বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব ৫০

0
687

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

৫০.
টিকলি হাত মোচড়াতে মোচড়াতে টায়রার পাশে বসলো। চিন্তার গলায় বলল, ‘উনি রাহুল ভাইয়ার সাথে দেখা করতে গেছেন।’

টায়রা কান থেকে ইয়ারফোন খুলে আমোদিত কণ্ঠে বলল, ‘সত্যিই?’

টিকলি মাথা ঝাকাঁলো। ইতস্তত করে বলল, ‘কিন্তু একটা ব্লান্ডার হয়ে গেছে সাথে একটা কান্ড ঘটেছে৷’

টায়রা পিটপিট করে তাকিয়ে বলল, ‘কোন গাছের কাণ্ড, ফুল, পাতা ঘটেছে সেটাই আগে বল?’

টিকলি ত্যাড়াচোখে তাকিয়ে বলল, ‘গাছের কাণ্ড, ফুল, পাতার কথা বলিনি। একটা ঘটনা ঘটেছে।’

টায়রা বিছানায় আগের মতো ঠেস দিয়ে বসে বলল, ‘বল।’

টিকলি কালকের রাহুলের বলা কথাগুলো বলল, ‘রাহুল ভাইয়া নাকি আমাকে ছোটথেকে ভালবাসে।’

টায়রা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। খানিক বাদে ওভার সিউর দিয়ে বলল, ‘আমি জানতাম। জানতাম এরকম কিছুই একটা হবে। লজ্জাজনক হলেও বলি আমি প্রথমে ভেবেছিলাম রাহুল ভাইয়া আমাকে পছন্দ করে। কারণ সে সবসময় আমার সাথে ঝগড়া করতো। চাপাবাজী করতো।’

টিকলি চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘ঝগড়া করলেই ভালোবাসা হয়?’

টায়রা ওভার সিউর দিয়ে আবার বলল, ‘অবশ্যই। হয়না মানে? তোর আর আদর ভাইয়ার তো ঝগড়া দিয়েই সব শুরু হলো। আমার আর ওই ভাদ্ররও তো ঝগড়া দিয়েই শুরু হলো।’

টিকলি অবাক হতবাক কণ্ঠে বলল, ‘কি বললি? কি বললি তুই? তুই আর আর্দ্র ভাইয়া মানে? তোরা দুজন প্রেম করিস?’

টায়রা হাত নাড়িয়ে বলল, ‘ওই ডেমরার সাথে প্রেম করবো তাও আবার আমি? মাথা খারাপ নাকি?’

টিকলি ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘তবে? ভালোবাসিস?’

টায়রা চুপ থাকলো। বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালো। দিন কালো হয়ে আসা মেঘলা আকাশ। চারিদিকে বৃষ্টি আমেজ। বৃষ্টির গন্ধ। প্রেমের ছন্দ। ভালোবাসার দ্বন্ধ। টায়রা মিস্টি হেসে স্মৃতিচারণ গলায় বলল,

‘তোর মনে আছে টিকলি? আমি ছোটবেলা থেকে সবসময় বাবাকে গিয়ে বলতাম আমাকে আর আপুকে এক বাড়িতে বিয়ে দিবে। যদি বিয়ে না দাও তাহলে তোমার খবর আছে। আমি অনেক কাদবো। আপু ছাড়া আমার ভালো লাগবে না তো! আমি একা হয়ে যাবো যে! আমি ভয় পাবো। আমি কষ্ট পাবো। কিন্তু খুশি হবো না।’

টিকলি যেনো চোখের সামনে দেখতে পেলো সেই ছোট্ট মিস্টি শ্যামল পুতুল টায়রাকে। ভাবতে ভাবতে একরকম নস্টালজিক হয়ে গেলো। মৃদু হাসলো টিকলি। সব বুঝে উঠতে বেশি সময় লাগলো না তার। বলল,

‘সময় চলে যাচ্ছে টায়রা। আর দুদিন পর বিয়ে। কাল গায়ে হলুদ। তুই আর্দ্র ভাইয়াকে বলে দে।’

টায়রা মাথা দুলিয়ে হেসে বলল, ‘ভালোবাসলেই বলতে হবে নাকি? সব ভালোবাসায় মিলন হতে হবে এমন কথা কোথাও লেখা আছে? আমি তো ভেবেছি বিয়ের দিন উনার বিয়ে দেখতে চলে যাবো। তোর তো বিয়ে হবেনা আমি সিউর। তাই এখানে বসে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।’

টায়রা একটু থেমে আস্তে গলায় বলল, ‘আমি দেখতে চাই আমার সামনে উনি আমার বেস্টফ্রেন্ডকে কীভাবে বিয়ে করে। আমি উনাকে কংগ্রাচুলেশন করতে চাই।’

টিকলি জানালা গলিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, ‘আল্লাহ! সব যেনো ভালো হয়৷ দুঃখের খরার পর সুখ যেনো বৃষ্টি হয়ে নামে।’

টায়রা ঘুরে দাড়ালো, ‘কি ব্লান্ডার করেছিস বললি নাতো?’

