মোনালিসা
মৌমিতা_দত্ত
পর্ব ৯
পৃথিবীতে সবচেয়ে বিচিত্র আর বিস্ময়কর জিনিস যদি কিছু থেকে থাকে , তা হল মানুষের মন। সময়ের থেকেও তীব্র গতিতে সর্বদা ধাবিত হয় মন। আর তাই কোনো ভাবনারই স্থায়ী ঠিকানা মনে গড়ে উঠতে পারেনা।
ঠিক যেমনটা এখন রাজীবের হচ্ছে। তার ধুধু মনের প্রান্তরে ভাবনারা এলোমেলো ভাবে ছুটে চলেছে। যে মনের নিয়ন্ত্রণ এতোদিনে কঠোর ভাবে সামলেছে সে আজ সেই মনই তার আয়ত্তের বাইরে।
এই যেমন আজ সোমবার দুপুরবেলা। অন্যান্য কর্মব্যস্ত সব মানুষই যখন নিজের নিজের কর্মে ব্যস্ত, তখন বাড়িতে কম্পিউটারের সামনে বসে গতকালের কথাই ভেবে চলেছে রাজীব।
সেই এক ঢাল এলিয়ে থাকা অগোছালো ভিজে চুলের বাইশ বছরের তন্বীর কথা । যার চোখের অভিমান মিশ্রিত চাহুনি আড়াল করে সযত্নে সে কঠোরতার ভান করে।
যে মেয়ে ছোট একটি অবলা জীবকেও সযত্নে কোলে তুলে নেয়। আগলে রাখে। মুখের সামনে দুধের বাটি ধরে।
আবার প্রয়োজনে তাকে অবহেলা করা মানুষকে দ্বিগুণ অবহেলা করে সে বুঝিয়ে দেয় সে সব হারিয়েও বাঁচতে জানে। এই মেয়ে কে? কেনই বা তার মন এতো দুর্বল হয়ে পড়ছে! কেনই বা বারবার গতকালের কথাগুলোই তার মনের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এ অনুভূতি তো তার এর আগে কখনো হয়নি।
এইসব ভাবতে ভাবতে দু- তিনবার দোতলার উপরের ঘরগুলোর দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থেকেও চোখ নামিয়ে নিচ্ছে সে। আর নিজের মনকেই বুঝিয়ে চলেছে ,হয়তো নিজের আবেগের বশে এ অনুভূতি তার মধ্যে অনুভূত হচ্ছে। সে তো আজও শুধু উর্বশীকেই মনে প্রাণে ভালোবাসে।
নাহ্, আর বেশিক্ষণ বাড়িতে থাকলে তার মাথা আর কাজ করবে না। এবার তাকে বেড়োতেই হবে।
এইভেবে উপরে উঠে নিজের ঘরে রেডি হতে যায় রাজীব। নিজের ঘর থেকে তৈরী হয়ে বেরোনোর সময় ঠিক তার ঘরের পাশের ঘরে থাকা লিসার ঘরের দরজা খোলা দেখে নিজের অজান্তেই তার পা জোড়া তাকে লিসার ঘরের দরজার সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়।
এবং কারোর অজান্তে তার ঘরে উঁকি দেওয়া যে অন্যায়, সে বোধ তার হয়না। বরং তার অবাধ্য দুচোখ প্রাণভরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা ঘুমন্ত লিসাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
নিষ্পাপ মুখের একটি মেয়ে ঘুমিয়ে আছে । আর কিছুটা দূরে তার মাথার কাছে গতকালের সেই বিড়াল শরীর এলিয়ে শুয়ে আছে। ভাবটা এমন যেন এই বিছানা, খাট এমনকি বাড়ির সবকিছুই সে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে পারে। এ দৃশ্য দেখার পর রাজীবের বেশ রাগ হয় বিড়ালটার উপর। কী সুন্দর সবথেকে কাছের হয়ে সে লিসার মাথার কাছে জায়গা করে নিয়েছে। ভাবলেই কেমন রাগ হয়ে যাচ্ছে তার। কিন্তু, তবুও তার পা জোড়া যেন আর এ জায়গা ছেড়ে কিছুতেই নড়তে চায়না।
এমনিভাবে বেশকিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আচমকা রাজীবের পকেটে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে।
আর সাথে সাথেই ঘুমন্ত লিসা ঘুম ভেঙে তাড়াতাড়ি বিছানায় উঠে বসেই দরজার সামনে রাজীবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ওঠে, “নাহ্, মানে হ্যাংলার সাথে খেলা করতে করতে কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতেই পারিনি। আপনার কিছু দরকার ছিল?”
