বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব ৫

0
875

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ?
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

০৫.
আকাশ ডেকে উঠছে বারংবার। কালো আকাশটা থেকে টিপটিপ বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে শরীর। ছুয়ে দিচ্ছে হালকা করে গায়ের লোমকূপ। টায়রা দৌড়ে গেলো হাওয়াই মিঠাইওয়ালার কাছে। বৃষ্টি থেকে খানিকটা রেহাই পেতে মাথার উপর এক হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

‘মামা দুটো হাওয়াই মিঠাই দেন তাড়াতাড়ি। ‘

সাথে সাথেই পাশ থেকে কেউ ভরাট জেদি গলায় বলল,

‘মামা আমারটা আগে দেন।’

টায়রা অবহেলায় সূক্ষ্ম চোখে তাকালো পাশের সেই অজানা মানুষটার দিকে। এরপর আবার তাকালো হাওয়াই মিঠাইওয়ালার দিকে। তেজি গলায় বলল, ‘আমি আগে চেয়েছি।’

আর্দ্র হচ্ছে পরিবেশবান্ধব। পরিবেশের সবকিছু তাকে সহজে আকৃষ্ট করে। অন্যদিকে আদর সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে। সে আকৃষ্ট হয় কম। কোনোকিছুতেই সে ভয়ানক রকম খুশি বা চমকায় না। সেদিক থেকে আর্দ্র ব্যাতিক্রম। এই রাস্তার ধারের মেয়েদের মতো ফুচকা, হাওয়াই মিঠাই, আইসক্রিম খেতে আর্দ্রর ভালো লাগে বৈ কি! অন্যদিকে আদর এসব দেখলেই নাক ছিটকায়। এখন হাওয়াই মিঠাই কিনতে এসেও আর্দ্র পরেছে আরেক বিপাকে। কোথা থেকে এক মেয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসে তার সাথে পাল্লাপাল্লি করছে৷ হল্লা শুরু করে দিয়েছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে আর্দ্র নবাবি চালে বলল,

‘এই যে ম্যাডাম আপনার আগে আমি এসেছি।’

টায়রা এবার পুরোদস্তুর ছেলেটার দিকে তাকালো। হলুদ ফর্সা তার গায়ের রং, থুতনিতে মাস্ক আটকে রেখেছে। উঁচু দাম্ভিক নাক, খয়েরি বর্ণের ঠোঁট, অতলান্ত গহীন এক জোড়া শক্ত চোখগুলো বিদ্যমান। বলিষ্ঠ স্পন্দমান তার দেহ, চওড়া বুক পিঠ। সাদা শার্ট টা খুব সুন্দর করে আটসাট ভাবে গেঁথে গেছে তার বলিষ্ঠ বুকটাতে। লোকটা দেখতে সুন্দর হলেও মুখের বুলি ক্যারক্যারা। টায়রা ফুসে উঠে বলল,

‘আমি আগে চেয়েছি।’

পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে এই টিপটিপ বৃষ্টির মাঝে হালকা ভিজতে ভিজতে আর্দ্র বলল, ‘জি না। আমি আগে এসেছি। আমি বলতে যাবো ওমনি আপনি হনহন করে হাওয়াই মিঠাই চেয়ে বসলেন।’

‘সো আলটিমেটলি আমি ই আগে এসেছি।’ টায়রা মুখ বাকিয়ে বলল। কিন্তু মাস্কের আড়ালে আর্দ্রর চোখে তা পরলো না।

আর্দ্র বিরক্ত চোখে চেয়ে বলল, ‘আপনি তো ভারী চাপাবাজ মেয়ে।’

ফুসে উঠে টায়রা একটানে মুখ থেকে সাদার উপর নীল সুতোর নকশা করা মাস্কটা টান দিয়ে থুতনি পর্যন্ত নামিয়ে আনলো। দৃশ্যমান হলো তার ঠোঁট, নাক, গাল। টায়রার মনে হয়, মাস্ক পরে থাকলে মন মতো ঝগড়া করা যায় না। অপর মানুষটা তো তার রিয়েকশন ই বুঝবে না মুখ না দেখলে।

