অনন্যময়ী সানজিতা_তুল_জান্নাত পর্ব_৫১

0
5491

অনন্যময়ী
সানজিতা_তুল_জান্নাত
পর্ব_৫১

চোখ ধাঁধানো আলোয় ঝলমল করে ওঠা পরিবেশটা ফুলের সুবাসেও সুরভিত হয়ে উঠেছে। মানসিক উৎফুল্লতার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। সাজানো ফুলগুলোর মাঝে ছোট ছোট লাইট ছন্দাকারে জ্বলছে আর নিভছে। সেই ছন্দের সাথে পাল্লা দিয়ে আরো একজনের হার্ট বিট ক্রমাগত ওঠানামা করছে। না সে প্রথমবারের মতো তার ভালোবাসার মানুষটার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে না। বহু পুরনো ভালোবাসার সম্পর্ক তার। তবুও যেন তার মাঝে এক বুক শঙ্কা। তাকে দেখে মনে হচ্ছে প্রথমবার সে তার ভালোবাসার সামনে প্রেম নিবেদন করতে যাচ্ছে আর তার মাঝে কাজ করছে এক বিশাল উত্তেজনা যেন এই বুঝি সে তার ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করে হৃদয় জুড়ে গড়ে ওঠা ভালোবাসার অনুভূতিকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে চলে যাবে। বুক ঢিপ ঢিপ করছে। শুধুই ভয় আর শঙ্কা সাথে ভালোবাসার সেই মুখাবয়বকে একটু ছুঁয়ে দেখার আকুল আকুতি।

এক পা দু পা করে সামনের দিকে এগিয়ে যায় রিশাদ। চারপাশে বেশ তীক্ষ্ণ নজরে চোখ বুলায়। যেদিকেই তাকায় সেদিকেই শুধু দেখতে পায় একটাই শব্দ লেখা “SORRY”রিশাদের মাথায় কিছু ঢুকছে না। অন্তত হাজার খানেক বেলুন যাতে শুধুই সরি লেখা। রিশাদ এসব কিছু দেখে একটু বেশিই অবাক হয়ে যায়। ফ্লোরে পড়ে থাকা বেলুন গুলোর মাঝে দিয়ে রিশাদ সামনের দিকে সেন্টারে রাখা টেবিলটার দিকে এগিয়ে যায়। আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না।

রিশাদ সেন্টারে আসতেই আলোর তীব্রতা কিছুটা কমে যায় আবছা অন্ধকারের উদ্ভব হয়। একটি মানব অবয়ব রিশাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। অন্ধকারে রিশাদ স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারছে না। অবয়বটা যে কোন মেয়ের তা সে বুঝতে পারছে। তবে তার সেই প্রত্যাশিত অবয়ব কিনা নিশ্চিত নয়।

রিশাদের সামনা সামনি এসে দাঁড়ায় অন্ধকারে রিশাদ তার মুখটা স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে না। রিশাদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আচমকা রিশাদকে দুই বাহু দ্বারা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। রিশাদ বুঝতে পারে এ তার অনির স্পর্শ নয়। পরনারীর স্পর্শ অনুভব করতে পেরে রিশাদ ধাক্কা দিয়ে দূরে চলে যায়। আর রিশাদের বিপরীতে থাকা মানুষটা ছিটকে পড়ে যায়।

লাইট গুলো জ্বলে ওঠে। রিশাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায় তার দীর্ঘ সময়ের পরিচিত সেই চেনা মুখটা। একসময় যাকে ঘিরে তার পুরো দুনিয়া ছিল। সেই অদ্রির সামনাসামনি আজ রিশাদ। রিশাদ যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যিই তো অদ্রিই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

সমস্ত সুখ কেড়ে নিয়ে এক সাগর অসম্মান আর উপেক্ষার মাঝে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিল আজ সেই মানুষটাই পুনরায় তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছ। তবে সেসবে রিশাদের মাথাব্যথা নেই। পরোক্ষভাবে বোধ হয় সে অদ্রির জন্যই জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান মানুষটিকে পেয়েছে। তাইতো সে সকল অভিমান ভুলে রাগ ভুলে অদ্রিকে হাসিমুখে মাফ করে দিয়েছে। তার অনন্যময়ীকে নিয়ে বেশ তো সুখেই আছে রিশাদ।

