পুষ্পের_হাতে_পদ্ম (পর্ব-০১)

0
4874

পুষ্পের_হাতে_পদ্ম (পর্ব-০১)
-সুমাইয়া বিনতে আ. আজিজ

(শুরুতেই একটা বিষয় ক্লিয়ার করে নেই। ইতোপূর্বে এই উপন্যাসটি ‘তীক্ষ্মবাণ’ নামে গল্পপোকা গ্রুপ কর্তৃক আয়োজিত একটি ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয়। তবে প্রতিযোগিতার মাঝ সময়টাতে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কর্তৃপক্ষ প্রতিযোগিতার সময় শেষ ঘোষণা করায় উপন্যাসটা তারাহুরো করে শেষ করতে হয়। যার ফলে শেষটা আমার মনের মতো হয়নি। এবার সেইটা সংযোজন-বিয়োজন করে নতুন করে পূর্ণাঙ্গরূপে লিখতে শুরু করেছি)

সেদিন সন্ধ্যার পরপর বড় কাকি কোত্থেকে যেন উন্মাদের মতো আমাদের ঘরে ঢুকে ধপাস করে ফ্লোরের ঠিক মাঝখানে আছড়ে পড়ে আর্তনাদ করে বললেন, “আমার বেক শ্যাষ অইয়্যা গেছে রে রুবি! বেককিছু শ্যাষ অইয়্যা গেছে। সব্বনাশ অইয়্যা গেছে আমার।”

আম্মা আর আমি দুজনে বিছানার উপর বসে ছিলাম। প্রতিদিন মাগরিবের নামাজের পর আমি রিয়াদুস সালেহিন বইয়ের দুই-চারটা হাদিস ও হাদিসের ব্যাখা পড়ে আম্মাকে শুনাই। আম্মা বসে বসে শুনেন। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। আমরা দুই মা-মেয়ে বসে হাদিস চর্চা করছিলাম। আচমকা বড় কাকির এমন আগমনে আম্মা ও আমি দুজনেই বেশ চমকে গেলাম। আম্মা তো লাফ দিয়ে নিচে গিয়ে বড় কাকিকে আকড়ে ধরলেন। আর আমি বিছানায় হতভম্ব হয়ে বসে বুঝার চেষ্টা করছিলাম যে, আসলে কাহিনীটা কী?

আম্মা বারবার কাকির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করছেন, “কী হইছে বড় ভাবী? কী হইছে?”

কিন্তু প্রথমদিকে কাকি কিছু বলতেই পারছিলেন না। শুধু বুক চাপড়াচ্ছিলেন আর ‘হায়রে আমার কী অইলো’ বলে আর্তনাদ করছিলেন। কিন্তু আম্মার বারংবার জিজ্ঞাসে কাকি নিজেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনে বললেন, “আমার আকিব্বা আকাম কইরা বইছে রে! ও যে অই বিয়াইত্তা মাইয়াডারে নিয়া ভাইগা গেছে রুবি। আমার এইডা কী অইলো রে! কিবা কলঙ্ক নাগাইলো আমার ব্যাটা! হায়রে আমার বেটা রে, এইডা তুই কী করলি?”

কাকি আম্মাকে জড়িয়ে ধরে এবার হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে একপর্যায়ে বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। উনার দাঁতে দাঁত লেগে গেল। এতক্ষণে মেজো কাকিও আমাদের ঘরে এসেছেন। আম্মা, মেজো কাকি দুজনে মিলে বড় কাকির সেবায় লেগে পড়লেন।

এদিকে আমি স্তব্ধ, অথর্ব হয়ে বিছানায় অনড়, নিশ্চল, প্রাণহীন মূর্তির মতো বসে রইলাম। আকিব ভাই শেষ মেশ এরকম একটা জঘন্য, বেপরোয়া কাজ করে বসবে সেটা কল্পনাতেও আনতে পারিনি কখনো। হ্যাঁ, এটা জানতাম যে সে ওই পুষ্প নামক মেয়েটাকে পছন্দ করতো। দুইবছর আগে সম্পর্ক ছিল ওদের। কিন্তু ওই মেয়েটার তো দুইবছর আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাহলে আবার এখন এসব কী? মাথায় কিছু ধরছিল না আমার। আমি কারো কান্না চোখের সামনে সহ্য করতে পারি না। বড় কাকির এই অবস্থা দেখে এই ঘরে আর থাকতে পারলাম না। এক দৌড়ে উঠানে চলে আসলাম।

