অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_৫৩

0
6172

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৫৩

অদ্রি অনি মুখোমুখি হতেই অদ্রি তার গালে সপাটে চড় মেরে দেয়। চড়ের শব্দে চারপাশটা যেন থমকে যায়। আচমকা অনি তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পরে যেতে নিলে অনির সবচেয়ে বিশ্বস্ত হাতদুটো এসে অনিকে সামলে নেয়। অনি আর কান্না চেপে রাখতে পেরে রিশাদের বাহুডোরেই শব্দ করে কেঁদে দেয়। অদ্রির অগ্নিদৃষ্টির বিপরীতে রিশাদ হাজার গুন বেশি ক্রোধের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অদ্রির দৃষ্টি প্রশমিত হয়ে যায় তবে সে পুরোপুরিভাবে দমে যায় না।

–হাউ ডেয়ার ইউ অদ্রি?তোমার সাহস কি করে হয় অনির গায়ে হাত তোলার?রাগান্বিত স্বরে উচ্চ আওয়াজে কথাগুলো অদ্রির দিকে ছুড়ে মারে রিশাদ। রিশাদের এমন রাগ দেখে অদ্রি কিছুটা কেঁপে ওঠে। রিশাদকে এতটা রাগতে সে কখনো দেখেনি। রিশাদের এই রাগের সাথে পরিচিত নয়। তাই হয়তো এর পরিণতিটাও সে আন্দাজ করতে পারছে না।

অদ্রি কিছুটা ভড়কে গেলেও সে তার ক্রোধভাব বজায় রেখে বলে;

–আমার বোনকে মারার জন্য আমি তোমার থেকে পারমিশন নেব না। সো স্টে আউট অফ ইট। (অদ্রি)

–ওহ ইউ শাট আপ। সে তোমার বোন হতে পারে বাড় নাউ শি ইজ মাই ওয়াইফ। রিশাদ খানের ওয়াইফের সাথে কেউ আওয়াজ তুলে কথা বলার সাহস পায়না সেখানে তোমার সাহস কি করে হয় হাত তোলার?(রিশাদ)

রিশাদের কথায় অদ্রি কিছুটা দমে যায়। রিশাদের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসাও দেখতে পায় না। দীর্ঘ পাঁচ বছরের ভালোবাসা কি এতটাই দ্রুত মুছে যেতে পারে?বিশ্বাসটা ভেঙে গেলে বোধ হয় ভালোবাসাও অবশিষ্ট থাকে না। এতটাই নিষ্ঠুর পরিণতি নিয়তি তার কপালে লিখে রেখেছিল। যেখানে আজ নিজের বোনকে ভালোবাসার মানুষের সাথে দেখতে হচ্ছে।

যে চোখে দিকে তাকিয়ে সে একসময় ভালোবাসার অতল গভীরে হারিয়ে যেত আজ সেখানে তার কোন জায়গা নেই। সবটা জুড়েই শুধু অনন্যময়ীর বিচরণ। রিশাদের অস্তিত্ব যে অনন্যময়ীর সাথে মিশে গেছে তা অদ্রির মতো বুদ্ধিমান মানুষের বুঝতে একটুও সময় লাগে নি।

রিশাদের প্রত্যাখ্যান অদ্রিকে এতটা কষ্ট দেয়নি যতটা কষ্ট পেয়ে অনি আর রিশাদের সম্পর্কে। নিজের করা অন্যায়গুলোকে ভুলে সে অনিকে দোষারোপ করতে ব্যস্ত।হয়তো এভাবে সে কিছুটা শান্তি পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। মরীচিকার ন্যায় সুখ খুঁজতে গিয়ে সে আসল সুখটাই হারিয়ে ফেলেছে।

অনির প্রতি রিশাদের এই ভালোবাসা অদ্রিকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। রিশাদের প্রতিটা কথা অদ্রিকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে।এতটা শাস্তি কি সত্যিই তার প্রাপ্য!একটা ভুলের মাশুল এভাবে দিতে হবে সে কোনদিন কল্পনাও করেনি।

