বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব ৯

0
704

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ?
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

০৯.
রাত যত গভীর হচ্ছিলো টায়রা আর্দ্রর ঝগড়ার তোড়জোড়ও বাড়ছিলো তত। শেষে না পেরে রাতের প্রথম প্রহরে দুজন অগ্নিশর্মা রাগ নিয়ে উঠে চলে গেলো নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত কেবিনগুলোতে। ওরা চলে যাওয়ার পর টিকলি একটু অস্বস্থি নিয়ে আদরের দিকে তাকালো সাথে জোরপূর্বক একটা হাসি দিলো। আদর চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঘুরতে যাচ্ছেন?’
কানের পাশে চুল গুজে দিয়ে টিকলি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে জবাব দিলো, ‘জি। আপনিও নিশ্চয়ই? ‘
‘হুম। কোথায় যাচ্ছেন?’
‘হাতিয়া। নিঝুম দ্বীপ।’
‘শুধু নিঝুম দ্বীপ ই ঘুরবেন?’
‘দেখি, হুট করে চলে এসেছি তো। প্ল্যানিং নেই। আপনি?’
‘আমিও নিঝুম দ্বীপ যাচ্ছি।’
‘ওহ।’ টিকলি আবার অস্বস্থিতে পরে গেলো কেনো যেনো। অথচ এতো আড়ষ্ট ভঙ্গিমা করার মতো কিছু হয়নি। আদর বলল, ‘রাত হয়ে যাচ্ছে। ঘুমোবেন না?’

টিকলির ছোট উত্তর, ‘জি। গুড নাইট। ভালো থাকবেন।’ একনজর আদরের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো সে। তার চলে যাওয়ার পর আদর ভাবতে বসলো।
এতো ভয়ে ভয়ে আরক্তনয়নে টিকলি কেনো কথা বলল কে জানে? হয়তো অপরিচিত ব্যক্তি তারউপর একটু আগেই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কবলে পরে এই মানুষটার সান্নিপাতিক হয়েছিলো সে; তার বুকে আচড়ে পরেছিলো তাই বোধ হয় এই অস্থির মনস্তাপ।

,

ফজরের নামাজ পড়ে নিয়ে টিকলি তার ব্যাগভর্তি বয়ে নিয়ে আসা উপন্যাসের স্তূপ থেকে একটা বই নিয়ে পড়ছিলো টায়রা বিরক্ত হয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গিয়ে লঞ্চের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে সূয্যিমামার সূর্যোদয়ের রঞ্জনরশ্মি দেখতে বসলো। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ গলা উঁচিয়ে চেঁচালো,

‘ওহ মাই গড। আপনার মুখ থেকে তো তেল বেরোচ্ছে।’

ঘুম থেকে উঠলে মুখ স্বাভাবিক ভাবেই একটু তেলতেলে থাকবে। যদিও ওজু করা হয়েছে কিন্তু মুখে কোনো ক্রিম, পাউডার বা অন্যকোনো প্রসাধনী মাখা হয়নি বলে টায়রার মুখের তেলতেলে ভাবটা রয়ে গেছে।

টায়রা একটু ঘাবড়ে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে দেখলো আবার সেই বেয়াদব ছেলেটা। রোষাগ্নি হয়ে টায়রা উত্তর দিলো ত্যাড়া ভাবে, ‘হ্যাঁ তো? সেই তেল দিয়ে আপনাকে রেধে খাওয়াবো।’

আর্দ্র নাক ছিটকিয়ে সরে গেলো সাথে টায়রাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, ‘উফফ এই লঞ্চ যে কখন থামবে আর কখন এই তৈলাক্ত মানুষজনদের কাছ থেকে রেহাই পাবো!’

