পুষ্পের_হাতে_পদ্ম (পর্ব- ০৮)

0
1620

#পুষ্পের_হাতে_পদ্ম (পর্ব- ০৮)
– সুমাইয়া বিনতে আ. আজিজ

১৬

রাত ১১ টা ১৫ মিনিট…
আকিব ভাইকে কেউ একজন ফোন করে বলল দ্রুত বাড়ি থেকে সরে গিয়ে গা ঢাকা দিতে। পুলিশ আসার সম্ভাবনা আছে বাড়িতে।

গতকালই আকিব ভাই এলাকার অন্যান্য বখাটেদের নিয়ে গুণ্ডাগিরি করে এসেছে চেয়ারম্যানের ছেলের সাথে। ওর কোন বখাটে বন্ধুর বোনকে নাকি স্কুলে যাওয়ার পথে চেয়ারম্যানের ছেলে উত্যক্ত করে, তাই সবাই মিলে তাকে গতকাল শাসিয়ে এসেছে এবং সেই সাথে হালকা-পাতলা উত্তম-মধ্যমও দিয়েছে।

সেই হালকা-পাতলা উত্তম-মধ্যমের জন্য যে আবার পুলিশের কবলে পড়তে হবে সেটা ওদের ধারণার বাইরে ছিল। ওদের দলের লিডারকে কিছুক্ষণ আগেই পুলিশ আচমকা এসে ধরেছে। এখন ওদেরও এক এক করে ধরতে পারে সেই আশঙ্কায় কোনো এক শুভাকাঙ্ক্ষী আগেই ওকে সতর্ক করে দিলো।

এত রাতে এমন একটা সংবাদ পেয়ে ভাই যতটুকু বিচলিত হয়ে পড়ল, তার চেয়ে বেশি বিচলিত হলো ভাবি। দ্রুত পাশের বাড়ির সমবয়সী এক চাচাতো ভাই আশিককে ডেকে আনা হলো বুদ্ধি-পরামর্শের জন্য। আশিক ভাই বলল, “এত উত্তেজিত হওনের কিছু নাই। পুষ্পরে তোর ঘরে রাইখা তুই আমার ঘরে আইয়া শু। কেউ আইলে পুষ্প ‘আমি কিছু জানি না’ বইলা হেগো বিদায় করবনি।”

পুষ্প বলল, “আমি এইটা কইলেই তারা মানবো নাকি যে আমি কিছুই জানি না? তারা খুঁজাখুঁজি করব না?”

আশিক বলল, “পুলিশ আইতে দেখলেই তুই ছোট্ট কইরা মিসকল মারবি আকিবের নাম্বারে। মিসকল পাইলেই বুঝমু যে পুলিশ আইছে। তহন ওরে এমন জায়গায় লুকাইয়া ফালামু যে, পুলিশ ক্যা; পুলিশের দাদার দাদা কব্বর থিকা উইঠা আইলেও আকিবরে খুঁইজা পাইব না। তুই খালি মনে কইরা মিসকলটা দিয়া আংগো এলাট করিস।”

অবশেষে আশিক ভাইয়ের কথাকেই মূল্যায়ন করা হলো। আকিব আশিকের ঘরে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। কিন্তু এদিকে পুষ্প একা থাকতে ভয় পাচ্ছে। সেজন্য সেই রাত ১২ টার দিকে আমাকে কাঁচা ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে গেছে ওর কাছে ঘুমানোর জন্য। কিন্তু কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলে পুনরায় ঘুম আসা কি এতই সহজ?

ওদিকে পুষ্পর চোখেও ঘুম নেই। প্রথম কতক্ষণ ওর মধ্যে অস্থিরতা উপলব্ধি করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সেসব ভুলে গিয়ে ও আমার সাথে গল্পে মশগুল হয়ে উঠল। স্মৃতির পাটাতনে চড়ে ভেসে যেতে লাগল পুরনো দিনগুলোতে। বাবা-মায়ের কথা, ভাইয়ের আদরের গল্প, এরপর পর্যায়ক্রমে আকিব ভাইয়ের সাথে প্রথম দেখা, প্রেম, প্রণয়ের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন না বলা গল্প বলতে বলতে রাত দুইটার মতো বেজে গেল।

দুইটার দিকে ভাবি বিছানা থেকে উঠে ঢকঢক করে একগ্লাস পানি পান করে এসে আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হওয়ার পর আমার শরীরের উপর পা তুলে দিতেই ওর পা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বিরক্তির স্বরে বললাম, “ঠিক ভাবে শু তো। গায়ে টাচ করবি না। ওই কিনারে যা একদম।”

আমার কথা শুনে ও অসহায় কণ্ঠে বলল, “স্বামীরে খুব মিস করতেছি।”

আমি এবার চাপা শব্দে হেসে দিলাম। কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, “ডাইকা আইনা অপমান, না? আমারে পাশে শুয়াইয়া ‘স্বামীরে মিস করতেছি’ কওয়া হইতাছে?”