এদিকে ফোনের জেরে ধরা পড়ে একরকম অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে রাজীব বলে ওঠে, “নাহ্, মানে আমি এখন বেড়োচ্ছি । কখন ফিরবো কোনো ঠিক নেই। তাই বলতে এসেছিলাম তোমাকে গেট লক করে বাড়িতে থাকতে। তুমি ঘুমিয়েছিলে তাই ডাকতে পারিনি।”
তার কথাটা যে খুব বেশি যুক্তিযুক্ত হবেনা তা জেনেও কথাগুলো বলে নিজেকে আড়াল করার প্রাথমিক চেষ্টা করে রাজীব।
এদিকে অবাক দৃষ্টে রাজীবের দিকে তাকিয়ে লিসা বলে ওঠে, “হ্যাঁ, তাই তো থাকি। আপনি তো নিজের মতো যাতায়াত করেন ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে , তাহলে আজ হঠাৎ বলছেন লক করে থাকতে! বুঝলাম না।”
লিসার সহজ প্রশ্নে পাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পায় তাই সে বলে ওঠে, “আমার তাড়া আছে চললাম।” এইবলে চলে যেতে গিয়েও দু’পা পিছিয়ে সামনে ফিরে আবারও রাজীব বলে ওঠে,”আর হ্যাঁ গতকাল বলা কথাগুলো ভুলে যেওনা। আমি তোমাকে বলেইছিলাম যে, অহেতুক আমার কোনো কাজের জন্য কাউকে জবাব দিহি করতে আমি বাধ্য নই।”
“আমি ভুলিনি। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন।”
“মানে!”
“মানেটা ভীষণ সহজ । কোনো প্রতিবেশীর উচিত নয় অন্য প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে উঁকি দেওয়া। আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি আপনি কথা ভাঙছেন।”
অহেতুক তর্কে সত্যিটা বেড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত বাড়ির থেকে বেরিয়ে পড়ে রাজীব।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আচমকাই সে প্রথম উপলব্ধি করে –
সব পুরুষই মনে প্রাণে এক একটি চঞ্চল প্রেমিক । তাই তো যার জীবনের সাথে নিজের জীবনের অস্তিত্বের সময়সীমা মাত্র একবছর সে নিজে নির্ধারিত করেছে। সেই মানুষটিকেই বার বার তার মন দুচোখ ভরে দেখতে চাইছে। সেই মানুষটির অনুপস্থিতিতেও মানুষটির কথা মনে পড়ামাত্র মানুষটি মনের ঘরে উপস্থিত হচ্ছে।
কিন্তু, এমনটাতো হওয়ার কথাও নয়। সে তো উর্বশীকে ভালোবাসে , তাহলে!
মাত্র কয়েকদিন হল তার বিয়ে হয়েছে আর এরমধ্যেই যদি এসব ভাবনা তাকে তাড়া করে বেড়ায় তাহলে এক বছরে তার অবস্থা কী ভয়ানক হতে পারে ভেবেই শিউরে ওঠে সে।
পরক্ষণেই তার মনে হয় – উর্বশীকে ভালোবাসা সত্ত্বেও আজ মোনালিসার মুখ তার চোখের সামনে ভাসছে। তার কারণ, কি শুধুই উর্বশীর ছেড়ে যাওয়া! নাকি একাকী দীর্ঘসময় নিজের জীবনের সাথে নিজের সময় কাটানোর জন্য দীর্ঘকালীন নিঃসঙ্গতা আজ ক্লান্ত হয়ে বিদায় চাইছে তার থেকে? নাকি সে চরিত্রহীন!