টায়রা নাকের পাটাতন ফুলিয়ে রাখলো। কথার উত্তর দিলো না কিন্তু সেও শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, ‘বোকারা কথা বলে বেশি রাগে বেশি। বুদ্ধিমানেরা কথা বলে কম রাগেও কম।’

‘হুহ…আসছে বুদ্ধিমান! যে বুদ্ধির ছটা জীবন হয়ে যাবে আমার দফা-রফা।’

__________________________________

নোয়াখালী জেলার মধ্যে একটি উপজেলা হলো হাতিয়া। এটি মূলত একটি দ্বীপ। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত মেঘনা নদীর মহোনায় জাগরিত সেই দ্বীপ। এর চারদিকে রয়েছে বিশাল জলরাশি। একসময় নোয়াখালীর মূল ভূমির সাথে সংযুক্ত থাকলেও ক্রমেই নদী ভাঙনের দাপটে এটি প্রায় বিচ্যুত। আস্তে আস্তে হয়তো এই হাতিয়া বিলীন হয়ে যাবে বিশাল জলরাশির কবলে। ভোলা এবং মনপুরা হাতিয়া উপজেলার দুটি উল্লেখিত দ্বীপাঞ্চল। ভোলা যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একটি দ্বীপ। এমনকি ২০১৫ সালে, বাংলাদেশ সরকার হাতিয়া দ্বীপের ভাসানচরে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের পুর্নবাসনের সিদ্ধান্ত নেন।

বেলা প্রায় সাড়ে দশটার দিকে লঞ্চ গিয়ে পৌছায় হাতিয়ার লঞ্চঘাটে। সম্ভবত এইঘাটকে তমরুদ্দি ঘাট ও বলা হয়। টিকলি টায়রা ব্যাগপত্র নিয়ে লঞ্চ থেকে নেমে বাজারের একটা দোকানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। টিকলির আগে টায়রার তীক্ষ্ণ দুটি চোখ আটকে গেলো একটা জায়গায়।

বাজারের এক কোণায় আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত আর্দ্র। রোদ উঠেছে তবে এদিকে হয়তো বৃষ্টি হয়েছিলো কাল রাতে অথবা আজ সকালে যার কারনে বাজারের আশপাশের মেঠোপথে কাদার ছড়াছড়ি এবং জমাট বাধা পানি। হঠাৎ দমকা বাতাসে পট করে ঝুলন্ত এক মাঝারি সাইজের কাঁচা আম গিয়ে পরলো ঠিক আর্দ্রর মাথার উপর। তা দেখে টায়রা হেসেই খুন। কোমড়ে এক হাত রেখে আরেক হাত কপালে রেখে সে হাসছে।

এদিকে টিকলির মনটা খারাপ কারন কিছুক্ষন আগে ঘটে গেছে একটি মন্দ ঘটনা। লঞ্চ থেকে নামার সময় টিকলি কাদায় আবারো পা পিছলে পরে যেতে নেয়। টায়রা ছিলো খানিকটা পেছনে। সে দেখেনি। কিন্তু এ যাত্রায় টিকলিকে বাঁচিয়ে নেয় আদর। এই ঘটনা যেনো পূর্বপরিচিত। টিকলির বন্ধ দুয়ারের অসহায় চোখ দুটো আস্তে করে তার দ্বার খুলল। সামনে তাকিয়ে দেখলো আদর তাকে শক্ত করে ধরে আছে। বলতে নেই, এক মিনিটের জন্য টিকলির মনে হলো এই সেই অসভ্য ছেলেটা।

যারপরনাই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবার ঘটায় আদরের মস্তিষ্কে খেলে গেলো কালকের বিকাল পাঁচটা পনেরোর ঘটনা। সেই নির্বোধ বোকা কিন্তু নিজেই নিজেকে ভাবা বুদ্ধিমান পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েকে মনে পরতেই আদরের ভেতরটা রাগ হয়ে গেলো। সেই রাগ প্রকাশ পেলো কাদার কবল থেকে মাত্র বেঁচে ফেরা বেচারা টিকলির উপর। টিকলি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আদরের মুখপানে। এক মুহুর্তের জন্য সে আদরের উপর সেই অসভ্য ছেলের ছায়া দেখতে পেলো। নাকের পাটাতন তখন অজান্তেই ফুলে গেলো। সে বলল,

‘আমি তো ইচ্ছে করে পরে যাইনি কাদা ছিলো তাইতো পরে যাচ্ছিলাম।’

‘কেনো পরবেন? আল্লাহ হাত পা চোখ সব দিয়েছে তাও যখন তখন পরে যাবেন? এখন নাহয় আমি বাঁচিয়েছি পরে কে বাঁচাবে? চিৎপটাং হয়ে তো তখন কাদায় গড়াগড়ি খেতে হবে।’ আদরের ঝাঁঝালো গলা।

টিকলির খারাপ লাগলো খুব। সে সরি বলে চলে এলো সেই জায়গা থেকে। বলতে গেলে, লোকটা তো আর মিথ্যা বলেনি। টায়রার জোরালো হাসির শব্দ আবারো কানে বাড়ি খেলো। ভাবনার সুতো কেটে টিকলি এবার বিরক্তচোখে তাকিয়ে বলল, ‘পাগলের মতোন এতো জোরে জোরে হাসছিস কেনো?’

