পুষ্পের_হাতে_পদ্ম (পর্ব- ০৯)

0
2064

#পুষ্পের_হাতে_পদ্ম (পর্ব- ০৯)
– সুমাইয়া বিনতে আ. আজিজ

১৭

ভাবির মিসক্যারেজের পর আরো দুইবছর চলে যায়। দ্বিতীয়বারের মতো ভাবির অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সুসংবাদ শুনতে পাই। এবার অবশ্য ভাবির প্রেগন্যান্সির খবর শুনে সবাই খুশি হয়েছিল। এখন আর আকিব ভাই আগের মতো অকর্মা, বেকার, ভাদাইমা নেই। এখন কোনো গাফিলতি ছাড়াই মন দিয়ে রোজগার করে।

ভাবিকে আমি প্রায়ই বলতাম, “ইশ ভাবি! তুইও কিউট, আকিব ভাইও কিউট। তোগো বাচ্চাটা যে কী পরিমাণ কিউট হইবো আমি ভাবতেও পারতেছি না।”

ভাবি আমার কথা শুনে লাজুক হাসত। আমি ভাবিকে বলতাম, “ভাবি, তোর একটা মেয়ে বাবু হইলে বেশি ভালো হইব। আমি সারাদিন ওরে আমার কাছে আইনা রাখতাম, ওর সাথে খেলতাম। ওরে নিয়া তোর কোনো চিন্তাই করা লাগতো না।”
তারপর অস্থিরতার সুরে বলতাম, “উফ, তাড়াতাড়ি একটা বাবু আইনা দে না ভাবি! আমার বিয়ে হইয়া গেলে তো হইয়াই গেল। তখন আর তোর মুখের দিকে একটা বাবুর জন্য চাইয়া থাকা লাগবো না। তখন ইন-শা-আল্লাহ আমার নিজেরই বাবু হইব। আমার বিয়ের পর তোর বাবু হলে আমার লাভ কী? ঝটপট আমার বিয়ের আগেই আমারে একটা বাবু আইনা দে। ওরে শুধু পৃথিবীতে এনে দেয়া অবধিই তোর দায়িত্ব শেষ। তারপর ওর বাদবাকি সব দায়িত্ব আমার নিজের!”

ভাবি আমার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বলত, “হ! তোর মতো অকর্মার আশায় থাইকা থাইকা আমি আমার ঘুম নষ্ট করি এহন!”

প্রায় দুই বছর আগে ভাবির টুইন বেবির ভ্রূণ মিসক্যারেজ হয়েছিল। আমার তো বাচ্চা এমনিতেই পছন্দ। তারমধ্য টুইন বেবি হলে তো কথাই নেই। ভাবির মিসক্যারেজ হওয়ার পর এত বেশি খারাপ লেগেছিল যে মনে হচ্ছিল, ভাবির না; বরং আমারই টুইন বেবির ভ্রুণ মিসক্যারেজ হইছে!

ওই বাবুদের কথা মনে পড়ায় আমি প্রায়ই ভাবিকে বলতাম, “ইশ, তোর ওই বাবুরা যদি থাকত!”

ভাবির মুখটা আমার কথা শুনে বিষন্নতায় ছেয়ে যেত। টলমল করা অশ্রুগুলো লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বলত, “অগো কথা বলিস না তো নন্দি। কষ্ট লাগে আমার!”

প্রায় দুইবছর পর এবার যখন আবারো শুনলাম যে, ভাবি প্রেগন্যান্ট, কী যে খুশি খুশি লাগছিল! বাড়িতে একটাও ছোট বাচ্চা নেই। ছোট বাচ্চা না থাকলে কোনো বাড়িতে আনন্দ থাকে বুঝি? ইশ, অবশেষে বাড়ির প্রতিটা কোণা কোণা আনন্দে ভরিয়ে দিতে আসছে কেউ একজন! খুশির চোটে বারবার মনে হচ্ছিল যে, ভাবির গর্ভের অনাগত বাচ্চাটা তো ভাবির না; বরং যেন আমার নিজেরই!

