অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_৬৩(শেষ পর্ব)

0
8685

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৬৩(শেষ পর্ব)

পাচঁ বছর পর

সময়ের বহমান স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে অনি রিশাদ কাটিয়ে দিয়েছে পাঁচটা বছর। অনেক কিছুই বদলে গেছে।বদলে গেছে তাদের সম্পর্ক। ভালোলাগা ভালোবাসার পরেই তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি হলো তাদের একমাত্র সন্তান জোহরা। এই প্রাপ্তির সাথে সাথে জীবন থেকে হারিয়েছে এক মহামূল্যবান অংশ। যিনি অনির জীবনে পিতামাতার ভূমিকা পালন করেছে। একজন দায়িত্ববান অভিভাবক হিসেবে সচেতনার সাথে অনিকে বড় করে তুলেছেন। অনির শূন্য জীবনে তিনি ছিলেন পূর্ণতা। তিনি আর কেউই নন জাহানারা বেগম।

কোন প্রাণীই অমর নয়। মৃত্যুর স্বাদ সবাইকেই গ্রহণ করতে হবে। এ যে এক চরম বাস্তবতা যাকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। বার্ধক্যের ভারে নত জাহানারা বেগম। জীবনে অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো কাটিয়েছেন তিনি তার ভালোবাসার নাতনি অনন্যময়ীর সাথে। পৃথিবীর মোহ ছাড়াটা কোন সহজ কাজ নয়। মন না চাইলেও শরীর যে আর সায় দেয় না। জীবনের পথ চলতে চলতে আজ ক্লান্ত তার শরীর। অসুস্থতা তাকে চারদিক থেকে গ্রাস করে নিচ্ছে। শরীরটা নেতিয়ে পড়ছে ক্রমশ। ভাজ পড়া চামড়াগুলোও যেন ঝিমিয়ে পরছে। চোখের ক্ষীণ দৃষ্টি, পাক ধরা চুল আর নড়বড়ে দাঁত নিয়েও তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হাসি মুখে কাটিয়েছেন। শরীরটা সায় না দিলেও তার ইচ্ছে যে আরো বহুদিন বাঁচার। সে আশা আর পূরণ হলো কই। তার জীবনের জ্বলন্ত বাতির জ্বালানি ফুরিয়ে এসেছে। নিভু নিভু বাতিটা একসময় নিভে গেল। চোখ দুটো চিরস্থায়ী নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। চারদিকে পরে গেল কান্নার রোল। সে সব উপেক্ষা করে সবাইকে পেছনে ফেলে সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দিয়ে পাড়ি জমালেন মহাযাত্রার পথে।

জাহানারা বেগমের পরলোক গমনের সাথে সাথে অনির মনে হচ্ছিল কেউ যেন তার বুক চিড়ে কলিজাটা খসে নিয়ে যাচ্ছে। নিথর দেহে লুটিয়ে পরে আছে আর তার চোখের সামনে দিয়েই নিয়ে চলে যাচ্ছে জাহানারা বেগমকে। জাহানারা বেগম প্রকৃতপক্ষেই অনির মা হয়ে উঠেছিলেন। কি করেননি তার জন্য। একজন মা হয়ে যা কিছু না করেছে তার সব দায়িত্বই তিনি পালন করেছেন। বার্ধক্যকালেও যেন তিনি এক সতেজ উদ্দীপনার সাথে নতুন করে অনন্যময়ী এক মা হয়ে উঠেছিলেন। অনন্যময়ীর মা তো অনন্যময়ীই হবে। জীবনের এই চরম বাস্তবতা যেন কিছুতেই মানতে পারছে না অনি। বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় হুহু করে ওঠে।এই বিচ্ছেদ যেন তার অন্তরে ক্রমাগত ছুরিকাঘাত করছে। ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে সে।

রাতে ঠিকমত ঘুমোতে পারেনা সে। চোখ বুজলেই যেন তার মমতাময়ী দিদার হাস্যজ্জ্বল মুখটা ভেসে ওঠে। বুকে চিন চিন ব্যথা হয় ক্রমাগত। জাহানারা বেগম কি জানতো যে তার চির বিদায়ে তার কলিজার টুকরা এভাবে ভেঙে পরবে? সব সময় তো সেই অনিকে সামলায়। অনিকে কে এখন সামলাবে?