রিশাদের ধাক্কায় তাল সামলাতে দুকদম পিছিয়ে যায় অদ্রি। নিজেকে সামলে নিয়ে সে রিশাদের সামনে উঠে দাঁড়ায়।কতদিন পর সামনাসামনি দেখছে সে রিশাদকে। অদ্রির দুচোখ ফেটে অশ্রুরা সব বেরিয়ে আসার প্রতিযোগিতায় নামে। তার তৃষ্ণার্ত চোখ রিশাদকে দেখতে ব্যস্ত। রিশাদ অদ্রির দিকে একবার তাকিয়েই তার নজর সরিয়ে নেয়।

অদ্রি রিশাদের দিকে এগিয়ে যায়। রিশাদের কাছাকাছি যেতে চাইলে রিশাদ হাত বাড়িয়ে অদ্রিকে থামিয়ে দেয়।অদ্রি মনে মনে রিশাদের অভিমানের পাহাড় ক্রমশ বেড়েই গেছে তাই তার অভিমান ভাঙাটা বোধ হয় সহজ হবেনা।নির্বোধ অদ্রি আপন মনেই নিজের মতো করে সবটা ভেবে নিচ্ছে। সে তো জানেই তার উপেক্ষায় ফেলে যাওয়া রিশাদ আজ নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে অনন্যময়ীর মাঝেই তার সবটুকু ভালোবাসা বিলিয়ে দিয়ে প্রকৃত সুখ খুঁজে নিয়েছে। কারো জন্য কেউ থেমে থাকেনা। উপরে একজন সবার উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন।তার বিধানেই অনি রিশাদ এক সুতায় বাঁধা পড়েছে। হয়তো কেউ তার কৃতকর্মের ফল পাচ্ছে আর কেউ তার ধৈর্যের।

এক ধ্যানে রিশাদের দিকে তাকিয়ে আছে অদ্রি। রিশাদ অদ্রির দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। অদ্রি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে রিশাদকে। তীব্র ব্যথা অনুভব হচ্ছে অদ্রির।কিছু হারানোর সংকেত দিচ্ছে তার অন্তরাত্মা অদ্রিকে। সেই ভয়েই হৃদয়ের মাঝে প্রায় তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে অদ্রির। অদ্রি ভেবেছিল রিশাদ তাকে বোধ হয় দেখার সাথে সাথে বুকে আগলে নেবে। অদ্রির ভাবনার অবসান ঘটিয়ে রিশাদ বলে;

–এসবের মানে কি অদ্রি?এসব তুমি করেছো?কেন করেছো?

–কেন রিশাদ তোমার ভালো লাগেনি?আমি তো শুধু তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।তাইতো তোমার জন্মদিনের আগেই আমি দেশে ফিরে এসে তোমার জন্য সব কিছু প্ল্যান করি।

অদ্রি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করে;এগারো বাজছে।আর একটু পরেই বারোটা বাজবে। তোমার জন্মদিন শুরু হবে। শুধুমাত্র তোমার জন্যই আমি এসব করেছি। তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে।

অদ্রি কথা শুনে রিশাদ হালকা শব্দ করে হাসে। অদ্রি রিশাদের এমন কান্ডের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না।রিশাদকে অনেক বেশি অচেনা মনে হচ্ছে তার। সেই আগের রিশাদের সাথে এই রিশাদকে সে মেলাতে পারছে না।অজানা শঙ্কায় অদ্রির মনটা ধ্বক করে ওঠে।

–সারপ্রাইজ অদ্রি!রিয়েলি?আর ইউ সিরিয়াস ম্যান?আমাকে তো আমার জীবনের বেস্ট সারপ্রাইজ টা তুমি অনেকদিন আগেই দিয়ে দিয়েছো। এসব কিছু একেবারেই ইউজলেস। জাস্ট ইউজলেস। সো প্লিজ স্টপ অল দিস ননসেন্স। এসব নাটকের কোন মানে হয় না।(রিশাদ)