টিকলি চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে কাচুমাচু হয়ে বলল, ‘আমি উনাকে এই কথাটা বলতেই ভুলে গিয়েছি। তার উপর উনি কাল অনেক টায়ার্ড ছিলেন। দূরের একটা গ্রামে মেডিকেল ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে আমি এই কথাটা বলিনি।’

টায়রা মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘আল্লাহ্! এই মেয়ে কি করে খাবে? এতো বড় একটা কথা আর তুই বললি না? তোর এই কথার জন্য যদি কোনো সমস্যা হয় তখন?’

টায়রার কথায় টিকলি ভয় পেলো। মাথায় হাত দিয়ে বসলো। এতো চিন্তা আর নেওয়া যাচ্ছে না। মাথা কেটে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে।

__________________________

উত্তাল, অশান্ত নিঃশ্বাসের ধ্বনির সাথে মিশে একাকার তখন স্তব্ধ, ভারী বাতাস। রাহুলের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আদর বাতাসে অক্সিজেনের সংকট বোধ করছে৷ স্বপ্নরাজ্য তৈরি করার আগেই কাচের মতো চুরচুর করে ভেঙে পড়ছে রাহুলের উপর। রাহুলের চোখ লাল। অসম্ভব লাল। সে নিচু মাথায় উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বিরবির করে বলল, ‘এসব কি? এসব হতে পারে না? টিকলি আর আদর ভাইয়া দুজনে কীভাবে সম্ভব? ওরা পরিচিত হলো কবে?’

রাহুলকে চুপ থাকতে দেখে আদর অস্থির হয়ে বলল, ‘কথা বলছো না কেনো রাহুল?’

রাহুল মাথা উঁচিয়ে সামনে থাকা কফির মগ ঘুরালো। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। খাওয়া যাবে না। খুব শান্ত গলায় রাহুল বলল, ‘কতদিনের সম্পর্ক আপনাদের?’

এতো কথার কি দরকার? আদর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে তিক্ততার সাথে বলল, ‘পাঁচমাস।’

রাহুল বাঁকা হাসলো। আদর তা দেখে ভ্রু কুচকালো। এরপর ধীরেসুস্থে বলল, ‘দেখো রাহুল, তুমি সরে যাও। বিয়েটা ভেঙে দেও কিংবা যা খুশি করো কিন্তু বিয়েটা যাতে না হয়।’

রাহুল ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘আপনি কেনো ভাঙছেন না? কেমন প্রেমিক আপনি?’

আদর রাহুলের ঠেস মেরে খোটা দেওয়াটা বুঝে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা না করে এসে তোমাকে বলিনি। আমার আর টিকলির অনেক আগেই বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। কিন্তু তখন আমরা দুজন দুজনকে পছন্দ করতাম না বলে বিয়েটা ভেঙেছি। এরপর দুই পরিবারের মধ্যে কয়েক দফা দ্বন্ধ লেগে গেছে। এখন তারা মানছে না। তাই এসে তোমাকে বলা।’

রাহুল ভ্রু উচিঁয়ে বলল, ‘আপনাদের প্রেমটা কীভাবে হলো ভাইয়া?’

আদর চোখ ছোট করে বলল, ‘রাহুল, আমি এখানে তোমাকে কাসুন্দি মাখা গল্প শোনাতে ডাকিনি। সময় থাকলে এসব তুমি পরেও শুনে নিতে পারবে। মেইন পয়েন্টে আসো। এন্ড দ্যা মেইন পয়েন্ট ইজ আমি এই পৃথিবীর বিনিময়েও উনাকে ছাড়তে পারবো না।’

রাহুল চোখ তুলে বলল, ‘আর টিকলি?’ অস্থির কণ্ঠে রাহুল আবার বলল, ‘আর টিকলি কি ভাইয়া? ও আপনাকে ছাড়তে পারবে না? পারবে হয়তো।’