আর্দ্র দেখলো তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে রজনীগন্ধার ফুলের ন্যায় দস্যি এক মেয়ে। যেখানে সেখানে দস্যিপনা করাই যার একমাত্র প্রধান কাজ। বৃষ্টির ঠান্ডা জোরালো বাতাসে তখন ঘাটের এক পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে ঝড়ে পরছিলো লাল ফুল। বিছিয়ে দিচ্ছিলো রাস্তায় লাল গালিচা। রাগে লাল হয়ে যাওয়া টায়রার গাল, জিদে ফুলিয়ে রাখা ঠোঁট, ট্যাপা নাক, বড় কপাল, তেজে ছোট ছোট হয়ে আসা ভাসমান দুটি নয়ন… ইশশ কি সুন্দর সব! তার আকাশি স্কাপে মাথার অর্ধেক চুল ঢাকা। বৃষ্টির ফোটায় সম্মুখ ভাগের কালো চুলগুলো ঢেকে গেছে সাদা সাদা চিকচিকে মুক্তোর ন্যায় জ্বলজ্বল করা পানিতে। মেয়েটাকে দেখে আর্দ্র কথা হারিয়ে ফেলল গহীন জঙ্গলে। সেই জঙ্গলে কথা খুঁজতে গেলে অনেকটা সময় পার হয়ে যাবে এখন। এর মাঝে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে হাওয়ায় উড়াল দিলো টায়রা।

এখন বাজে পাঁচটা বিশ। আদর ভাইয়ের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। নিচু গলায় একটু বিরবির করে সে বলল, ‘এই ছেলেটা বড্ড কেয়ারলেস। মেয়েদের মতো শুধু তার ছুকছুক স্বভাব। কোনো দরকার ছিলো এখন হাওয়াই মিঠাই কিনতে যাওয়ার? গেলো তো গেলোই এখন আসছেও না।’

আদর এগিয়ে গেলো একটু। কিছু কদম যেতেই দেখা পেলো তার অতি বুদ্ধু ভাইটির। যে কিনা হাওয়াই মিঠাইওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক দৃষ্টিতে সম্মুখে চেয়ে। আদর এগিয়ে গিয়ে কাধে এক চাপড় মারলো। আর্দ্র লাফিয়ে উঠলো। এরপর ভাইকে দেখেই মাথা চুলকে হেসে দিলো। আদর বলল,

‘থাপ্পড় দেওয়া দরকার। হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো এখানে? চল।’

_____________________________

গোলাপি পায়জামা টার নিচের দিকটায় কাদায় মাখামাখি। টিকলির নাকে সাদার উপর গোলাপি কারুকাজ করা মাস্ক। ঠিক টায়রার মতো। ওরা দুই বোন একই জিনিস পরতে এবং একভাবে সাজতে ভালোবাসে।
নাক ছিটকে টিকলি দুই ব্যাগের হাতল ধরে অনেক কষ্টে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো হঠাৎ কেউ ছু মেরে তার বাম হাত থেকে একটা ট্রলি নিয়ে হাটা শুরু করলো। টিকলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। অবাক হয়ে দেখলো অগ্নিশর্মা টায়রা ঠক ঠক শব্দ তুলে জোরেসোরে ট্রলি টা নিয়ে যাচ্ছে।

কেবিনের দরজার সামনে এসে টিকলি জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’

ওদের মধ্যে আবার কোনো আড়াল টাড়াল চলে না। দুজনের কাছে সবসময় সত্যি কথা বলার ওয়াদা বদ্ধ তারা। টায়রা ফুসে উঠে টিকলির হাতে ঠাস করে একটা হাওয়াই মিঠাই ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার এই হাওয়াই মিঠাইয়ের জন্য আজকে আমাকে অপমানিত হতে হলো।’

টিকলি অবাকপ্রসন্ন গলায় বলে, ‘অপমান করেছে? তোকে? এ বুকের পাটা কারোর হয়েছে বুঝি? কেউ একটা বললে তো তুই দশটা শুনিয়ে দিস।’

টায়রা গরম চোখে তাকালো টিকলির দিকে। কেবিনের ভেতর ঢুকে টিকলি মাস্ক খুলে জোরালো এক শ্বাস নিলো। টায়রা এতোক্ষন বাদে টিকলির দিকে ভালো ভাবে নজর দিতেই উঁচু গলায় বলল, ‘হায়হায়! তোর পায়জামার কাদা কেনো? কার সাথে কুস্তি লড়ছস?’

বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে গেলো টিকলির মুখ। চোখে মুখে আরক্তিম ভাব ফুটিয়ে সে বলল, ‘লঞ্চে উঠার সময় পা পিছলে কাদার মধ্যে পরে যেতে ধরেছিলাম। তখন একটা ছেলে এসে আমাকে বাঁচায়। তখনি বোধ হয় কাদা লেগেছে?’

টায়রা একটু ভেবে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো, ‘কোন ছেলে?’

‘যার সাথে আমার বিয়ের হওয়ার কথা ছিলো।’ চোখে মুখে তিক্ত ভাব ফুটিয়ে টিকলি আবারো বলল, ‘ছেলেটা মারাত্মক ফাজিল, ফালতু এবং অসভ্য, অভদ্র। আমাকে আজ আবারো খোঁচা দিয়ে অপমান করেছে।’

বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে টায়রা বলল, ‘হাইরে! তোকে চিনে ফেলছে? এখন যদি বাবাকে ফোন দিয়ে বলে আমরা সদরঘাটে?’

কপালে ভাঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে টিকলি বলল, ‘পাগল নাকি তুই? সে কেনো বাবাকে বলতে যাবে? সে জানবে কিভাবে আমরা পালাচ্ছি? তাছাড়া আমাদের সাথে কি তার কোনো সম্পর্ক আছে? সে আমাদের কেউ হয়? সে বলার কে? আশ্চর্য!’

টায়রা গালে হাত দিয়ে বসলো। টিকলি পাওয়ার লেন্সটা খুলে চোখে তার মোটা ফ্রেমের চশমা লাগালো। মাস্ক পরা অবস্থায় টিকলি চশমা পরে না তখন সে চোখে লেন্স লাগায়। কারন মাস্কের জ্বালায় কিছুক্ষন পরপর চশমা ঘোলা হয়ে যায়। তখন চলতে ফিরতে অসুবিধা হয়।

পোশাক চেঞ্জ করে চোখে চশমা লাগিয়ে টিকলি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল, ‘উফফ..ফাইনালি টেনশন ফ্রি।’

টায়রাও হাপ ছেড়ে বাঁচা গলায় বলল, ‘হুম।’
‘যা চেঞ্জ করে আয়। বৃষ্টিতে তো ভিজে গিয়েছিস। ঠান্ডা লাগবে।’

টায়রা চলে গেলো ওয়াশরুমে। লঞ্চ সাইরেন বাজালো। বোধ হয় এখনি যাত্রা আরম্ভ করবে। লঞ্চ ছাড়তে ছাড়তে বেজে গেলো প্রায় ছয়টা। ঘন কালো ধূসর রঙের আকাশটাতে পরিবেশ কালো হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। টায়রা ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসলো। একটু পর মাগরিবের আজান দিলো। টিকলি নামাজ পড়ে উঠে ফোন হাতে নিতেই দেখলো ফোনটা সাইলেন্ট এবং মায়ের নাম্বার থেকে তিনটে মিসড কল। টিকলির হাতে ফোন থাকা অবস্থাতেই মায়ের নাম্বার থেকে আবারো কল আসলো। শ্বাসরুদ্ধ গলায় সে বলল,

‘টায়রা, মা ফোন দিয়েছে।’

টায়রা তখন বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খাচ্ছিলো। টিকলির কথা শুনে তার মুখ থেকে ছিটকে পানি পরে গেলো। চোখ মুখ লাল করে সে কাশতে লাগলো। টিকলি টায়রার পিঠে হাত বুলালো কিছুক্ষন। এদিকে শায়লা আক্তার ফোন দিয়েই যাচ্ছেন। টায়রা এবার তেজি গলায় বলল,

‘তুই ফোন অফ করস নাই?’

