অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_৬১

0
6769

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৬১

ভোরের ধূসর আকাশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। পাখিদের কলরবে মুখরিত প্রকৃতি। ফজরের নামাজ পড়ে বেলকনিতে বসেছে অনি।রিশাদ এখনো মসজিদ থেকে ফেরেনি। বাড়ির নিচটায় বেশ কোলাহল শোনা যাচ্ছে। বিয়ে বাড়ি বলে ভোর থেকেই এদিক ওদিক ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। কোলাহল অনির বড্ড বিরক্ত লাগছে। তবুও কিছু করার নেই। দোলনা থেকে উঠে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায় এক ফালি রোদ এসে অনির মুখে পড়ে। শব্দহীন নীরব কষ্টগুলো কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। তবুও এক অসহনীয় যন্ত্রণায় ভুগছে। সব কিছু পেয়েও যেন কিছুই পেল না।বেলকনির গ্রিল দিয়ে হাত বের করে ঝুলে রাখা লম্বা লম্বা ঝারবাতি গুলোয় হাত বুলোয় অনি। কিছু একটা ভাবছে সে। এই মূহুর্তে তার জীবনটাও ঝারবাতির মতোই মনে হচ্ছে। রাতের আঁধারে জ্বলে ওঠা ঝারবাতি গুলো দিনের আলো ফোটার পূর্বেই নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। থেকে থেকে জ্বলে ওঠা ঝারবাতির মতোই অনির সুখ যা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে সীমাহীন আকাশটার সাথে তার দুঃখগুলো ভাগ করার চেষ্টা করছে। বিশাল আকাশটাও যেন কম পড়বে বলে মনে হচ্ছে।

গাড়ির শব্দে ধ্যান ভাঙে অনির। গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে রিশাদ। একটা মিনি সাইজের ট্রাক ভেতরে প্রবেশ করে। তাতে ডেকোরেশনের সামগ্রী আর কিছু কাঁচা বাজার।মধ্য বয়স্ক দুজন লোককে দিয়ে রিশাদ জিনিস গুলো নামিয়ে নিচ্ছেন। রায়হান সাহেবও সেখানেই অন্য কাজ গুলো তদারকি করছিলেন। অনি উপর থেকে দাঁড়িয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করছে। রিশাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তার গতিবিধি লক্ষ্য করছে। রিশাদের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ভুল করেও সে একবারো উপরের দিকে তাকাচ্ছে না। অনির অবশ্য এই মূহুর্তে তাতে কোন অনুভূতি নেই।

শায়লা বেগমের ডাকে অনি পেছনে ফিরে তাকায়। বেলকনির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। অনি ভূত দেখার মতো চমকে যায়। এত সকাল সকাল সে হয়তো শায়লা বেগমকে এখানে প্রত্যাশা করেনি।

–কিরে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন মা?চল নিচে চল। সবার সাথে বসে থাকবি ভালো লাগবে।

শায়লা বেগমের কথায় অনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। যদিও তার ইচ্ছে নেই নিচে যাওয়ার তবে শায়লা বেগমকে না বলারও কোন আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছে না অনি। তাকে যে পাত্রে রাখা হচ্ছে সেই পাত্রেরই আকার ধারণ করছে।ভালো লাগা বা খারাপ লাগার অনুভূতিগুলো সাময়িকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো বন্ধ করে দিয়েছে বোধ হয়।

শায়লা বেগমের পেছনে পেছনে নিচে নামে অনি। ড্রইংরুমে বসে অনির সমবয়সী কিছু মেয়েরা গল্পগুজব করছিল। রান্নাঘরে মহিলারা তরকারি কাটা ও বাটাবাটির কাজ করছিলেন। শায়লা বেগম ও সাবরিনার দম ফেলবার ফুসরত নেই। মিথিলা রিশাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না অনি। এদিক ওদিক তাকিয়ে সে একবার দেখে নেয়।না নেই। হয়তো এখনো ঘুমোচ্ছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বুলায়। এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে সে?কাল অবধি সে নিজেই সব কিছু সামলাচ্ছিল আর আজ যেন এসবকিছু থেকে পালাতে পারলে বেঁচে যায়।

