অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৫২
রিশাদ এক পা দু পা করব ভেতরে প্রবেশ করে। রিশাদের মাঝে জড়তা কাজ করছে কিছুটা। অনিকে ঘিরে যতসব কল্পনারা এসে উঁকি দেয়। রিশাদ অবশেষে বড় দম নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে ঢুকে চারপাশে চোখ বুলাতেই তার চোখ কপালে উঠে যায়।
ছাদের কর্নারের দিকে ফুল দিয়ে সাজানো দোলনায় গুটিসুটি মেরে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে অনি। বিগত দুদিন যাবত একটু রেস্ট করার সুযোগ পায়নি সে। সবার জন্য কিছু কেনাকাটা করা, পরীক্ষার পড়াশোনা, রিশাদের সাথে রাত জেগে কথা বলা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল ঘন্টা দুয়েকের বেশি ঘুম হয়নি। এতদূর থেকে জার্নি করে আসায় শরীরটা বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছে অনির। চোখে মুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ তবুও রিশাদের সাথে দেখা করার এক অকৃত্রিম উচ্ছ্বাস।
নীলচে আলোর আভায় নীলাভ হয়ে গেছে অনির মুখ। ছোট্ট ডায়মন্ডের নাকফুলটা চক চক করে আলোর প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। পাপড়িযুগল মৃদু কাঁপছে রিশাদ এক ধ্যানে অনির দিকে তাকিয়ে আছে।রিশাদের চোখ দুটো তার ঘুমন্ত পরীটাকে দেখতে ব্যস্ত। কোন দিকে খেয়াল নেই তার। আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে রিশাদ অনির গালে হাত রাখে।অনি এভাবে এসে রিশাদকে সারপ্রাইজ দেবে তা রিশাদের কল্পনাতীত ছিল। এই জন্যেই বোধ হয় সে রিশাদের ফোন ধরছিল না। আর সে কিনা ভেবেছে অনি তাকে ইগনোর করছে। অনন্যময়ী কখনো কল্পনাতেও তার সাথে এমনটা করতে পারে না।
এতদিন পর প্রিয় মানুষটাকে সামনাসামনি দেখতে পেয়ে রিশাদের মনে অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করে। হৃদয়ের গহীনে চেপে রাখা অভিমান আর কষ্টগুলো যেন তার প্রিয়তমার সান্নিধ্য পাওয়ার সাথে সাথেই উধাও। রিশাদ তার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। অনি কিছুটা কেঁপে ওঠে।
ঘুম ঘুম চোখে চোখ মেলে তাকায় রিশাদের দিকে।ঘুমের ঘোরে অনি রিশাদের দিকে তাকিয়ে হাতটা বাড়িয়ে রিশাদের মুখ বুলায়। সে ভেবেছিল বোধ হয় স্বপ্ন দেখছে। রিশাদের মুখ বুলিয়ে রিশাদের অস্তিত্ব টের পেতেই অনি চোখ বড় বড় করে তাকায়। সত্যিই রিশাদ তার সামনে।
চারপাশে তাকিয়ে অনির হুশ হয় সে কোথায় আর কি করতে এসেছে। দোলনা থেকে নেমে দাঁড়ায় অনি। রিশাদকে সারপ্রাইজ দিতে এসে সে কেমন বেআক্কেলের মতো ঘুমিয়ে পড়েছে ভাবতেই হতাশ হয় অনি।
–একি তুমি কখন এলে?আমি তো টেরই পেলাম না।কিছুটা হতাশ কণ্ঠে বলে অনি।
–আপনি যখন গভীর ঘুমে মগ্ন ছিলেন তখনই চুপি চুপি এসে আপনাকে দেখছিলাম।
অনি কপাল চাপড়ে বলে;ধ্যাত আমার সারপ্রাইজটাই মাটি হয়ে গেলো।বাই দ্যা ওয়ে তুমি এত দেরিতে আসলে কেন?সেই কখন থেকে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
–রিশাদ কি জানতো যে অনন্যময়ী তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে তো সারপ্রাইজ দিতে যেয়ে রিশাদকে জানাতে ভুলেই গেছে তার দেশে ফেরার কথা।(রিশাদ)