রাতের আঁধারে অশ্রুসিক্ত অনি ঘুমন্ত রিশাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাগানে যায় জাহানারা বেগমের কবরের কাছে। তার মাঝে কোন ভয় কাজ করছে না। রয়েছে আকুলতা শুধু একবার তার দিদার স্নেহমাখা ওই মুখখানা দেখার একবার তার কোলে মাথা রাখার। কবরের পাশেই কিছুটা দূরে ঘাসের উপর বসে পরে অনি। নির্জন এই রাতে অনির কান্নার সাক্ষী এই বোবা আঁধার রাতের প্রকৃতি আর কিছু জোনাকি পোকা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। খুব মিস করছে তার দিদাকে। শেষ দিনগুলোতে সে নিজে সেবাযত্ন করেছে দিদার।

অনেকবার অনি নিয়ে যেতে চেয়েছিল নিজের কাছে। কিন্তু কোনমতেই রাজি হননি তিনি। তাই অনিকেই এবাড়িতে চলে আসতে হয়। জাহানারা হয়তো ভেবেছিলেন এবাড়িতে থাকলে অনি আর অনামিকার সম্পর্কের উন্নতি হবে। তবে তার তিনি হতাশ হন। কোন পরিবর্তন হয়নি। একসময় তিনি হাল ছেড়ে দেন। আল্লাহর উপরেই সব ছেড়ে দেন।

অশ্রুসিক্ত অনি মাথায় হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে তাকায়। অনামিকা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের কোণায় অশ্রুকণা চিক চিক করছে। অনি একবার তাকিয়ে নজর ফিরিয়ে নেয়। আগের মতোই সে বসে থাকে।তবে তার দৃষ্টি সামনে জাহানারা বেগমের কবরের দিকে।

শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে অনামিকা প্রশ্ন করেন; এখানে কি করছো এত রাতে?চলো ভেতরে চলো।

অনি কোন উত্তর দেয় না। অনির নীরবতায় কষ্ট পান জাহানারা। এত বছরেও মেয়ে তার সাথে ভালো করে কথা বলে না। কখনো কখনো তো সে প্রয়োজনেও কথা বলে না অনামিকার সাথে। অনির ব্যবহারে বেশ কষ্ট পান অনামিকা তবে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারেন না। মা হারানোর শোকে তিনি নিজেও বেশ বিপর্যস্ত।

অনামিকা অনির পাশে বসে পড়েন। অনির সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তার উদাস দৃষ্টি সামনের দিকে। আশেপাশের কোন কিছুর উপর তার কোন আগ্রহ নেই।

–আমাকে কি কোন দিনও ক্ষমা করবে না? আমি তো তোমার মা।একবার কি মাকে ক্ষমা করা যায় না। আমি যে ভুলগুলো করে তোমাকে হারিয়েছি সেগুলো কি তুমিও করতে চাও? মাকে ক্ষমা করে দিয়ে একবার কাছে টেনে নেয়া যায় না? (অনামিকা)

–“মা! আমার মা তো নেই। ওই যে দেখুন ওখানে শুয়ে আছে আমার মা। আপনি তো শুধু আমাকে জন্ম দিয়েছেন। ওখানে মাটির নিচে যে মানুষটা শুয়ে আছে সেই তো আমার মা। জন্ম দিলেই কি মা হওয়া যায় বলুন তো। জানেন খুব ভালো হতো আমি যদি আপনার গর্ভে জন্ম না নিয়ে আমার এই মায়ের গর্ভে জন্ম নিতাম। কি করার বলুন আমার ইচ্ছাই তো আর সব না। আমার মা তো আর এই পৃথিবীতে নেই। আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেছে। জন্ম দিয়ে আপনি জন্মদাত্রী হতে পেরেছেন কখনো কি আমার মা হতে পেরেছেন?” শান্ত কণ্ঠে কথা গুলো বলে অনি। সে একবারের জন্যও অনামিকার দিকে তাকায় না।

