অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_০৮

0
7708

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_০৮

বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেমে যাওয়ায় ধ্যান ভাঙে অনির।গাড়িতে উদাসীনভাবে বসে থাকে অনি।দৃষ্টি তার কাচের জানালা ভেদ করে বাইরের দিকে।

গাড়ি থামতেই অনি আড়চোখে রিশাদের দিকে তাকায়।রিশাদের দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়।অনি দ্রুত তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।দ্রুতগতিতে গতিতে গাড়ির দরজা খুলে নেমে যায় অনি।হড়বড় করে নামতে গিয়ে পায়ে কিছুটা ব্যথা পায় অনি।

রায়হান সাহেব বিচলিত কণ্ঠে অনিকে বলে;
এতো তাড়াহুড়ো করছিস কেন মা?ব্যথা পাবি তো।

অনি শান্ত কণ্ঠে বলে;আমি ঠিক আছি আংকেল কিচ্ছু হয়নি আমার।

রায়হান সাহেব রিশাদের পাশের দরজাটা খুলে অনির সাহায্যে তাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দেন।
অনি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে চোখ বুলায়। বিশাল আকারের দোতালা ডপ্লেক্স হাইজ।বাড়ির সামনে থেকে মেইনরোড পর্যন্ত পাকা রাস্তা।রাস্তার দুপাশ দিয়ে পাতাবাহারের গাছ লাগানো সাথে ফুলের বাগান।দেশি ফুলের পাশাপাশি বিদেশি ফুলও দেখতে পায় অনি। ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে অনির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।

প্রত্যেক মেয়েরই শ্বশুর বাড়িতে প্রথম আগমন নিয়ে কিছু স্বপ্ন মনের গহীনে যত্ন করে তোলা থাকে।অনির সেরকম কোন স্বপ্ন না থাকলেও সে এই সময় তার জীবনে ঘটে যাওয়া গত দুদিনের কথা ভাবছে।বিয়েটা হলো খুব অপ্রত্যাশিত ভাবে।তার চেয়েও বেশি অপ্রত্যাশিত ছিল বিয়ের পরেই রিশাদের হুট করে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার পরের এক্সিডেন্ট।গ্রামের দিকে হলে অনিকে এ বিষয়ে অনেক কথা শুনতে হত যার সাথে যুক্ত হতো অপয়া উপাধি।শহরে হওয়ায় তাকে কোন কথা শুনতে হয়নি ঠিকি তবে এক শ্রেণির লোক তাকে নিয়ে কানাঘুষা করেছে ঠিকি।তাতে অনির তেমন কোন মাথা ব্যথা নেই। তবে যে পরিস্থিতিতে বিয়েটা হয়েছে তাতে অনির অণু পরিমাণ দোষও নেই। যখন রিশাদের এক্সিডেন্ট এর খবর আসে তখনও অনি বাপের বাড়ি থেকে তার শ্বশুরবাড়িতে এসে পৌঁছায় নি। যার জন্য বাপের বাড়ি থেকে তার গন্তব্য ছিল সোজা হাসপাতালের দিকে। শ্বশুর বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে এসব কথা তার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে।এই বিয়ে নিয়ে অনির কোন মাথা ব্যথা নেই।তাই এসব বিষয়ও তার ভাবনার জগতে বেশি ক্ষণ ঠাই পায় না। তাকে যে ছাচে ঢালা হচ্ছে সেই ছাচের নকশাতেই নিজেকে গড়িয়ে নিচ্ছে যেন গলিত স্বর্ণের মত।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডোরবেল বাজায় রায়হান সাহেব। সাথে সাথেই শায়লা বেগম দরজা খুলে দেন যেন তিনি দরজা খোলার জন্য আশেপাশেই ছিলেন।এতক্ষণে তার অপেক্ষার অবসান হয়। অনি তাকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে। ছেলেকে দেখে ম্লান হাসি দেন শায়লা বেগম।হুইলচেয়ারে বসে থাকতে দেখতে তার বুকের ভেতর হুহু করে ওঠে। চোখ ফেটে তার পানি বেরিয়ে আসে। ভাইকে দেখে রিশার মুখেও ম্লান হাসির দেখা মেলে। তারা রিশাদকে ভেতরে নিয়ে যায়।