মাথা কাজ করা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় তার। সে বেশ বুঝতে পারে বাড়িতে যত বেশিক্ষণ সে থাকবে ততই সে দুর্বল হয়ে পড়বে।
তাই সে মনে মনে স্থির করে সে আগামীকাল থেকেই অফিস জয়েন করবে।
ভাবামাত্র পকেট থেকে ফোন বার করে অফিসে ফোন করতে গিয়ে তার খেয়াল হয়, আজ বাড়িতে থাকাকালীন আবীরের ফোনটা এসেছিল। অথচ তখন তালেগোলে আর আবীরকে ফোনই করা হয়নি।
আবীরকে ফোন করে অল্প কথা বলে ফোনটা রাখলেও দুদিন ধরে হওয়া তার আকস্মিক মনের পরিবর্তনের কথা সে আবীরকে জানায় না। পাছে আবীর তার চরিত্র নিয়ে হাসাহাসি করে এইভেবে।
এদিকে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সামনের একটা পার্কে এসে বসে সে।
সন্ধ্যের প্রাক্কালে অনিয়মিত জীবনের ছন্দে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন বয়সী কত যুগল পার্কে এসে বসছে, কথা বলছে, গল্প করছে। সবকিছুই দুচোখ ভরে উপভোগ করতে থাকে সে।
দীর্ঘদিন মনের নির্বাসনে নিজেকে বন্দি রাখার পর আজ যেন নিজেকে মুক্ত করেছে সে। অস্তমিত মেঘের আড়ালে তার মনের ক্ষতগুলোও যেন আজ অস্ত যেতে চাইছে।
এমন সময় আবারও রাজীবের ফোনের স্ক্রিনে আবীরের নামটা ভেসে ওঠে। আজ আবীরের সাথে তার বার – এ যাওয়ার কথা। কিন্তু, ইচ্ছাকৃতই সে ফোনটা ধরেনা। কারণ, মদের নেশায় জীবনকে আবিষ্কারের নেশা ত্যাগ করে তার মন তখন অস্তমিত আকাশের কোণের লালচে রেখায় একজনের মুখ কল্পনা করে নিজেকে আচ্ছন্ন করতে ব্যস্ত।
এদিকে, হ্যাংলা , রাণী, দানব ,কুচিমুচি সকলের সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পর নিজের অবসর সময় কাটানোর জন্য প্রতিদিনের মত আজও ঘর গোছানোর কাজে লেগে পড়ে লিসা। এই কয়দিনে অন্যান্য সব ঘর মোটামুটি গোছানো হয়ে গেলেও স্টাডি রুমটা তার গোছানো হয়ে ওঠেনি।
তাই যথারীতি স্টাডি রুমের ভেতর গিয়ে হাজির হয় লিসা। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অগোছালো বইয়ের স্তূপের বইগুলো সামনের আলমারিতে একে একে তুলে রাখার সময় আচমকাই একটা মোটা বইয়ের ভেতর থেকে একটা কাগজ মাটিতে পড়ে গেলে কৌতূহল বশত তা হাতে তুলে সেটা পড়তে শুরু করে লিসা।
তাতে লেখা –
মা,
এই বইটা ক্লাস নাইনে পড়ার সময় তুমি আমাকে কিনে দিয়েছিলে। বইটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “গল্পগুচ্ছ”। সেদিন পড়ার নেশায় শুধু গল্প পড়তাম। উপহারের মাহাত্ম্য বুঝতাম না। আজ “মা” তুমি আমাকে দিদিকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছো। আজ আর কারণে অকারণে আমার মনের সবটুকু বুঝে নিতে কেউ পারবে না।
সবথেকে জেদি, স্বল্প ভাষী ছেলের মনের অনেক না বলা কথা বুঝে নেওয়ার মানুষটাই আজ হারিয়ে গেল জীবন থেকে।
আজ উপহারের মাহাত্ম্য আমি বুঝি। আজ বুঝি জীবনের গুচ্ছ গুচ্ছ গল্পে আমাদের ভূমিকারা আমাদের অলক্ষ্যে হাসে।