একটু আগের ঘটনা

অনির আগমনে আজ রিশাদদের বাড়িটা আগের মতো চঞ্চল হয়ে গেছে। কাঠফাটা রোদ্দুরে রঙিন ফুলগুলো যেমন বৃষ্টির আগমনে সতেজ হয়ে ওঠে তেমনি রিশাদদের বাড়ির সবাই যেন আজ প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।উৎসবে মেতে উঠেছে সবাই যেন।শায়লা বেগম আর সাবরিনা সকাল থেকে রান্নাবান্না নিয়েই ব্যস্ত। রিশা আর মিথিলা অনিকে ছাড়ছেই না। অনি ড্রইংরুমে বসে একে একে সবার জন্য আনা গিফট গুলো সবাইকে দিয়ে দেয়।

রিশাদের খুব বিরক্ত লাগছে। আজকের দিনটা অনির সাথে কাটাবে বলে সে অফিস যায়নি। এদিকে অনির পাত্তাই পাচ্ছে না সে। অনি মাঝে মাঝে রিশাদের অসহায় চাহনি দেখে মুখ টিপে হাসছে।এতে যেন রিশাদের আরো রাগ হচ্ছে । অন্যদিকে রিশা রিশাদকে ক্ষেপিয়ে মজা নিচ্ছে।

বিরক্ত হয়ে রিশাকে ভেংচি কেটে রিশাদ উঠে রুমে চলে যায়। অনি এবার বুঝতে পারে রিশাদ খুব রেগে গেছে। অনি উঠে রুমে যেতে চাইলে রিশা আর মিথিলা তাকে আটকে দেয়। বিধায় সে আর রুম্ব যেতে পারে না।

রিশাদ রুমে গিয়ে রাগে ফুঁসছে। কত শখ করে সে আজ অফিস ছুটি নিলো সেম যার জন্য ছুটি নিল তারই কোন হদিস নেই। বিছানায় হেলা দিয়ে বসে ফোন টিপছে সে।

বেশ কিছুক্ষণ পর অনি রুমে আসে। রিশাদ একটু নড়েচড়ে বসে। অনি রিশাদের দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে। রিশাদ অনির দিকে একবারও তাকায় না।

অনি রিশাদের পাশে বসতেই রিশাদ উঠে গিয়ে সোফায় বসে একটা ফাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। অনি সময় ব্যয় না করে উঠে গিয়ে রিশাদের গা ঘেঁষে বসে পরে। রিশাদ অনির দিকে একবার তাকাতেই অনির সাথে চোখাচোখি হয়।

অনি রিশাদের হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে টেবিলে রেখে দেয়। রিশাদ পুনরায় ফাইলটা হাতে নিলে অনি আবারো তা সরিয়ে দেয়।

— কি হয়েছে?এমন করছো কেন?দেখতেই পারছো আমি ফাইলটা পড়ছি তাহলে সরিয়ে দিচ্ছো কেন বার বার?(রিশাদ)

–উঁহু এখন কোন কাজ করা যাবে না।(অনি)

–তাহলে আমি কি করবো?তুমি নিচে যাও সবার সাথে আড্ডা দাও। আমাকে কাজ করতে দাও।(রিশাদ)

–এরকম করবা আমার সাথে?কিছুটা অসহায় ভাব নিয়ে বলে অনি।

-কি করলাম আমি আবার?(রিশাদ)

–এই যে আমাকে পাত্তা দিচ্ছো না।(অনি)

–হোয়াট?আর ইউ সিরিয়াস অনন্যময়ী? আমি পাত্তা দিচ্ছি না!এই কথাটাও আমাকে শুনতে হলো তাইনা। এদিকে আমি যে কারো জন্য আজ অফিস ছুটি নিয়ে বাসায় থাকলাম সেদিকে তো কারো খেয়াল নেই। উনি তো ওনার মতোই সবার সাথে ব্যস্ত আছে। আর এখন বলছে আমি নাকি পাত্তা দেইনা। হাউ ফানি!(রিশাদ)