একটা লোকের সাথে হাত নাড়িয়ে কথা বলতে বলতে ভেতরে ঢোকে রিশাদ। রিশাদের গলার আওয়াজ পেয়ে অনির নজর সেদিকে যায়। রিশাদের সাথে এক দফা চোখাচোখি হয়।রিশাদ অনিকে দেখে মুচকি হেসে পুনরায় কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনির মুখের ভাব অবিকৃত রেখে উপরের দিকে চলে যায়। দুটো সিঁড়ি পেরোতেই রিশাদের ডাক পরে।

রিশাদ অনিকে কিছুটা জোর করেই সবার মাঝে নিয়ে যায়। অনি ভদ্রতার খাতিরে সবার সাথে টুক টাক কথা বলছে। একটু পরেই মিথিলা আর রিশা নিচে নামে। তাদের চোখে মুখে ফুটন্ত উজ্জ্বলতায় তাদের খুশির বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে।সবাই রিশা আর মিথিলাকে ঘিরে ধরে।

শায়লা বেগম এসে সবাইকে নাস্তা করার জন্য তাড়া দেয়। সবাই একসাথে নাস্তা করার জন্য বসে পড়ে। রিশাদকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। তাই অনি আর বসে না। শায়লা বেগমের সাথে হাতে হাতে দু একটা কাজ করে দেয়। নাস্তা সার্ভ করতে হেল্প করে অনি।

গেস্ট দের সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে রিশাদ অনি সহ বাড়ির সবাই খেতে বসে। খাওয়া শেষ করে অনি রুমে যায়।কিছুক্ষণ জাহানারা বেগমের সাথে কথা বলে সে। ফোনটা রেখে ওয়াশরুমে যায়। রিশাদ রুমে এসে অনিকে কোথাও দেখতে পায়না। পানির শব্দ পেয়ে সে বুঝতে পারে অনি ওয়াশরুমে।

অনির জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রিশাদ। কাজের মধ্যেও সে লক্ষ্য করছে অনির মনটা খারাপ হয়ে আছে।

অনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখতে পায় রিশাদ তার জন্য বসে আছে। অনিকে বেরোতে দেখে রিশাদ উঠে দাঁড়ায়।

অনির মন খারাপের কারণটা জানা সত্ত্বেও রিশাদ গাধার মতো জিজ্ঞাসা করে –“কি হয়েছে?”

রিশাদের প্রশ্নের জবাবে কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না অনি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রিশাদের দিকে।রিশাদ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।

–কিছু হয়নি তো।তুমি শুধু শুধু টেনশন করছো।বলেই অনি হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে।

রিশাদ অনির হাসির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে কবে আবার তার অনন্যময়ী আগের মতো হয়ে যাবে?আগের হাসি খুশি দুষ্টু মিষ্টি সেই অনন্যময়ী ফিরে আসবে!

–ওই কি হলো?কোথায় হারিয়ে গেলে?(অনি)

–উঁহু না তো। তুমি একটু দেখো তো পার্লারের মহিলারা কতদূর?বারোটা বাজতেছে এখনো আসার নাম নেই। (রিশাদ)

–আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি যাও আমি আসছি। রিশাদ চলে যায়। অনি রিশাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। দুমিনিট পর অনি ফোনটা বের করে পার্লারের মহিলাকে কল দিতে নেয়।

রেহানা বেগমের মিসড কল। সে যখন ওয়াশরুমে ছিল তখন কল করেছিলেন। ফোনের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো স্থির হয়ে যায়। ভাবনায় পড়ে যায়। কিছু একটা ভেবে সে পার্লারের মহিলাকে কল দেয়। তারা আসছে বলে জানায়।

