বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব ৪

0
958

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ❤️
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

০৪.
আকাশে মুক্ত পাখিদের আনাগোনা। কিচিরমিচির শব্দে বাড়ি ফিরে যাওয়ার তাড়না আর একটুপরেই ডুববে সূর্য। ডুববে এই ধরণীতল আধার রাজ্যে। টিকলি রেডি হয়ে গেছে। মাথায় সাদা স্কাপ পরে গায়ে গোলাপি কামিজ জড়িয়ে হাতে একটা হলুদ কালারের ব্যাগ নিয়ে সে একবার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারলো। তখন হুরমুড় করে দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলো টায়রা। ক্ষনিকের জন্য ভয়ে টিকলির প্রাণ পাখি উড়ে গেলো। টায়রাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। টায়রা গলার মুখের ঘাম মুছে হাঁপ ধরা গলায় বলল,

‘সব রেডি টিকলি?’

‘ইয়েস ডান। কিন্তু আমাদের ব্যাগ?’

নিজের কালো রঙের হ্যান্ড ব্যাগটা হাতে নিতে নিতে টায়রা নিচু গলায় বলল, ‘ব্যাগপত্র সব রাতুলের বাসায়। কাল রাতে ওকে দিয়ে ওর বাসায় রেখেছি। লঞ্চ ছাড়ার ঠিক আধ ঘন্টা আগে এসে দিয়ে যাবে।’

রাতুল ওদের ব্যাচমেট। ছেলেটাকে বোকাসোকা পেয়ে টায়রা ওকে বাদর নাচন নাচায়। টিকলি প্রশ্ন করলো, ‘কয়টায় লঞ্চ?’

টায়রা তখন নিজের আর টিকলির আর কিছু বাবা মায়ের ঘর থেকে চুরি করা টাকা গুনছিলো। টিকলির কথা শুনে ঠাস করে টাকা গুলোকে বিছানার উপর রেখে তেজি গলায় বলল,

‘তোর জন্য আমরা পালাইতাছি। আর তুই জানোস না লঞ্চ কয়টায়? ভাই তুই কই থাকোস? দিন দুনিয়ার আছোস নাকি নাই?’

টিকলি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল, ‘যাই হোক। আমরা তো এখনি বের হবো নাকি? বাবা মা কোথায়?’

‘হুম এখনি বের হবো। সাড়ে পাঁচটায় লঞ্চ। লঞ্চের নাম এম ভি.তাসরিফ-১। ডাবল কেবিন নিয়েছি। ভাড়া ২২০০ টাকা।’ টায়রা ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বলল,

‘আর এখন বাজে চারটা। বাবা মা বিকাল বেলা ঘুমোয় তা নিশ্চয়ই তুমি জানো? আমরা এখন বের হবো। সদরঘাট পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে যাবে পাঁচটা। তারপর রাতুল আসবে। আমরা ব্যাগ নিবো। লঞ্চে উঠবো। কেবিন খুঁজবো। তারপর কেবিনে ঢুকে পায়ের উপর পা তুলে নোয়াখালীর হাতিয়া চলে যাবো। সেখান থেকে নিঝুম দ্বীপ। আর কিছু জানার আছে?’

টিকলি চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘না।’

‘তাহলে চলো এবার।’ টায়রা ব্যাগপত্র নিতে নিতেই বলল, ‘টাকা গুলো তোর কাছে রাখ। আমি কেয়ারলেস। হারিয়ে ফেলবো।’

টিকলি টাকা গুনে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা চল।’

দরজার মুখে এসেই দাঁড়িয়ে পরলো টায়রা। টিকলির মতো নখ কামড়াতে কামড়াতে বলল, ‘ওই, কাজের লোকগুলো আছে তো।’

টিকলি তার চশমার নিচে বাম চোখ টিপে দিয়ে বলল, ‘টেনশন নিস না। দুপুরে খাওয়ার সময় ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় দিছি।’

বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে টায়রা ফিক করে হেসে দিলো। একটা হাই ফাই দিয়ে বলল, ‘তুই মামা বহুত সেয়ানা। চশমার আড়ালে দেখাস ভদ্র বাচ্চা।’