রিশাদের কথায় অদ্রির মনে হচ্ছে কেউ যেন তার বুকের মাঝে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। তার ধারণা ছিল রিশাদের রাগ ভাঙাতে সে সক্ষম হবে। তবে এই রিশাদের রাগ ভাঙাবে কি করে কেননা অদ্রি নামক মানুষটা রিশাদের জীবনে দীর্ঘসময়ের ভালো স্বপ্নের মতো এক অতীত যার শেষ ভাগে এসে তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। সে শুধুই এখন রিশাদের স্মৃতির পাতায় আর চারটে স্বাভাবিক মানুষের মতোই বিরাজমান।

–রিশাদ প্লিজ আমি ভুল করেছি। আমাকে মাফ করে দাও। বিশ্বাস করো রিশাদ তোমাকে ছাড়া আমি একটুও ভালো ছিলাম না। প্রতিটা মূহুর্তে আমি তোমার শুন্যতা অনুভব করেছি। একটা বার আমাকে মাফ করে দাও রিশাদ।প্লিজ রিশাদ আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি জানি তুমিও অনেক কষ্ট পেয়েছো। তাইতো আমি ফিরে এসেছি। আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়ে নতুন করে শুরু করতে চাই। প্লিজ রিশাদ আমাকে একটা শেষ সুযোগ দাও। তোমাকে ছাড়া প্রতিটি মূহুর্তই যন্ত্রণাময়। তুমিহীনতায় ভুগছি আমি। প্রতি মূহুর্তে তোমার অনুপস্থিতি আমাকে এক সাগর বিষাদময় মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দাও রিশাদ।

কথা গুলো বলতে বলতে অদ্রি কান্নায় ভেঙে পড়ে। কান্নার বেগে তার কথাগুলো আটকে আসছে। কাঁদতে কাঁদতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অদ্রির কান্না আজ রিশাদের কানকে ছাড়িয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছালেও তার আজ তাকে কোনভাবেই প্রভাবিত করছে না। নিরেট অনুভূতি হীন বলে মনে হচ্ছে। চারপাশের বাকি সব আওয়াজের মতোই লাগছে অদ্রির কান্নার শব্দকে। অদ্রির কান্নার বেগ ক্রমাগত বাড়তেই থাকে।

অনুভূতিহীন রিশাদ অদ্রির কান্নার বীপরীতে নীরব। আসলে সে বুঝতেও পারছে না তার কি করা উচিত। এসব কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না রিশাদ।

রিশাদ কিছু একটা ভেবে অদ্রিকে দুই বাহু ধরে দাঁড় করায়। অশ্রুসিক্ত নয়নে অদ্রি রিশাদের দিকে কিঞ্চিত আশার আলো নিয়ে তাকায়। রিশাদ অদ্রির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে;

–অদ্রি তুমি হলে সুবিশাল মুক্ত আকাশের পাখি যে সর্বদাই উড়তে পছন্দ করে। ওই আকাশটাই তোমার জন্য যথা যোগ্য স্থান। রিশাদ নামক ছোট্ট নীড়ে আবদ্ধ থাকা তোমাকে মানায় না। তুমি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলে। আর এই যে বললে ক্ষমা করার কথা। তোমাকে আমি অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমার বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ, আক্রোশ, রাগ,অভিমান কিছুই নেই। অযথা এসব করে নিজেকে ছোট করো না।

রিশাদ অদ্রির উপর রেগে নেই ভেবেই অদ্রির মুখে হাসি ফোটে। অদ্রির নিভু নিভু আশার আলো কিছুটা দীপ্তি পায়।

–তুমি আমার উপর রেগে নেই?তার মানে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো?আমি জানতাম তুমি আমার উপর রাগ করে থাকতেই পারো না। আমি কথা দিচ্ছি রিশাদ আমি আর কখনো তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাব না। আমার কিচ্ছু লাগবে না শুধু তোমাকেই চাই। আমি আর কখনো তোমাকে কোন কষ্ট দেবো না। বলেই অদ্রি রিশাদকে পুনরায় জড়িয়ে ধরতে গেলে রিশাদ হাত বাড়িয়ে আটকে দেয়। অদ্রি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রিশাদের দিকে তাকায়।