রিশাদের কথায় অনি বুঝতে পারে সে কেমন বেআক্কেলের মতো প্রশ্ন করেছে।
–হুম হইছে এখন আর বাহানা মারতে হবে না।নিজে দেরিতে এসেছে আর এখন আমাকে বলছে আমি বলিনি। সারপ্রাইজ কি কেউ কখনো আগে থেকে বলে নাকি। আমি যে এতদূর থেকে এসেছি শুধু তাকে সারপ্রাইজ দিতে সেদিকে কোন খেয়াল নাই। বলেই অনি রাগ দেখিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকায়।
রিশাদ মুচকি হেসে অনিকে তার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বাহুডোরে আবদ্ধ করে। অভিমানী অনি রিশাদের দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে থাকে। রিশাদ অনিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। অনিও চুপচাপ রিশাদের বুকে মাথা দিয়ে অনুভব করতে থাকে।
নিশ্চুপ অনির কানে রিশাদের হৃদস্পন্দনের শব্দটা ছন্দাকারে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। হৃদয়ে বহমান প্রশান্তির ঢেউয়ে অদ্ভুত শিহরণ জাগছে। এই অনুভূতিগুলোর শুন্যতাতেই তো ভুগছিল সে এতদিন। ভালোবাসার মানুষটার সান্নিধ্য পেয়ে তার মস্তিষ্ক পুনরায় সতেজ হয়ে উঠেছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে যাওয়া শিহরণে অনির মনে হচ্ছে সে যেন ক্রমাগত শান্তির সাগরে ডুবে যাচ্ছে। সুখের অনুভূতিগুলো সব যেন একসাথে আছড়ে পড়েছে আজ অনির ঝুলিতে। সুখ শুন্য ঝুলিতে আজ উপচে পড়া সুখ। ধৈর্য ধারণ করলে সৃষ্টিকর্তা যে কাউকে খালি হাতে ফেরান না তারই প্রমাণ পাচ্ছে বার বার অনি। আর তার রবের উপর বিশ্বাসটা দৃঢ় হচ্ছে।
নীরবতা কাটিয়ে রিশাদ কিছুটা ধীর কণ্ঠে বলে;
–অনন্যময়ী!এত কষ্ট করে তোমাকে এসব কে করতে বলেছে বলো তো। এই ক্লান্ত শরীরে তুমি বাসায় না যেয়ে এভাবে সারা রাত জেগে আমার জন্য বসে আছো।তুমি তো আমাকে আগেও জানাও নি। তোমার কোন বিপদ হলে কি হতো বলো তো। আমার তো এসব সারপ্রাইজ চাইনা শুধু তুমি হলেই যথেষ্ট।
–উঁহু একদম কষ্ট হয়নি। তোমার জন্য কিছু করতে একটুও কষ্ট হয়না।বরং আরো বেশি ভালো লাগে। আর আমার সাথে এটা তোমার প্রথম জন্মদিন। আমি সারপ্রাইজ না দিলে কে দিবে শুনি।(অনি)
–পাগলি কোথাকার!এতদূর থেকে শুধু এসেছে আমাকে সারপ্রাইজ দিতে। তোমার তো এক্সাম চলছিল। (রিশাদ)
–হুম।এক্সাম শেষ হলেই আমরা রওনা দিয়েছি। তোমাকে আমি ইচ্ছে করেই বলিনি। যদি বলতাম তাহলে তো আর সারপ্রাইজ দিতে পারতাম না। (অনি)
–বুঝেছি ম্যাম।এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন?(রিশাদ)
–কেন তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে নাকি।তাহলে ছেড়ে দাও। আমি বাসায় চলে যাচ্ছি। কিছুটা অভিমানী কণ্ঠে বলে অনি।
রিশাদ অনির অভিমানী সুর শুনে মুচকি হেসে আরো জোরে অনিকে চেপে ধরে।
–ভুল হয়ে গেছে আমার।আমি সব সময় তোমাকে এভাবেই রাখবো।কোথাও যেতে দেব না। হয়েছে এবার। (রিশাদ)
অনি রিশাদের কথার জবাব না দিয়ে তার ঠোঁটের কোণায় প্রশস্ত হাসি ফুটে ওঠে। আজ এতদিন পর রিশাদ যেন অনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্তি পাচ্ছে। অনিকে ছাড়া প্রতিটা মূহুর্ত সে একবুক শুন্যতার মধ্যে কাটিয়েছে।আজ অনিকে বুকে জড়িয়ে ধরায় যেন সেই শুন্যতাগুলো ভরাট হয়ে গেছে। রিশাদের মুখে আজ বিশ্বজয়ের হাসি।