শায়লা বেগমের কান্না দেখে রিশাদের মোটেও ভালো লাগছে না।রিশাদ তার মা কে বলে;
উফফ মা এতো কান্না করছো কেন?আমার কিচ্ছু হয়নি।কিছুদিনের মধ্যেই আমি ঠিক হয়ে যাব।তুমি এখন মরাকান্না বন্ধ করেন।

রিশাদের কথা শুনে তার কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়।রিশাদ তার মাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে।শায়লা বেগম ছেলের বুকে মাথা রেখে পরম শান্তি অনুভব করেন।এখন তার সুখের অশ্রু বয়ে যাচ্ছে।রিশাদের চোখেও পানি চলে আসে।রিশা এসে খুশিতে তার মা আর ভাইকে জড়িয়ে ধরে। রায়হান সাহেব ও যোগদান দেন।

সবাইকে একসাথে দেখে অনির চোখ ভিজে গেলেও তার মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। অনি এরকম সুখানুভূতি এর আগে কখনো হয়নি।পরিবারের এমন দৃশ্য সে খুব কমই দেখার সু্যোগ পেয়েছে।
শায়লা বেগম অনিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনিকে ইশারা করেন।অনিও সবাইকে জড়িয়ে ধরে।অনির মনে ভালোলাগার সুখানুভূতি বয়ে যায়।

একটু পর রিশাদ বলে ওঠে; তোমারা আমাকে যেভাবে চেপে ধরেছ আমি তো এখানেই চপকে যাব।আমার এই হাতটাও ভেঙে যাব।
রিশাদের কথা সবাই হেসে ওঠে।রিশাদকে ছেড়ে দেয় সবাই। শায়লা বেগম রিশা কে বলেন অনি আর রিশাদকে তার ঘরে নিয়ে যেতে।
রিশা আনন্দে তার ভাই ভাবিকে নিয়ে ঘরের দিকে যায়।

শায়লা বেগম ব্যস্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে যান। তিনি আজ তার ছেলের সব পছন্দের রান্না বান্না করছেন।আজ তার কাছে যেন কোন ফুসরত নেই অন্য কোন কাজের।ছেলের বাড়ি ফিরে আসায় আজ তিনি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন।

রিশা তার ভাই ভাবিকে রুমে নিয়ে যায়। রিশা অনিকে ভাবি ভাবি বলে পাগল করে দিচ্ছে। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও এখন তার কোন অনুভূতিই হচ্ছে না অবশ্য তার যে ভালো লাগছে সেরকম কিছুও না। অনি রুমে ঢুকে চারদিকটা এক নজরে দেখে নেয়। রুমের মাঝ বরাবর একটা লাক্সারি বেড।দেয়াল জুড়ে টাঙানো রিশাদের ছবি। রিশাদের ছোটবেলার কিছু ছবিও অনির চোখে পড়ে। দামী দামী আসবাব পত্র দিয়ে ভরা রুমটার পরতে পরতে আভিজাত্যের ছোঁয়া। রুমটা বেশ গোছানো একদম পরিপাটি। যে জিনিসটি অনির সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে তা হলো জানালার মাজ বরাবর ঝুলানো ওয়াইন্ড চাইম। হাওয়ায় দুলে টূং টুং শব্দে অনির মনটা ভালো হয়ে যায়।

রিশার ডাকে অনির ধ্যান ভাঙে।রিশা অনিকে বলে;ভাবি তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।আমি আসছি।