পুষ্প সম্পর্কে আমার বেয়াইন লাগে। সে আকিব ভাইয়েরও বেয়াইন। মেজো চাচার মেয়ে নাহার আপুর ননদ হচ্ছে পুষ্প। নাহার আপুর বিয়ে হয় আজ থেকে তিনবছর আগে। আমি তখন সবে মাত্র ক্লাস এইটে পড়ি। পুষ্প মেয়েটাকে সেই বিয়েতেই আমি প্রথম দেখি। সে আমার সমবয়সী। আর নাহার আপুর বিয়ের সূত্র ধরেই আকিব ভাই আর পুষ্পের সম্পর্কের শুরু।

প্রথম কয়েকমাস ওদের সম্পর্ক বেশ ভালোভাবেই চলে। মায়ের বাটন সেট ফোন দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আকিব ভাইয়ের সাথে ফোনালাপ কিংবা মেসেজিং করা, স্কুলে যাওয়ার পথে আকিব ভাই যখন রাস্তার এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকত পুষ্পকে দেখার জন্য তখন আকিব ভাইকে দেখে পুষ্পর মুচকি হাসি দেয়া, কখনো-বা স্কুল ছুটির পর স্কুল গেটের বাইরে এসে আশেপাশে আকুপাকু করে আকিব ভাইকে খুঁজে না পেয়ে অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে থাকা; সব মিলিয়ে কিশোর বয়সী প্রেমটা বেশ জমছিল বলা চলে। আকিব ভাইয়ের বয়সও খুব একটা বেশি না। এইতো বিশ কিংবা একুশ হবে। দুজনের ভেতরটাই আবেগে ভরপুর ছিল। আশেপাশে যা দেখতো তাই বুঝি রঙিন লাগত। সেজন্যই হয়তো-বা ভবিষ্যতের চিন্তা কিংবা দুই পরিবারের তথাকথিত সামাজিক অবস্থানের তোয়াক্কা না করে দুজন দুজনের হাত ধরে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়ার প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে পেরেছিল।

কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই নিয়তি ওদের সহায় ছিল না। তাই মাস ছয়েক পরেই একদিন প্রেমিকের সাথে কথা বলতে গিয়ে দুলাভাইয়ের কাছে ধরা খায় পুষ্প। আর তারপর থেকেই যত ঝামেলা শুরু।

আমার বাপ-চাচারা তিন ভাই। এই তিন ভাইয়ের তিন পরিবারের মধ্যে আর্থিক অবস্থা শুধুমাত্র আমাদেরই যা একটু ভালো। বড় কাকা, মেজো কাকাকে হতদরিদ্র বললেও ভুল হবে না। মেজো কাকা দিন মজুর, আর বড় কাকার ছোট একটা দোকান আছে বাড়ির কাছেই কাঁচা রাস্তার ওপারে। বড় কাকা আগে ঢাকার একটা পাটকলের শ্রমিক ছিলেন। কিন্তু বছর দুয়েক আগে একদিন ঢাকা যাওয়ার পথে দুর্ভাগ্যবশত রোড এক্সিডেন্টে পা হারিয়ে বাড়িতে বসে ছোট ওই দোকানে চা আর গুটিকয়েক বাচ্চাদের খাবারের জিনিস সাজিয়ে দোকানদারি করেন। গাভীও আছে একটা। সেই গাভীর দুধ বিক্রি করে যা টাকা হয়, আর দোকান থেকে যে দুই-চার টাকা আসে তা দিয়েই বড় কাকার সংসার চলে।