এভাবে কতক্ষণ অনি রিশাদ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ছিল সেদিকে তাদের কোন হুশ নেই। অনন্তকাল এভাবে একসাথে থাকলেও যেন তাদের যেন কোন হুশই থাকবে না।দীর্ঘসময়ের বিচ্ছেদের পর আজ তাদের মিলন ঘটেছে। পুরো দুনিয়া একদিকে আর তারা তাদের ভালোবাসার সাগরে নিমজ্জিত। যেখানে তৃতীয় কোন সত্তার স্থান নেই। নিয়তির বিধানে তারা এক ডোরে বাধা পড়েছে যেখানে ভালোবাসার কোন কমতি নেই।
রিশাদের জন্মদিনে অনি রিশাদকে তার জীবনের সুন্দর ও শ্রেষ্ঠতম এক রজনী উপহার দেয়। নিঃসন্দেহে রিশাদ আজ নিজেকে বড্ড সৌভাগ্যমান মনে করছে। অনন্যময়ী নামক সুখের সাগরে ডুবে আত্মঘাতী হলেও যেন তার কোন আফসোস থাকবে না। খুব বাজে ভাবে সে তার অনন্যময়ীর মায়ায় আটকা পরেছে।এই জীবনে এই মায়া কাটানোর সাধ্য রিশাদের নেই। রিশাদ চায়ও না এই মায়া কাটাতে। বার বার নতুন করে সে তার অনন্যময়ীর প্রেমে পড়ে পড়তে চায়। অল্পসময়ের ব্যবধানে রিশাদের অস্তিত্ব জুড়ে অনির এত প্রকট বিচরণ সত্যিই খুব আশ্চর্যজনক লাগে রিশাদের কাছে।
সারারাত একসাথে কাটানোর পর অনিকে নিয়ে রিশাদ ভোরবেলার দিকে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। রিশাদ তার আহ্লাদী প্রিয়তমাকে কোলে করে নিয়ে আসে হোটেলের বাইরে। লজ্জাবতী অনি বার বার লজ্জায় রিশাদের বুকে মুখ গুঁজে। তবুও ভোরবেলার দিকে মানুষের আনাগোনা না থাকায় অনির লজ্জার মাত্রাটুকু কম ছিল। আর ভাবলেশহীন রিশাদের সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। সে তো নিজের মতোই তার প্রেয়সীর ভালোবাসায় সিক্ত।
ক্লান্ত অনি আর জেগে থাকতে না পেরে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ে।ঘুমের ঘোরে অনির মাথাটা দোল খেয়ে পড়ে যেতে নিলে রিশাদ তার কাঁধের উপর অনির মাথাটা। বাড়ি ফিরে বেল বাজাতেই রিশা দরজা খুলে দেয়। রিশাদ অনিকে কোলে করে উপরে নিয়ে যায়। ভাই ভাবীর এই ভালোবাসার সুখের মুহূর্তে রিশার মনটাও পুলকিত হয়। দরজা লাগিয়ে সে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে রুমের দিকে যায়। অতীতের কিছু সুখ মিশ্রিত তিক্ত স্মৃতির কথা মনে করে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘশ্বাস সাথে নিজেকে বিদ্রূপ করে এক নিষ্ঠুর হাসি।
রিশাদ অনিকে রুমে নিয়ে শুইয়ে দেয়। আজ তার শুন্য ঘরটাও যেন পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ঘরের প্রতিটি কোণায় কোণায় সে অনির অনুপস্থিতি টের পেত। মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে আর সে প্রিয় মুখটা দেখে রাত জাগা হতো না রিশাদের। রিশাদের নীরব আর্তনাদ গুলোর সাক্ষী এই রুমটাই আর এখানকার প্রতিটি আসবাবপত্র। অনির অনুপস্থিতি কাটিয়ে উঠতেই সে রাত জেগে তার প্রিয়তমার স্পর্শযুক্ত জিনিসগুলাই হাত বুলিয়ে দিত। অশ্রুগুলোকে জোর করে আটকে রাখতো। মাঝে মাঝে ব্যর্থও হতো।