রাহুলের চোখ মুখ জ্বলজ্বল করছিলো। কিছু পাওয়ার আশা। আদর হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘সেটা বাড়ি ফিরে টিকলিকে জিজ্ঞেস করো।’

রাহুল চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাড়ালো। আদর নির্বিঘ্নে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকলো। যাওয়ার আগে রাহুল বলল,

‘আপনি মাত্র পাঁচমাসের ভালোবাসার জন্য বলছেন এই পৃথিবীর বিনিময়ে ছাড়তে পারবেন না। আর আমি তো পাঁচ বছর বয়স থেকেই ভালোবাসি। আর এখন আমি পঁচিশ পার করবো। আমি আমার বিশ বছরের ভালোবাসা কীভাবে ত্যাগ করবো বলতে পারবেন? আপনার মতো তবে আমারও বলা উচিত, এই মহাকাশের বিনিময়েও আমি টিকলিকে ছাড়তে পারবো না।’

রাহুল চলে গেলো। আদর হতভম্ব চোখে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য গলায় বলল, ‘রাহুল টিকলিকে ভালোবাসে? এতো ছোটোবেলা থেকে? আর উনি এ কথাটা আমাকে একবারো বললেন না? বললে আমি ব্যাপারটা রাহুলকে অন্যভাবে বুঝাতে পারতাম। বয়সে জুনিয়র একটা ছেলের কাছে এভাবে অপমানিত হতাম না। এতো বড় সত্যি কি করে চেপে গেলেন উনি?’

_____________________________

রাহুল এসেছে অনেকক্ষণ হলো। এসে সকালের নাস্তা করলো না। দুপুরে খেলো। এখন দুপুর গড়ালো। টিকলি সকাল থেকে কন্টিনিউয়াসলি আদরকে ফোন করছে। কিন্তু আদরের ফোন বন্ধ। টেনশনে টিকলির হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো। শরীর ঘেমে উঠছে বারংবার। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে টিকলি আবার আদরের ফোনে কল লাগালো। কিন্তু আবার সেই একই কথা। বিরক্তি রাগে ক্ষোভে টিকলি ফোন ঢেল দিলো। সাথে সাথে চুরচুর হয়ে গেলো ফোন।

টিকলি মাথার চুল টেনে ধরে ছাদে গেলো। টিকলিকে দেখে রাহুল হাসলো। সে জানতো টিকলি আসবে কিন্তু এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় আশা করেনি। এলোমেলো চুল, চোখে মুখে ঘাম, ছলছলে চোখ, কাঁপুনি থুতনি। দুপুরের খাবারটাও খায়নি। টলমল পায়ে টিকলি রাহুলের সামনে গেলো। অগোছালো টিকলিকে দেখে রাহুলের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠলো। টিকলি কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাহুল টিকলির মাথা হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

‘আজ রাতে আমি চলে যাবো। কাল আবার আসবো তোকে হলুদ ছোয়াতে।’

টিকলির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কয়েক মুহুর্ত কাটলো রাহুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে। রাহুল এসব কি বলছে? তবে কি আদর ওকে কিছু বলেনি? ওর সাথে দেখা করেনি? সব জানলে রাহুল এতো সহজভাবে অবলীলায় এই কথাগুলো কেনো বলবে? এরজন্যই কি তবে আদর ফোন বন্ধ রেখেছে? টিকলির চোখ কুয়াশা-মাখানো ঝাপসা হয়ে এলো।

রাহুল কিছুক্ষণ টিকলির দিকে তাকিয়ে থাকলো। তাকিয়ে থাকলো টিকলির চোখের দিকে। বরাবরের মতোই তার জন্য কিচ্ছু খুঁজে পেলো না। কিন্তু আজ হঠাৎ রাহুলের মনে হলো টিকলির চোখগুলোতে আদরের জন্য সীমাহীন ভালোবাসা। আদরের থেকেও আদরের প্রতি বেশি ভালোবাসা। রাহুলের বুকটা চিনচিন করে উঠলো। আদর বলেছিলো বাড়ি ফিরে টিকলিকে জিজ্ঞেস করতে কিন্তু যেখানে টিকলির চোখ মুখ’ই সাক্ষ্যপ্রমাণ সেখানে জিজ্ঞেস করাটা বোকামি। নিজেকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। টিকলি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই রাহুল আটকিয়ে দিলো,

‘যা ঘরে যা। কাল থেকে অনেক ধকল যাবে। রেস্ট নে।’

রাহুল টিকলিকে ঠেলে পাঠিয়ে দিলো। টিকলি সিড়িতে পা রাখার আগে বলল, ‘টিকলি শোন।’

টিকলি পেছন ঘুরে তাকালো। রাহুল আহত কণ্ঠে বলল, ‘আমি তোকে খুব ভালোবাসি রে। আমার বুকটা পুড়ছে। গন্ধ পাস? পাস না তাই না?’

