অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_০৯

0
7439

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_০৯

বুকের উপর দু হাত ভাজ করে রেখে সোফায় চুপটি করে বসে থাকে অনি। একটু পর দরজায় খট খট আওয়াজ শোনে।সাথে ভেসে আসে রিশার কণ্ঠ।অনি ভ্রু কুঁচকে ভাবে সে তো দরজা লক করেনি তাহলে নক করছে কেন?কিছু একটা মনে হতেই সে দরজার কাছে যায়। রুমে ঢোকার সময় সে দরজাটা কিছুটা লাগিয়ে দিয়েছিল। দরজা খুলেই রিশা একটা লম্বা হাসি দেয়।যার অর্থ অনির বোধগম্য হয় না।

রিশার সাথে দাঁড়িয়ে ছিল শায়লা বেগম যাকে দেখে অনি কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করে।দরজা এভাবে লাগানোর জন্য সে মনে মনে বেশ লজ্জা পায়। শায়লা বেগম ও রিশা দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে।

রিশাদ চোখ মেলে তাকিয়ে তার মা আর বোন কে দেখে নিজেকে সংযত করে নেয়।সে কারো সামনে তার অসহ্যকর যন্ত্রণাগুলো প্রকাশ করতে চায় না। বিশেষ করে তার মায়ের সামনে।

শায়লা বেগম বিছানায় বসে অনিকে তার পাশে বসান।তার হাতে ছিল কয়েকটা শপিং ব্যাগ আর গয়নার বাক্স। অনি ব্যাগগুলো দেখে কিছু একটা অনুমান করতে পারে তবে সে কিছু না বলে শায়লা বেগমের বলার অপেক্ষায় থাকেন।

শায়লা বেগম অনির হাতে শপিং ব্যাগ আর গয়নার বাক্সগুলো দেন।অনি কিছুটা ইতস্তত বোধ করে শপিং ব্যাগগুলো হাতে নেয়।

শায়লা বেগম অনির অবস্থা বুঝতে পেরে বলেন;
প্রথম যেদিন তোর সাথে আমার আলাপ হয় সেদিন থেকেই আমি তোকে আমার রিশাদ রিশা অদ্রির মতোই দেখি। দেখনা অদ্রিটা কি করল আমার ছেলের সাথে।আমি তো ওকে কম ভালোবাসিনি। আমার রিশাদ রিশার চেয়ে বেশিই ভালোবাসতাম। অদ্রিকে আমার মেয়ের মতোই ভালোবাসতাম;তার থেকেও বেশি বলা চলে।ওর বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই তবে মন থেকে কোনদিনও ভালোবাসতে পারবো না রে।ও ওর জীবনে ভালো থাকুক। আমি শুধু চাই আমার
ছেলেটাও একটু ভালো থাকুক। প্রথম যেদিন ও বাড়িতে তোকে দেখেছিলাম অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করেছিল।তোকে প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লেগে গেছিল। তবে তুই আমার আঁধার ঘরে আলো করে আসবি তা আমি কোন দিন কল্পনাও করিনি। আল্লাহ হয়ত অন্যকিছু ভেবেছিল তাইতো আমার ঘরে তোকে পাঠিয়েছেন। সবকিছু মেনে নেয়া সহজ না ঠিকি তবে অসম্ভব ও না কিন্তু। সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। শুধু আমাদের ছেড়ে যাস না। দেখবি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। আজ এই বিয়েটা হয়ত তোর সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক মনে হতে পারে তবে একদিন দেখবি এই বিয়েটার জন্য শুকরিয়া আদায় করবি।