অনির ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিল রিশাদ। সেই খারাপ সময়ের কথাগুলো মনে করে সে কষ্ট পেতে চায় না। অনির মাথার কাছে বসে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দেয় রিশাদ। ফজরের আযানের মধুর সুর কানে ভেসে আসতেই রিশাদ অনিকে ছেড়ে ওয়াশরুমের দিকে যায়। এতক্ষণও তার অফিসের জামাকাপড় খোলা হয়নি।
রিশাদ ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একেবারে গোসল করে বেরিয়ে আসে। এখন তার একটু আরামদায়ক লাগছে। অনি এখনো ঘুমে বিভোর। ক্লান্তির ছাপ অনির মুখে স্পষ্ট। তাই তার আর মন চাইছিল না অনিকে ডাকতে। তবুও নামাজ কাজা হবে ভেবে অনিকে রিশাদ জোর করে ঘুম থেকে তোলে।
অনির পরনের শাড়িটাও কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছে। ঘুমের ঘোরের মধ্যেই রিশাদ অনিকে ড্রেস চেঞ্জ করিয়ে হাতমুখ ধুয়ে দাঁত ব্রাশ করিয়ে দেয়। অনির ঘুমের ভাব কিছুটা দূর হয়। তবুও সে বার বার বড় বড় করে হাই তুলছিল।
অনি অযু করে বেরিয়ে আসলে রিশাদ মসজিদে যায় নামাজ পড়তে। অনি নামাজ পড়ে এলোমেলো ভাবে বিছানায়া শুয়ে পড়ে। শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই যেন দুচোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নামে। চোখ খুলে রাখা দায় হয়ে গেছে তার।
শায়লা বেগম সবে মাত্র ফজরের নামাজ পড়ে উঠেছেন। আজ তার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। তার কারণটা কারোই অজানা নেই। তার ঘর আলো করে অনি ফিরে এসেছে। অনি চলে যাওয়ার পর সবাই কেমন যেন একটু চুপ চাপ হয়ে গিয়েছিল।বাড়িটাই ফাঁকাফাঁকা লাগতো। সারাক্ষণ শায়লা বেগমের আশে পাশে ঘুর ঘুর করতো মেয়েটা। অনি ফিরে আসায় যেন তিনি একেবারে উৎফুল্ল হয়ে গেছেন।
কালকে আসার পর থেকে অনির সাথে ঠিকমতো কথাই হয়নি শায়লা বেগমের। তাই তিনি জায়নামাজটা গুছিয়ে রেখে অনির রুমের দিকে যান। অনির সাথে দেখা করার যেন তার আর তর সইছে না।
অনির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে রুমে প্রবেশ করেন। শায়লা বেগম রুমে এসে দেখতে পান নামাজ পড়ার হিজাবটা পরেই এলোমেলো ভাবে বিছানায় শুয়ে আছে অনি। দু বার ডাক দিয়েও অনির কোন সাড়া পাননা তিনি।
–পাগলি মেয়ে!নামাজ পড়েই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। হালকা হেসে তিনি অনিকে বিছানায় সোজা করে শুইয়ে দেন। হিজাবটা খুলে দেন।
কিছুক্ষণ বসে থাকেন অনির পাশে। কতদিন পর দেখছে অনিকে। অনিকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ শুকিয়ে গেছে।চোখ মুখ বেশ শুষ্ক লাগছে। ফর্শা মুখটা কেমন যেন সাদা সাদা দেখাচ্ছে। শায়লা বেগম বুঝতে পারেন যে অনি মোটেও নিয়ম করে খাওয়া দাওয়া করেনি।
তিনি মনে মনে ভাবেন;আমার কাছে এসেছিস ঠিকমতো খাইয়ে দাইয়ে আবার আগের মতো করে দেব। কি অবস্থা করেছে নিজের।
রিশাদ রুমে এসে দেখতে পায় অনি মাথার কাছে বসে শায়লা বেগম কি যেন বিড় বিড় করছে। রিশাদ টুপিটা খুলে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলে;
–আম্মু তুমি এখানে এতো সকাল সকাল?