‘মনে ছিলো না। আর মনে থাকবে কেমনে আমি তো সারাদিনে দুইবারও ফোন হাত দিয়ে ধরি না।’

টায়রা আদেশরূপে বলল, ‘তাড়াতাড়ি অফ কর যা।’

ফোনের স্কিনে ভেসে উঠেছে মায়ের হাস্যোদ্দীপক মুখখানা। গেঁজ দাঁত তার ঝিলিক দিচ্ছে। শ্যামলা মুখখানাটাতে ভারী মায়া। টিকলি হয়েছে একদম মায়ের মতো শুধু তার গায়ের রং টা ফর্সা। বাবার রং পেয়েছে সে। অন্যদিকে টায়রা দেখতে একদম বাবার মতো কিন্তু তার গায়ের রং টাকে শ্যামলাও বলা যায় না আবার ফর্সাও বলা যায় না। মাঝখানে একটা। ফোন অফ করতে গিয়েও মায়ের মায়াভরা মুখখানা দেখে ফোন অফ করতে পারলো না টিকলি। অসহায় মুখে বলল,

‘আম্মু চিন্তা করবে। আমি একটা মেসেজ পাঠিয়ে তারপর ফোন অফ করে দিচ্ছি।’

টায়রা মুখ বাকিয়ে বলল, ‘মায়ের বাধ্য সন্তান রে..।’

আগেই বলেছিলাম, টায়রা একটু বেপরোয়া। কোনো দিকে তার হুশ নেই। চিন্তামুক্ত থাকতেই পছন্দ করে সে সবসময়। তার জীবনটা উচ্ছোন্নে গেলেও সে হাসিমুখে ঠাট্টার সুরে বলবে, ‘এখন উচ্ছোন্নে যাচ্ছো যাও। কিন্তু ঠিক সময় আবার যথাস্থানে ভদ্রভাবে ফিরে এসো।’

অন্যদিকে টিকলি বিনয়ী, তেজি, মারাত্মক ঠান্ডা মেজাজের রাগী। চারিপাশে মানুষজনদের নিয়ে তার ভাবনার একশেষ। নিজের প্রতি সে কেয়ারলেস। চিন্তারা সারাক্ষন তার মাথায় কিলবিল করতে থাকে। এক মিনিটের জন্যেও শান্তি দেয় না। সবার প্রশান্তিতেই তার সন্তুষ্টি। বাড়ির বড় মেয়েগুলো বুঝি টিকলির মতোই হয়। আর ছোট গুলো টায়রার মতো।

টিকলি মেসেজ পাঠালো, ‘আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে কেনো লেগেছো মা? আমি চলে যাচ্ছি। যেইদিন তোমাদের ঘাড় থেকে এই ভূত নামবে এবং মেয়ের মর্ম বুঝতে পারবে সেইদিন ফিরবো। আর টায়রা আমার সাথে আছে। চিন্তা করো না। ভালো মতো থেকো। লাভ ইউ মা।’

টায়রা এবার একটু চিন্তিন মুখে বলল, ‘আচ্ছা ওই ছেলে এই ঘাটে কি করছিলো?’

‘কোন ছেলে?’ টিকলির প্রশ্ন।

‘ওই যে যার সাথে তোর বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। ধুর ছাই নামটাও জানি না। তুই এমন কেনো বল তো? যার সাথে বিয়ে করতে যাবি তার নামটাও জানিসনি। এমনকি মুখটাও দেখিসনি। আমি হলে চোদ্দগুষ্টির নাম মুখস্ত করে যেতাম। আর ছেলের মুখ দেখা ছাড়া তো নরতামই না। যতই বিয়ে না করি।’

‘আমি তো তুই না। আমি তো আমিই।’ চশমাটা ঠিক করে চোখে লাগিয়ে বলল টিকলি।

‘হুম বুদ্ধিহীন, নির্বোধ, সহজ-সরল বালিকা। যাই হোক, কি করছিলো সে?’

‘আমি কি তার বিয়ে করা বউ? আমি সবকিছু জেনে বসে আছি?’ টিকলির তেরছা উত্তর।

‘তাও ঠিক। কিন্তু তুই জাতির বউ। বিয়ের আগে সব ছেলেমেয়ের একে অপরের উপর পঁচিশ পার্সেন্ট অধিকার থাকে। আমার উপরেও আছে ডোন্ট ওয়ারি। চাপ নিও না ময়না।’ টায়রা বাম চোখ টিপে বলল। টিকলি হেসে টায়রার পিঠে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিলো।

টায়রা ছোট ছোট চোখ করে বলল, ‘হাসতে হাসতে মারো? ভালোই তো টেকনিক শিখছো বনু।’

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here