অনির প্রতিটা কথা যেন অনামিকার অন্তরে তীরের মতো বিঁধছে। গাল বেয়ে অশ্রু পড়ছে। তাকে আটকানোর কোন প্রচেষ্টা করছে না অনামিকা। কতটা কষ্ট অনির কথাগুলোর মধ্যে তা শুধু অনুভব করার চেষ্টা করছে। সন্তান হিসেবে নিশ্চিত ভাবেই অনি একজন আদর্শ সন্তান তবে মা হিসেবে যে কোন কিছুই করতে পারেন নি অনামিকা তার জন্য। মহানবী (সা.) বলেছিলেনঃ “মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত” অনামিকা অনন্যময়ীর ক্ষেত্রেও কি তাই??

অনামিকা আর সেখানে বসে থাকতে পারেন না। কোন কথা না বলে তিনি চলে আসেন সেখান থেকে। মনের ভেতরে চেপে রাখা কথাগুলো অপ্রকাশিতই থেকে যায়। কম তো চেষ্টা করেননি তিনি আজ বড্ড ক্লান্ত মনে হচ্ছে। তার কর্মফল যে এভাবে ভোগ করতে হবে তা ভাবতে পারেন নি। কি অদ্ভুত যে মেয়েকে একদিন তিনি সহ্যই করতে পারতেন না আজ তার বিন্দুমাত্র উপেক্ষাও যেন তার কাছে মৃত্যুর মতো যন্ত্রণাদায়ক মনে হয়।

অনামিকা চলে গেলে অনি সামনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। চোখ বুজতেই কয়েক ফোটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। কোন অনুভূতিই হয় না যে আজ তার মায়ের প্রতি। মা নামক সত্ত্বার অস্তিত্বকে আঁকড়ে ধরার কোন আকুলতাই নেই যে আজ তার মাঝে। আছে শুধু কিছু অপূর্ণতা আর অপ্রাপ্তির অসুখ। এই অসুখ যে গ্রাস করে ফেলছে অনিকে। যেন এক মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত আজ সে।

জাহানারা বেগমকে আজ কোথাও খুঁজে পায়না অনি। পৃথিবীর এত কোটি কোটি মানুষের মাঝে কোথাও নেই তার সেই প্রিয় মানুষটা। যেন বিশ্বাস করতে পারেনা সে। নামাজের মোনাজাত জুড়ে একটা বিরাট অংশ বরাদ্দ শুধুমাত্র তার দিদার জন্য। অশ্রু ফেলে রবের কাছে প্রার্থনা করে তার দিদার পরলোকৌক সুখের জন্য।

জাহানারা বেগমের শোকটা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। একেবারেই চুপ চাপ হয়ে গিয়েছিল সে। অনির এই অবস্থায় সবাই যেন মন খারাপের অসুখে আক্রান্ত হয়ে গেছে। ঠিক তখনই আগমন ঘটে অনি রিশাদের জীবনে মহান আল্লাহ তায়ালার এক বিরাট নিয়ামতের। অনির মাঝে বেড়ে উঠতে শুরু রিশাদ অনির ভালোবাসার অস্তিত্ব। তা অনুধাবন হতেই অনি আস্তে আস্তে জাহানারা বেগমের শোকটা কাটিয়ে ওঠে। সাথে খুশির বন্যা বয়ে যায় রিশাদদের বাড়িতে। প্রথম নাতি নাতনি হবার খুশিতে যেন শায়লা বেগম আর রায়হান সাহেব খুশিতে পাগল হওয়ার উপক্রম।