‘চল তো দেরি হয়ে যাচ্ছে। আব্বু আম্মু উঠে পরবে।’

____________________________

কাল রাত থেকেই উদাও খান বাড়ির দুই ছেলে। আজিম খান মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন এবং মনোয়ারা খান বিলাপ পেরে বৃথা চোখের পানি ভাসাচ্ছেন। আজিম খান কপালে হাত রেখে হাতের মুঠোয় ধরে থাকা চিঠিটাতে আরেকবার চোখ বুলালেন। চিঠিতে লেখা,

আমার সম্মানিত পিতা,

আমি আপনার একান্ত বাধ্যগত সন্তান। আপনার সকল সিদ্ধান্তকে আমি বরাবরই সমর্থন করে এসেছি। কিন্তু আমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার মতো আপনার এই বিদগুটে অবান্তর সিদ্ধান্তকে আমি অসমর্থন করেছি প্রথম দিন থেকে। কিন্তু আপনি কথা শুনলেন না। আজ আপনার দেখা আরো একটি পাত্রীর সাথে আমাকে সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও আপনার সেই ইচ্ছা পূরণ করতে পারছি না বলে আমি দুঃখিত। তাই যথারীতি আমি আমার আদরের ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে ভেগে যাচ্ছি। যেদিন আপনার মাথা থেকে ভূত নামবে সেইদিন ফিরে আসবো। বিদায় আমার আব্বাজান।

ইতি,
আপনার ভদ্র ছোট বাচ্চার বড় ভাই।

মনোয়ারা খান বিলাপ পেরে হাত পা ছুড়ে কাদতে কাদতে বললেন, ‘ওরে আমরা কি অপরাধ করেছিলাম রে বাবা? ফিরে আয়। মায়ের কোলে দুই ভাই ফিরে আয়। এই জন্নমে আর বিয়ে করার কথা বলবো না। তোর বাপ বললে তার মুখ আমি সেলাই করে দিবো।’

আজিম খান বিরক্তিতে কপাল কুচকালেন। আজ সারাদিন স্ত্রীর এই আহাজারি শুনতে শুনতে তিনি ক্লান্ত। চিঠিতে আরেকবার চোখ রাখলেন। তিনি জানেন এ চিঠি তার বড় পুত্রের লেখা নয়। এ চিঠি তার একমাত্র ধড়িবাজ ছোট ছেলে আর্দ্রর লেখা। কারন আদর কখনো এসব মেয়েলী কথাবার্তা বলবে না বা এতো অতিভক্তি চোরের লক্ষণ টাইপ কথার চিঠিও লিখবে না। সে লিখলে অতিসংক্ষেপে আসল কথাটি ই লিখতো। কিন্তু যেই লিখুক, ছেলে দুটো যে ভেগে যায়নি বরং কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দেওয়ার জন্য বাইরে গেছে এটা বেশ বুঝতে পারছে আজিম খান। একটা হতাশ শ্বাস ফেলে তিনি সোফা ছেড়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

,

কাল সারারাত নিজের চেম্বারেই ছিলো আদর। লঞ্চটা সাড়ে পাঁচটায় হওয়ায় একদিন আগেই বাড়ি থেকে চলে যেতে হলো। কারন দিনের বেলা বাড়ি থেকে বের হওয়া ছিলো ভীষণ দুষ্কর। আর ভাইয়ের লেজ ধরে হাটিহাটি পা পা করে চলে এসেছে আর্দ্রও। এই চেম্বারেই দুই ভাই সারারাত হাসি ঠাট্টা, নাটক-মুভি দেখে পার করেছে।
পরের দিন সকাল হতেই রোগী দেখতে বসে গেছে আদর। বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত রোগী দেখে সে বের হয়েছে সদরঘাটের উদ্দেশ্যে।

আর্দ্র এলএলবি কমপ্লিট করে এখন ল’ প্র‍্যাকটিস করছে এক নামিদামী উকিলের সাথে পাশাপাশি BJS (Bangladesh Judicial Service) এর প্রিপারেশন নিচ্ছে। BJS অনেকটা BCS এর মতো। এই পরীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে মাজিস্ট্রেট বা জজ হওয়া যায়।