কিছুটা সময় নিয়ে অনি রেহানা বেগমকে কল দেয়। শুরুর দিক থেকেই রেহানা অনিকে বেশ স্নেহ করেন। অনিও তাকে বেশ শ্রদ্ধা করে। অনির পরিচয়টা জানার পর থেকে বেশ উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন অনিকে কাছে পাবার জন্য। তার নিজের কোন মেয়ে নেই। বিধায় অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অনিকে নিজের মেয়ে বলে মেনে নিয়েছেন। রাহাত তার কাছে ছিল তার ছোট ভাইয়ের মতো আর সেখানে রাহাতের মেয়ে নিশ্চিত ভাবেই তার কলিজার টুকরার হিসেবে স্থান পাবে এটাই স্বাভাবিক।

রেহানার সাথে বেশ কিছুক্ষণ যাবত কথা বলে অনি। বার বার তাকে বলছিল যাওয়ার জন্য। অনিরও ইচ্ছে ছিল একবার ওবাড়িতে যাওয়ার। অদৃশ্য টান অনুভব করে ওবাড়ির প্রতি,সেখানকার মানুষগুলোর প্রতি। কথা বলা শেষ করে অনি ফোনটা রেখে বাইরে যায়।

মিথিলা রিশাকে সাজানো শুরু হয়েছে। সবাই তাদের ঘিরে ধরেই বসে আছে। অনেকে আবার নিজেদের মতো করে সাজছে। অনি কিছুক্ষণ বসে থাকে সেখানে।

নিচে নেমে অনি দেখতে পায় শায়লা বেগম আর সাবরিনার নাজেহাল অবস্থা সবটা সামলাতে সামলাতে। অনির কিছুটা খারাপ লাগে। অনি রিশাদই সব কিছুর দায়িত্বে ছিল। হঠাৎ করে অনির অসম্পৃক্ততায় সবাই একটু সমস্যায় পড়েছে। অনি কিছুক্ষণ ভাবতে থাকে। তার জন্য সবাই কতটা সমস্যায় পড়েছে।

ভাবনার ইতি টেনে অনি রান্নাঘর থেকে শরবত বানিয়ে এনে শায়লা আর সাবরিনাকে জোর করে খাইয়ে দেয়। তাদের থেকে বাকি কাজ গুলো বুঝে নিয়ে অনি কাজে নেমে পড়ে। একরকম জোর করেই সে বুঝিয়ে নেয়। কেননা শায়লা বেগম চাচ্ছিলেন না অনিকে কোন কাজ করতে দিতে।

অনি রিশাদ মিলে আগের মতোই সবটা সামলাচ্ছে। অনিকে কিছুটা প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে।তবে তার মুখে লেপ্টে থাকা হাসিটা উধাও হয়ে গেছে। তবুও যে সে আগের থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে তাতেই খুশি রিশাদ।

দুপুরের শেষে গোসল করে অনি। রিশাদ রুমে এসে চটপট গোসল করে পাঞ্জাবি পড়ে নেয়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বরযাত্রী এসে হাজির হবে। রেডি হয়ে রিশাদ রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিয়ে আবার ফিরে আসে। অনির কাছে এসে বলে;

–আজকে কি পরবে?একা তো আর শাড়ি পরতে পারবে না। (রিশাদ)

অনি সাবলীলভাবে উত্তর দেয়; তাহলে তুমি পরিয়ে দাও। বলেই অনি রিশাদের দিকে মেরুন কালারের শাড়িটা এগিয়ে দেয়। রিশাদ মুচকি হেসে অনির থেকে শাড়িটা নেয়। কিছুটা সময় নিয়ে অনিকে শাড়ি পরিয়ে দেয় রিশাদ। রিশাদ অনিকে দাঁড় করিয়ে একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেয়। অনির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে;

–খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। (রিশাদ)