বাবা হওয়ার অনুভূতি কেমন তা রিশাদের জানা নেই। এই অজানা অনুভূতিটা আবিষ্কার করার পর থেকে রিশাদ নিজের মাঝেও এক নতুন সত্ত্বার আবিষ্কার করে। বাবা শব্দটা তার মস্তিষ্কে এসে অদ্ভুত এক ভালো লাগার শিহরণ জাগায়। সেই রাতটাকে ভুলতে পারে না। অনি যখন মাঝ রাতে ঘুম ঘুম রিশাদের কানের কাছে এসে চুপি চুপি তার বাবা হওয়ার জানান দিয়েছিল। রিশাদের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। আনন্দের উত্তেজনায় সে যেন এক মূহুর্তের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। অবশ্যই তা রিশাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ রজনী গুলোর মধ্যে অন্যতম।

মা হওয়ার অনুভূতির সাথে পরিচিত নয় অনি। নিজের মাঝে এক নতুন অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে এটা তার নিজের সন্তান ভাবতেই যেন তার লোম গুলো দাঁড়িয়ে যায়। এই সময়ে খুব প্রয়োজন ছিল তার পাশে তার দিদাকে। তবে সে আজ নেই ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

দেখতে দেখতে নয়টা মাস কেটে যায়। পেট ফুলে গেছে। শরীরটাও কিছুটা মুটিয়ে গেছে। রিশাদ যেন তাকে মাটিতে পা ই ফেলতে দেয়না। সাথে রিশাদের পরিবারের শবাইও। ফুপি হবে বলে রিশা মিথিলার যেন খুশির সীমা নেই। কিছু দিন পর পরই এসে দেখে যায়।

অদ্রিও বেশ খুশি অনির মা হওয়ার খবর শুনে। কয়েক বছর হলো সেও বিয়ে করে নিয়েছে সাদাতকে। তারপর ঢাকাতেই সেটেল হয়ে যায়। তাদের ঘরও আলো করে এসেছে তাদের একমাত্র সন্তান সাদিফ। অদ্রির অবজারভেশনেই আছে অনি। অনির এই সময়গুলোতে অদ্রি সব সময় পাশে ছিল। দুদিন পর পর সে এসে অনির চেকাপ করে যায়। ঢাকার বেস্ট গায়নোকোলজিস্ট দের সাথে কথা বলে রেখেছে অদ্রি। যেকোন ইমারজেন্সির জন্যও সে প্রিপারেশন নিয়ে রেখেছে। রিশাদ ও তার পরিবারের সবার সাথেও অদ্রির সম্পর্কটা বেশ ভালো হয়েছে।

অনামিকা এসেও দেখে গেছেন অনিকে। অনি বিশেষ কোন আগ্রহ নেই সেদিকে। তবে অনামিকার সাথে খারাপ ব্যবহারও করেনা সে। অনামিকার অস্তিত্ব তাকে ভাবায় না। শুধুমাত্র গুরুজন বলেই সে সালাম জানিয়ে কুশল বিনিময় করে তার মায়ের সাথে। অনামিকা এতে কষ্ট পেলেও মুখ ফুটে কিছু বলেন না আর। অনি যে অনামিকাকে তার পাশে থাকতে দিয়েছে এতেই সে খুব খুশি।