–একটু দাঁড়াও অদ্রি। আমার কথা হয়তো তুমি বুঝতে পারোনি। তোমাকে আমি ক্ষমা করেছি। আমার জীবনে আসার দ্বতীয় সুযোগ দেইনি। তুমি একজন পর নারী হয়ে আমাকে বার বার এভাবে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে বিব্রত করছো। আর হ্যা বলেছিলাম না রিশাদের নীড়ে তোমাকে মানায় না। ওই খোলা আকাশটাই তোমাকে মানায়। যেখানে তুমি স্বাধীনভাবে উড়তে পারবে। নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে কোন বাঁধা আসবে না। আর এসব পাগলামি কখনো করো না। আর তুমি জানো অদ্রি কোন কাচের জিনিস যখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় তখন তাকে জোড়া লাগানো যায় না। আর যদি জোর করে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করো তবে তাতে থাকা ফাটলগুলোর জন্য আগের মতো মজবুত হয় না। সম্পর্কগুলোও ঠিক তেমনি। আমি তোমার উপযুক্ত ছিলাম না তাই বোধ হয় সৃষ্টিকর্তা আমাদের পথ আলাদা করে দিয়েছে। বিশ্বাস করো এতেই আমাদের কল্যাণ। আর আমি যে মানুষটার জন্য উপযুক্ত তাকে পেয়েছি। আল্লাহর রহমতে সময় থাকতেই তাকে আপন করে নিতে পেরেছি বিধায় আর কোন আফসোস নেই। তো নিজে ভালো থেকো আমাকেও ভালো থাকতে দিও। দোয়া রইল জীবনে সুখী হও। কেউ রাত জেগে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। পরিশেষে ধন্যবাদ তোমাকে তোমার জন্যই বোধ হয় জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার পেয়েছি। তুমি দেশে ফিরেছো ভালো কথা। অনেক রাত হয়ে গেছে সাবধানে বাসায় ফিরে যেও। আল্লাহ হাফেয।

বলেই রিশাদ এক মূহুর্তও অপেক্ষা না করে হন হন করে বেরিয়ে যায়। অদ্রির কানে রিশাদের কথাগুলো বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সকল শক্তি যেন হারিয়ে গেছে। রিশাদকে আটকানোর শক্তিটুকুও নেই। সবকিছু কেমন শুন্য শুন্য লাগছে তার। তার সকল আশার আলো এক নিমিষেই ধপ করে নিভিয়ে যায়। রিশাদের কথার মানে তার কাছে স্পষ্ট হয়েও যেন অস্পষ্টই রয়ে গেল। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। অদ্রির মাথা টা চক্কর দিয়ে ওঠে। ফ্লোরে বসে পড়ে রিশাদের গমন পথের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে।

ধীরে ধীরে রিশাদ অদ্রির দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। অসহনীয় সব মানসিক যন্ত্রণা গুলো এসে অদ্রির হৃদয় ও মস্তিষ্কে এসে ভিড় জমায়। বুকটা খা খা করছে। রিশাদের এই প্রত্যাখ্যান সে মেনে নিতে পারছে না। তার একটা সিদ্ধান্তে আজ এই পরিণতিতে এসে পৌঁছেছে তার জীবন। কাউকে কষ্ট দিয়ে যে সুখে থাকা যায়না হারে হারে টের পাচ্ছে অদ্রি। দীর্ঘা পাঁচ বছরের ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান পাওয়াটা যে কতটা কষ্টকর তা পরিপূর্ণ ভাবে আজ সে উপলব্ধি করতে পারছে।

রিশাদ সেদিন যে পরিস্থিতিটার মধ্যে দিয়ে গেছে তার কিছুটা হলেও হয়তো অদ্রির আজ বুঝতে পারছে। তার সুন্দর জীবনটা আজ একেবারেই ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে। রিশাদের জীবনে অন্যকারো উপস্থিতির কথা মনে পড়তেই তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। কান্নায় ভেঙে পড়ে অদ্রি। তার কান্নায় তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যেও পাশে কেউ নেই।