আর্দ্র আজ সারাদিন ছিলো তার এক বন্ধুর বাসায়। সদরঘাট থেকে বন্ধুর বাসা একটু দূরে হওয়ায় সে সাড়ে তিনটা সময় বেরিয়ে পরে লঞ্চের উদ্দেশ্যে।

_____________________________

মাথায় স্কাপ বেধে মুখে মাস্ক পরে দুইবোন দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট দশেক হলো মাত্র রাতুল ব্যাগ দিয়ে গেছে। দুই বোনের হাতে মাঝারি সাইজের দুটো ট্রলি। দেখে মনে হচ্ছে তারা দিন পনেরোর ট্যুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করবে। মেয়ে মানুষ তো! সবকিছুতে বেশি বেশি। একদিনের জন্য কোনো জায়গায় বেড়াতে গেলে পাঁচ দিনের জামা-কাপড় নিবে।

ঘড়িতে পাচঁটা দশ বাজে। বৃষ্টির দিন হওয়ায় আশেপাশে কাদা কাদা মাটি। এমতাবস্থায় ঘাটে চলাফেরা করা একটু দুষ্কর্ম। একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে হাওয়াই মিঠাই। মেঘলা আকাশ…বাতাসে ঠান্ডা আমেজ…আমোদিত সন্ধ্যা-বিকেল এর মাঝে হাওয়াই মিঠাই। টিকলি টায়রাকে বলল, ‘শোন, তুই উঠ। আমি একটু আসছি।’

‘মানে? কোথায় যাবি? লঞ্চ ছেড়ে দিবে। এমনিতেই আমরা আসতে দেরি করেছি।’ টায়রার গলায় হালকা তেজ।

টিকলি ইশারায় সামনে দেখিয়ে বলল, ‘তুই উঠ না, আমি হাওয়াই মিঠাই কিনেই আসছি।’

টায়রা বিরক্তি ভঙ্গিতে বলল, ‘হইছে তোর যাওয়া লাগবো না। আমি যাইতাছি। তুমি লঞ্চে উইঠে আমারে উদ্ধার করো।’

‘আচ্ছা তোর ব্যাগ রেখে যা। আমি উঠাচ্ছি। পরে ব্যাগ উঠাতে দেরি হয়ে যাবে।’
‘পারবি? শিউর?’
‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট।’
‘ওকে।’

টায়রা চলে যেতেই দুই ট্রলির দুই হাতল ধরে টিকলি নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে হালকা একটু উপরে তুলতে পারলো। বলাই বাহুল্য, ট্রলি দুটো ভীষণ ভারী যা টিকলির এই ছোটোছোটো হাত দুটো তার ভর সইতে পারছে না। কাদা মাড়িয়ে যেতেই শ্যাতশ্যাতে একটা স্থানে বৃষ্টির পানি জমে যাওয়ায় পিছলে উল্টে পরে যেতে নিলো টিকলি। চোখ মুখ কুচকে চিল্লানোর আগেই একটা শক্ত পোক্ত হাত এসে জড়িয়ে ধরলো তার সূক্ষ্ম, মিহি, কোমল কোমড়টা।

বৃষ্টির দিনগুলোতে বিকাল হলেই মনে হয় রাত নেমে এসেছে। সে ক্ষেত্রে এই বৃষ্টির দিনে বেলা পাঁচটা পনেরোকে মনে হচ্ছে যেনো সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে। আশেপাশে ট্রলার, লঞ্চ,জাহাজ গুলোতে অজস্র বাতি জ্বলে উঠেছে। কিছু লঞ্চ জাহাজ সাইরেন বাজিয়ে তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেছে তো কিছু যানবাহন যাত্রা আরম্ভ করবে।