অনি খুব মনোযোগ দিয়ে শায়লা বেগমের কথা গুলো শুনছে।শায়লা বেগমের কথাগুলো তার মাথায় ঘুরপাক করছে।তবে অনি এখন ভীষণ ভাবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। সে চুড়ান্ত ভাবে কোন পরিণতিতে পৌঁছাতে পারছে না।অদ্রির জায়গায় নিজেকে রাখা অনির পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। অনির জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে অদ্রির বিচরণ। তার জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে যে মানুষগুলোকে অনি তার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো অদ্রি।তাই সে সবকিছু এত সহজে মেনে নিতে পারছে না। চরম বিড়ম্বনায় পড়ে যায় সে। রিশাদের পরিবারে সবাইকে এই সীমিত সময়ের মধ্যেই অনির খুব কাছের মনে হয় শুধুমাত্র রিশাদ ব্যতীত। রিশাদের প্রতি অনির সেরকম কোন কোন অনুভূতিই কাজ করে না। দায়সারা ভাবে সে নিজের দায়িত্ব গুলো পালন করে চলেছে।রিশাদের মায়ের কথায় অনি সেভাবে কোন জবাব দিতে পারেনা। অনি কিছুটা শান্ত গলায় বলে; আন্টি আপনি কোন চিন্তা করবেন না।আমি চেষ্টা করব।ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।

শায়লা বেগম অনির কথা শুনে কিছুটা আস্বস্ত হন।তিনি অনির অবস্থাটাও উপলব্ধি করতে পারেন।তাই তিনি অনিকে এই বিষয়ে আর কিছু বলেন না।তিনি মনে মনে ভাবেন মেয়েটাকে কিছুদিন সময় দেয়া উচিত। অনির গালের উপর দুহাত রেখে কপালে স্নেহের পরশ এঁকে দেন শায়লা বেগম। শায়লা বেগম চুমু খাওয়ায় অনি ভেতর থেকে কেঁপে ওঠে। তার মনে এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। খুশিতে তার চোখমুখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। শায়লা বেগমের কাছ থেকে সে মায়ের ভালোবাসা অনুভব করতে পারছে যেটা সে তার বাইশ বছরের জীবনে কোনদিনও অনুভব করেনি। এই মূহুর্তে তার মনে হচ্ছে শায়লা বেগমকে জড়িয়ে ধরে তার আটকে থাকা অশ্রুগুলোকে বিসর্জন দিতে। তার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে শায়লা বেগম আদুরে গলায় বলেন;
দেখতো এই শাড়ি গুলা তোর পছন্দ হয় কিনা। এগুলা আমি নিজে পছন্দ করে কিনেছি আমার ছেলের বউয়ের জন্য। আর এই গয়না গুলো রাখ।
অনি আবারো ইতস্ততভাবে গয়নাগুলো নেয়।এই মানুষটাকে না বলার সাধ্য অনির নেই। তাই সে শায়লা বেগমের মান রাখতে গয়নাগুলো নিয়ে নেয়।
শায়লা বেগম অনিকে বলেন;
গোসল করে এখান থেকে একটা শাড়ি পরে নিবি কেমন।বাড়ির নতুন বউ শাড়ি না পরলে হয় বল। আর শাড়ির সাথে গয়নাও পরবি কিন্তু।তোরা আজকালকার মেয়েরা তো গয়নাগাটি একদমই পরতে চাস না। খান বাড়ির একমাত্র বউ তুই খালি গায়ে থাকলে একদম মানাবে না।

শাড়ি পরার কথা শুনে অনির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে কখনো শাড়ি পরেনি। জীবনে প্রথম ও শেষবার শাড়ি পড়েছিল তার অপ্রত্যাশিত বিয়ে উপলক্ষে। সে ভেবে পায়না এখন কি করবে। ফ্যালফ্যাল করে শায়লা বেগমের দিকে চেয়ে থাকে।অনির এই চাহনির সাথে শায়লা বেগম পরিচিত নন তাই তিনি অনির মনের কথা বুঝতে না পেরে অনিকে বলেন; কোন সমস্যা তোর? এটা তোর নিজের বাড়ি তাই একদম নিজের বাড়ির মতো করেই থাকবি। কোন সমস্যা হলে সরাসরি আমাকে বলবি। শায়লা বেগমের মাথাতেই আসে না যে অনি শাড়ি পরতে জানে কিনা।