–আমি কি ইচ্ছে করে করেছি? রিশাই তো আমাকে বার বার আটকে দিচ্ছিল।প্লিজ রাগ করো না।প্লিজ প্লিজ প্লিজ।করুণ স্বরে বলে অনি।

রিশাদ একবার অনির দিকে তাকায়। অনির অসহায় চাহনি দেখে আর রাগ করে থাকতে পারে না। মুচকি হেসে অনিকে জড়িয়ে ধরে। ভালোবাসার খুনসুটিতে মেতে ওঠে অনি রিশাদ।

সকালবেলা সবাই মিলে একসাথে ব্রেকফাস্ট করার পর রিশাদ একটু বাইরে যায়। আজ সে অফিস ছুটি নিয়েছে ঠিকি তব্র প্রোজেক্টের একটা কাগজ ডিসি অফিসে আটকে ছিল। সেটার জন্যই মূলত তাকে বেরোতে হয়।

সবার সাথে আড্ডা দেয়া শেষে অনি উপরে নিজের রুমে যায় কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে। রুমে এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ বোত হওয়ার পর সে জাহানারা বেগমের কাছে ফোন দেয় দেশে আসার পর থেকে কথাই হয়নি জাহানারা বেগমের সাথে।

জাহানারা বেগম অদ্রিকে খাইয়ে দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেন। অদ্রি একেবারে চুপ চাপ হয়ে গেছে। দু একটা প্রশ্নের উত্তর দেয়া ছাড়া কারো সাথে কোন কথা বলছে না। অনামিকা অদ্রির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অদ্রি চুপ চাপ বেলকনির ফাঁকা অংশ দিয়ে বাইরের দিকে উদাসীনভাবে তাকিয়ে আছে।

জাহানারা বেগমের ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে অনির নামটা দেখে তিনি অনামিকার দিকে একবার তাকিয়ে বাইরে বেরিয়ে যান।

ফোন রিসিভ করতেই অনির উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর ভেসে আসে জাহানারা বেগমের কানে। আগে যেমন অনির উৎফুল্লতায় জাহানারা বেগম খুশি হতেন আজ তিনি কেমন যেন খুশি হতে পারছেন না। অদ্রি অনি সামনা সামনি হলে কি হবে ভাবতেই এক রাশ ভয় তাকে ঘিরে ধরে। কিভাবে সামলাবেন তিনি বুঝেই উঠতে পারছেন না।

–হ্যালো দিদা আমার কথা শুনতে পারছো? (অনি)

–হ্যা বলো। কেমন আছো তুমি?(জাহানারা)

–আলহামদুলিল্লাহ ভালো!তুমি কেমন আছো?ওবাড়িতে সবাই কেমন আছে?(অনি)

কুশল বিনিময় করার পর জাহানারা বেগম ইতস্ততবোধ করতে করতে অনিকে অদ্রির ফিরে আসার কথাটা বলে ফেলেন। অদ্রি ফিরে এসেছে শুনে অনি খুব খুশি হয়। তবে অদ্রির বর্তমান অবস্থা ও এর পেছনের কারণটা ভেবে সে অস্থির হয়ে যায়। অদ্রিকে একবার দেখার জন্য তার মনটা উতলা হয়ে যায়। জাহানারা বেগমের সাথে কথা বলে সে ফোনটা রেখে দেয়।

সোফায় হেলান দিয়ে বসে দুচোখ বুজে সে অদ্রির কথাই ভাবছে। অদ্রির এভাবে হঠাৎ চলে আসা,এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না অনি। অদ্রির সাথে কি খারাপ কিছু হয়েছে?অদ্রির চিন্তায় অনি বিচলিত হয়ে পড়েছে।