আর সবচেয়ে বেশি ভালো ও শান্তি শান্তি লাগছিল এটা ভেবে যে, আকিব ভাই ও পুষ্প ভাবির বিয়ে সম্প্রতি নতুন করে আবার পড়ানো হয়েছে। আম্মা আর আমার এতগুলো বছরের ঘ্যানঘ্যানানি অবশেষে আর ওরা ফেলতে পারেনি। পুষ্পের গর্ভের বাচ্চাটাকে এবার আর অবৈধ বলার কোনো সুযোগ নেই।

কয়েকমাস আগে একদিন ভাবিকে কাছে গিয়ে তাকবীর ভাইয়ের ফোন নাম্বারটা চাই। দৈবাৎ আমার এই ফোন নাম্বার চাওয়ায় ভাবি বেশ অবাকই হয়। কারণ জানতে চাইলে বলি, “উনাকে বলব, তোকে তালাক দিতে।”

ভাবি কপাল কুঁচকে বিস্মিত ভঙ্গিতে বলে, “মানে? কিসের তালাক? তালাক তো হইয়াই গেছে।”

“তালাক তো তুই ওকে দিছস। ও কি তোকে দিছে? ইসলামী শরীয়তে কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারে না। আর দিলেও সেই তালাক হয় না। এখন আমি যা করতে চাইতেছি করতে দে। যদি আজ কোনোরকম বাঁধা দেস, তো আর জীবনেও কথা বলতে আসবি না আমার সাথে।”

কথাগুলো খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে, রূঢ় স্বরে বলায় ভাবি আমার মুখের উপর আর কিছু বলার সাহস পেল না। গড়গড় করে তাকবীরের ইমু নাম্বারটা মুখস্থ আওড়ালে আমি সেটা ফোনে উঠিয়ে নেই। ফোন দেয়ার আগ মুহূর্তে ভাবি ভীত স্বরে বলল, “যাই করস তাই করস, কোনোরকম ঝামেলা জানি না হয়।”

আমি তাকবীরের সাথে সরাসরি কথা বলে তাকে সবটা বুঝিয়ে বলি। সেও শরীয়তসম্মতভাবে পুষ্পকে তালাক দিতে সম্মত হয়। তাকবীরের কাছ থেকে শরীয়তসম্মতভাবে তালাক আদায় করার পর পুষ্পকে ইদ্দত পালনের সময়সীমাসহ অন্যান্য বিষয়াবলি বুঝিয়ে বলি সবটা। ইদ্দত পালন শেষে করোনাময় প্রথম রমাদানের এক জুম্মাবারেই ওদের নতুন করে বিয়ে হয়।

সেই বিয়ের দিনের কথা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। যদিও সেই বিয়ের আসরে অতিরিক্ত কিংবা বাইরের কোনো মানুষ ছিল না। বাইরের লোক বলতে পুষ্পর বাবা, তিনজন সাক্ষী, আর মসজিদের হুজুর ছিল শুধু। তবুও ভাবির সেদিন সে কী লজ্জা! ওকে যখন কবুল বলতে বলা হলো তখন ও কবুল বলবে কী, মুখ চেপে ধরে হেসেই বাঁচে না। যার সাথে এতকাল ঘর সংসার করে আসলো তাকেই আবার নতুন করে বিয়ে করতে হচ্ছে ভেবেই হেসে কুটিকুটি হচ্ছিল ও।

সেদিন বিয়ে সম্পন্ন করে আকিব ভাই আমাদের সবার হাতে মিল্ক ক্যান্ডি ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, “বিয়ার মিষ্টি খা। এক বউরে দুইবার বিয়া করলাম।”

সেদিনের সেই বিয়ে ভাই-ভাবির মনে কতখানি তৃপ্তি এনে দিতে পেরেছিল জানি না। তবে আমি শুধু তৃপ্তিই যে পেয়েছিলাম তা নয়। বরং মনে হচ্ছিল গলায় বিঁধে থাকা যন্ত্রণাদায়ক এক কাটা এতদিনে দূর হলো! বিশেষ করে ভাবির প্রেগন্যান্সির কথা শোনার পর স্বস্তির মাত্রা গগণচুম্বী হয়েছিল এই ভেবে যে, বাচ্চাটা বৈধ বাচ্চা।

তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ওর প্রেগন্যান্সির খবর শুনে বাকি সবাই খুশি হলেও ভাবি নিজে খুশি না। না, ঠিক খুশি না তা না। খুশি; তবে, ওর ভেতর একটা অস্বাভাবিক উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা সর্বদা বিরাজমান। ওর এই উৎকন্ঠার কারণটা অবশ্য আমার অজানা নয়।

দুইবছর আগে প্রথমবার যখন ওর মিসক্যারেজ হয় তখন প্রথম দুই-তিনদিন প্রায় সারাদিনই ও বিছানায় শুয়ে শুয়ে কান্না করত। না করত কাজকর্ম আর না অন্যকিছু। ওকে মানসিক সাপোর্ট দেয়ার জন্য তৃতীয় দিন যখন ওর কাছে গেলান, সেদিনই জানতে পারলাম এক ভয়াবহ কথা, যেটা এতদিন পর্যন্ত ভাবি আমার কাছে লুকিয়ে রেখেছিল।

তাকবীরের সাথে ওর শেষবারের মতো যেদিন ফোনে কথা হয়েছিল সেদিন তাকবীর বারবার ওকে অনুরোধ করছিল ওর কাছে ফিরে যেতে। সে ওর সব ভুল মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু অনেক কাকুতি-মিনতি, কান্নাকাটির পরেও পুষ্পর মন সেদিন টলাতে পারেনি সে। শেষ পর্যন্ত তার ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। পুষ্পকে এত বোঝানোর পরেও যখন পুষ্প ওকে ফিরিয়ে দিলো তখন তাকবীর এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুষ্পকে অভিশাপ দিয়ে বসল। সে পুষ্পকে সেদিন বলেছিল, “তোমার যেন নিজের বাচ্চা কোলে নেয়ার সৌভাগ্য কোনোদিন না হয়। আল্লাহ যেন কোনোদিন তোমারে মা ডাক না শোনায়।”

গতবার পুষ্পর মিসক্যারেজের পর তাকবীরের এই কথাটাই বারবার ওর কানে বাজছিল। ওর বারবার মনে হচ্ছিল যে, তাকবীরের অভিশাপ লেগে গিয়েছে। আর সেজন্যই বাচ্চা দুইটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাকবীরের অভিশাপ লেগে গিয়েছে, এই কথাটি মনে করেই এভাবে অনবরত কান্না করে গিয়েছে সে। ওইদিনের পর তো কয়েকটা বছর চলে গিয়েছে। পুষ্প ওর ভুল বুঝতে পেরেছে আরো অনেক আগেই। কিন্তু যখন বুঝতে পেরেছিল তখন ভুল শুধরানোর কোনো সুযোগ ছিল না। তাকবীরের কাছে ক্ষমা চাওয়ার মতো মুখও নেই। তাকবীরের ওই অভিশাপটা ওর মনে গেঁথে থাকলেও কোথাও যেন একটুখানি ভরসা ছিল। ভেবেছিল, হয়তো-বা মা হতে
ও পারবে কোনো একদিন। ওর অনুতপ্ততা আল্লাহ তো ঠিকই টের পেয়েছেন। আল্লাহ হয়তো ওকে ক্ষমা করবেন।

কিন্তু যখন দেখলো বাচ্চা সত্যি সত্যিই নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তখন ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। মনে একটা ভয় ঢুকে যায়। ভাবে, সত্যি সত্যিই যদি ওর কখনো নিজের বাচ্চা কোলে নেয়ার সৌভাগ্য না হয়? এই ভাবনাটা ওকে প্রতিনিয়তই তাড়া করে বেড়াত। আর এখন এই প্রেগন্যান্সির সময় সেটা আরো বেশি করে তাড়া করছে সেটা।