রিশা চলে যাওয়ার পর অনি ঠায় সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।রিশাদ অনিকে বলে;
অনন্যময়ী আমাকে একটু বেডে বসাই দিবেন প্লিয। দেখুন না রিশাকে বললাম আমাকে বসায় দিতে সে দৌড়ে পালায় গেল। রিশাদের মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে ওঠে।

অনি রিশাদকে বলে;ফ্রেশ হয়ে তারপর বসেবেন। আপনার ড্রেসটাও তো চেঞ্জ করা হয়নি।

রিশাদ আমতা আমতা করে বলে;আচ্ছা ঠিক আছে।আপনি তাহলে প্লিয একটু কষ্ট করে আলমারি থেকে আমার কাপড়টা বের কবেন??

অনি কোন উত্তর না দিয়ে আলমারি থেকে একটা শার্ট আর ট্রাউজার বের করে রিশাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।
সে রিশাদ কে হুইলচেয়ার থেকে নিজের কাধে ভর দিয়ে দাঁড় করায়।রিশাদ পুরো ভাড় অনির উপর ছেড়ে দিতেই সে অনি কিছুটা ব্যালেন্স হারিয়ে রিশাদকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরে সামলে নেয়। এভাবে চেপে ধরায় রিশাদ স্থির হয়ে যায়। সে যেন এক পাও আগাতে পারছে না। অনি ব্যালেন্স রাখতে গিয়ে রিশাদকে ধরে ফেললেও সে এখন খুবই অস্বস্তি বোধ করছে।

রিশাদকে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় অনি।মলিন গলায় বলে; আপনি কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি ফ্রেশ হবেন?

রিশাদ কোন জবাব না দিয়ে ধীরে ধীরে সামনে পা বাড়ায়। ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে রিশাদের হাত মুখ ধুয়ে মুছে দেয়। রিশাদ বাম হাত দিয়ে শার্ট এর বোতাম খোলার চেষ্টা করে। তবে সে কোনভাবেই একটা বোতামও খুলতে পারেনা। সে এখন বিরক্ত হয়ে যায়।অসহায় ভাবে অনির দিকে তাকিয়ে থাকে।
অনি এতক্ষণ ধিরে রিশাদের কর্মকাণ্ড গুলো দেখছিল।রিশাদকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে বুঝে উঠতে পারে না কি করবে। কিছুক্ষণ এভাবেই নীরবতার মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে দেয় দুজন।

হুট করে অনি রিশাদের শার্ট এর বোতামগুলো খুলে দিয়ে আরেকটা শার্ট রিশাদকে পরিয়ে দেয়। কোন দিকে না তাকিয়ে সে নিজের কাজ করে। রিশাদ অনির কাজে আরো একবার অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।সে হা করে অনির তাকিয়ে থাকে।মুখে কিছু বলতে পারেনা। কোন শব্দই এখন তার মাথায় আসছে না। মস্তিষ্ক তার ফাকা ফাকা লাগছে।অনির সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।সে অবলীলায় নিজের কাজ চালিয়ে যায়।

তারপর অনি রিশাদকে রুমে এনে বিছানায় হেলান দিয়ে বসিয়ে ওয়াশ্রুমে ঢুকে যায়। ওয়াশরুমে ঢুকে অনি লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে থাকে। একটু আগে সে কি করেছে ভাবতেই তার হাত পা কেঁপে কেঁপে উঠছে।অনি চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নেয়। আয়নায় সে ঝাপসা চোখে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে। এই মূহুর্তে সে কেমন অনুভূতি করছে তা সে সংজ্ঞায়িত করতে পারছে না।একটুপর ফ্রেশ হয়ে সে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে।

অনিকে বেরিয়ে আসতে দেখে রিশাদ একবার তার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। এই মূহুর্তে তার মাথায় অদ্রি স্মৃতি গুলো বার বার উঁকি দিচ্ছে যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোন উপায় রিশাদের জানা নেই।অসহ্যকর ব্যথা অনুভব হচ্ছে রিশাদের। খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুজে থাকে রিশাদ।সে চাইছে না তার চোখের অশ্রুগুলোকে বাইরে বের হোক।