কিছু একটা ভেবে সে তার দিদা কে আবার ফোন দিয়ে বলে সে আসছে। জাহানারা বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অনি ফোনটা কেটে দেয়। এরপর সে রিশাদকে ফোন দেয়। রিশাদকে জানায় সে তাদের বাড়িতে যাচ্ছে। তবে অদ্রির ব্যাপারটা সে রিশাদকে জানায় না। সে চেয়েছিল রিশাদকে সামনা সামনি বলতে। রিশাদও অনিকে সম্মতি দেয় যাওয়ার জন্য। ব্যস্ততার মধ্যে সে ভুলেই গিয়েছিল প্রায় অদ্রির কথাটা।

অনি শায়লা বেগমকে জানিয়ে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। শায়লা বেগমকেও সে এই মূহুর্তে অদ্রির ফিরে আসার কথাটা জানায় না।

প্রায় ত্রিশ মিনিট পর অনি তাদের বাসায় পৌঁছায়। বাসায় ঢুকতেই মুখোমুখি হয় অনামিকা শেখের। স্মিত হেসে অনামিকার সাথে কুশল বিনিময় করে অনি। সকালে বেলা অদ্রিকে নিয়ে এত ধকল গেল। অনিকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পান। তবে অনি অনামিকা দেখে কোনরূপ অতিরিক্ত সখ্যতা দেখানোর চেষ্টা করেনা। একরকম সে দায়সারা ভাবে সে অনামিকার সাথে কথা বলে।

–অদ্রিপু কোথায়?(অনি)

–উপরে রুমে।(অনামিকা)

অনি আর কোন কথা না বাড়িয়ে উপরে চলে যায়। অনামিকা অনির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর সে রান্নাঘরের দিকে যায়।

অদ্রির রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনি। ভেতরে ঢুকতে কেমন এক ভয় কাজ করছে তার। আসন্ন বিপদের কিঞ্চিত পূর্বাভাসে আচ্ছন্ন হয়ে আছে অনির অবচেতন মন।

রুমে ঢুকে দেখতে পায় অদ্রি বিছানার কোণায় উদাসভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে আছে। অদ্রিকে কি বিষন্ন দেখাচ্ছে। অদিকে এ অবস্থায় দেখে অনির মনটা খারাপ হয়ে যায়।

অনি রুমে প্রবেশ করে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে অদ্রি মাথা তুলে তাকায়। অনিকে দেখে কিছুটা অবাক হয় অদ্রি। অদ্রির মনে প্রশ্ন জাগে অনিকে তাহলে ফিরে যায়নি?দিদাকেও দেখলাম বাসায়। এতক্ষণ তাহলে অনি কোথায় ছিল?আমার সাথে দেখা করতে আসলো না তো?

অদ্রি সেসব প্রশ্নে পাত্তা দেয় না। রিশাদ নামক অসহনীয় যন্ত্রণায় সে আচ্ছন্ন। অদ্রি অনিকে দেখে মলিন হাসি দেয়। অনির বুকটা হুহু করে ওঠে অদ্রিকে দেখে।

হাতের পার্সটা বিছানায় রেখে অনি অদ্রিকে জড়িয়ে ধরে। বিষন্নতার চাদরে মোড়ানো অদ্রি অনিকে দেখে আর তার কান্না আটকে রাখতে পারেনা। শব্দ করে কেঁদে দেয়। অনির চোখ দিয়েও জল বেরিয়ে আসে। একদফা কান্নার পর অনি অদ্রির চোখ মুছে দেয়।

অদ্রিকে টুক টাক প্রশ্ন করে অনি তবে সব প্রশ্নই প্রায় এড়িয়ে যায়। তাই অনি আর কিছু বলে না। দুপুরে অনি অদ্রিকে গোসল করিয়ে দিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়।অদ্রি খেতে চাইছিল না বলেই অনি জোর করে খাইয়ে দেয়। দরজায় দাঁড়িয়ে অনামিকা এই দৃশ্য দেখে চোখের জল আটকে রাখতে পারেন না। আচল দিয়ে মুখটা ঢেকে তিনি নিজের রুমে যান। অদ্ভুত এক সুখমিশ্রিত কষ্ট তাকে অস্থির করে তুলছে।