ভাবি গম্ভীরমুখে বলল, “নাহ্, আসলেই মিস করতেছি।”

আমি বললাম, “লাইলিগিরি করা বাদ দিয়া চুপচাপ ঘুমা। ঘুমাইতে দে আমারে।”

“তাইলে একটু পা তুলতে দে তোর উপরে।”

“থাপ্রা খাইছস?” বিরক্তির সুরে বললাম।

“স্বামীর উপরে পা তুইলা দিলে ও কিছুই কয় না।”

“আমি তোর স্বামী না।”

“তাইলে স্বামীরে মিসকল দেই একটা।”

“মিসকল দিবি ক্যান?”

“মিসকল দিলেই বুঝব যে, আমি ওরে মিস করতেছি।”

আমি ফিক করে হেসে দিলাম। ও আমার হাসিকে উপেক্ষা করেই ভাইয়ের নাম্বারে মিসকল দিলো। এবং তার দুই মিনিট পর রিপ্লাই আসলো, “ইট’স ওকে।”

রিপ্লাই দেখে ভাবি কপাল কুঁচকাল। আমাকে দেখানোর পর আমি আবারো হেসে দিলাম। বললাম, “তুই ভাইরে মিস ইউ কইলে ভাই কি ইট’স ওকে কয়?” বলেই চাপা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।

ভাবি কপট রাগ দেখিয়ে ভাইকে আবারো মিসকল দিলো। মিসকল দেয়ার সাথে সাথেই ফোন আসলো। ভাবি ফোন রিসিভ করে ফিসফিস করে বলল, “মিস ইউ কলিজা।”

ওপাশ থেকেও ফিসফিস শব্দে বলা হলো, “কী হইছে তোর?”

ভাবি ফিসফিস করে আহ্লাদী ভঙ্গিতে বলল, “এইভাবে কথা বলতেছ ক্যান? একটু আদর কইরা কথা কও। মিস করতেছি দেইখা মিসকল দিলাম, আর তুমি কী একটা রিপ্লাই দিলা! এখন আবার এইডা কইতাছ। এত আনরোমান্টিক হইয়া কবে থিকা?”

আশিক এবার সশব্দে বলল, “মিস কইরা মিসকল দিছস তুই? হালার বলদা, আর আমি পুলিশ আইছে ভাইবা তোর জামাইরে পিছন দরজা দিয়া বাইর কইরা দিছি। জঙ্গলে বইয়া ও মশার কামড় মনোয় খাইতাছে।”

এতক্ষণে ভাবি ও আমার; দুজনেরই খেয়াল হলো যে, ওরা তো পুলিশ আসলে মিসকল দিয়ে ওদের সতর্ক করতে বলেছিল। ভাবির মিসকল দেয়ার সময় আমাদের কারোরই এই কথা খেয়াল ছিল না। এই সময় ভাবি সেকেন্ড কয়েক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে থাকলেও ওর কুকড়ে যাওয়া লাজুক, অগাচণ্ডী মুখটা দেখে আমি রাতের নির্জনতাকে উপেক্ষা করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।

হাসিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কিছুক্ষণ পরই দরজায় টোকা পড়ল। এরপর শুনতে পেলাম আকিব ভাইয়ের কন্ঠস্বর। ভাবি গিয়ে দরজা খুলতেই ভাই ‘এত বলদ হইছস ক্যা’ বলতে বলতে ভাবির গলাটা চেপে ধরল। এভাবে গলা চেপে ধরতে এর আগেও দেখেছি। প্রতিবারই মজা করে চেপে ধরেছে। আজও মজা করেই ধরেছে। কিন্তু একটু বেশি চাপ লেগে গিয়েছে হয়তো। এত জোরে চেপে ধরেছে যে একপর্যায়ে ভাবির জিহ্বা যখন বের হয়ে গিয়েছে তখন ভাইয়ের হুঁশ ফিরেছে। ভাই ছেড়ে দেয়ার পর ভাবি অনবরত কাশতে শুরু করল।

কিছুক্ষণ পর ভাবি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ভাই যখন ওকে আদর করে ধরতে গেল ও নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে বলল, “ছুইতে আসব না আমারে। আশিক ভাইর কাছে গিয়াই ঘুমাও। নন্দিরে ঘুমাইতে দেও। সকালে ওর প্রাইভেট আছে।”

ভাই বলল, “ও ওগো ঘরে যাইক।”

ভাবি আপত্তি জানিয়ে বলল, “রাইত কয়ডা বাজে? এখন যাইয়া ও ওর মারে ডাইকা তুলব?”