প্রেগন্যান্সির দুইমাসের সময় ওর আবারো সেই অতিপরিচিত ব্যাথাটা শুরু হয়। পেটে চিনচিন একটা ব্যাথা। হাঁটতে পারে না ভালোভাবে, না পারে কোথাও দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকতে। হাঁটার সময় নয়মাসের গর্ভবতীদের মতো করে পেট ধরে ধরে আস্তে আস্তে হাঁটে। খেতে পারে না কিছু। এক বেলা খায় তো আরেক বেলা না খেয়ে থাকে। এসব নিয়েও বাড়ির লোকের শত কথা শুনতে হয়।

দুইদিন হয় নাই প্রেগন্যান্সি ধরা পড়েছে, এখনই কিসের এত ঢঙ? কেন ওইভাবে পেট ধরে ধরে হাঁটতে হবে? ভাব ধরে এরকম না খেয়ে থাকার মানে কী? আগে মানুষ নয় মাসের পেট নিয়ে ঢেঁকিতে ধান বেনে খেত। আর আজকালকার ননীর পুতুলেরা এক মাসের পেট নিয়ে হাঁটতেই পারে না!
আরো কত ধরনের কথা!

ভাবি সবার কথা শুনত চুপ করে। প্রত্যুত্তরে শুধু একটা ম্লান হাসি দিত। আর কিছুই বলত না।

আর কেউ ওর এই কষ্টটা অনুভব করতে না পারলেও আমি ঠিকই পারতাম। মানুষের এত রঙ-সঙের কথা শুনে আমার খারাপ লাগত। ওইরকম টিপ্পনী কাটা কথাগুলো ভাবিকে নীরবে সহ্য করতে দেখে আরো বেশি খারাপ লাগত। মাঝে মাঝে ভাবির হয়ে আমি বড়দের কথার জবাব দিতাম। কিন্তু লাভের লাভ তো কিছু হতই না। উল্টা আমাকেও ঝাড়ি খেতে হত।

প্রেগন্যান্সির আড়াইমাস তখন রানিং। ভাবির অসুস্থতা সেরকমই রয়ে গিয়েছে। ওই অবস্থাতেই জৈষ্ঠ্যমাসের দুপুরের মতো তপ্ত এক দুপুরের প্রচণ্ড গরমের মাঝে রান্না করতে বসল। ভাত রান্না শেষে তরকারি রান্নার জন্য কড়াইটা চূলায় বসাল। একে একে তেল, পেঁয়াজ, মরিচ গরম তেলে ছেড়ে একটু একটু করে নাড়তে লাগল। ঠিক এই পর্যায়ে মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল ওর। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। ওদিকে তরকারির পেঁয়াজ, মরিচও পুড়ে যাচ্ছে। কোনোমতে একটা ন্যাকড়া দিয়ে ধরে কড়াইটা চূলা থেকে নিচে নামাল। এই অবস্থায় কড়াই নামাতে গিয়েও ঘটল আরেক বিপত্তি। কড়াই খানিকটা বাঁকা হয়ে তেল পড়লো ওর হাতের উপর। জোরে একটা চিৎকার দিয়ে ওখানেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেল।

বড় কাকি কাকার দোকানের কাছে গিয়েছিলেন। মেজো কাকি উঠানেই ছিলেন। ভাবির চিৎকার শুনে দৌড়ে ওদের রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলে ভাবিকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে তিনিও চিৎকার দিয়ে উঠেন। কাকির চিৎকারে আরো কয়েকজন এগিয়ে আসে। সবাই মিলে ভাবিকে ধরে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে প্রাথমিক চিকিৎসাগুলো দিতে থাকে। ওদিকে গ্রামের ডাক্তারকে ফোন করেও আসতে বলা হয়। ডাক্তার আসলে স্যালাইন দেয়া হয় ভাবিকে। না খেয়ে থাকতে থাকতে শরীর দুর্বল হয়ে গিয়েছে কি-না!