টিকলি চোখ ভেঙে কান্না আসলো৷ অজস্র চিন্তা ভাবনায় মাথা গোলগোল ঘুরতে লাগলো৷ ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দূর্বল গলায় বলল,

‘আমার সাথেই কেনো এমন হচ্ছে বলতে পারো? আমার ভেতরে যে আগুন জ্বলছে। একটুপর সেই আগুনে আমিসহ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবো।’

টিকলি এলোমেলো পায়ে চলে গেলো। রাহুলের কষ্ট লাগলো। সিগারেট ধরালো সে।

,

আর্দ্রর বাড়ি থেকে হলুদ যাবে নিভার বাড়িতে। বেশ বড়সড় জাকজমকপূর্ণ ভাবে ছেলের বিয়ে দিচ্ছে আজিম খান। সকাল থেকে বড় ছেলেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়টি নিয়ে তিনি খানিকটা চিন্তিত হলেও বিচলিত নন। আর্দ্রের হলুদ শেষে পোলাপান সবাই জোর করে আর্দ্রকেও নিভার বাসায় নিয়ে গেলো।

ফাঁক বুঝে আর্দ্র নিভার ঘরে ডুকলো। নিভা চমকে বলল, ‘তুমি?’

আর্দ্র কয়েক পা এগিয়ে বলল, ‘দেখ নিভা আমি তোকে বিয়ে করতে পারবো না। এটা সম্ভব না। ইম্পসিবল।’

নিভা অবাক হলো। এরপর বলল, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইনা আর্দ্র ভাইয়া। কিন্তু আমার হাতে কোনো উপায় নেই।’

আর্দ্র চাপা ক্রোধ নিয়ে বলল, ‘উপায় খুঁজলেই উপায় বের হবে। আমি তোকে বোনের নজরে দেখেছি। এখন তোকে বউয়ের নজরে দেখা কোনোমতেই সম্ভব নয়। আর তাছাড়া…’

নিভা ভ্রু কুচকে বলল, ‘তাছাড়া?’

আর্দ্র সময় নিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় আই এম ফল ইন লাভ উইথ টায়রা।’

নিভা হেসে বলল, ‘এই কথাটা বুঝতে এতোদিন লাগলো ভাইয়া? আজ গায়ে হলুদের দিন এসে বলছো! বড্ড দেরি করে ফেললে। আমার হাতে এখন কিচ্ছু নেই। আমি যদি বাবা মাকে গিয়ে বলি যে এই বিয়েটা আমি করবো না তবুও কোনো লাভ হবে না। এই মুহুর্তে আমার কথার কোনো মূল্য নেই। এক পার্সেন্ট মূল্যও নেই। উল্টো অকথ্য কথা শুনতে হবে। মারও খেতে হতে পারে। তবে তুমি নিশ্চিত থাকো এই বিয়েতে আমার 100% মত নেই।’

আর্দ্র ভ্রু কুচকে বলল, ‘নেই তো? পরে কোনোদিন কোনোসময় কোনোকালে আমাকে ব্লেম করবি না তো?’

‘কক্ষনো না।’

‘আমি যা বলবো তাই শুনবি?’

নিভা মাথা ঝাকালো।

‘আমি যদি বিয়ের আসরে বিষ খেতেও বলি, বিয়ে ভাঙতে বিষও খাবি বুঝলি?’

আর্দ্রের কথা শুনে নিভা চোখ বড় বড় করে তাকালো। আর্দ্র যেমনভাবে এসেছিলো তেমন ভাবে চলে গেলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো, ‘কোনোমতেই শরীরে হলুদ লাগাবি না।’

,

টিকলি ঘরের দোর দিয়ে বসে আছে। জামিলুর রেজা, শায়লা আক্তার অনেক্ক্ষণ থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছে। টায়রা রেডি হয়েছে কোথাও যাবে। টিকলির সেদিকে খেয়াল নেই। উল্টো হয়ে নিস্তব্ধ সে শুয়ে আছে। একটুপর টায়রা বিরক্ত মুখে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। জামিলুর রেজা এবং শায়লা আক্তার হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলেন৷ পেছনে তাকিয়ে শায়লা আক্তার বলল, ‘কোথায় গেলো মেয়েটা?’