সারা বিকেলটা অনি অদ্রি একসাথে কাটায়। অদ্রি অনির সঙ্গ পেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হয়। তবে অদ্রির এখনো চরম সত্যিটা জানা বাকি আছে। যে সত্যিটা তাকে আরেক দফায় মানসিকভাবে গুড়িয়ে দেবে ।

রিশাদ তার কাজ শেষ করে অনিকে টেক্সট করে সে বাসায় ফেরার সময় নিয়ে যাবে অনিকে। এতক্ষণে রিশাদের খেয়াল হয়েছে অদ্রির কথা। তাই সে চায়না অনি ওবাড়িতে থাকুক। অদ্রির মানসিক অবস্থা বিবেচনা করেই সে এটা ভেবেছিল।
অনিদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রিশাদ অনিকে কল করে।

অদ্রি রুমে বসে অনির জন্য অপেক্ষা করছে। তার দুবোন মিলে ভেবেছিল এই সুন্দর বিকেলটা তারা কফির সাথে উপভোগ করবে। মূলত প্ল্যানটা অনিরই ছিল অদ্রিকে স্বাভাবিক করে তোলার জন্য। সে ভেবেছিল কফি খেতে খেতে জেনে নেবে কি হয়েছে অদ্রির।

বিছানার উপর রাখা পার্সটা শব্দ করে কেঁপে ওঠে। অদ্রির নজর সেদিকে যায়। রিংটোনের শব্দ পেয়ে সে বুঝতে পারে অনির ফোন বাজছে। দূরে বসে তাকিয়ে দেখতে দেখতেই কল কেটে যায় শব্দ বন্ধ হয়।

পুনরায় ফোনটা বেজে ওঠে। অদ্রি অনিকে দুবার ডাকে তবে কোন সাড়া পায়না। তাই সে নিজেই উঠে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করার জন্য বের করে।

ফোনটা বের করতেই অনির চোখ দুটো স্থির হয়ে যায় ফোনের স্ক্রিনে রিশাদ অনি দম্পতির ক্যামেরায় বন্দি হাস্যজ্জ্বল এক ভালোবাসার মূহুর্ত দেখে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রিংটোন বন্ধ হয়ে ফোনের স্ক্রিন বন্ধ হয়ে যায়।

অনির ফোনটা হাতে নিয়ে অদ্রির হাত দুটো কাঁপতে থাকে।অনির চোখ দুটো অশ্রুতে ভরে ঝাপসা হয়ে যায়। ফোনটা আবার বেজে উঠতেই অশ্রুর ফোটাগুলো অনি রিশাদের ছবির উপর পরে। অদ্রির কাছে সব কিছু কেমন অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে। এই ছবিটার মানে সে বুঝতে পেরেও যেন তার মন অস্বীকার করতে চাইছে। কিছুতেই সম্ভব না এটা।

দুই কাপ কফি হাতে নিয়ে অনি রুমে প্রবেশ করে। অনি দেখতে পায় অদ্রি তার ফোনটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে এসে অদ্রিকে উদ্দেশ্য করে যখন বলে কে ফোন দিয়েছে অদ্রি ফোনটা অনির সামনে তুলে ধরে।

স্ক্রিনে রিশাদের নামের সাথে ছবিটা দেখে অনির বুকটা ধ্বক করে ওঠে। সে চায়নি এভাবে সত্যিটা অদ্রির সামনে বেরিয়ে আসুক। অনির মনে পুরনো অপরাধবোধ গুলো নতুন করে জেগে ওঠে। সে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।