এতক্ষণে ওর জ্ঞান ফিরলেও সারাশরীর ব্যাথায় অবশ হয়ে আছে। কেউ ওর শরীরে হালকাভাবে স্পর্শ করলেও ব্যাথায় কুকিয়ে উঠছে ও। আর বলছে, “আমার শরীলে ছুইয়ো না তোমরা। ব্যাথা পাই আমি।”

এদিকে আমি বাড়িতে ছিলাম না। ছিলাম কলেজে। কলেজ থেকে গিয়েছি বান্ধবীর বাড়ি। সেখানে থেকে লেখিকা মোর্শেদা হোসেন রুবির মানহা বইটা নিয়ে বাড়িতে ফিরি মাগরিবের আগে আগে। এই লেখিকা আমার সবচেয়ে পছন্দের লেখিকদের একজন। কিন্তু উনার এই বইটা এখনো আমার পড়া হয়নি। প্রি-অর্ডার করে রেখেছিলাম একদম প্রথমেই। কিন্তু বই আসার পর আমার ওই বান্ধবী আমি পড়ার আগেই বইটা নিয়ে যায়। তারপর ওর থেকে আরেকজন, তার থেকে আবার আরেকজন; এভাবে গত কয়েকমাস শুধু ঘুরতেই ছিল। অবশেষে প্রাণের বইটা হাতে পেয়ে লম্বা করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিলাম। এতদিন পর কাঙ্ক্ষিত এই বইটা হাতে পাওয়ার পর বই ব্যতীত অন্যদিকে খেয়াল দেয়ার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না আমার। তাই বাড়ি এসে মাগরিবের নামাজটা পড়ে অমনিই মানহা বইটা নিয়ে বসছিলাম। আম্মা নামাজ শেষ করে আমাকে বলল, “পুষ্প অসুস্থ হইয়া পড়ছে। ডাক্তার আইসা স্যালাইন দিয়া গেছিল। আয় ওরে দেইখা যা।”

আমি আম্মার কথার বিশেষ গুরুত্ব দিলাম না। পুষ্প অসুস্থ সেটা তো আজ নতুন না। বাবু পেটে আসার পর থেকেই তো অসুস্থ। আর না খেয়ে থাকতে থাকতে আজকে বোধহয় একটু বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছিল, তাই ডাক্তার এসে স্যালাইন দিয়ে গেছে। এটা এমন গুরুতর কিছু না।

এইসব ভাবতে ভাবতেই বইয়ে আবার মন দিলাম। ভাবি তো আর পাহিয়ে যাচ্ছে না। ঘুমানোর আগে একবার গিয়ে দেখে আসলেই হবে।

আম্মা ভাবিকে দেখে আবার আমাদের ঘরে আসলো। পুষ্পর শারিরীক অবস্থার বর্ণনা দিতে লাগলেন আপনমনে। সেগুলো আবছা আবছাভাবে আমার কানে আসলো কী না আসলো! আমার আসলে ওসব কথায় গুরুত্ব দিতে ইচ্ছে করছিল না। দিলামও না গুরুত্ব। আমি অতক্ষণে ডুবে গিয়েছে উপন্যাসের কাহিনীর ভেতর। ভাবি অসুস্থ হয়েছে, ঠিকও হয়ে যাবে ইন-শা-আল্লাহ। এত টেনশনের কিছু নেই।

রাত নয়টার দিকে উপন্যাস রেখে উঠলাম। ভাবলাম, এখন একটু গিয়ে দেখে আসি ভাবিকে। উঠানে পা রাখতেই আকিব ভাইয়ের চিৎকার শুনতে পেলাম। ভেতরটা কেমন যেম কেঁপে উঠল। এক দৌড়ে চলে গেলাম ওদের রুমে। গিয়ে দেখলাম ভাবি শুয়ে আছে। ভাবির মা ভাবির পায়জামা চেঞ্জ করে দিচ্ছে। আর আকিব ভাই ভাবির মাথার কাছে বসে ভাবিকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে আর কান্না করছে। কান্না করতে করতে বারবার অস্থিরতার সাথে ভাবিকে জিজ্ঞেস করছে, “এহন কেমনে লাগে পুষ্প? এহন কেমনে লাগে?”