রিশাদ রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে। একবারের জন্যও পেছনে ফিরে তাকায় না। পেছনে ফেলে আসা মানুষটার প্রতি তার কোন পিছুটান মেই,নেই কোন অনুভূতি। সে শুধুই তার শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যতীত আর কিছুই নয়। এত দিনের সখ্যতা তো আর চাইলেই দূর করা যায় না। রিশাদের মনে কোন অপরাধবোধ নেই,নেই কোন অস্বস্তি। বরং অদ্রিকে কথাগুলো বলতে পেরে সে যেন স্বস্তি পাচ্ছে। রিশাদ গাড়ি চালিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।

ড্রইংরুমে পাইচারি করছে রিশা। একটু আগেই অনি তাকে ফোন করে জানিয়েছে রিশাদ এখনো পৌঁছায় নি।এদিকে রিশাদও তার ফোন ধরছে না। অফিসে ফোন করে জানতে পেরেছে রিশাদ প্রায় ঘন্টা খানেক আগে বেরিয়েছে। এখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজতে চলেছে। রিশার এখন টেনশন হচ্ছে।এত রিশাদ কোথায় গেল ভাবতে ভাবতে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। রিশাদ তার চিরকুট টা পেয়েছে কিনা সে ব্যাপারেও রিশা নিশ্চিত হতে পারছে না।

তার জন্য অনির সারপ্রাইজটা মাটি হয়ে যাবে ভাবতেই তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। অনি কত আশা নিয়ে এত দূর থেকে তাড়াহুড়ো করে এসেছে। ভাবতে ভাবতেই রিশাদ বাড়িতে প্রবেশ করে। রিশার ধ্যান ভাঙে। ভাইকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে সে কিছু বুঝতে পারছে না। তাহলে অনি কি বাসায় ফিরলো নাকি ভাইয়ার জন্য এখনো অপেক্ষা করছে।

–একি ভাইয়া তুমি এই সময় এখানে কি করছো?(রিশা)

–ওই ছাগল এত রাতে বাসায় ফিরবো না তো কি চকিদার হয়ে ঘুরবো আমি?(রিশাদ)

–না মানে ভাইয়া তুমি মানে। তুমি অফিসে কোন চিরকুটা পাওনি? ফুলের তোড়ায় তো…

–চিরকুট? হ্যা চিরকুট তো… চিরকুট মানে তুই চিরকুট রেখেছিলি?

–হ্যা মানে ওই আরকি। তুমি চিরকুট পেয়ে থাকলে যাওনি কেন?

–আর ইউ ইডিয়ট রিশা?চিরকুট কেন রেখেছিলি তুই?

–ভাইয়া তুমি আমাকে বকছো কেন?আমি তো ভাবির কথা শুনেই তোমার জন্য চিরকুট রেখেছিলাম। তুমি শুধু আমাকে বকছো।

–ভাবীর কথা শুনে মানে?অনন্যময়ী তোকে বলেছিল চিরকুট রাখতে?কেন? কি হচ্ছে এসব আমাকে একটু বলবি তোরা?

বেশ রেগে গিয়েই কথাগুলো বলে রিশাদ। রিশাদের ধমক খেয়ে রিশা গড় গড় করে সবটা বলে দেয়। অনির সারপ্রাইজ প্ল্যান করা,দেশে আসা সবটা শুনে রিশাদের মাথায় হাত পড়ে। রিশাদ অনির চিরকুটটা পায়ই নাই। সে ভালো ভাবে খেয়ালই করেনি রুমের ভেতর। প্রথম চিরকুট টা পেয়েই সে রুম থেকে বের হয়ে এসেছিল। এখন তার খুব আফসোস হচ্ছে। অনি ফিরেছে শুনতেই রিশাদের মনটা যেন ভালো হয়ে যায়। বারোটা বাজতে এখনো কিছুটা বাকি আছে।

–গাধা আমাকে আগে বলবি না?(রিশাদ)

–আশ্চর্য তো সারপ্রাইজ কি কেউ আগে বলে ভাইয়া?