আর আমাদের আকিব ভাই, ওর কথা আর কী বলব! মুখখানা সিনেমার নায়কদের মতো হলেও গ্রামের বখে যাওয়া ছেলেদের অন্যতম একজন সে। সারাদিন বখাটের মতো পুরো এলাকা টইটই করে ঘুরে বেরায়। বড় হয়েছে, অসুস্থ বাবা ঘরে, ছোট একটা ভাই আছে, ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ আছে, সংসারের হাল ধরতে হবে; সেসবের দিকে তার খেয়ালই নেই কোনো। জুয়া খেলার নেশাও আছে বটে তার। লেখাপড়া তো সেই সিক্সে উঠার পরই বাদ দিয়েছে।

ওদিকে পুষ্পদের অবস্থা ছিল ঠিক এর বিপরীত। আমার মেজো চাচার আর্থিক অবস্থা খারাপ হলেও সৌভাগ্যক্রমে মেয়েকে বেশ বনেদি ঘরেই বিয়ে দিতে পেরেছেন। আমার দুলাভাইও মা-শা-আল্লাহ সুপাত্র; যাকে বলে লাখে একটা। ওদিকে পরিবারের সামাজিক অবস্থান, পরিবারিক সুনাম; কোনোদিকেই যেন কমতি নেই। পুষ্পও ছাত্রী হিসেবে বেশ ভালো ছিল। পিএসসিতে গোল্ডেন পেয়েছিল। ভর্তিপরীক্ষায় বিন্দুবাসিনী সরকারি গার্লস স্কুলে চান্সও পায়। কিন্তু দুলাভাই বোনকে একটু বেশিই ভালোবাসেন কি-না, তাই ছোট্ট এই পুতুল পুতুল বোনটাকে চোখের আড়ালে হোস্টেলে রেখে পড়ানোর সাহস উনার হয়ে উঠেছিল না। তাই গ্রামের হাইস্কুলেই ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। আর বলেছেন যে, এসএসসির পর টাংগাইলের কোনো একটা ভালো কলেজে ভর্তি করিয়ে দেবেন। তখন তো পুতুল পুতুল এই ছোট্ট বোনটি আর এত ছোট থাকবে না। দুলাভাইয়ের খুব ইচ্ছে, তার বোন একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। সে বুক ফুলিয়ে মানুষকে বলে বেড়াবেন যে, “আমার বোন ঢাবিয়ান।”

যে বোনকে নিয়ে এত স্বপ্ন, এত আশা; সেই বোনের এরকম একটা ভুলকে তিনি প্রশ্রয় দিবেন কিভাবে? আর কাউকে পেল না সে প্রেম করার জন্য? এরকম একটা বখাটে ছেলেকেই বেছে নিতে হলো? ওই চকচকে চেহারা ছাড়া আর কী আছে ওই আকিবের মধ্যে? বখে যাওয়া বেকার ছেলে, যার পরিবারে কিনা নুন আনতে পান্তা ফুরায়; এরকম পরিবারের একটা ছেলের সাথে তাঁর বোনটা কিভাবে নিজেকে এমন করে জড়াতে পারলো? একবারও নিজের, নিজের পরিবারের সামাজিক অবস্থান কিংবা সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে দেখলো না? আচ্ছা সে না হয় বাদই দেয়া যাক; কিন্তু একটাবার তো অন্তত নিজের সুখের কথা ভাবা উচিত। ওই ছেলেকে বিয়ে করলে ওর ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা কি একবারও ও ভেবে দেখেছে? আবেগ দিয়ে কতদিন চলবে? পেটে ভাত না থাকলে আবেগ, ভালোবাসা যে জানালা দিয়ে পালায় সেটা তার না বুঝলে চলবে?

এইটুকুন বয়সে তাঁর মেধাবী এই বোনটা লেখাপড়া বাদ দিয়ে এরকম একটা কাহিনী করে বসবে সেটা উনি কল্পনাতেও কখনো ভাবেননি। যেখানে যে বোনের কাছ থেকে উনার এখন একের পর এক পরীক্ষার ভালো রেজাল্টের সংবাদ শোনার কথা, সেখানে তিনি বোনের ঘটানো এরকম একটা অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা অবলোকন করে একইসাথে বিস্মিত, ব্যথিত, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

