মোনালিসা পর্ব ৮

0
1942

মোনালিসা
মৌমিতা_দত্ত
পর্ব ৮

প্রতিদিনের মতই পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে ভেজা চুলে আয়নার সামনে যখন লিসা এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক তখনি আয়নাতে আটকে থাকা একটা ছোট কাগজে তার নজর আটকে যায়।
কৌতূহল মিশ্রিত দৃষ্টিতে কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে দেখে তাতে লেখা, ‘আমার কিছু কথা ছিল। যদি কথাগুলো শোনার ইচ্ছা থাকে তাহলে স্টাডি রুমে আসলেই হবে। – রাজীব।’
দোতলা বাড়ির স্টাডি রুমটা একতলার দক্ষিণে। যথারীতি কাগজের টুকরোটা আয়নার পাশে রেখে তরঙ্গায়িত একঢাল চুল আঁচড়ে , সিঁথিতে সিঁদুরটা পরে অতি ধীর পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে সে।
মনে মনে এক অজানা শঙ্কায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় তার।
স্টাডি রুমের দরজার কাছে পৌঁছে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে সে ।
স্টাডি রুমের ভেতর দরজার দিকে পিঠ করে বসে একমনে রাজীব কিছু একটা পড়তে ব‍্যস্ত। সে খেয়ালই করেনি দ‍রজার কাছে লিসার উপস্থিতি। আসলে বরাবরই ছুটির দিনে যেকোনো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে পছন্দ করে রাজীব। আর পড়ার সময় অন‍্য কোনদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল থাকেনা।

এদিকে মনের দোটানায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কি বলা উচিত, আর কি বলা উচিত নয়! ভেবে যখন লিসা অস্থির ঠিক সেই সময় রাজীব আচমকা দরজার দিকে তাকাতেই তার চোখ জোড়া যেন কিছুক্ষণের জন‍্য স্থির হয়ে যায়।
কোমড় অবধি বিন‍্যস্ত এক ঢাল ভেজা চুল একপাশে গোছা করে নিয়ে শ‍্যামবর্ণা, ছিপছিপে গড়নের মেয়েটি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। যার ভেজা চুলের অবাধ‍্য জলরাশি কাপড়ের কিছু অংশও ভিজিয়ে দিয়েছে। জড়োসড়ো ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা তন্বীর দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন‍্য স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যেতে থাকে রাজীবের। বিয়ের পর প্রথম সে তার স্ত্রীকে দেখলো। যার দিকে এ অবধি তার নজর যায়নি। কিন্তু আজ যেন অদ্ভুত এক জেদ ধরে বসেছে তার চোখ – অবাধ‍্য হয়ে চেয়ে আছে ভেজা চুলে দাঁড়িয়ে থাকা এক গ্রাম‍্য মেয়ের দিকে। যাকে জ্ঞানত কখনো স্বীকারই করেনি তার মন।
নিজেকে সংযত করে এবার রাজীব বলে ওঠে, “ভেতরে এসে বসলে ভালো হয়।”

বাধ‍্য ছাত্রীর মত মাথা নেড়ে ভেতরে থাকা একটা ফাঁকা চেয়ারে গিয়ে বসে লিসা।

বার কয়েক গলা ঝারা দিয়ে রাজীব বলতে থাকে, “যে কারণে এখানে ডাকা, আজ আমি কিছু কথা বলবো। তবে অবশ্যই তা আমার নিজের স্বার্থেই ,কারণ আজ অবধি নিজের কোনো কাজের সাফাই আমি কখনো কাউকে দিইনি আর ভবিষ্যতে না তো দেবো।
তবুও আজ কিছু কথা বলতে চাই। কারণ, আমাদের বিয়েটা হয়ে গেছে। আমরা বিবাহিত। তার আগে আমার কাছে কিছু জানার থাকলে,আমাকে বললে আমি কিছু মনে করবো না।” এইবলে অপরপক্ষের উত্তরের জন‍্য অপেক্ষা করতে থাকে রাজীব। কিন্তু লিসার দিক থেকে কোনো উত্তর বা প্রশ্ন কিছু না পেয়ে নিজেই আবার বলে ওঠে, “তার মানে কিছু বলার নেই। আচ্ছা তাহলে আমিই বলছি, আমার পক্ষে এই সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে চলা সম্ভব নয়। দিদির জেদে বাধ‍্য হয়েছিলাম বিয়েটা করতে । কিন্তু, মন থেকে এই সম্পর্ক আমার পক্ষে মেনে সম্ভব নয়। কারণ, জানতে চাইলে বলতে পারি।”