শায়লা বেগম রিশাদের দিকে তাকান। রিশাদের চোখমুখ চক চক করছে। রিশাদের ম্লান চেহারাটা আজ উজ্জ্বল হয়ে গেছে। বিগত দিনগুলোতে শায়লা বেগম ছেলের কষ্টটা বেশ ভালোভাবেই অনুভব করতে পেরেছেন। আজ ছেলেকে কিছুটা হাসিখুশি দেখে তিনি মনে মনে শান্তি পাচ্ছেন। তার ছেলেমেয়ে দুটোর সুখ কামনা করেন তিনি মনে মনে।
–হ্যা অনিকে দেখতে এসেছিলাম। এসে দেখি বিছানায় ঘুমোচ্ছে। তুই নামাজ পড়তে গিয়েছিল?তোর বাবা কোথায়?
-হ্যা বাবাও এসেছে। বাবা রুমে গেছে।
–ওহ আচ্ছা। থাক তোরা আমি আসছি। কফি খাবি তুই এখন?
–না আম্মু এখন কিছু খাবো না।
শায়লা বেগম হাসি মুখে রুম থেকে বেরিয়ে যান।অনির আগমনে তার বাড়িটা যেন খুশিতে ঝলমল করে উঠেছে।
ভোরের আলো এখনো ফোটেনি। রিশাদ অনির কাছে গিয়ে কয়েক বার ডাকে। শব্দ করে সাড়া দিলেও চোখ মেলে তাকায় না। রিশাদ অনির পাশে বসতেই অনি শোয়া অবস্থাতেই রিশাদের দিকে সরে এসে তার কোলে মাথা গুঁজে দিয়ে আরামসে ঘুমাতে থাকে।
রিশাদ মুচকি হেসে অনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। অনি রিশাদের স্পর্শে মুচকি হাসি দেয় রিশাদের অগোচরে।
আশরাফ শেখ নামাজ পড়ে এসে ড্রইং রুমের সোফায় বসেছেন।অনামিকা বেগম নিজেও ফজরের নামাজ পড়ে সবেমাত্র নিচে এসেছেন রান্নার তদারকি করার জন্য। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ড্রইংরুম পার করে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। কলিং বেলের শব্দ শুনে তার গতি মন্থর হয়ে যায়।
এতো সকাল সকাল কার আগমন হলো?কৌতূহলী অনামিকা দরজার কাছে যান। দরজা খুলতেই সামনের মানুষটাকে দেখে অনামিকা দারুণভাবে অবাক হন। মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। তবে খুশি হওয়ার পরিবর্তে অদ্রির বিধ্বস্ত এলোমেলো চেহারা দেখে অনামিকারও চেহারার রঙ পাল্টে যায়।
অস্ফুট স্বরে কিছুটা শব্দ করে বলেন;”অদ্রি!”
আশরাফ শেখ নিজেও কে এসেছে জানার জন্য দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। অনামিকার জন্য তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। তাই নিজেও উঠে আসেন। দরজায় অদ্রিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশরাফ শেখ নিজেও অবাক হন। তবে অদ্রির শুষ্ক চোখমুখ আশরাফ শেখের খুব ভালো মনে হচ্ছে না।
পরনের শাড়িটা কুঁচকে গেছে। কুচিগুলোও কিছুটা আলগা হয়ে গেছে। শুধু মাত্র সেফটিপিনের জোরে শাড়িটা শরীরের সাথে লেগে আছে। বাঁধা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। চোখের কাজল লেপ্টে কালো হয়ে গেছে। গাল বেয়ে পরা চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়ার দাগ স্পষ্ট।
অদ্রি তার বাবাকে দেখেই দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। আশরাফ শেখ মেয়ের করুণ দশা দেখে রাগ অভিমান সব ভুলে মেয়েকে বুকে আগলে নেন। একবার এইবুকে তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরার জন্য খা খা করছিল। অদ্রি বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
অনামিকা নীরব দর্শক হয়ে সবটা দেখছে। এতদিন পর অদ্রিকে দেখার খুশিটা যেন অদ্রির কান্নার সাথে সাথে বিষাদে রূপান্তরিত হয়ে যায়। অদ্রির কি হয়েছে তা বুঝে উঠতে পারছে না। অদ্রি যেমন কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গিয়েছিল ঠিক তেমনভাবেই আবার ফিরে এসেছে। অদ্রির সাথে কি খারাপ কিছু হয়েছে। অনামিকার মনে হাজার খারাপ চিন্তা ভাবনা আসতে শুরু করে। এসব চিন্তা মাথা থেকে দূর করে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন যেন অনামিকার ভাবনাগুলো সত্যি না হয়।