আজ এক বছর পূর্ণ হয়েছে জাহানারা বেগমের মৃত্যুর। অনির ডেলিভারির ডেটও এগিয়ে এসেছে তবে যেকোন মূহুর্তেও হতে পারে। তাই রিশাদ একটু বেশিই যত্ন নিচ্ছে। মাঝে মাঝে সবার এত যত্ন পেয়ে বিরক্ত হয়ে যায় অনি। আর রিশাদ অনির মুড সুইংস সামলাতে সামলাতেও যেন বিরক্ত হয়না। অনির শুধু মুখ ফুটে বলার অপেক্ষা। রিশাদ বিনা বাক্য ব্যয়ে তার সামনে হাজির করে। রিশাদ কতটা দায়িত্বশীল একজন পিতা হবে তা ভালো ভাবেই টের পাচ্ছে অনি। এত সুখ যে তার কপালে লেখা ছিল ভাবতেই চোখে জল চলে আসে। সৃষ্টিকর্তার কাছে সারা জীবন শুকরিয়া আদায় করলেও তা পর্যাপ্ত হবে না বলে মনে হয় অনির কাছে।

মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ এতিমদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। রিশাদই সব ব্যবস্থা করেছে দিদার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে। অনি বেলকনির চেয়ারে বসে বসে দেখছে। দিদাকে খুব মিস করে সে। তার অবচেতন মন আজও জাহানারা বেগমকে ফিরে পাবার অপেক্ষায় বসে আছে।

ইজি চেয়ার থেকে উঠে দেয়াল ধরে আস্তে আস্তে রুমে চলে যায় অনি। সকাল থেকেই পেটটা ভারী ভারী লাগছে। তলপেটের দিকে ভারী অনুভূত হচ্ছে। সাদিফ অনির সাথে বসে খেলা করছিল। অদ্রি নিচে গেছে অনির জন্য খাবার আনতে। অনির খুব পানি পিপাসা পেয়েছে। গ্লাসটা টেনে নেয়ার চেষ্টা করে।নাগাল পাচ্ছে না। সাদিফ এসে গ্লাসটা এগিয়ে দেয় অনিকে। অনি মুচকি হেসে সাদিফের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ঢক ঢক করে পানি খেয়ে ফেলে।

পানি খেয়ে বিছানায় হেলান দেয় অনি। পানি খাওয়ার পর থেকেই পেটে হালকা ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার। মূহুর্তের মধ্যেই যেন ব্যথা টা তীব্র হয়ে যায়। ব্যথায় অনির ধব ধবে ফর্সা মুখটা নীল হয়ে যায়। আর্তনাদ করে ওঠে অনি। বেশি জোরে চিল্লাতেও পারছে না সে। ব্যথাটা যেন আরো বাড়ছে। এসি চলা সত্ত্বেও প্রচণ্ড ঘামছে অনি। ছোট্ট সাদিফ ভয়ে জড় সড় হয়ে যায়। খালামণির কাছে এসে সে বার বার ডাকতে থাকে। অনি খুব কষ্ট করে তাকে বোঝায় ডেকে আনার কথা। সাদিফ দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

সাদিফ তার মাকে গিয়ে অনির অবস্থার কথা বলতেই অদ্রি স্যুপের বাটিটা এক রকম দৌঁড়ে উপরে চলে আসে। ব্যথায় কাতরাচ্ছে অনি। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পরছে। অদ্রি দৌঁড়ে গিয়ে তার পাশে বসে পড়ে। মাথা হাত বুলিয়ে তার অনিকে আত্মবিশ্বাস জোগায় সে। রিশাদকে ফোন করে উপরে চলে আসতে বলে। সবাই উপস্থিত হয় অনির রুমে। অনিকে ব্যথায় কাতরাতে দেখে রিশাদ ঘাবড়ে যায়। তার মাথা কাজ করছে না।

অদ্রি রিশাদকে বলে অনিকে কোলে তুলে নিতে তাকে এক্ষুণি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। অদ্রির কথামতো রিশাদ অনিকে কোলে করে গাড়িতে নিয়ে যায়। অদ্রির কোলে মাথা রাখে। শায়লা বেগমও যান তাদের সাথে। বাকিরা সবাই অন্য গাড়িতে আসে। অদ্রি গাড়িতে বসেই হসপিটালে ফোন করে জানিয়ে দেয় ওটি রেডি করতে। তার ডাক্তার ফ্রেন্ডকেও জানিয়ে দেয় যে অনির ডেলিভারি করাবে।