অনির চোখমুখের দিকে তাকিয়ে অদ্রি যা বোঝার বুঝে যায়। সবটা অদ্রির কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। সে যেন কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না। দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে অনিই কেন?নিজের বোনের সাথে সে কি সহ্য করবে তার ভালোবাসার মানুষকে।এ যন্ত্রণা যে সহ্য করার শক্তি তার নেই।

অদ্রি অনির দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। কাঁদতে কাঁদতে সে ফ্লোরে বসে পড়ে। অনি তাকে ধরতে গেলে অদ্রি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। গরম কফি পড়ে হাতের উপর পড়ে হাত পুড়ে যায়। অনি সে যন্ত্রণা কে উপেক্ষা করে অদ্রির কাছে যায়।

অদ্রি অনিকে এক মূহুর্তের জন্যেও সহ্য করতে পারছে না। অনিকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অদ্রি অনিকে যা নয় তাই বলে।অনি শুধুই নীরবে কথাগুলো সহ্য করে নেয়। অদ্রি রাগ সামলাতে না পেরে অনির গালে সপাটে চড় মেরে দেয়। আর তখনই আগমন ঘটে রিশাদের। রিশাদ অনিকে ফোনে না পেয়ে বাড়ির ভেতরে চলে আসে। চেঁচামেচির শব্দ শুনে উপরে এসে অদ্রির এমন উগ্র আচরণে রিশাদ আর ক্রোধ সংবরণ করতে পারে না।

বর্তমান

–ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিটস অদ্রি। তুমি যা কিছু করেছো আমার সাথে তারপরেও আমি তো তোমাকে কোনরূপ বাজে কথা বলিনি।সেখানে তোমার সাহস কি করে হয় অনির গায়ে হাত তোলার। কি পেয়েছো টা কি তুমি?হ্যাভ ইউ গন ম্যাড?(রিশাদ)

–হ্যা হ্যা আমি পাগল হয়ে গেছি। তোমার জন্যই আমি পাগল হয়ে গেছি।কেন করলে আমার সাথে এই রকম?আমাকে শাস্তি দিতে তুমি আমার বোনকেই বিয়ে করে নিলে!বাহ রিশাদ বাহ!আমাদের পাঁচ বছরের ভালোবাসাকে তুমি এই কয়েক মাসে ভুলে যেতে পারলে কিভাবে রিশাদ?কিভাবে পারলে আমাকে ভুলে অন্য কাউকে আপন করে নিতে।পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে কথাগুলো বলে অদ্রি।

–স্টপ ইউর ননসেন্স টকিংস। আমাদের পাঁচ বছরের সম্পর্ক কে উপেক্ষা করে যখন নিজের ক্যারিয়ারের জন্য আমাকে সমাজের সবার সামনে অপমানের মধ্যে ফেলে চলে গিয়েছিলে তখন কোথায় ছিল তোমার পাঁচ বছরের ভালোবাসা?সব সময় শুধু নিজের স্বার্থের জন্য আমাকে ব্যবহার করে গেছো।তখন বুঝতে পারিনি। শুধু নিজের ক্যারিয়ার ছাড়া আর কিছুই তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনন্যমিয়ীর সাথে তো কোন সম্পর্ক নেই। তবুও আমি যখন অসুস্থ ছিলাম সে নিজের স্বপ্ন পূরণের সবচেয়ে বড় সুযোগটাও হাত ছাড়া করে দিন রাত আমার সেবাযত্ন করে আমাকে সুস্থ করে তুলেছে। আমার পরিবারের খারাপ সময়ে তাদের পাশে দাড়িয়েছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার তাইনা। প্রতিটা মূহুর্ত আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে ছাড়া আমি কতটা অচল। নিঃস্বার্থভাবে আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। তার বিনিময়ে তুমি শুধুই আমাকে উপেক্ষা আর অপমান দিয়েছো।একবার তো বলে দেখতে তুমি বিয়েটা করতে চাওনা। আমি নিজে তোমাকে তোমার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে দিতাম। কিন্তজ তুমি তো তুমিই সব সময় নিজের মরজিমাফিক চলেছো। কখনো কোন বাধা দেইনি বলেই ওইদিনটা দেখতে হয়েছিল। তুমি নিজে আমাদের পথ আলাদা করে দিয়েছো। তাই বোধ আল্লাহ তায়ালা দুঃসময়ে আমার জীবনে আশীর্বাদ হিসেবে অনন্যময়ীকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি প্রতিটি মোনাজাতে শুকরিয়া আদায় করি অনন্যময়ীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ায়। আমার আধারে ফেলে গিয়েছিল অনন্যময়ী আলো হয়ে এসেছে। কোন একদিন ভালোবেসেছিলাম বলেই আজ তোমায় ছেড়ে দিচ্ছি অনির গায়ে হাত তোলার জন্য। দ্বিতীয় বার এই ভুলটা করার সাহস ভুলেও দেখাতে এসোনা।