অনি শায়লা বেগমের কথায় কিছু না বলে ঘাড় ঘুরিয়ে সম্মতি জানায়। শায়লা বেগম অনির সাথে আরো টুকটাক কিছু কথা বলে বেরিয়ে যান। রিশাও একটু পর চলে যায়।

অনি ভেবে কূল পায় না সে কিভাবে শাড়ি পরবে।এই মূহুর্তে তার মনে হচ্ছে তার বাংলাদেশে আসাই উচিত হয়নি।এখানে না আসলে এত বিরক্তিকর সব পরিস্থিতিতে পরতেই হত না। তার মেজাজ এখন খারাপ। একিরাশ বিরক্তি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ধুপ করে দরজা লাগিয়ে দেয়।

এতক্ষণ রিশাদ আড়চোখে অনিকে দেখছিল। সে বুঝতে পেরেছিল অনি কিছু একটা নিয়ে খুব বিরক্ত হয়ে আছে কিন্তু তার পেছনের কারণ সে বুঝতে পারছিল না।ধুপ করে দরজা লাগিয়ে দেয়ায় রিশাদ চমকে ওঠে। সে মনে মনে ভাবতে থাকে; এই মেয়েটার আবার কি হলো? ভূত টূত চেপে বসল নাকি আবার??

অনেক সময় নিয়ে গোসল শেষ করে অনি।কোনমতে শাড়িটা গায়ের সাথে পেচিয়ে নেয় অনি। কুচির জায়গাটায় বেশ খানিকটা ফুলে আছে।আচলটা বেশি লম্বা হয়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।কোনমতে কোমড়ের সাথে আটকে আছে শাড়িটা। অনি বুঝতে পারছে না সে ঠিকমতো শাড়িটা পরতে পেরেছে কিনা।বার বার কোমড়ের চারপাশ দিয়ে বেরিয়ে আসা অংশগুলো গুজে দিচ্ছে।অনেকটা সংকোচবোধ নিয়ে সে বেরিয়ে আসে।

দরজা খোলার আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকায় রিশাদ। সে যেন অনির বেরিয়ে আসার অপেক্ষাতেই ছিল। অনি বেরিয়ে আসতেই রিশাদ পা থেকে মাথা পর্যন্ত তার দিকে চোখ বুলায়। মাথায় চুলগুলো সাদা তোয়ালে দিয়ে পেচানো হালকা গোলাপি রঙের শাড়িটা যেকোন সময় খুলে পরতে পারে ভয়ে অনি সেগুলোকে বার বার এদিক ওদিক থেকে গুজে গুজে ঠিক করে নিচ্ছে। অনিকে এই অবস্থায় দেখে রিশাদ পুরো ঘটনাটা বুঝতে পেরে ফিক করে হেসে দেয়। হাসির শব্দ পেয়ে অনি রিশাদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।

রিশাদ অনিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরো জোরে জোরে হেসে দেয়।অন্য কোন মেয়ে হলে রিশাদের এই হাসি দেখে তার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকত।তবে রিশাদের এই হাসি অনির ক্রোধ মিশ্রিত বিরক্তির মাত্রা যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে।

অনি রিশাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে রাগান্বিত গলায় বলে; আপনার সমস্যা কি? এভাবে হাসছেন কেন পাগলের মত?
রিশাদ হাসি মুখে জবাব দেয়;আমি পাগলের মতো হাসছি না।লোকে আপনাকে দেখলে পাগল বলবে যে ভাবে শাড়ি পরেছেন। উফফ পাগলও হাসবে আমি তো সুস্থ মমস্তিষ্কের মানব।

রিশাদের কথায় অনি আরো বেশি বিরক্ত হয়। তবে সে কোন কথা বলেনা।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এই মূহুর্তে তার খুব অসহায় লাগছে। অনির অসহায় চাহনি দেখে রিশাদ হাসি থামিয়ে বলে;
অনেক কিছু তো করলেন আমার জন্য। আরেকটু কষ্ট করে আমার ফোনটা একটু দিবেন প্লিজ??