এই শ্যাতশ্যাতে কর্দমাক্ত জমিনের উপর নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পেরে উল্টে পরে না গিয়ে কারোর উপর হেলে যাওয়ায় অবাক হলো টিকলি। ভয়ে কুচকানো চোখ জোড়ার পাটাতন আস্তে করে খুলল। সূর্য তখন ডুবি ডুবি। সেই ডুবন্ত সূর্যের হলুদ-লাল বৃষ্টিভেজা আলোয় মুখের ঠিক উপর হেলে পরে থাকা মাস্ক পরিহিতা এই ছেলের চোখ দুটো যেনো ভিষণ চেনা টিকলির। সাথে কপালটাও ভিষন রকমের চেনা। টিকলি উঠতে চাইলো কিন্তু কর্দমাক্ত এই জমিনে পা পিছলে আবারো পরে যেতে নিলো। প্রাণ বাঁচানো সেই ব্যাক্তি আবারো শক্ত করে ধরলো টিকলিকে। এরপর আস্তে করে উঠালো। কাদা-ছিট মাটিতে দাড় হবার পর ছেলেটার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরই বিস্ময় ঘেরা উঁচু গলায় তর্জনী আঙ্গুল দেখিয়ে টিকলি বলল,

‘আপনি?’

কাদার কবল থেকে এই মেয়েটাকে পরতে পরতে বাঁচানোর পরও তার এহেন ভাবভঙ্গিতে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আদর। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর আদর খেয়াল করলো এই সেই মেয়ে। যার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়ে। আদর নিজের বিস্ময় চেপে গিয়ে আমোদপূর্ণ খোঁচা দেওয়ার গলায় বলল,

‘ওহ আপনি! পনেরো দিনের প্রেগন্যান্সির পেইন নিয়ে এই সদরঘাটেও চলে এসেছেন? মানতে হবে আপনার স্পিরিট আছে। হাটস অফ টু ইউ।’

নাকের পাটাতন ফুলিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে যেই কিছু বলতে যাবে টিকলি ওমনি তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আদর বলল, ‘ওহ সরি। এখন তো আর পনেরো দিন না এখন তো আপনি এক মাস এক দিনের প্রেগন্যান্ট। বাহ! ভালোই ডেভেলপ হয়েছে দেখি! তা পেটের বাচ্চা কেমন আছে? লাথি টাথি দেয় এখনি?’

‘দেখুন..।’ টিকলির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আদর আবারো বলল,

‘আবার দেখবো? এই দেখানোর অভ্যাস টা আপনার এখনো গেলো না? যাই হোক, আপনি যেমন সুপার ফাস্ট। বিয়ে করার জন্য ছেলে দেখতে গিয়ে বলেন, আপনি পনে..রো দিনের প্রেগন্যান্ট। ভাবা যায়? তার বাচ্চার পক্ষে এই একমাস একদিনে পেটের মাঝে ফুটবল খেলাও সম্ভব। নাথিং ইজ ইম্পসিবল। যাই হোক, আপনার বয়ফ্রেন্ড ফিরে এসেছে? ওই যে বলেছিলেন যে, একমাস আগে বয়ফ্রেন্ড উদাও আর আপনি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট হলেন। এনিওয়ে, বাবা মাকে বলেছেন তো? আর আপনি না বললেও শুনেছি আমার বাবা নাকি বলে দিয়েছে..’

আদরের কথার মাঝেই টিকলি চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘সাট আপ। আপনি তো মহা ফালতুবাজ ছেলে। আপনার মতো অসভ্য, অভদ্র, ইতর আমি আর একটাও দেখি নাই। আপনার বাবা আমার বাবাকে অপমান করেছে। আপনি আমাকে অপমান করছেন। পেয়েছেন টা কি হ্যা? যত্তসব। ভালোই হয়েছে আপনার ফ্যামিলির সাথে সম্পর্ক না হয়ে। এখনি যা রূপ ভবিষ্যতে কি করতেন আল্লাহ জানে।’

‘কপাল ভালো তো আমার। সো কল্ড পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মহিলাকে বিয়ে করতে হয়নি।’ চোখ উল্টিয়ে আদর বলল।

‘উউফফ…আপনি..আপনি একটা অসহ্য।’ টিকলি ধপ ধপ শব্দ করে পা এগোলো লঞ্চের দিকে।

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here