জামিলুর রেজা উনাকে কনুই দিয়ে হালকা গুতা মেরে সামনের দিকে ইশারা করলেন। শায়লা আক্তার সামনে তাকিয়ে দেখলেন টিকলি স্তব্ধ নিরব। পুরো বিছানা ফাঁকা রেখে একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। শায়লা আক্তার আস্তে করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলেন। টিকলি জেগেই ছিলো। এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকলো। শায়লা আক্তার বললেন,

‘উঠ মা। গায়ে হলুদের সময় হয়ে গেছে।’

জামিলুর রেজা টিকলির মাথায় হাত রাখতেই। টিকলি আকস্মিক এক কাজ করে বসলো। ঝটকানি দিয়ে জামিলুর রেজার হাত সরিয়ে দিলো। শায়লা আক্তার থেকে দূরে সরে বসলো। উন্মত্ত ক্ষিপ্ত গলায় বলল,

‘দূরে থাকো। আমার থেকে দূরে থাকো। চলে যাও এক্ষুণি। আমি হলুদ লাগাবো না। যাও।’

শায়লা আক্তার বললেন, ‘বেশি না মা। একটু লাগাবো আয়।’

টিকলি আগুন গরম চোখে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘তোমরা যাবে? নয়তো খারাপ হবে। খুব খারাপ।’

জামিলুর রেজা তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালেন। পরে যদি আবার মেয়ে বিয়ে না করার জন্য চিল্লাচিল্লি করে। বাড়ি ভরতি লোকজন। মানসম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। এই চিন্তায় তাড়াতাড়ি স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ঘর ছাড়লেন। গিয়ে রাহুলকে পাঠিয়ে দিলেন।

বাবা মা যেতেই টিকলি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। বিছানায় গিয়ে বসে ডুকরে কেদে উঠলো। একটু পর রাহুলের কণ্ঠ শোনা গেলো। দরজা ধাক্কাচ্ছে সে। টিকলি বিরক্তিতে কান চেপে ধরলো। অস্ফুট শব্দ করলো। বারান্দায় চলে গেলো এই বিকট শব্দ থেকে বাঁচতে৷ মিনিট দশেক অনবরত দরজা ধাক্কিয়ে টিকলিকে ডেকে রাহুল ক্লান্ত হয়ে উঠলো। দরজায় সামান্য হলুদ লাগিয়ে সে চলে গেলো। সাথে রেখে গেলো ভালোবাসা,

‘নাই বা ছোঁয়ালাম তোর গায়ে। তাতে কি? শয়নে স্বপনে জাগরণে তুই আমার। আমি মন থেকে তোকে হলুদ ছুইয়ে দিয়েছি। তাতেই পর্যাপ্ত।’

,

আর্দ্র নিভার ঘর থেকে বের হতেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে টায়রার মুখোমুখি হলো। অপ্রস্তুত ভাবে ঘাবড়ে গেলো। টায়রা স্ফূর্তি কণ্ঠে বলল, ‘আরে ভাদ্র সাহেব যে!’

আর্দ্র হাসলো। আশার মোমবাতি জ্বললো বাতাসে বাতাসে। আর্দ্র বলল, ‘টায়রা শুনুন।’

‘আরেব্বাস! টায়রা? এতো উন্নতি? ভালো ভালো। নতুন নতুন বিয়ে করছেন তো। বুদ্ধি খুলছে।’

আর্দ্র অস্থির হয়ে বলল, ‘আচ্ছা ফুটা টায়ার শুনুন।’

‘জি বলুন।’

আর্দ্র বলতে ধরলো, ‘আমি..’

আর্দ্রকে টায়রা আটকিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওহ হো ভুলেই গিয়েছিলাম। কংগ্রাচুলেশন।’

আর্দ্র ভ্রু কুচকে বলল, ‘কেনো?’

টায়রা প্রস্ফুটিত কণ্ঠে বলল, ‘এই যে আগামী নতুন দিনগুলোর জন্য। ভাবছি এবার আমিও বিয়ে করে ফেলবো। আপনি বিয়ে করছেন। টিকলি বিয়ে করছে। নিভা বিয়ে করছে। রাহুল ভাইয়া বিয়ে করছে। শুধু আমি আর আদর ভাইয়া সিঙ্গেল।’

আর্দ্র অবাক হলো। টিকলি বিয়ে করছে? অথচ ও এসবের কিছু জানে না। আর্দ্র বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘টিকলি বিয়ে করছে মানে? কাকে? আর রাহুল ভাইয়া? কোন রাহুল?’