অনি কোন উত্তর না দিয়ে সাবধনতার সহিত হেটে রিশাদের ফোনটা এনে দেয়।

রিশাদ কাউকে একটা ফোন দিয়ে বলে;
হ্যালো বুড়ি একটু আমার রুমে আসবি প্লিয। খুদ দরকার এক্ষুণি আয়।
রিশাদ ফোন রেখে দেয়।অপর পাশের ব্যক্তি কি বলে তা অনি শুনতে পায়না।

অনি অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। রিশাদকে মিন মিন করে বলে;
আপনি কাকে ফোন করলেন? আপনি কি সত্যিই সবার সামনে পাগল বানাবেন নাকি?? এমন করছেন কেন কি করছি আমি আপনার?

অনির কথায় রিশাদ এক দফা হেসে নিয়ে অনিকে বলে;
আপনার সব সময়ই যে বেশি বেশি ভাবার অভ্যাস তা আমি প্রথম দিনেই বুঝে গেছি। ছোট্ট মাথায় এত প্রেসার না দিয়ে একটু ধৈর্য ধরে বসে থাকুন সব বুঝতে পারবেন।

অনি মুখ গোমড়া করে বসে থাকে।একটু পর রিশা রুমে প্রবেশ করে। রিশাকে রুমে আসতে দেখে অনির কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে রিশাদ রিশাকে বুড়ি বলে ডাকে। অনক রিশাদের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সে মিটমিট করে হাসছে। অনির প্রচণ্ড রাগ হয় তবে তা সে রিশার সামনে প্রকাশ করেনা। মনে মনে ভাবে; আমকে নাকানিচুবানি খাইয়ে মজা নিচ্ছেন তো আপনাকে যদি এর চেয়ে দশ গুণ বেশি নাকানিচুবানি না খাইয়েছি আমার নাম অনন্যময়ী শেখ না।

রুমে ঢুকেই রিশা তার ভাইকে বলে;
কিরে ভাইয়া আমার এত জরুরি তলব কেন?? কি দরকার??
রিশাদ তার আঙুল অনির দিকে করে অনিকে দেখিয়ে বলে দরকারটা আমার না ওনার।

রিশা অনির দিকে তাকাতেই অনি একটা বোকা মার্কা হাসি দেয়।

অনিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে রিশা ঘর কাঁপানো হাসি দেয়। রিশাদ ও রিশার সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে থাকে। রিশাকে হাসতে দেখে অনি বেশ বিরক্ত হয়।তবে তা মুখে প্রকাশ করে না।সে মনে মনে ভাবতে থাকে; দুই ভাই বোন একই রকম। একেবারে খচ্চর।

অনিকে চুপ হয়ে যেতে রিশা হাসি থামিয়ে বলে; ভাবি তুমি এটা কি পরেছ? আমাকে ডাকলেই হতো আমি পরিয়ে দিতাম। শুধু শুধু কষ্ট করলে কেন? বাই দ্যা ওয়ে ভাবি তোমাকে বেশ কিউট লাগছে। বলেই রিশা দাঁত বের করা হাসি দেয়।
অনি বলে; আসলে আমি কোনদিনও শাড়ি পরিনি। বিয়ের দিন একবার পরেছিলাম তারপর আজকে।
রিশা অনির কথায় অবাক হয়না।কারণ সে জানত অনি ছোটবেলা থেকেই বাইরে থাকে।এসব কিছুর সাথে পরিচিত নয় সে।

রিশা অনির সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে তাকে সুন্দর করে শাড়িটা পরিয়ে দেয়। একটু বেশি করে পিন লাগিয়ে সেট করে দেয় যাতে না খুলে যায়। অনিকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলে;
মাশ আল্লাহ ভাবী তোমাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে। একদম বউ বউ লাগছে।
রিশার কথায় অনি জোর করে একটু হাসি দেয়।
রিশা রুম থেকে বেরিয়ে গেলে অনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখে নেয়।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here