রিশাদের কথা অনি কিছুটা লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসি দেয়।

–হুম যাও এখন। নিচে তো অনেক কাজ আছে। যেকোন মূহুর্তে বরযাত্রী চলে আসবে। (অনি)

–হুম যাচ্ছি। তুমি বেশিক্ষণ দেরি করো না। (রিশাদ)

রিশাদ নিচে চলে যায়। অনি আয়নায় নিজেকে দেখে হিজাবটা পড়ে নেয়। হাতে একজোড়া চিকন ডায়মন্ডের চুরি পড়ে নেয়। সাজগোজ শেষ করে অনি বাইরে যায়। মিথিলা রিশাকেও রেডি করানো হয়েছে।

অনি মিথিলা রিশাকে নিয়ে নিচে নেমে যায়। স্টেজে তাদের বসানো হয়। বিশাল স্টেজের দুই পাশে রাফি-রিশা, ইভান-মিথিলা কে বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বরযাত্রীর আগমন ঘটলে সবাই সেদিকে ভিড় জমায়। রিশা মিথিলা দুজনেই কিছুতা নার্ভাস ফিল করছে। এক অন্যরকম অনুভূতির উদ্ভব ঘটছে তাদের মাঝে। যে যার ভালোবাসার মানুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য সবার হয়না। রিশা মিথিলা তাদের নতুন জীবনের দিকে পা বাড়াতে চলেছে। কিছুটা ভয় ও শঙ্কার মাঝেও ভালোলাগারা সুখানুভূতিটাই প্রাধান্য পাচ্ছে। এক দিনের অপেক্ষাতেই ছিল তারা।বিচ্ছেদ বিরহের পাঠ চুকিয়ে আজ চার হাত এক হতে চলেছে।

শায়লা ও সাবরিনা হবু জামাই দেরকে বরণ করে নেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ে পড়ানো হয়। প্রথমে মিথিলা আর ইভানের বিয়ে পড়ানো হয় এরপর রিশা আর রাফির। তাদেরকে একসাথে বসানো হয়।

বহু অপেক্ষার পর রিশা রাফির বিচ্ছেদের অবসান ঘটিয়ে আজ তারা এক হয়েছে। অনুভূতিটা প্রকাশ করার মতো শব্দ রিশার জানা নেই। রিশা যেন আজ আজ সুখের সাগরে ভাসছে। অন্যদিকে রাফি তার প্রেয়সীর লজ্জামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে যেন প্রশান্তি অনুভব করে। কতদিনের লালন করা স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে তাদের।

অন্যদিকে মিথিলা আর ইভানের ভালোবাসাও পূর্ণতা পেয়েছে আজ। জীবনের ভুলগুলো শোধরানোর সুযোগ পেয়েছিল সে। আর সেই সুযোগেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো ইভান। যার আগমনে মিথিলা এক সুন্দর জীবনের সন্ধান পেয়েছে। জীবনটাকে সে নতুন করে জানতে শিখেছে। ভালোবাসতে শিখেছে।

বিয়েটা যতটা আনন্দের ছিল বিদায়বেলাটা ঠিক ততটাই কষ্টদায়ক। বাড়ির দুই মেয়ের একসাথে বিদায়টা যেন কষ্টটাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। শায়লা আর সাবরিনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে দুই মেয়ে।আড়ালে চোখের জল ফেলছেন রায়হান সাহেব।

রিশাদকে বেশ উষ্কখুষ্ক দেখাচ্ছে। তার কলিজার টুকরার ছোট বোনটার বিদায়বেলায় যে তার এতটা কষ্ট হবে ধারণা ছিল না। রিশা অশ্রুসিক্ত নয়নে তার ভাইয়ের সামনে দাঁড়ায়। রিশাদ আজ রিশার দিকে তাকাতেই পারছে না। এইতো সেদিন তাকে কোলে করে নিয়ে ঘুরতো। স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা রেখেই মায়ের ঘরে দৌঁড় দিত সে। পুতুল বোনটার সাথে সারাদিন খেলেই পার করতো। সেই বোনটা নাকি আজ এতটা বড় হয়ে গেছে যে অন্যের ঘরে চলে যাচ্ছে।