কাঁদতে কাঁদতে অদ্রি তার বাবার বুকে ঢলে পড়ে। তার কান্নার আওয়াজ থেমে যায়। শরীরটা নেতিয়ে পড়ে। হাত পা অবশ হয়ে যায়। আশরাফ শেখ মেয়ের ভাড়ে নুইয়ে পড়তে নিলে অনামিকা এসে সামলে নেয়। অদ্রি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আশরাফ সাহেব আর অনামিকা দুজনে মিলে ধরাধরি করে অদ্রিকে নিয়ে সোফায় শুইয়ে দেয়।
অনামিকা দৌঁড়ে রান্না ঘরে যায়। আর আশরাফ অশ্রুসিক্ত নয়নে অদ্রির নাম ধরে বার বার ডাকতে থাকেন। কোন সাড়া পান না। পালস চেক করে দেখতে পান পালস চলছে। তিনি হাত পা মালিশ করতে থাকেন। অদ্রির হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে।
শোরগোলের শব্দ শুনে জাহানারা বেগম নিচে নামেন। জাহানারা বেগম অদ্রিকে এ অবস্থায় দেখে কিছুটা ভড়কে যান। অদ্রিকেও তিনি কম ভালোবাসেন না। অদ্রির জন্য তার চিন্তা শুরু হয়। অনামিকা রান্নাঘর থেকে পানি আনলে জাহানারা বেগম তা অদ্রির চোখেমুখে ছিটিয়ে দেন।
অদ্রির কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। আরো বেশ কিছুক্ষণ যাবত চেষ্টা করার পর অদ্রির জ্ঞান ফেরে। কয়েক মূহুর্তের জন্য সে কিছুই মনে করতে পারছিল না।আস্তে আস্তে তার কাছে সবটা পরিষ্কার হন।
জাহানারা বেগম ব্যথিত নয়নে অদ্রির মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকেন।আগের অদ্রির সাথে যেন তার সামনে শুয়ে থাকা অদ্রির মাঝে আকাশ পাতাল ফারাক। কি থেকে কি হয়ে গেছে মেয়েটা। জাহানারা বেগম ঠিকই সবার অগোচরে এতদিন অদ্রির খবর নিয়েছেন। তবে এভাবে অদ্রিকে দেখার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। এখন তার একটাই চিন্তা অদ্রি কিভাবে সবটা মোকাবিলা করবে?পারবে তো সে সবটা মেনে নিতে?নিজের ভাগ্যকে তো আর কেউ খণ্ডাতে পারে না। অদ্রি না চাইলেও তাকে সবটা মেনে নিয়ে ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
জ্ঞান ফেরার পর অদ্রি আশরাফ আর অনামিকার দুই একটা প্রশ্নের উত্তর দেয়। বেশির ভাগ কথাই সে এড়িয়ে যায়। অদ্রি তার নিজের সিদ্ধান্তের জন্য বেশ অনুতপ্ত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার মা বাবা তাকে সাপোর্ট করেছে। আর নিজের জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিয়েছে। তাই বোধ হয় আজ তাকে এতোটা পস্তাতে হচ্ছে।
অদ্রির শারীরিক অবস্থার দিকে তাকিয়ে আশরাফ সাহেব তাকে কোনরূপ জোর করেন না। অনামিকা আর জাহানারা বেগম তাকে ধরে ধরে রুমে নিয়ে যায়। অদ্রির ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ করে দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেন। অদ্রির শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে। অনামিকা শেখ অদ্রির জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে নিচে যান। আর জাহানারা বেগমের কোলে মাথা রেখে অদ্রি চোখ বুজে শুইয়ে থাকে।
বুকের মধ্যে কষ্টগুলো তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে। যেকোন মূহুর্তে তা বেরিয়ে আসতে পারে। অদ্রি কিছুতেই রিশাদের প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারছে না। কি মারাত্মক ভুল সে করে ফেলেছে। সব কিছু পেয়েও যেন সে তার জীবনের মুল্যবান এক বস্তু হারিয়ে ফেলেছে। নীরবে অশ্রুপাত করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে অদ্রি।
চলবে……
আসসালামু আলাইকুম?