অপরপক্ষ লিসা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সংক্ষেপে বলে ওঠে, “প্রয়োজন নেই।”

গ্রামের একটা গাঁইয়া মেয়ের মধ‍্যে কান্নাকাটির কোনো লক্ষণ না দেখে মনে মনে বেশ অবাক হয়ে যায় রাজীব। সে ভেবেছিল হয়তো তার বলা কথাগুলো শুনে মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা হবে মেয়েটার। কোথায় যাবে? কী করবে? এই সমস্ত প্রশ্নে জর্জরিত করবে তাকে মেয়েটা। কিন্তু , বিপরীত আচরণ দেখে কিছুটা অবাক হয়ে যায় রাজীব। এবার সে বলে ওঠে, “এক বছরের আগে ডিভোর্স পাওয়া সম্ভব নয়। তাই যেহেতু একই বাড়িতে আমরা আছি তাই আমার মতে এই এক বছর আমরা নিজেদের মধ‍্যে প্রতিবেশী সুলভ আচরণ বজায় রেখে থাকতেই পারি। কেউ কারোর জীবনে দখল না দিয়ে দিনের শেষে এক ছাদের তলায় আলাদা আলাদা ঘরে থাকবো। তাই আমার মনে হয় আমরা নিজেদের মধ‍্যে সাধারণ কথা বলেও থাকতে পারি। শুধু একজনের আর একজনের উপর কোনো অধিকার থাকবে না। আসলে এক বাড়িতে আছি তখন কথা বলে থাকা যেতেই পারে।”

এবারও বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে লিসা বলে ওঠে, ” যেটা ভালো বুঝবেন।”

অপরপক্ষের থেকে সম্মতি পেয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে রাজীব মনে মনে ভাবে , যাক একটা বড় বোঝা নেমে গেল। তাই কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে সে বলতে থাকে, “তাহলে যখন এক ছাদের তলায় থাকবো আমরা । আর তুমি বয়সেও অনেক ছোট আমার থেকে তাহলে আমরা বরং ‘তুই – তুমি’ সম্পর্ক বজায় রাখবো।”

লিসার বড় বড় সুন্দর পটল চেরা চোখ কিছুটা বিস্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে রাজীবের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে , “মানে?”

নিজের পথের সব বাধা সরিয়ে ফেলার আনন্দে আনন্দিত হয়ে রাজীব বলে ওঠে, “মানে – আমি তোমাকে তুই করে কথা বলবো আর তুমি আমাকে তুমি সম্বোধনে।”

এতক্ষণে রাজীবকে অবাক করে লিসা বলে ওঠে , “তা সম্ভব নয়।”

“কেনো সম্ভব নয়?”

এবার স্থির দৃষ্টিতে রাজীবের চোখের দিকে তাকিয়ে হাত দুয়েক দূরত্বে বসে থাকা লিসা দৃপ্ত কন্ঠে বলে ওঠে, “যারা আমার খুব কাছের তারাই আমাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতে পারে। যেমন – জোজো আমার ভাই। মাফ করবেন আপনি আমার কাছের কেউ নন। তাই ‘তুই’ সম্বোধন আপনি আমাকে করবেন না।
আর আমি আপনাকে তুমি বলতে পারবো না। কারণ, অপরিচিত কারোর সাথে কোনো সম্পর্কে জড়ানো বা তাকে নিয়ে অহেতুক কৌতূহল আমার নেই। তাই একজন অচেনা ব‍্যক্তির সাথে আচমকা আলাপে আমি যেমন তাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করি ,আপনাকেও তাই করবো।
তাই আমাদের সম্পর্কটা ‘আপনি – আপনি’ তেই সীমাবদ্ধ রাখা শ্রেয়। তাতে কারোরই অচেনাকে চেনার ভয় থাকবে না।
আর হ‍্যাঁ, নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। এই প্রতিবেশী প্রতিবেশীর ঘরে বা জীবনে কখনোই উঁকিঝুঁকি মারবে না। আশাকরি আপনার আর কিছু বলার নেই। আমি তাহলে এবার আসি।” এইবলে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় লিসা।