রিশাদকে জড়িয়ে ধরতেই আপনা আপনি চোখের জল বেরিয়ে আসে। কান্না আটকাতে পারছে না রিশাদ। রিশা কাঁদতে কাঁদতে হেচকি তুলে ফেলেছে।

রিশাদ রিশার চোখের জল মুছে দিয়ে বলে; পাগলি মেয়ে কাঁদছিস কেন?আমাদের ছেড়ে একবারে চলে যাচ্ছিস নাকি?কালই তো আমরা তোকে নিয়ে আসবো। একদম কাঁদবি না।কাঁদলে তোকে একদম পেত্নীর মতো লাগে। একদম কাঁদবি না। কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলে রিশাদ।

রাফিকে উদ্দেশ্য করে বলে; আমার বোনটার খেয়াল রেখো। ছেলেমানুষ ও কখনো কোন ভুল ত্রুটি হলে বুঝিয়ে শুধরে নিও। কোন কষ্ট পেত দিওনা। এই একটাই অনুরোধ আমার। রাফি রিশাদকে জড়িয়ে ধরে আশ্বস্ত করে সে কখনো রিশাকে কষ্ট দেবে না। সকল বিপদ থেকে আগলে রাখবে।

মিথিলাকেও ঠিক একই ভাবে বিদায় দেয় রিশাদ। রিশার মতো মিথিলাও যে তার অনেক ভালোবাসার ছিল। মিথিলা রিশাদের থেকে বিদায় নেয়। ইভান রিশাদকে আশ্বস্ত করে মিথিলার খেয়াল রাখার।

অদূরে দাঁড়িয়ে অনি সবটা দেখছে। একটা মেয়ের জন্য বিয়ে যতটা সুখের ঠিক ততটাই কষ্টের নিজের পরিবার ছেড়ে শ্বশুড়বাড়িতে যাওয়া। চেনা মানুষগুলোকে ছেড়ে অচেনা মানুষকে আপন করে নেওয়া। তবে এক্ষেত্রে তার ভালোই হয়েছে। সে তো শ্বশুড়বাড়িতে এসেই পরিবারের সান্নিধ্য পেয়েছে। পরিবার কি বুঝতে পেরেছে।রিশা মিথিলাও যেন ঠিক এমনই পরিবার পায়।

অনি রিশাদ মিথিলা রিশাকে বিদায় দিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। ফুল দিয়ে সজ্জিত চলন্ত গাড়ির দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে রিশাদ। আর অনি তাকিয়ে থাকে রিশাদের দিকে। আজ অন্যভাবে রিশাদকে আবিষ্কার করছে অনি। ভাই হিসেবে রিশাদ কতটা শ্রেষ্ঠ আজ অনুধাবন করতে পেরেছে অনি। সত্যিই মানুষ হিসেবে রিশাদের কোন তুলনা হয়না। সারাক্ষণ যে বোনের সাথে ঝগড়াঝাঁটি মারামারি করে কাটিয়েছে আজ তার বিদায়ে রিশাদই যেন সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে।

রিশাদের কাঁধে হাত রাখে অনি। অনিকে জড়িয়ে ধরে রিশাদের নীরব কান্না শব্দ পায়। শব্দ করে কাঁদতে থাকে। অনির চোখেও অশ্রুরা এসে ভিড় জমায়। এই কান্নাকে থামানোর কোন প্রয়াস করেনা অনি।