অনিকে উদ্দেশ্য করে অদ্রি বলে; তুই আমার বোন হয়ে কি করলে পারলি আমার এত বড় সর্বনাশ করতে। আমার অনুপস্থিতিতে আমার বরকেই বিয়ে করে নিলি!আমার সব জিনিসে ভাগ বসিয়েছিস তুই। আমার বাবার উপর আমার বাড়িঘর সব কিছুতে। হাসিমুখে আমি তোকে আপন করে নিয়েছি। নিজের বোনের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছি। আর আজ এই দিনটা আমাকে দেখতে হচ্ছে শুধু তোর জন্যে। কেন এমন করলি আমার সাথে কেন?আমার ভালোবাসার মানুষকেই তুই কেড়ে নিলি?কি ক্ষতি আমি করেছিলাম তোর বল?কেন করলি এমন আমার সাথে?(অদ্রি)

–অনিকে নিয়ে তুমি কখনোই সুখী হতে পারবে না রিশাদ। আমাকে কষ্ট দিয়ে তোরা কেউ সুখী হতে পারবি না।যার নিজের বাবার সমাজে কোন পরিচয় নেই যার,নিজের মা যাকে আজ অবধি আপন করে নিতে পারেনি,সমাজ যাকে অবৈধ বলে তাকে নিয়ে তুমি কখনোই সুখী হতে পারবে না রিশাদ। (অদ্রি)

অদ্রির কথাগুলো শুনে অনির পৃথিবীটা যেন থেমে গেছে। কান্নাগুলো সব বুকের মধ্যেই আটকে গেছে। বার বার তার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অবৈধ শব্দটা। নীরবে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছে। নিজের কানের উপর যেন বিশ্বাস হারিয়ে গেছে তার। এসব কথায় সে যতটা না আঘাত পেয়েছে তার চেয়েও বেশি আঘাত পেয়েছে যে মানুষটা বলছে তাকে। যে অদ্রি কয়েক মিনিট আগেও তাকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেছিল সেই এখন তার জন্ম নিয়ে কথা বলছে। জীবনে কখনো যে কথাগুলো শুনতে হয়নি আজ সেসব তাকে শুনতে হচ্ছে। পৃথিবীর বুকে হয়তো এই দিনটাই তার জন্যে সবচেয়ে বেশি কষ্টকর হিসেবে তার স্মৃতির পাতায় পরিচয় পাবে। অনির শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। রিশাদের গায়ের উপর সে শরীরের ভাড় ছেড়ে দেয়। মস্তিষ্ক যেন অচল হয়ে গেছে। অনুভূতিরা সব জটলা পেকে গেছে।

রিশাদ কিছু বলার আগেই অনামিকা শেখ অদ্রিকে থাপ্পড় মারেন।গালে হাত দিয়ে সে সামনে তাকিয়ে দেখতে পায় অনামিকা শেখের অশ্রুসিক্ত অগ্নিদৃষ্টি। এতক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছিলেন জাহানারা আর অনামিকা। অদ্রির কথায় তিনি আর চুপ করে থাকতে পারেন নি। আজ তার নিজের পেটের সন্তান যখন বৈধতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে তিনি আর সহ্য করতে পারেন নি। অনির সাথে করা অন্যায়গুলোর অনুশোচনা তাকে প্রতিবাদ করতে বাধ্য করে।