পুষ্পর সাথে দুলাভাই প্রথমে এই বিষয়টা নিয়ে রাগারাগি না করে ঠান্ডা মাথায় বুঝানোর মাধ্যমে বোনকে ফিরানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পুষ্পর বয়সটা তখন কোনো বুঝ মানার বয়স ছিল না। সেটা ছিল আবেগের বয়স। তাই স্বাভাবিকভাবেই কারো কোনো বুঝ না মেনে সে গোঁ ধরে বসে থাকে। ওই মুহূর্তে তো তার মাথায় আকিব ছাড়া অন্যকিছু ছিল না।

দিনের পর দিন আকিবকে নিয়ে তার বাড়াবাড়ি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে থাকে। আকিবের সাথে যোগাযোগের সব উপায় বন্ধ হওয়ায় নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে অঘোষিত অনশন পালনে মারিয়া হয়ে উঠে সে। ফলশ্রুতিতে আমার ধৈর্যশীল দুলাভাইও তাঁর ধৈর্য্য শক্তি ধরে রাখতে অক্ষমতা পোষণ করেন। যে কিনা নিজের আদরের পুতুল পুতুল ওই ছোট বোনটাকে রাগ করে কখনো একটা ধমকও দেননি, সেই মানুষটাই এই পর্যায়ে এসে বোনকে অন্যায় থেকে ফেরাতে ব্যর্থ হওয়ার দরুন নিজের রাগ সংবরণ করতে না পেরে জীবনের প্রথমবারের মতো বোনের গায়ে হাত তুলেন। শুধু গায়ে হাত তুলেই ক্ষান্ত হন না; অবিশ্বাস্যভাবে জেদ বশত এই অপরিপক্ক বয়সে বোনকে বিয়ে দিতেও মারিয়া হয়ে উঠেন তিনি।

অতঃপর মাত্র একমাসের মাথায় এক প্রবাসী ছেলেকে ধরে আনেন বোনের জন্য। ছেলের বাড়ি পাশের গ্রামেই। ছেলেটির বয়স পুষ্পর বয়সের প্রায় দ্বিগুণ হলেও দেখতে, শুনতে সবদিকেই ভালো ছিল। বছর তিনেক আগে ইতিহাসে অনার্স পাশ করে ইতালি পাড়ি জমায়। এবার বিয়ে করার জন্যই ছুটিতে এসেছে। পারিবারিক অবস্থাও বেশ ভালো। গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবার যাকে বলে। পরিবারের প্রতিটা লোকজনের ব্যবহারও অত্যন্ত অমায়িক। দুলাভাই ছেলে ও ছেলেপক্ষের ব্যাপারে সব ধরনের খবরাখবর খুব নিগূঢ়ভাবে নিয়েছেন। কোথাও একটুও ফাঁকফোকর রাখেননি। বিয়ের পর বোনের যেন অন্যান্য মেয়েদের মতো কষ্ট সহ্য করতে না হয় সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন তিনি।

স্বাভাবিকভাবেই পুষ্প এই বিয়েতে রাজি ছিল না। ওদিকে আকিবের সাথেও কোনোপ্রকার যোগাযোগ করতে পারছিল না। কারণ ওকে একপ্রকার ঘরবন্দী ও নজরবন্দী করে রাখা হয়েছিল। স্কুলে যাওয়া তো বন্ধই। সেই সাথে বিয়ের আগ পর্যন্ত বাড়ির বাইরে, এমনকি প্রাকৃতিক প্রয়োজন ব্যতীত ঘরের বাইরে যাওয়াও নিষিদ্ধ ছিল। ওর অবস্থা তখন এমন হয়েছিল যে, না পারছিল এসব সইতে আর না পারছিল কিছু কইতে। আত্মহত্যার চিন্তাও যে মাথাতে আনেনি সেটাও না। কিন্তু আত্মহত্যা করার সুযোগ পাবে কোথায়? ও তো সবার নজরবন্দী ছিল।

অবশেষে বাধ্য হয়েই বিয়েটা করতে হয় পুষ্পকে। এক বুক যন্ত্রণা, সবার প্রতি এক আকাশ পরিমাণ অভিমান নিয়ে সে পাড়ি জমায় শ্বশুরবাড়ি।