‘আপনাদের বাসায় ব্যাচেলর ভাড়া থেকেছে সেই রাহুল। আমার মামাতো ভাই। টিকলিকে বিয়ে করছে৷ কাল ই বিয়ে।’

আর্দ্র রাগ নিয়ে বলল, ‘আমার ভাইয়ের কি হবে তাহলে? আপনার বোন কীভাবে বিয়ে করতে পারে?’

টায়রা ঠোঁট উল্টে বলল, ‘বিয়ে করবে না তো।’

আর্দ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো, ‘কি বলছেন? স্পষ্ট ভাবে বলুন। গোলমেলে লাগছে আপনার কথা।’

টায়রা হাত নাড়িয়ে বলল, ‘আপনার ওতো কিছু জানতে হবে না। তাদেরটা তারা বুঝে নিবে। আপনি আমার কথা শুনুন, আমি ভেবেছি কাল টিকলির বিয়ে এটেন্ড করবো না। আমি আপনার বিয়েতে চলে যাবো। আপনি কীভাবে কবুল বলেন, কবুল বলার সময় লজ্জা পান কিনা কিংবা কেঁপে উঠেন কিনা তা দেখতে হবে না? ঝমকালো একটা গোলাপি শাড়ি পড়বো। আপনার তো নীল রং পছন্দ তাই না? ইশশ..আমার গোলাপি পছন্দ। এই জায়গায়ও আমাদের ম্যাচ করলো না। ঠিকাছে, আমার একটা নীল গোলাপি মিশ্রণের শাড়ি আছে। জমিন নীল, কুচি আর আচঁল গোলাপি। সেটা পরে যাবো।’

আর্দ্র হাত মুঠো করে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে টায়রার কথা শুনলো। টায়রা নিজের কথা শেষ করে বলল, ‘আপনি কি যেনো বলতে চেয়েছিলেন?’

দাঁত কিড়িমিড়ি করে আর্দ্র বলল, ‘কিচ্ছু বলতে চাইনি। আপনি আমার বিয়েতে আইসেন। আপনার জন্য আমি আলাদা একটা টেবিল বুক করে দিবো। পেট ভরে খেয়ে যাবেন। রাক্ষসী!’

টায়রা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আপনি আমাকে রাক্ষসী বললেন? আপনি নিজে একটা… একটা বিটকেলের বংশধর। পিশাচের নাতিন।’

আর্দ্র বিরক্ত মুখে বলল, ‘আচ্ছা এতো কথা যে বললেন! আমি কি একবারো আমার বিয়েতে আপনাকে ইনভাইট করেছি? ছ্যাচড়া চাপাবাজ মেয়ে কোথাকার!’

আর্দ্র রেগে গটগট করে হেটে চলে গেলো। অতি উৎসাহ নিয়ে যা বলতে চেয়েছিলো তা বলার আগেই এই মেয়েটা সব বিগড়ে দিলো। টায়রা মুখ হা করে নিজের দিকে আঙ্গুল তাক করে বড় বড় চোখে বলল,

‘আমি ছ্যাচড়া? আমি? তুই ছ্যাচড়া! তোর ক্যারেক্টর লুজ। খচ্চরের উত্তরাধিকারী। খারাপ! দেখ শুধু তোর বিয়েতে গিয়ে আমি কি করি! প্লেট উপচিয়ে খাবার নিবো। নিতেই থাকবো। বাড়ি থেকে ইয়া বড় বড় টিফিন বক্স নিয়ে যাবো৷ খাবার টিফিন বক্সে শুধু ভরবো। আমি একাই ১০০ জনের খাবার খাবো। তোর বাপেরে কালকে ভালোমতোন টাইট দিবো। আমাদের এলাকার রাস্তার পিচ্চি পিচ্চি পোলাপান গুলোকে সহ নিয়ে যাবো। তোর বিয়েতে আমি একটা সুতাও গিফট দিবো না দেখিস। তোর মতো অভাবগ্রস্ত কেউ যদি আবার জিজ্ঞেস করে, এতো খেলেন অথচ গিফটের নামে ফকফকা। তখন আমি তার কানেকানে ফিসফিস করে তোর নামে কূটনামি করবো, ‘শুনেন বর আমার এক্স ঝগড়ুটে পার্টনার বুঝলেন? সাথে বউ আমার বিরাট বড় বান্ধবী। আর বান্ধবীর বিয়েতে আবার গিফট কিসের!’

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here