠ্য মাসে বলছিস বাতাসে আর্দ্রতা কম? তোর শীত লাগছে? যদিও এখন ঝড়ের সময়। কাল বৌশাখী ঝড়! আর আজও বৃষ্টি হয়েছে। তাই বোধ হয় শীত লাগছে। নচেৎ গ্রীষ্মকাল কী শীত লাগার সময়?’

টায়রা একবার আর্দ্রকে দেখে নিলো। আর্দ্র নাক গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে ছিলো ওদের দিকে। টায়রা বিদ্রুপাত্মক হাসি দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ রে তাই তো। ইশশ..কত্তো ব্রিলিয়ান্ট রে তুই! যাই হোক, বেশি জ্ঞান দিস।’

টিকলি চোখ পাকিয়ে তাকালো, ‘আমি তোর চেয়ে এক বছরের বড়।’

সঙ্গে সঙ্গে হাত জোর করে মেকি গলায় টায়রা বলল, ‘মাফ কর ভাই। এই কথা শুনতে শুনতে কান আমার ঝালাপালা।’

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here