বিশ মিনিট পর অনিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছায়। সবকিছু রেডি থাকায় বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। অদ্রি অনিকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকে। রিশাদ সহ দুই পরিবারের সবাই বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে।

রিশাদ চিন্তায় এক জায়গায় স্থির থাকতে পারছে না। খুব চিন্তা হচ্ছে তার অনির জন্য। অনির আর্তনাদ গুলো রিশাদের কানে বাজছে। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। কিছুটা ভয়ও কাজ করছে অনিচ্ছাকৃত ভাবেই। সবার কপালেই চিন্তার ভাজ আর অজানা শঙ্কা।

সবার চিন্তার ইতি ঘটিয়ে কান্নার আওয়াজ হাওয়ায় ভেসে আসে। রিশাদ কান্নার শব্দ পেয়ে যেন স্বস্তি পায়। একজন নার্স বেরিয়ে এসে কন্যা সন্তানের সু সংবাদ দেয়। খুশিতে রিশাদের চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে। বাচ্চা ও মাকে কেবিনে দিতে কিছুটা সময় লাগবে। তাই রিশাদ ওয়েটিং রুমে বসেই দু রাকাত নফল নামাজ আদায় করে আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করে।

আজ রিশাদের পরিবার সম্পূর্ণ হলো। তাদের ঘর আলো করে এসেছে তাদের রাজকন্যা। বাবা হওয়ার নতুন এই অনুভূতি আরেকবার নতুনত্ব লাভ করে যখন রিশাদ তার সদ্য জন্ম নেয়া রাজকন্যাকে কোলে নেয়। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আছে। শার্ট এর হাতায় চোখ মুছে রিশাদ তার রাজকন্যার কপালে চুমু খায়। রাজকন্যাও যেন বাবার আদর পেয়ে ঠোঁটদুটো প্রশ্বস্ত করে শব্দহীন হাসি দেয়। তার হাসিতেই খুশির রোল পরে যায়।

অনির জ্ঞান ফিরলে আবছা আবছা দেখতে পায় রিশাদের মুখ। রিশাদের মুখ স্পষ্ট হতেই রিশাদের হাতে থাকা তাদের রাজকন্যার দিকে নজর যায়। রিশাদ অনির দিকে এগিয়ে যায়। অনির পাশে বাচ্চাকে শুইয়ে দিয়ে রিশাদ বলে;

-দেখো আমাদের মেয়ে।

ক্লান্ত অনির মলিন মুখে চোখদুটো জ্বল জ্বল করে ওঠে খুশিতে। মেয়ের দিকে ঝুঁকে তাকে চুমু খায় সে। কোলে নেয়ার চেষ্টা করলে শারীরিক দুর্বলতার জন্য ব্যর্থ হয়। রিশাদ অনির হাত দুটো ধরে শক্ত করে কোলে তুলে দেয়। প্রশান্তি অনুভব করে অনি। প্রাপ্তির খাতায় আরেকটি যুক্ত হয় আজ। আজকের বিশেষ দিনে অনি তার সন্তানকে জন্ম দিয়েছে। প্রচণ্ডভাবে জাহানারা বেগমের অভাব বোধ করছে সে। এই ছোট্ট প্রাণটার মধ্যেই অনি জাহানারা বেগমের অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা করে। তাই তার নাম রেখেছে জোহরা বিনতে রিশাদ।

জোহরার আগমনে বদলে যায় অনি রিশাদের জীবন। মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করে যেন জন্ম হয় এক নতুন অনন্যময়ীর। জীবনের এই নতুন পরিচয় সাদরে গ্রহণ করে অনন্যময়ী রিশাদ। সুখপাখিরা যেন তাদের খাঁচায় বন্দী হয়ে যায়। এক নতুন জগতে পাড়ি জমায় তারা শুভ সূচনার মাধ্যমে। অটুট হয় তাদের ভালোবাসার বন্ধন।

