অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_১০

0
7439

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_১০

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। দুদিন আগে যখন সে শাড়ি পরেছিল তখন একরকম লেগেছিল আজ অন্যরকম লাগছে। শাড়িতে আজ তাকে পরিপুর্ণ লাগছে। অনির চোখে মুখে এক অজানা সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে।অবাক হয়ে অনি নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনি কিছু একটা ভাবতে থাকে। অনেকটা ইতস্ততবোধ নিয়ে তোয়ালে খুলে তার চুল গুলো মেলে দেয়। ভেজা চুলগুলো ফ্লোরে গড়িয়ে পরে।

অনির দিকে তাকিয়ে রিশাদের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। এই প্রথম সে অনিকে হিজাব ছাড়া দেখছে। তার চুল কেমন হতে পারে তা নিয়ে রিশাদের কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তার কল্পনাতীত ছিল এত লম্বা চুল হতে পারে। রিশাদ এই প্রথম বাস্তবে কোন নারীর এত লম্বা চুল দেখছে। বিদেশে বড় হয়েও অনির এত লম্বা চুল দেখে রিশাদ খুব ভালোভাবেই অবাক হয়। এই মেয়েকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে রিশাদ। সব কিছুই তার কাছে যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। অনির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে রিশাদ। অনি চুলগুলো ঝাড়া দিতেই রিশাদের চোখে মুখে পানির ঝাপটা লাগে।তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

অনি চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে ভালোভাবে মোছার চেষ্টা করতে থাকে। দাঁড়িয়ে থেকে চুল মুছতে মুছতে অনি কিছুটা হাঁপাতে থাকে। তারপর সে সোফায় বসে পরে। অনেক সময় নিয়ে চুলগুলো ভালোভাবে মুছে চিরুনি করে নেয়। সে এমনভাবে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় যেন কোন যুদ্ধ করে ফেলল। তবে অনির কাছে এটা যুদ্ধের থেকে কম কিছু মনে হয় না। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।

রিশাদ কয়েকবার আড়চোখে তাকায় অনির দিকে। অনির কাজগুলো মাঝে মাঝে রিশাদকে চরম আকারে অবাক করে তোলে। রিশাদের সমস্ত ধারনার উর্ধে যেন অনির অবস্থান।

অনি কিছুক্ষণ পর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। জাহানারা বেগমের মিসড কল দেখে অনি ফোনটা রেখে দেয়। জাহানারা বেগম ছাড়া অনির ফোনে সচরাচর কেউ ফোন দেয় না।

অনি ফোনটা রেখে ওয়াশরুম এ যায় ওযু করতে। সে মনে মনে ভাবে;এখন দিদার সাথে কথা বলতে গেলে নামাযের দেরি হয়ে যাবে।তাই আগে নামাজ টা পড়ে নেই তারপর দিদাকে ফোন দিব।

অযু করে বেরিয়ে আসে অনি। ফ্লোরে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পরে নেয় সে। রিশাদ বার বার ঘুরে ফিরে অনির দিকেই তাকায়। মনে হচ্ছে এখন যেন তার একটাই কাজ হলো শুয়ে শুয়ে অনির গতিবিধি লক্ষ্য করা।

অনি নামাজ শেষ করে উঠতেই রিশাদের দিকে তাকিয়ে দেখে সে তার দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে আছে। অনি কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করে। সে রিশাদকে বলে;
কি হইছে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
রিশাদ সোজা সাপটা জবাব দেয়; আমার রুম আমার চোখ যেদিকে খুশি সেদিকে তাকাবো।
রিশাদের কথায় অনি কোন জবাব না দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কেটে চলে যায়। রিশাদ বেশ মজা পায়।

অনি ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে জাহানারা বেগমকে কল দেয়।প্রথমবার রিং হতেই জাহানারা বেগম কল রিসিভ করেন।মনে হচ্ছিল তিনি যেন অনির ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন।

অনি জাহানারা বেগমকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে।
জাহানারা বেগম বলেন;
কেমন আছিস দিদিভাই?শ্বশুর বাড়ি যেয়ে তো এই বুড়িকে ভুলেই গেছিস। এখন আর আমাকে মনে রাখবি কেন?
অনি হালকা হেসে বলে; ওরে আমার ড্রামাকুইন দিদা।তোমাকে আমি ভুলে যাব কিভাবে হুম।অনি কিছুটা কাব্যিক ভাব এনে বলে;