পুষ্প দেখতে বেশ সুন্দরী হলেও উচ্চতায় খাটো ছিল বেশ। মাত্র চার ফুট এগারো ইঞ্চি উচ্চতার অধিকারী হওয়ায় ওকে ওর বয়সের তুলনায় আরো ছোট লাগতো। সব মিলিয়ে ওকে একটা বাচ্চা পুতুল বলেই মনে হতো। পুরো মুখটা ছিল মায়ার এক বিশাল রাজ্য। সে রাজ্যে মায়ার অভাব ছিল না কোনো। পুষ্পর মায়া মায়া ওই আদুরে মুখটার দিকে তাকালে প্রখর বিষিয়ে যাওয়া মনও ভালো হয়ে যেতে যেন বাধ্য!

শ্বশুরালয়ের প্রতিটা সদস্য মায়া রাজ্যের একচ্ছত্র অধিকারিণী পুষ্পকে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছিল। বাড়ির ছোট বউ পুষ্পকে কেউ বউ হিসেবে না; মেয়ে হিসেবেই দেখতো। ওর প্রতি কারো ভালোবাসা কিংবা মায়ার যেন কমতি ছিল না।

দুলাভাই বোনকে যেরকম সুখে দেখতে চেয়েছিলেন, উনার বোন ঠিক সেরকম সুখের জায়গায়ই পড়েছিল। বাড়ির বউ; অথচ কোনো কাজে হাত লাগাতে দেয় না কেউ। বিয়ের পর পর পুষ্পর দাদি ওর শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন। ওকে সবসময় কাজ না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে উনি একদিন চোখ রাঙিয়ে বলেছিলেন, “হশুরবাড়ি আইয়্যা কেউ এমনে নবাবজাদীর নাগালা বইয়্যা থাকে? অই দেখ তোর জায় রান্দাবাড়া করতাছে। জায়ের লগে যাইয়া কামে হাত নাগা। কুটাবাছা কইরা দে যা।”

দাদির কথা শুনে পুষ্প ভেংচি কেটে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। দাদি তো জানে না যে, পুষ্প এই বাড়ির কারো সাথে কখনো ভালো ব্যবহার না করার ব্যাপারে মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ!

দাদির কথায় পুষ্প ভেংচি কেটে অন্যদিকে মুখ ফেরালেও তার জা মুন্নি একগাল হেসে দাদিকে বলেছিল, “আরে দাদি থাইক! এখনই ওর কাজ-কামে হাত দেওয়া লাগব ক্যান? আমি আছি তাইলে কীয়েত্তে? দুইদিন পর আমার দেবরডা বিদেশের বাড়ি যাইবো গা। এখন ও আমার দেবররেই সময় দিক। কাজ-কাম করার জন্যে তো সারাজীবন পইরাই রইছে।” এতটুকু বলে পুষ্পর দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে নিজের কথার সমর্থন পাওয়ার আশায় বলতো, “কী কও পুষ্প? ঠিক কইছি না আমি?”

পুষ্প মুন্নির কথায় কোনো জবাব না দিয়ে গোমড়ামুখো হয়ে সেখান থেকে উঠে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। দাদি ‘হায় হায়’ রবে বলে উঠেন, “ওই মাইয়্যা, পেঁচার নাগালা মুখ বানাইয়া যাস ক্যা উইঠা?”

মুন্নি আগের মতোই একটা বিস্তৃত হাসির রেখা ঠোঁটে টেনে বলে, “যাইতে দেন দাদি। আবার দেবরডা একা একা ঘরে রইছে। দেবরের কাছে গেলে পেঁচার নাগালা মুখ টিয়া পাখির নাগালা হইয়্যা যাইবো দেইখেন।”

পুষ্প যে ওর স্বামী তাকবিরের সাথেও খারাপ ব্যবহার করার চেষ্টা করেনি তেমনটাও না। বিয়ের প্রথম রাত থেকেই তাকে উপেক্ষা করার চেষ্টায় সে উঠেপড়ে লেগেছে। বিয়ের রাতে বাসরঘরে ঢুকে মুখের উপর বালিশ চেপে দিয়ে শুয়ে পড়েছিল। তাকবির বাসর ঘরে ঢুকে যখন পুষ্পকে ডাকে তখন পুষ্প ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে সেভাবেই। যদিও সারারাত সে এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি। আকিবের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত তাকে পুরোটা রাত কুঁড়েকুঁড়ে খেয়েছে। বাসরঘরের তাজা ফুলগুলোর মন মাতানো সুবাস সেই রাতে ওর মন মাতাতে পারেনি। বরং এই সুবাস ওর বিষিয়ে যাওয়া মনে বিষাক্ত কাটার মতো বিঁধছিল।

অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরেও যখন পুষ্পের উঠার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না তখন তাকবির তার সদ্য বিবাহিত এই পুতুল পুতুল অবুঝ বউটার অবুঝপনায় হাসবে, রাগ করবে নাকি অভিমান করবে সেটা মুহূর্তখানেক সময়ের জন্য বুঝে উঠতে পারছিল না। পরে অবশ্য রাগ, অভিমানের উপর হাসিটাই বিজয়ী হয়েছিল। আনমনে মুচকি হেসে নিজেকেই নিজে বলছিল, “এরকম একটা অবুঝ বাচ্চা বিয়ে করে বাসর রাতের সুখ কোন আক্কেলে পাওয়ার আশা করো বাছাধন?”

পুষ্পকে আর ডাকাডাকি না করে তাকবির সে রাতে শুয়ে পড়েছিল ওর পাশে। এরপর ওকে একটু কাছে টেনে বুকে চেপে ধরেছিল একটুখানি। ঘুমের ভান ধরায় তাকবিরের এই কাছে টানাকে সাথে সাথেই উপেক্ষা করতে পারেনি পুষ্প। কিন্তু কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর নিজের কৌশলে ঠিকই তাকবিরের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল সে।

সেদিনের পর প্রায় সপ্তাহখানেক সময় কেটে গিয়েছে। এখন পর্যন্ত তাকবিরের সাথে হাসিমুখে একটা কথা বলে দেখেনি সে। বরং তাকবির কিছু বললেও সে ‘ডন্ট কেয়ার’ ভাব দেখিয়ে বসে থাকে। এমনভাবে থাকে, মনে হয় যেন তাকবিরের কোনো কথা সে শুনতেই পায়নি।

রাতে তাকবির ওর সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইলেও রেগেমেগে, কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে যায়। বিয়ের ষষ্ঠ দিন রাতে তো বাড়ির সবাই শুনতে পাবে এরকম আওয়াজেই কান্না জুড়ে দেয় সে। পুষ্পর কান্না শুনে শাশুড়ির কথামতো মুন্নি এসে ওদের দরজায় করাঘাত করে কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা জানতে চায়। পুষ্প কান্না করতে করতে হাঁক ছেড়ে বলে, “উনি আমার সাথে প্রতিদিনই কেমন কেমন করতে চায় ভাবি। আমি থাকমু না এই ঘরে। নিয়া যান আমারে।”

পুষ্পর কথা শুনে মুন্নি যেমন লজ্জা পায়, তেমন লজ্জা পায় তাকবির নিজেও। তাকবির যে কী পরিমাণ লজ্জা আর বিপাকে পড়েছিল ওই সময়টাতে! ওর ইচ্ছে করছিল লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য এখনই মাটির নিচে লুকিয়ে পড়তে। মনে মনে তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, এই মেয়েকে জোর করে আর কোনোদিন কাছে টানার চেষ্টা করবে না সে। কখনো যদি পুষ্প নিজে থেকে তার কাছে আসে তবে সেটা ভিন্ন ব্যাপার।

ওদিকে পুষ্পর কথা শুনে মুন্নি আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ায়নি। এসব সমস্যার সমাধান ওরা স্বামী-স্ত্রীই করতে পারবে। তৃতীয় ব্যক্তির প্রয়োজন নেই এখানে। এই মুহূর্তে এই ব্যাপারে কিছুই করার নেই মুন্নির। তবে ভেবে রেখেছে যে, কাল দিনের বেলায় একবার পুষ্পকে কাছে ডেকে এনে বুঝিয়ে বলবে, যাতে আর কখনো এরকম না করে।

চলবে ইন-শা-আল্লাহ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here