অনি রিশাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।সে রিশাদের হাবভাব দেখে তার মনে কি চলছে বোঝার চেষ্টা করে।তবে সে কিছুই বুঝতে পারে না তবে অনুমান করতে পারছে রিশাদের মুড অফ।তাই সে রিশাদকে আর ঘাটাতে চায় না।

সোফায় বসে পরে অনি। ফ্রেশ সে অস্বস্তি বোধ করছে।হিজাবটা এখন তার বেশ গরম লাগছে।সে আঙুল মুখে দিয়ে ভাবছে হিজাবটা খুলবে কিনা। সে দ্বিধায় পড়ে যায়। শেষমেশ হিজাবটা না খুলে সে সোফাতেই বসে থাকে। সে চাইছে এখন একবার গোসল দিতে কিন্তু তার কাছে এক্সট্রা কোন জামা কাপড় নেই।এক্সট্রা কোন কাপড় না রাখায় অনি মনে মনে নিজের বোকামির উপর বিরক্ত হয়।এখানে সে এখন জামা কাপড় কোথায় পাবে। ভেবেই সে হতাশ হয়ে বসে থাকে। পরক্ষণেই তার রিশার কথা মনে পড়ে।গোসল না করায় তার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে।

নানান ধরনের কল্পনা জল্পনা করতে করতে অনি রুম থেকে বেরিয়ে যায় রিশার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রুম থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূর যেতেই পাশেই একটা রুমে রিশার আওয়াজ পায়। সে দরজায় নক করতেই রিশা বেড়িয়ে আসে।

রিশা অনিকে দেখে বলে;
ভাবী তোমার কি কিছু লাগবে?? আমাকে একবার ডাকলেই হতো তুমি ভাইয়াকে একা রেখে এলে কেন?
অনি কোন ভনিতা না করে বলে;
রিশা তোমার কাছে কি কোন জামা হবে? আসলে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে গোসল করলে একটু কমফোর্টেবল লাগত।আমি তো এক্সট্রা কোন ড্রেস সাথে আনিনি।তুমি কি কিছু ম্যানেজ করতে পারবে??
রিশা অনিকে বলে; তুমি তোমার রুমে যাও আমি কিছু একটা ম্যানেজ করছি।

অনি কিছুটা অবাক হয়।এখানে তার রুম কোথায়??

অনির অবস্থা বুঝতে পেরে রিশা বলে; তোমার রুম মানে ভাইয়ার রুম। এখন তো তোমাদের বিয়ে হয়ে গেছে তাই ভাইয়ার সব জিনিসই তোমার। তো মাই ডিয়ার সুইট ভাবি তুমি তোমার রুমে যাও আমি এক্ষুণি আসছি। বলেই রিশা হেসে দেয়।

অনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর সে রুমে এসে বসে পড়ে। এখন তার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে।মাথা ব্যথাটাও নাড়া দিচ্ছে।অনেকক্ষণ হলো তার কফি খাওয়া হয়নি। কফির প্রতি তার অদম্য নেশা। তিন বেলা নিয়ম করে খাবার না খেলেও কফি খেতেই হবে তাকে। গত দুদিন যাবত সে মাত্র দুকাপ কফি খেয়েছে। ভাবতেই সে কিছুটা অবাক হয়। তার এখন মনে হচ্ছে মাথায় একটা বাড়ি দিতে। তাহলে যদি মাথা ব্যথাটা না থাকে।

রিশাদ আড়চোখে একবার অনির মুখের দিকে তাকিয়ে আগের মতোই শুয়ে থাকে। সে অনির বিরক্তভাব কিছুটা বুঝতে পারলেও এখন তার সেই বিষয়ে ভাবতে মন চাচ্ছে না। রিশাদের মুখে বিষাদের ছায়া ঘন হয়ে আসছে।

চলবে…………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here