ভাবি বোধহয় বিরক্ত হচ্ছিল ভাইয়ের এমন কান্নাকাটিতে। কিছুটা বিরক্ত স্বরেই বললো, “এমনে কাঁনতাছ ক্যান তুমি? আমি ভালো আছি। এত কাঁইন্দো না।”

ভাইয়ের এমন কান্নাকাটি দেখে আমিও বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ভাইয়ের দিকে। ইশ, এভাবে কেউ কান্না করে? এত কান্না করার কী আছে এখানে? একটু অসুস্থ হয়েছে, ঠিকও হয়ে যাবে ইন-শা-আল্লাহ। এমনভাবে কান্না করছে মনে হচ্ছে যে, ভাবি অসুস্থ হয় নাই; বরং মরে গিয়েছে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিলাম। এমন সময় বড়কাকি এসে আমার হাতে নারিকেল তেলের বোতল দিয়ে বলল ভাবির মাথায় তেলটা লাগিয়ে দিতে। আমি ভাবির মাথার কাছে গিয়ে হাতের তালুতে একটু তেল নিয়ে মাথার উপরিভাগে তেল ঘষে দিয়ে চুল একটুখানি টেনে টেনে দিতে লাগলাম। ভাবলাম চুল হালকা করে টেনে দিলে ভাবি আরাম পাবে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে ভাবি আমাকে খানিকটা ধমকের সুরে বলে উঠলো, “চুল টানোস ক্যা? দুক্কু পাই না?”

আমি বিস্মিত হয়ে কপাল কুঁচকে ফেললাম। এইটুকু টানেই ব্যাথা পায় কেউ! একটু অসুস্থ বলেই এমন রূঢ় আচরণ করবে সে আমার সাথে?

মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমি আর বেশিক্ষণ দাঁড়ালাম না সেখানে। মানহা আমাকে টানছে। ছটফট লাগছে ভেতরটা। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে গিয়ে এশার নামাজ পড়ে আবার মানহা নিয়ে বসলাম। খানিকক্ষণ বাদে আম্মা ভাবিদের ওখান থেকে দৌড়ে এসে আমাকে জানালো যে, ভাবিকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কথাটা শুনে খানিকটা চমকে গেলাম বোধহয়। কী এমন হয়েছে যে হসপিটালেই নিয়ে যাওয়া লাগবে এত রাত করে? আকিব ভাই বোধহয় একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে এখন। মনে মনে কিছুটা উদ্বিগ্ন হলেও এত রাতে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে কেন যেন একটু বাড়াবাড়িই মনে হলো আমার।

রাত দেড়টার দিকে মানহা শেষ হয়। ঘুমাতে ঘুমাতে দুইটার বেশি বেজে যায়। ওদিকে ফজরের সময় আম্মা ডেকে তুলে। কোনোমতে নামাজ পড়ে আবার ঘুম দেই। ছয়টার দিকে ঘুম থেকে উঠলাম আম্মার ডাকে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে দেখি আম্মার গায়ে বোরকা। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কই যাও এই সকালে?”

আম্মা হন্তদন্ত হয়ে আমাকে বললেন, “হাসপাতালে যাই। পুষ্পর অবস্থা নাকি খারাপ। পেট ফুইলা নাকি ঢোল হইছে একদম। মেজো ভাবি ফোন দিয়া যাইতে বলল। ওরা একা সামলাইতে পারতাছে না।”

উল্লেখ্য যে, রাতে হসপিটালে ভাবির সাথে ভাবির মা, মেজো কাকি আর আকিব ভাই গিয়েছিল। বড় কাকি বাড়িতেই ছিল। ভাবির পেট ফুলে ঢোল হয়ে গেছে শুনে আমার এবার সিরিয়াস টাইপের চিন্তা হতে লাগল। তাকবীরের সেই অভিশাপের কথা মনে পড়ে গেল। বাচ্চাটা বোধহয় এবারও নষ্ট হয়ে যাবে! ভাবি কি তবে সত্যি সত্যিই কখনো নিজের বাচ্চা কোলে নিতে পারবে না? মা ডাক শুনতে পারবে না? ভাবতেও বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল।

চলবে ইন-শা-আল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here