কষ্টবিহীন সুখের কোন মূল্য থাকে না মানুষের জীবনে। কষ্টের পরিমাণ যত বেশি হবে সুখটাও ততটাই তৃপ্তিদায়ক হয়। রিশাদকে সামলে নিয়ে অনি ভেতরে নিয়ে যায়। উৎসবমুখর পরিবেশটা কেমন বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছে। শায়লা বেগমকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পারিয়ে দেয়। সাবরিনাকেও জোর খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আছে। রিশাদ নিজেকে শক্ত করে নিয়েছে। সবকিছু গুছিয়ে ঘুমোতে যেতে যেতে রাত গভীর হয়ে যায়। বাড়িতে আত্মীয় স্বজনও অনেক। সবাইকে বিছানা ঠিক করে দিতে দিতে অনির নাজেহাল অবস্থা। অনি রিশাদকে নিজেদের রুমটাও ছেড়ে দিতে হয়।

বিয়ের ঝামেলা শেষ করে ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় তিনটে বেজে যায়। ড্রইং রুমের সোফায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরে রিশাদ। আর অনি উপরে একটা রুমে কোনমতে মাথা রাখার জায়গাটা পায়। কারোরই ঘুম ভালো হয়না। তাই ভোরবেলা খুব তাড়াতাড়িই উঠে পড়ে অনি রিশাদ। অনি সবেমাত্র নামাজ পড়ে নিচে নামছে। রিশাদও বাড়িতেই নামাজ পড়ে নেয়।

অনিকে নিচে নামতে দেখে রিশাদ দাঁড়িয়ে যায়। রিশাদের চোখ মুখ এমনিতেই বিকৃত হয়ে ছিল। অনিকে দেখে সে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। রিশাদের চোখমুখ কিছুটা ফুলে আছে।

অনি রিশাদের পাশে গিয়ে বলে; কি হয়েছে?রাত ঘুম হয় নি তোমার?(অনি)

–উফফ আর ঘুম!মশার অত্যাচারে ঘুমোতেই পারিনি। হতাশ হয়ে বলে রিশাদ।

–আহা রে!চলো বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি।(অনি)

অনির প্রস্তাবটা রিশাদের কাছে মন্দ লাগে না। এমনিতেই বাসায় এত মানুষজনদের মাঝে এখন তার খুব বিরক্ত লাগছে। একটু ফ্রেশ হওয়ার প্রয়োজন।

অনিকে নিয়ে রিশাদ বাইরের দিকে যায়। বিয়েবাড়িতে অনেক লোকজন থাকায় কিছু মানুষ সজাগ হয়েছে। কেউ ফ্রেশ হচ্ছে তো কেউ উঠে একটু হাঁটাহাঁটি করছে। রিশাদ অনি বাগানে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে রাস্তায় বের হয়। ঠান্ডা আবহাওয়া, কুয়াশায় বেশি দূর দেখা যাচ্ছে না। এখনো শীত পুরোপুরিভাবে পড়েনি তবে সকালবেলার দিকে কুয়াশা বেশ ভালোই দেখা যায়। রিশাদ অনির শীতল হাতটা নিজের হাতেয় বন্দী করে নেয়। কুয়াশার মাঝ দিয়ে তারা দুজন রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়।

কিছুদূর এগিয়ে এসে অনি উপরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। মাথার উপর বিশাল জায়গা জুড়ে লাল লাল ফুল দেখা যাচ্ছে। রাস্তাটাও লালা রং এর কুয়াশায় ভেজা ফুল দ্বারা ভরে গেছে। অনি অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

অনি রিশাদের দিকে তাকিয়ে বলে; এগুলো কি ফুল?