–হ রে বইন তোদের এই সারপ্রাইজ চিরকুটের চক্করে পড়ে আমার জীবনটা তেজপাতা হয়ে গেল?

–ওহ হো ভাইয়া তুমি তো বললে চিরকুট পেয়েছো তাহলে যাওনি কেন?দোষটা তো তোমারই নাকি।শুধু শুধু আমাকে বকছো!

–তুই একটু দয়া করে মুখটা বন্ধ রাখ এমনিতেই আমার মাথাটা ঘুরছে। তোর সাথে দেখা না হলে কি হয়ে যেত। অনি ওখানে একা একা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। পাগল আমাকে তো ফোন করবি একবার।

–ফোনটা বের করে দেখো একবার কতবার তোমাকে কল করেছি।

–রিশাদ ফোন বের করে দেখে রিশার অনেকগুলো মিসড কল। সময়ের দিকে নজর পরতেই রিশাদ রিশার থেকে ঠিকানা নিয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যায়।

রিশা রিশাদকে যাওয়া আগে বলে দেয় সে যেন অনিকে এসব না জানায়। জানলে অনির মন খারাপ হবে সাথে তাকেও এক বস্তা ঝাড়ি খেতে হবে। রিশাদও নিজেও মনে মনে তাই ভাবছিল। সে চাইছিল যেন অনির সারপ্রাইজটা নষ্ট না হয়ে যায়। অনি যদি জানতে পারে রিশাদকে এগে থেকেই জানতো তবে সে অনির আত্মতৃপ্তিময় হাসি দেখা থেকে বঞ্চিত হবে।

রিশাদ দ্রুত গাড়ি চালিয়ে রেস্টুরেন্ট এর দিকে যায়। গাড়ির খোলা জানালার বহমান বাতাসের সাথে তাল মিলিয়্ব রিশাদের হৃদয়েও সুখের হাওয়া বইছে। কতদিন পর আজ সে তার প্রিয় মানুষটাকে দেখবে। কাছাকাছি, সামনাসামনি পাবে। চাইলেই সে এক টুকরো ভালোবাসার পরশ দিতে পারবে। একটু ছুঁয়ে অনুভব করতে পারবে। রিশাদ তার অনন্যময়ীকে নিয়ে কল্পনার ভালোবাসার সাগরে অতলে তলিয়ে যাচ্ছে।

মিনিট বিশেকের মধ্যে রিশাদ রেস্টুরেন্টে পৌঁছে যায়। গাড়ি থেকে নেমে হাতের ঘড়িটা ঠিক করে দেখতে পায় বারোটা বাজতে এখনো দশ মিনিট সময় বাকি আছে।রিশাদ মুচকি হেসে ভেতরে প্রবেশ করতেই একজন স্টাফ এসে তাকে হাসিমুখে স্বাগতম জানায়। তার নাম বলতেই স্টাফ বুঝে যায়। তাই রিশাদকে নিয়ে সেই স্টাফ একেবারে রুফ টপে নিয়ে যায় যেখানে অনি তার সারপ্রাই প্ল্যান করেছিল।

রিশাদকে দরজার কাছে রেখে এসে হাসিমুখে বিদায় নেয় স্টাফ। দুমিনিট সেখানেই দাঁড়ায় রিশাদ। কেমন এক উত্তেজনা কাজ করছে রিশাদের মাঝে। হার্ট বিট যেন একটু বেশিই ফাস্ট কাজ করছে। এত দিনের বিচ্ছেদের পর আজ পুনরায় তারা একে অপরের সান্নিধ্য পেতে চলেছে। একটু উত্তেজনা তো থাকাটা স্বাভাবিক।

রিশাদ এক পা দু পা করব ভেতরে প্রবেশ করে। রিশাদের মাঝে জড়তা কাজ করছে কিছুটা। অনিকে ঘিরে যতসব কল্পনারা এসে উঁকি দেয়। রিশাদ অবশেষে বড় দম নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে ঢুকে চারপাশে চোখ বুলাতেই তার চোখ কপালে উঠে যায়।

চলবে…….

আসসালামু আলাইকুম?
পরের পর্বে আর কোন প্যাচ দিবনা নিশ্চিন্ত থাকেন সবাই।??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here