ভাই আর কথা বাড়াল না। আশিক ভাইদের বাড়ি চলে গেল। ভাবি দরজা আটকে চুপ করে শুয়ে পড়ল। একটা কথাও বলল না আর।

পরদিন সকালে ওর বাবার অসুস্থতার মিথ্যা অজুহাতে বাবার বাড়ি চলে গেল। গিয়ে আকিব ভাইকে ফোন করে জানালো যে, যে পর্যন্ত আকিব ভাই মস্তানি বাদ দিতে না পারবে, যে পর্যন্ত আয়-রোজগার করতে না পারবে সে পর্যন্ত ভাবি আর ওই বাড়িতে যাবে না। পুলিশের দৌড়ানি খেয়ে রাত-বিরেতে পালাতে যাওয়া কোনো স্বামীর ভাত খেতে সে রাজি না।

কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝলাম না। হঠাৎ ভাবির এরকম আচরণের কোনো যুৎসই কারণ খুঁজে পেলাম না। তবে ভাই যেন উলটা রেগে গেল। এতদিন বিভিন্ন আকার-ইঙ্গিতে ভাবিকে বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে বলত বিদেশ যাওয়ার জন্য। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে কোনো ইঙ্গিতের মাধ্যমে নয়, সরাসরিই টাকা চেয়ে বসল ভাবির কাছে।

টাকা চাওয়ার ঠিক সাতদিন পরেই ভাবি ওর বাবা আর এক চাচাতো ভাইকে নিয়ে বাইকে চেপে শ্বশুরবাড়ি ফিরল। ভাবির বাবা বাইকের চাবিটা আকিব ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলল, “বিদেশ যাওয়া লাগব না তোমার। এই মোটরসাইকেলডা তোমারে কিনা দিলাম। ঢাকায় গিয়া পাঠাও এর কাম করবা। মন দিয়া কাম করলে টাকার অভাব হইব না ইন-শা-আল্লাহ।”

ভাই পরের সপ্তাহে বাইক নিয়ে ঢাকায় চলে গেল রোজগারের উদ্দেশ্যে। বাড়ির লোকেরও মুখের কালিমা দূর হলো। পুষ্পও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ পেল। কিন্তু দিন শেষে যেই লাউ, সেই কদু। আকিব ভাইয়ের কোনো মনোযোগ নেই কাজের প্রতি। দুইদিন পর পরই নানান অজুহাতে বাড়ি চলে আসে। বাড়ি এসে বাইক নিয়ে টইটই করে পুরো এলাকা ঘুরে বেড়ায়। ওদিকে পুষ্পর সব মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না। সব জেনে শুনেই সে এই জাহান্নামে পা দিয়েছে।

মাসখানেক পর পুষ্প একটা লম্বা সময়ের জন্য বাবার বাড়ি গেল সেলাই কাজ শিখতে। ওদের ওখানকার এক মহিলা নাকি সেলাই কাজ শেখায়। মাসখানেক পর ভাবি শ্বশুরবাড়ি ফিরল সেলাই মেশিন নিয়ে। সে বুঝে গিয়েছিল, এই বাড়িতে সে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে পেট পুরে তৃপ্তি সহকারে তিনবেলা কখনো খেতে পারবে না।

সেলাই মেশিনের হাত ধরে তার নতুন সংগ্রাম শুরু হয়। বাজারের দর্জিদের তুলনায় অর্ধেক মজুরি রাখত বলে পাড়ার সবাই ওর কাছেই জামা বানাতে দিত। সে পাড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাজারের দর্জিদের সাথেও শেয়ারে কাজ করত। তাদের কাছ থেকে অর্ডার আনত। বাজারের সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্জির সাথে যে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল। সেই দর্জির কাছে সবসময় অতিরিক্ত অর্ডার থেকেই যেত। এমনও হয় যে, সে কাজ বেশি থাকায় সে কাস্টমার ফিরিয়ে দিত। ভাবি গিয়ে তার সাথে এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, সে যেন কখনো কোনো কাস্টমার ফিরিয়ে না দিয়ে বরং সবার অর্ডারই যেন রাখে। যেগুলো অতিরিক্ত অর্ডার আসবে সেগুলো ভাবি বাড়িতে নিয়ে এসে বানিয়ে দেবে। বিনিময়ে ভাবি পাবে মজুরির ৫০% এবং দর্জি শুধুমাত্র অর্ডার নেয়ার কারণেই পেয়ে যাবে মজুরির ৫০%।

সংসার সামলে ওভাবে সেলাই কাজ করা ভাবির জন্য কষ্টসাধ্যই হয়েছিল বটে। কিন্তু ওর কোনো অভিযোগ ছিল না কারো প্রতি। কখনো দেখিনি মন ভার করে থাকতে। মুখে হাসি সবসময় লেগেই থেকেছে।

মুখে হাসির রেখা ঝুলিয়ে রেখে নির্দ্বিধায় এরকম আপাত অসাধ্য কাজ সাধন করায় এবার আর অবাক হইনি আমি। বিস্মিত হয়ে মনে মনে ভাবিনি যে, “কিভাবে সম্ভব? মানে কিভাবে!”
বরং নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিলাম এই বলে যে, ঠেলায় পড়লে বাঘও তো নাকি ঘাস খায়। তাহলে ভাবি কেন পারবে না পেটের দায়ে হাসিমুখে এরকম অক্লান্ত পরিশ্রম করতে?

চলবে ইন-শা-আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here