“তুমি আমার শরতের নীল রঙা আকাশের সাদা মেঘের ভেলা;হাওয়ায় দোল খাওয়া কাশ ফুলের মেলা।

তুমি যেমন কুয়াশাছন্ন শীতের সকালের রোদের উষ্ণ পরশ তেমনি গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ্দুরে মন ভেজানো এক পশলা বৃষ্টি।

বসন্তের দক্ষিণা হাওয়ায় ভেসে আসা কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, কাঠগোলাপের ভেসে আসা মিষ্টি ঘ্রাণ।

তোমার জন্য রয়েছে শুধু মায়ায় জড়ানো হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা।”

জাহানারা বেগম অনির কবিতা শুনে একগাল হেসে দেন। হাসির আওয়াজ পেয়ে অনির মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। বাইরে থাকাকালীন জাহানারা বেগম যখনই অনির উপর রেগে যেতেন অনি জাহানারা বেগমের গলা জড়িয়ে ধরে তাকে নিয়ে বানানো কবিতা শুনালেই জাহানারা বেগমের সব রাগ উধাও। এক গাল হেসে তিনি অনির কপালে চুমু খান।অনিও বেশ উৎফুল্ল হয়ে যায় এতে করে। জাহানার বেগম বরাবরই কবিতাপ্রেমী মানুষ। তাই অনিও সু্যোগ বুঝে তার দূর্বলতা গুলো আয়ত্ত করে নিয়েছে। অনির কবিতা শুনে জাহানারা বেগমও খুশিতে গদ গদ হয়ে যান।

জাহানারা বেগম অনিকে আদুরে গলায় বলেন; হয়েছে থাক।এখন আর এই বুড়ি দিদার মান ভাঙাতে হবে না। এখন তো তোমার আরো অনেক লোক চলে এসেছে।

অনি হালকা হেসে জবাব দেয়; উফফ দিদা তুমি আমার সুইটহার্ট তোমার সাথে কারো তুলনা হয় না। তোমার সামনে একদম সবাই বোল্ড আউট হয়ে যাবে। এরপর সে এবাড়িতে আসার পর থেকে যা যা ঘটেছে গড় গড় করে সব বলে দেয়।

জাহানারা বেগম হাসিতে গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম। হাসতে হাসতে বলেন;
আমার দিদিভাই সত্যি বড় হয়ে গেছে মনে হচ্ছে এখন।
তিনি আরো কিছুক্ষণ অনির সাথে কথা বলেন।

অনি কথা বলে ফোন রেখে রিশাদের দিকে তাকিয়ে দেখে সে কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে; দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত। তবে তা নিয়ে অনির মনে বিশেষ কোন ভাবনার উদ্রেক হয় না। সে চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসে ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে থাকে।

একটু পর রিশা এসে তাদেরকে খাওয়ার জন্য ডেকে যায়। রিশাদের জন্য শায়লা বেগম খাবার নিয়ে রুমে আসে। রিশাদকে পরম যত্নের সাথে শায়লা বেগম নিজ হাতে তুলে খাওয়ায়। রিশাদ বেশ তৃপ্তি নিয়ে মায়ের হাতে খায়। এমন সুখময় দৃশ্য দেখে অনির চোখ ছলছল করে ওঠে।

শায়লা বেগম অনির দিকে তাকিয়ে তাকে ইশারা করে তার পাশে বসতে বলেন।অনির সামনে তিনি এক লোকমা খাবার তুলে দিলে অনির খুব কষ্টে চেপে রাখা অশ্রুগুলো টপটপ করে ঝড়ে পড়ে। শায়লা বেগম অনিকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। রিশাদের মতো অনিকেও তিনি পরম যত্নের সাথে তুলে খাওয়ান। অনি শায়লা বেগমের কাছ থেকে মাতৃত্বের ভালোবাসা গুলো সূক্ষ্ম ভাবে অনুভব করে। জাহানারা বেগম ব্যতীত কেউ কখনো তাকে এভাবে আদর যত্ন করে খাওয়ায় নি। তার জন্মদিন উপলক্ষে তার বাবার কাছ থেকে অনি এই ধরনের ভালোবাসাগুলো পেয়েছে তবে আজ তার অনুভূতিগুলোর সাথে সে পরিচিত নয়। এক অজানা সুখময় অনুভূতি হচ্ছে তার।
অনি রিশাদের সাথে এসে যোগ দেয় রিশা।