টায়রা সামনের দিকে হাত দিয়ে ইশারায় দেখিয়ে দিলো। টিকলি দেখলো আর্দ্র মুখ ফুলিয়ে মাথায় বাম হাত ঘষছে এবং তার ডান হাতে এক টসটসে কাঁচা আম ধরে রাখা। টায়রা হাসতে হাসতে এগিয়ে গেলো সেইদিকে। টিকলি চোখ সরিয়ে বিরক্তির শ্বাস ফেলল। সূর্যের প্রকটন আলোতে ধাতস্থ হয়ে এদিক সেদিক তাকালো। দেখলো তার পাশের দোকান থেকে আদর মিরিন্ডা কিনছে। টিকলি তার ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া ভ্রু জোড়া সোজা করে তাকালো। মনটা আরো খানিক খারাপ হয়ে গেলো। তাকে লক্ষ্য করে ততক্ষনে এগিয়ে এসেছে আদর। হাতে থাকা একটা ত্রিশ টাকার মিরিন্ডার বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘সূর্যের তাপে আপনার চোখ মুখ তো লাল হয়ে গিয়েছে। নিন এটা খান।’

আদরের এহেন মিস্টি বাক্যে টিকলির শত রাগ, কোটি মন খারাপ পরে গেলো। মিনিট খানিকের জন্য যে ভেবেছিলো, এই ছেলে বুঝি সেই অসভ্য ছেলে তা ভেবে টিকলি নিজেকেই ধিক জানালো। আসলে এই লোকটা তো টিকলির ভালো চায় তাই বকা-ঝকা করেছে। কিন্তু ওই লোকটা তো কারনে অকারণে অপমান করে। অভদ্র লোক একটা! টিকলি সৌজন্যে একটা হাসি উপহার দিয়ে কোল্ড ড্রিংকস টা নিয়ে সহাস্যে বলল, ‘আচ্ছা আপনি কি করেন?’

‘ নিউরোলজিস্ট।’ আরেকটা বোতলে মুখ লাগালো আদর। এরপর প্রশ্ন করলো, ‘তো দাঁড়িয়ে আছেন কেনো এখনো?’

টিকলি কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবতে বসলো। পুরো সমস্যার বীজটা তো এখানেই? দাঁড়িয়ে আছে কেনো? আর এই দাঁড়িয়ে থাকার পেছনে রয়েছে পুরো ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের ব্যখ্যা হলো, হাতিয়ার এই ঘাট থেকে মোটরসাইকেলে করে যেতে হবে হাতিয়ার একদম শেষ মাথা মোক্তারিয়া ঘাটে। এখন সমস্যার মূল শেকড় টা হলো মোটরসাইকেলে যাবে কীভাবে? এক মোটরসাইকেলে দুজন মেয়ে বসা সম্ভব না। সুতরাং, টিকলি এবং টায়রাকে দুটো মোটরসাইকেলে যেতে হবে। তারউপর তারা কেউ ঠিকমতো জায়গাগুলো চেনে না। একা দুজন মেয়ে। স্থানীয় এলাকায় এসব ড্রাইভাররা হয় প্রচন্ড লেভেলের বেয়াদব। তাছাড়া মোটরসাইকেলে উঠলে লোকগুলোর কাধে হাত রাখতে হবে। টিকলি যদিও পেছনের হ্যান্ডেল ধরে যেতে পারবে কিন্তু টায়রা তো পারবে না। আর এই মোটরসাইকেলের ভেজাল শুনলে টায়রা যেতেই রাজি হবেনা। এখন কি করা যায়?

টিকলিকে চিন্তিত দেখে আদর তুড়ি বাজালো। চমকে টিকলি বলল, ‘হ্যাঁ?হ্যাঁ? কী?’