দুই দিন পর রিলিজ দেয়া হয় অনিকে। রিশাদ জোহরার কপালে চুমু খেয়ে অনির কোলে দেয়। অনি মুচকি হেসে রিশাদের দিকে তাকায়। জোহরার ছোট হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রিশাদের শার্ট। একে অপরের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে দেয় অনি রিশাদ। অদ্রি রুমে আসায় তাদের হাসিতে বিরতি পরে।

জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিয়ে গাড়িতে তুলে নেয় রিশাদ। অনিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে জোহরাকে তার কোলে তুলে দেয় অদ্রি। সেও অনির পাশে বসে পড়ে। সামনের ড্রাইভিং সিটে রিশাদ।

রিশাদদের বাড়িতে আজ হুলস্থুল কাণ্ড। শায়লা বেগম যেন আজ খুশিতে আত্মহারা। খুশি ও উত্তেজনায় তিনি যেন কোন দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না। গাড়ির শব্দ হতেই তার চোখ মুখ চক চক করে ওঠে।

জোহরাকে কোলে করে নিয়ে বাড়িতে ঢোকে অনি। বাড়িতে ঢুকে সে বড়সড় ধাক্কা খায়। পুরো বাড়িটা বেলুন দিয়ে সাজানো। মাঝে মাঝে লাইটিং করা। দিনের বেলা হওয়ায় তা বোঝা যাচ্ছে না।চিনতেই পারছে না সে। শায়লা বেগম নাতনি ও বউমাকে বরণ করে নেন। জোহরার গলায় পরিয়ে দেন সোনার চেইন আর অনিকে উপহার দেন এক জোড়া কানের দুল।

বেশ উৎসব উৎসব ভাব আজ। জোহরাকে সবাই কোলে নিয়ে আদর করে দিচ্ছে। অনির কোলে আসার সুযোগই দিচ্ছে না। একবার তার দাদা দাদীর কোলে তো আরেক বার তার ফুপীদের কোলে। সোফায় বসে অনি তাকিয়ে দেখছে জোহরাকে নিয়ে সবাই কতটা উৎফুল্ল। রিশাদের হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখে অনির মনে ভালো লাগার মৃদু হাওয়া বহমান হয়।

অনির খুশিটা দ্বিগুণ বেড়ে যায় চৌধুরী পরিবারের সবাইকে দেখে। হাসপাতালে অনির পাশে পাশে থেকেছেন রেহানা। রিলিজ হওয়ার একদিন আগে অনি তাকে জোর করে পাঠিয়ে দেয়। অনি হাসিমুখে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করে। নাতনিকে পেয়ে তারাও মহাখুশি।ছোট্ট গুনগুন এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। তবে উৎফুল্লতা আগের মতোই আছে। জোহরাকে কোলে নিয়ে আদর করে দেয় তারা।

মাঝরাতে কান্নার শব্দে ঘুম যায় রিশাদের। জোহরাকে কোলে নিয়ে কান্না থামাতে হিম শিম খাচ্ছে অনি। রিশাদ অনির দিকে তাকাতেই কিছুটা অসহায় মুখ করে তাকায় অনি। রিশাদ অনির কোল থেকে জোহরা নিয়ে রুমের মধ্যে পাইচারি করছে। রিশাদের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে জোহরা। কিছুক্ষণ পর রিশাদ বিছানায় শুইয়ে দেয়। অনি কোলবালিশ দুটো দুই পাশে দিয়ে পাতলা কাথা চাপিয়ে দেয় জোহরার গায়ে। রিশাদ তার ছোট্ট পরীর কপালে চুমু খায়। অনি তা দেখে মুচকি হাসে।

রিশাদ অনিকে হাসতে দেখে বলে;

–এই তুমি হাসছো কেন? ভ্রু কুঁচকে তাকায় রিশাদ।

–কিছু না এমনি।ঘুম আসছে না। চলো না একটু বেলকুনিতে গিয়ে বসি। (অনি)