শায়লা বেগমকে রিশা বলে;
ছেলে আর ছেলের বউকে পেয়ে তো তোমার যে একটা মেয়ে আছে ভুলেই গেছো তুমি।
রিশাদ রিশাকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলে; দেখলি তো আমি কি আর এমনিই বলি নাকি যে তোকে কুড়িয়ে আনছি আমরা। হাতে নাতে প্রমাণ পেলি তো। আর ঝগড়া করতে আসবি না আমার সাথে।

রিশার কথায় অনি শায়লা বেগমের আচল ধরে নাকে কান্না শুরু করলে শায়লা বেগম রিশাদের কান মলা দিয়ে বলেন; তুই অসুস্থ অবস্থাতেও আমার মেয়ের পিছনে লাগছিস কেন? আমার ২টা না ৪টা না একমাত্র ছোট মেয়ে। বলেই তিনি রিশাকে জড়িয়ে ধরেন।

রিশাদ ভ্রু বাঁকিয়ে বলে; ছোট মেয়ে আবার কয়টা হয় মা একটাই তো হয়।
রিশাদের কথায় সবাই হেসে ওঠে।

একটু পরেই রায়হান সাহেব ভিতরে আসেন। সবাইকে একসাথে এত হাসিখুশি দেখে তার বুকটা জুড়িয়ে যায়। এই দিনটা অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি।তার চোখে খুশির অশ্রু এসে ভিড় জমায়। চশামার ফাক দিয়ে তা মুছে নিয়ে সবার সাথে যোগ দেন।

খাওয়া শেষ করে রিশাদ বিছানায় শুয়ে ফোন ঘাটাঘাটি করতে থাকে। অনেকদিন হলো সে অনলাইনে যায় না। ডাটা অন হতেই মেসেজের হুড় পরে যায়। কিছু কিছু মেসেজ দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে ফেসবুক ইন্সটাগ্রাম থেকে তার আর অদ্রির সকল ছবি ডিলিট করে দেয়।
পুরনো সকল স্মৃতি সে মুছে ফেলতে চায়। তবে সে কি মন থেকে মুছে ফেলতে পারবে কখনো?? রিশাদ নিজেই নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এর কোন উত্তর রিশাদের কাছে নেই। অদ্রিকে ভোলা তার পক্ষে অসম্ভব। রিশাদ সবকিছু প্র‍্যাকটিকালি চিন্তা ভাবনা করে।তবে এ বিষয়ে তার কোন ভাবান্তত হয়না। সে কিচ্ছু ভাবতে পারছে না। তার মন মস্তিষ্ক সবটা জুড়েই অদ্রির বিচরণ। রিশাদ ফোনটা বেডসাইড টেবিলে রেখে চোখ বুজে শুয়ে থাকে। এই মূহুর্তে অদ্রির স্মৃতি গুলো তাকে প্রচণ্ডভাবে কষ্ট দিচ্ছে। অদ্রির এ ধরনের কাজ সে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারে না। তার কষ্টগুলো অশ্রু হয়ে ঝরে পড়া শুরু করে।

রিশাদ মনে মনে ভাবে ;তুমি আমার সাথে কিভাবে এরকম করতে পারলে অদ্রি?আমার চেয়ে তোমার কাছে তোমার ক্যারিয়ারটা বড় হয়ে গেল।আমি তো তোমাকে কখনো কোন কিছুতে বাধা দেইনি।একটা বার তুমি আমাকে বলতে পারলে না? অদ্রির উপর অভিমানের পাল্লাটা ভারী হয়ে যায় রিশাদের। সে অদ্রিকে নিয়ে একদম ভাবতে চায় না। তবে না চাইতেও সে বার বার একি কথা ভাবে। অসহ্যকর যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির শিকার হচ্ছে সে যা থেকে মুক্তি পেতে চায় রিশাদ।

অনি সোফায় বসে কিছু একটা ভাবছে। এই রুমে এসে সে বেশির ভাব সময় সোফায় বসেই কাটিয়ে দিয়েছে। শায়লা বেগমের উপস্থিতকালে দু একবার সে বিছানায় রিশাদের পাশে বসেছে। তবে এই মূহুর্তে তার খুব ক্লান্ত লাগছে। তার উপর শাড়ি পরে তার দম বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা।মনটা বার বার চাইছে বিছানায় গিয়ে এলিয়ে দিতে। তবে সে তা পারছে না রিশাদের জন্য। তাই সে মুখটা গোমড়া করে সোফায় বসে পা দোলাতে থাকে। এক সময় সোফায় পা মেলিয়ে দিয়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ফেলে।তার দুচোখ জুড়ে তন্দ্রা নেমে আসে।

চলবে………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here