কপালে ভাঁজ ফেলে আদর বলল, ‘আচ্ছা মোটরসাইকেলে আপনারা যাবেন কীভাবে?’

তাদেরকে নিয়ে ভাবতে দেখে টিকলি বিস্ময় বোধ করলো। সাথে টিকলির মনটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় এর মতো উত্থাপন করলো। সে বলেই ফেলল, ‘আমাদের নিয়ে ভাবছেন যে?’

আদর একটুও বিব্রত বা বিভ্রান্তবোধ করলো না। সে হেসে খেলে বলল,

‘ডাক্তার মানুষ তো সবাইকে নিয়ে ভাবা একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই যে দেখুন না দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওই মহিলা। একপাশে একটা বাচ্চা, কোলে আরেকটা ছোট বাচ্চা এবং আরেক হাতে একটা মস্ত বড় ব্যাগ। তাকে দেখেও আমি ভেবেছিলাম, শীঘ্রই মহিলাটি অসুস্থ হয়ে পরবে। এতো ধকল আর শরীরে সইবে না। খুব সম্ভবত আজ রাতে মহিলাটির গা ব্যাথা করবে নয়তো পা ব্যাথা। জ্বরও হতে পারে। সেইক্ষেত্রে আপনি অল্পমাত্রার হলেও পরিচিত। আপনাকে নিয়ে ভাবা স্বাভাবিক।’

টিকলি অবাকপ্রসন্ন গলায় বলে, ‘বাব্বাহ! এতো ভাবনা?’

‘ভাবতে হয়। সবসময় ভাবনা চিন্তার উপরই থাকতে হয়। শুধু ডাক্তারদের না এভরিবডি শুড থিংক। এন্ড দে মাস্ট টু বি ট্রাই। এখন সেই প্রশ্নের উত্তরটা বলুন।’

টিকলি একটু ভাবলো কোন প্রশ্ন। পেছনের কিছু কথোপকথন ঘাটতেই বেরিয়ে এলো প্রশ্নটা। টিকলি নিচু গলায় উত্তর দিলো, ‘আসলে অপরিচিত জায়গা তারউপর আমরা দুজনেই মেয়ে। আবার মোটরসাইকেল করে নাকি যেতে হবে। এক মোটরসাইকেলে দু’বোন মিলে ড্রাইভার সহ গাদাগাদি করে বসা অসম্ভব। আর এসব ড্রাইভারগুলো তো হয় সুযোগসন্ধানী। সুযোগ পেলেই তাদের হাত নিশপিশ নিশপিশ করে।’

টিকলিকে থামিয়ে আদর বলল, ‘বুঝেছি। আর ব্যাখ্যা দিতে হবে না। কিন্তু আপনি চাইলে এক কাজ করা যেতে পারে। এক মোটরসাইকেলে তিনজন করে যাওয়া যাবে। আমি আপনি আর ড্রাইভার এবং আর্দ্র টায়রা আর ড্রাইভার।’

আদরের কথা শুনে টিকলি বড় বড় চোখ করে এক বাক্যে না করে দিলো। আদর একটু অবাক হলো। টিকলি নখ কামড়িয়ে আবারো ভাবতে বসলো, লাভটা কি হলো? সেই তো ঘুরেফিরে একই কথা। এক মোটরসাইকেলে ছেলেদের সাথে গাদাগাদি করে বসা তো কখনোই সম্ভব না। বুকের সাথে পিঠ লেগেই থাকবে। আর টিকলির পক্ষে তা অসম্ভব। টিকলি বিচক্ষণ। সব দিক ভেবে যেই দিক সুশীল এবং সুশৃঙ্খল সেই দিকেই পা বাড়াবে সে। কিন্তু এখানে তো কোনোটাই সুশীল নয় সব অশ্লীল। এখন উপায়?

আদর বোধ হয় ধরতে পারলো টিকলির চিন্তাধারা। সে বুঝে বলল, ‘আপনি যা চিন্তা করছেন সেটাও ঠিক আছে। মেয়ে হিসেবে আপনার এই চিন্তাকে আমি সমর্থন জানাচ্ছি। ‘

লজ্জায় টিকলি মাথা নোয়ালো। এই ফাঁকে আদর গেলো মোটরসাইকেলের ড্রাইভারদের সাথে কথা বলতে। মিনিট দশেক পরে ফিরেও এলো।

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here