“মা” সবার আড়ালে এই চিঠিই তোমার ছেলের তোমাকে দেওয়া উপহার। ভালো থেকো। আর আমি অনাথ মনে অভিভাবক খুঁজবো, আমি তোমাকে খুঁজবো “মা”।
– রাজীব
অন্যের চিঠি না জানিয়ে পড়া অন্যায়। তবুও মানুষের অজানাকে জানার আগ্রহ বরাবরই একটু বেশি থাকে। তাই, ন্যায় অন্যায় ভুলে সামনের মানুষটার এক অচেনা রূপকে জানতে এবার অন্যান্য বইগুলো গোছাতে গোছাতে একটা করে কাগজের টুকরোর আশায় প্রতিটি বই – ই
ভালো করে ঘাঁটতে থাকে লিসা।
নিরাশ মনে কয়েকটি ইংরেজি বই গুছিয়ে রাখার পর এবার বিভূতিভূষণের লেখা “আরণ্যক” বইটির মাঝামাঝি জায়গায় আর একটা চিঠি আবিষ্কার করে লিসা।
যথারীতি ন্যায় – নিতীর ভাবনা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে উৎসাহের সাথে চিঠিটা পড়তে শুরু করে সে –
বাবা,
জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তোমার দেওয়া উপহার। সেদিন জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ন হওয়ার আনন্দে আমি এ উপহার কে খুব বেশি গুরুত্ব দিইনি।
পড়েছিলাম, ভালো লেগেছিল । ব্যস ঐ অবধি।
একদিন তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। ভরসা একমাত্র দিদি।
কিন্তু , তারপর থেকে জীবনের সব বড় পরীক্ষায় আমি পর পর অকৃতকার্য হয়ে চলেছি। জীবনের অরণ্যে আমি একাই পথের অন্বেষণে ঘুরে বেড়াচ্ছি বাবা।
আজ উপহারের মাহাত্ম্য বুঝি কিন্তু আজ আর উপহার পাইনা।
– রাজীব
এরপর “শ্রীকান্ত” উপন্যাসের ভেতর থেকে বেরোয় আর একটা চিঠি। যাতে লেখা –
“বিদেশে যাওয়ার আগে দিদি দিলো এই বইটা উপহার। আসলে দিদি হয়তো বোঝাতে চাইলো জীবন যুদ্ধে সবাই ‘ইন্দ্রনাথ’ হতে পারেনা।
‘শ্রীকান্ত’ – এর সংখ্যাই বেশি। তাই ‘শ্রীকান্ত’ যেমন জীবন জোয়ারে ভাসতে ভাসতে ভাঁটার প্রতিকূলতার সাথেও লড়াই চালিয়ে গেছে। আমাকেও লড়তে হবে।
দিদি তুই আমার সব ছিলিস। আজ তুইও আমার থেকে অনেক দূরে আছিস। আমি সেই একা হয়ে পড়লাম রে ….একা!”
চিঠিটা পড়ার পর সযত্নে তা বইয়ের ভেতর রেখে বাকি বইগুলো গুছিয়ে রেখে স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে উপরে এসে নিজের রুমে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকে লিসা।
তারপর একদৃষ্টে অ্যাকোয়ারিয়ামে থাকা মাছগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর , সেদিকে এগিয়ে গিয়ে অ্যাকোয়ারিয়ামের কাঁচে হাত রেখে সে বলে ওঠে, “কী অদ্ভুত ব্যাপার নারে! তোরা বাঁচার জন্য সাঁতার কাটিস। আর আমরা ডুবে যাওয়ার ভয়ে।
আমাদের সবার জীবনের গল্পেই আমরা সবাই নিজেদের মতো করে একা বল!
শুধু সাঁতরে চলেছি আর একটা শেষ হওয়া গল্পের সন্ধানে। যার খোঁজ পেলে হয়তো আমাদের গল্পটা আবারও নতুন করে শুরু করতে পারবো এই আশায়। আমরা সবাই কতো নিঃস্ব বল!”………
চলবে…