রিশাদ কিছু একটা ভেবে অনির কথায় সম্মতি জানায়। জোহরা ঠিকমতো ঘুমোচ্ছে কিনা তা দেখে নিয়ে রিশাদ অনিকে নিয়ে বেলকুনিতে যায়।দরজা খুলতেই হালকা ঠান্ডা বাতাস অনির মুখে লাগে। চোখ বুজে সে বাতাস অনুভব করার চেষ্টা করে। ফুলের সুবাস এসে তীক্ষ্ণ ভাবে অনির নাকে লাগছে। আকাশে চাঁদ থাকলেও অন্য রাতের তুলনায় আলো কম। তবুও স্নিগ্ধতায় ছেয়ে আছে পরিবেশটা। বিশাল ওই আকাশটা হাতছানি দিচ্ছে তাদের দিকে। বেলকনির রেলিং এ ভর দিয়ে দাঁড়ায় রিশাদ। অনি রিশাদের কাঁধে ভর দিতেই রিশাদ এক হাত দিয়ে অনিকে আঁকড়ে ধরে। অনি মুচকি হেসে তাকায় রিশাদের দিকে।

–তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহারটা দিয়েছো আমায় অনন্যময়ী। আমাদের রাজকন্যাকে দিয়েছো আমায়। ভালোবাসি অনন্যময়ী। সারাজীবন ভালোবাসতে চাই। আল্লাহ আজ আমার পরিবারকে পূর্ণ করে দিয়েছে তোমার মাধ্যমে।আমি আজ কতটা খুশি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। (রিশাদ)

রিশাদের কথা শুনে অনি কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে বুঝে উঠতে পারছে না।রিশাদকে পেয়েই তার জীবনটা আজ এত সুন্দর হয়েছে। রিশাদ তার জীবনের সকল আনন্দের মূল উৎস। অনির সকল হাসিকান্না,ভালো থাকা রিশাদকে ঘিরেই। অনির অনুভূতি গুলো ভাষায় প্রকাশ করার মতো স্বপ্ন খুঁজে পাচ্ছে না। রিশাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরে আস্তে করে বলে; ভালোবাসি রিশাদ। আরো অনেক বছর পার করতে চাই তোমার সাথে।

রিশাদ চোখ বুজে তার প্রিয়তমাকে জড়িয়ে ধরে। সুখের অনুভূতিগুলো তার হৃদয় জুড়ে বিচরণ করছে। জীবনের খারাপ সময়গুলো কাটিয়ে উঠে আজ তারা এত সুখের সাক্ষী হতে পেরেছে। জীবনে চলার পথটা মসৃণ ছিল না তাদের জন্য তবুও একসাথে থেকে তারা সব খারাপ সময় গুলো অতিক্রম করেই আজ এতটা সুখী হতে পেরেছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে কোন অভিযোগ কোন চাওয়া নেই আজ তার। এই সুখগুলোর সাহায্যেই অনি তার জীবনের অতীতে বিষাক্ত অভিজ্ঞতা গুলো কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। জীবন যে এতটা সুখের হতে পারে তা অনির ধারণা ছিল না। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল অনন্যময়ী রিশাদরা।

আসসালামু আলাইকুম?
অনন্যময়ী গল্পটা আজ থেকে শেষ। প্রায় পাচঁ মাস ধরে গল্পটা চলছিল। পড়াশোনার ব্যস্ততার জন্য অনেক বেশি সময় লাগছে গল্পটা শেষ করতে। তবুও অনেকে ধৈর্য ধরে আমার গল্পটা পড়েছেন, প্রয়োজনে ভুল ত্রুটি গুলো ধরিয়ে দিয়েছেন। তার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ সবাইকে। এন্ডিংটা খুব ভালো করে হয়তো বা দিতে পারিনি। ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ সবাইকে। ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here