–কৃষ্ণচূড়া।

অনি বিড় বিড় করে নামটা আওড়ায়। রিশাদের হাত ছেড়ে সে মাটি থেকে সদ্য পড়া দুটো সতেজ ফুল উঠিয়ে নেয়। নাকের কাছে নিয়ে সে ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করে। বিশেষ কোন ঘ্রাণ পায়না। হালকা একটা মোহনীয় ঘ্রাণ অনির নাকের স্নায়ুগুলোতে যেন ধরা দিয়েও ধরা দেয় না। অনি বড় করে দম নিয়ে ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করে। রিশাদ অনির কান্ড দেখে মুচকি হাসে।

কিছুটা দূরে সরে গিয়ে সে ফোনটা বের করে এই অবস্থাতেই অনির কয়েকটা ছবি তুলে নেয় অনির অগোচরে। আবার সে আগের জায়গায় ফিরে আসে।

অনির হাত থেকে একটা ফুল নিয়ে সে তার কানের পিঠে গুঁজে দেয়। অনির হাস্যজ্জ্বল চোখ দুটো রিশাদের চোখের দিকে তাকায়।

–ফুলটা এখন আরো বেশি সুন্দর লাগছে। (রিশাদ)

অনি রিশাদের কথায় কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায়। লজ্জার আবরণ থেকে বেরিয়ে এসে আশেপাশে তাকিয়ে কোন প্রাণীর চিহ্ন না পেয়ে ঝড়ের বেগে রিশাদের গালে একটা চুমু দিয়ে দেয়। রিশাদ থ হয়ে যায়। রিশাদ কখনোই প্রত্যাশা করেনি অনি এই সময় এমন একটা কাজ করে বসবে। রিশাদের হাতটা আপনা আপনি তার গালে চলে যায়।চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়।

অনি লজ্জা পেয়ে রিশাদকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়ে। রিশাদ খপ করে অনির হাতটা ধরে নেয়। অনি লজ্জায় নুইয়ে পড়ছে। এক ঝটকায় রিশাদ অনিকে তার সামনে এনে দাঁড় করায়। অনি তাল সামলাতে না পেরে রিশাদকে আঁকড়ে ধরে। রিশাদ অনিকে নিজের সাথে মিশে নেয়। অনবদ্য এক ভালোবাসার মূহুর্ত দিয়ে দিনের শুরুটা হয় অনি রিশাদের। তবে যখনই তাদের হুশ হয় যে এই মূহুর্তে তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে রিশাদ অনিকে ছেড়ে দেয়। জায়গাটা কিছুটা নির্জন হওয়ায় সকালবেলার দিকে মানুষের আনাগোনা নেই। কি এক লজ্জাকর অবস্থা হতো যদি কেউ দেখে ফেলতো।

রিশাদ অনিকে নিয়ে বাসার দিকে রওনা দেয়। হাঁটতে হাঁটতে বেশ দূরেই চলে গিয়েছিল তারা। বাসায় ফিরতে ফিরতে পুরোপুরিভাবে সকাল হয়ে যায়। সবাই প্রায় ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। রিশাদ অনি বাসায় নেই ভেবে আত্মীয়স্বজনদের কেউ কেউ চিন্তিত হয়। তবে শায়লা বেগম বা এই পরিবারের সদস্যরা সবাই ই জানে রিশাদ অনি মাঝে মাঝেই সকালবেলা হাঁটতে যাওয়ার অভ্যাস এর কথা তাই তারা চিন্তিত হন না।

গত দিনগুলোর তুলনায় আজকে একটু কাজের চাপ কম আছে। ডেকোরেশনের লোকজনরা সবাই জিনিসপত্র গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে। আলোকবাতি গুলো এক এক করে সরানো হচ্ছে। বাড়িটা আস্তে আস্তে আগের রূপে ফিরে আসছে। তবে আত্মীয় স্বজনদের ভিড় কমেনি। আজ বৌভাতের পর হয়তো কমে যাবে।

একই দিনে রিসেপশন হওয়ায় রাফি ও ইভানের পরিবার একটা রিসোর্ট বুক করে। একসাথে তো আর রিশাদরা দুই জায়গায় উপস্থিত হতে পারবে না। তাই রিসেপশনের জন্য শহরের বাইরে একটা ছিমছাম রিসোর্ট বুক করা হয়েছে। যেহেতু যেতে কিছুটা সময় লাগবে তাই তাড়াতাড়িই রওনা দিতে হবে।