–ছি অদ্রি।তুমি এতটা নীচে নেমে যাবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। নিজের মেয়েকে দূরে ঠেলে আমি তোমাকে আপন করে নিয়েছি। কখনোই এটা ভাবার কোন সুযোগ দেইনি আমি তোমার সৎ মা। সেই তুমি আমার পেটের সন্তানকে অবৈধ বলছো? এই দিনটা দেখতে হবে আমি কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি। এটা কি সেই অদ্রি যে ছোটবেলায় অনিকে সব সময় চোখে হারাতো। অনি বিদেশ চলে যাবার পর দুদিন তুমি না খেয়ে ছিলে,সারা দিনরাত কেঁদেছিলে “আমার বাবুনিকে এনে দাও” বলে। সেই সব কথা কি তুমি ভুলে গেছো?তুমি তোমার বাবাকে আমাকে সবাইকে ফেলে চলে গিয়েছিলে শুধু মাত্র নিজের ক্যারিয়ারের জন্য। মানুষের কাছে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচিয়েছে অনিই যাকে কোনদিনও আমি জন্মের পর থেকেও একবারের জন্যও কাছে টেনে নেইনি। আর তুমি তার জন্ম নিয়ে প্রশ্ন করছো।আল্লাহ তোমাকে হেদায়েত দান করুক। আমি চাইনা আমি যে ভুল করেছি তা তুমিও করো।

কথাগুলো বলে অনামিকা অনির দিকে তাকান। অনির নীরব শুন্য দৃষ্টি দেখে অনামিকার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। অনির পবিত্র মুখটার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ওঠেন অনামিকা। অনির কাছে গিয়ে তার গালে হাত রেখে বলেন;

–মা হিসেবে আমি কোনদিনও তোমার কোন দায়িত্ব পালন করিনি। অন্যের রাগ আমি তোমার উপর দেখিয়ে জন্মের পর থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছি।নিজের ভুলগুলো যতদিনে বুঝতে পেরেছি ততদিনে আমার থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলে। এতগুলো বছর শুধু অনুতাপের অনলে পুড়েছি। তোমার মতো মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আর আমি পেয়েও তা নিজের দোষে হারিয়েছি।বোধ হয় মা হওয়ার কোন যোগ্যতা আমার নেই। তবুও আমি শুধু এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। কোনদিনও মায়ের দাবী নিয়ে আমি তোমার কাছে আসবো না। শুধু আমাকে ক্ষমা করে দিও তাতেই আমি শান্তিতে মরতে পারবো।

অনামিকা শেখ অশ্রুসিক্ত নয়নে কথা গুলো বলে উত্তরের অপেক্ষায় অনির দিকে তাকিয়ে থাকেন। নীরব অনি কষ্টের ধাক্কা সামলাতে না পেরে যেন আজ স্থির করেই নিয়েছে যে সে কথা বলবে না।

নীরবতা ছিন্ন করে রিশাদের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে;

–আমি বাড়ি যাবো রিশাদ।(অনি)

রিশাদ আর কোন কথা বাড়ায় না। অনিকে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। অনামিকা হতাশায় ভেঙে পরেন। অন্যদিকে অদ্রি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। একটার পর একটা ঝড় এসে যেন তাকে নতুন করে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে। যার ফলে যেন সে নিজের ন্যায় অন্যায় বোধ হারিয়ে ফেলেছে। শুধু একটাই যন্ত্রণা তাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে।

চলবে……

আসসালামু আলাইকুম?
দুঃখিত দেরি করে দেয়ার জন্য।রোজার দিন লিখতে প্রচুর আলসেমি লাগে।সরি??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here