সকালের নাস্তা খাবার পর থেকেই রিশাদ সবাইকে তাড়া দিতে শুরু করে। বাড়ির গাড়িগুলোর পাশাপাশি রিশাদ আরো কিছু গাড়ি ভাড়া করেছে সবার যাওয়ার জন্য। রিশা ও মিথিলাকে বাসায় নিয়ে আসার জন্য আলাদা করে দুটি গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে।

সবাই রেডি হতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সবার মাঝে অনির আজ বড্ড একা লাগছে। রিশাদের আত্মীয়স্বজনদের সাথে তার বিশেষ কোন ভাব নেই। রিশাদের কাজিনদের সাথে কিছুটা ভাব জমলেও রিশা আর মিথিলার কথা খুব মনে পড়ছে। তিনজনে কত আনন্দ করতো একসাথে। খুব মিস করছে অনি তাদেরকে। রিশা মিথিলার জন্য মনটাও বড্ড খারাপ হয়ে আছে।

অনি রুমে এসে গোসল সেরে নেয়। আলমারি থেকে রিশাদের কিনে দেয়া লেহেঙ্গাটা বের করে অনি। একবার চোখ বুলিয়ে নেয় লেহেঙ্গাটার দিকে। বেবি পিংক কালারের লেহেঙ্গা পুরোটা কাজ করা সাথে ডিজাইনার ওড়না।রিশাদের জন্য ম্যাচিং করে কেনা পাঞ্জাবিটাও বের করে রাখে বিছানার উপর।

রিশাদ রুমে এসে গোসলে ঢুকতে নিলে অনিও রেডি হয়। লেহেঙ্গাটা পড়ে নিয়ে অনি ওড়নাটা উল্টে পাল্টে দেখছে। এই প্রথম সে লেহেঙ্গা পরছে।তাই ওড়নাটা কিভাবে পরবে ঠিক বুঝতে পারছে না অনি। একবার বুকের উপর দিয়ে ছড়িয়ে নিচ্ছে তো আরেকবার এক সাইড দিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। কোনভাবেই ঠিক করতে পারছে না।

রিশাদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখতে পায় অনি লেহেঙ্গার ওড়নাটার সাথে রীতিমত যুদ্ধ করছে। ক্লান্ত হয়ে অনি ওড়নাটা মাটিতে ফেলে দেয়।

রিশাদ তোয়ালেটা চেয়ারের উপর রেখে ওড়নাটা তুলে নেয়। অনিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। ওড়নার এক পাশ কোমড়ে গুঁজে দিয়ে অপরপাশ ঘাড়ের উপর দিয়ে বুকে ছড়িয়ে দিয়ে ভাজ করে দেয়। কয়েকটা পিন লাগিয়ে দেয় যাতে খুলে পরে না যায়।

ওড়নাটা লাগানো শেষ করে অনিকে একবার পা থেকে দেখে নিয়ে বলে; ডান। দেখো তো আয়নায় ঠিক হয়েছে কিনা।

অনি আয়নায় চোখ বুলায়। ওড়নাটা খুব সুন্দর করে সেট করে দিয়েছে রিশাদ। এরপর রিশাদ অনিকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা একটা টুলে বসিয়ে দিয়ে অনির এলোমেলো চুল গুলো আচড়িয়ে দেয়। অনি আয়নার ভেতর দিয়ে রিশাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। রিশাদের যত্নশীলতা দেখে অনি মুগ্ধ হচ্ছে। রিশাদের মতো স্বামী পেয়ে অনি যে ভাগ্যবতী তা স্বীকার করতে কোনরূপ দ্বিধা নেই তার। হাজার বিষাদের মাঝে রিশাদই যেন তার কাছে এক চিলতে সুখ। জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।

চলবে…..
আসসালামু আলাইকুম?
আজকের পর্বটা ভালো করে লিখতে পারিনি মনে হচ্ছে??।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here