এবার সিঁড়ি দিয়ে লিসার বাড়ির দোতলার দিকে উঠে যাওয়ার দিকে একমনে তাকিয়ে থেকে মনে মনে রাজীব ভাবে, “সত‍্যিই কী সে বোঝা নামাতে পারলো! নাকি বোঝাটাই তাকে চরম শিক্ষা দিলো!
সে অবাক হয়ে যায় এইভেবে যে, গ্রামের একটা বাচ্চা ,অল্পশিক্ষিত মেয়ের এতো স্পর্ধা, সাহস পায় কোথা থেকে?”
পরক্ষণেই সে মনে মনে ভাবে, “এই কথাগুলো নিয়ে এতো মাথা ঘামানোর দরকারই নেই তার। সে যা চাইছিল, তা তো পূরণ হতে চলেছে ব‍্যস। আর কিছু দরকার নেই তার। আপনি আর তুমিতে কী যায় আসে!” প্রাথমিকভাবে মনকে সান্ত্বনা দিলেও মনের ভেতরটা কেমন যেন খচখচ করতে থাকে তার।

দুপুরে রাজীব যখন নিজের ঘরে ঘুমিয়ে আছে। তখন ঠিক তার পাশের ঘরে রোজকার মতো দুটো কাগজ নিয়ে চিঠি লিখতে বসে লিসা।
প্রথম চিঠিটা জোজোর জন‍্য লেখা শুরু করে ।

জোজো ,
কেমন আছিস? জানি তুই ভীষণ ভালো আছিস । আমিও ভালো আছি। তোর কথা ভীষণ মনে পড়ে আমার। জানিস অ্যাকোরিয়ামের মাছ গুলোর নাম ঠিক করে ফেলেছি আমি। লাল রঙের মাছটার লালী, কমলা রঙের গোল্ড ফিসটার নাম দিয়েছি সুন্দরী, আর হাঙরের মত দেখতে ফাইটার মাছগুলোর নাম দিয়েছি দানব। আরও অনেক ছোট ছোট মাছ আছে। ওদের নাম দিয়েছি কুচিমুচি।
জানিস, সারাদিন মাছ গুলো জলের মধ‍্যে লেজ উঁচিয়ে সাঁতার কেটেই চলেছে , ওদের বিরাম নেই। আর যখন রঙ বেরঙের ছোট ছোট গোল দানাগুলো ওদের খেতে দিই তখন যা দৃশ‍্য দেখি তোকে কী বলবো । দেখার মত লাগে লেজ উঁচিয়ে সুন্দরী (গোল্ড ফিস) ছুটে আসে সবার আগে।
এখানে গাছ গাছালি কম থাকায় বেশি পাখি নেই। কিন্তু, কাকেরা খুব জ্বালাতন করে। তবে হ‍্যাঁ, আমাদের গ্রামের মত দাঁড় কাক নয়। এখানে সব পাতি কাক।
শোন মন দিয়ে পড়াশোনা করিস। আর ভালো ছেলে হয়ে থাকিস।

লিসা

চিঠিটা লেখার পর চার ভাঁজ করে তাতে আজকের তারিখ বসিয়ে পাশে রেখে দেয় লিসা।
মনে মনে বলে ওঠে, “ফোন করে তোর খোঁজ নেওয়ার উপায় আমার নেই। ফোন করলেই দুর্বল হয়ে পড়বো। তাই চিঠি লেখা। যাতে তুই কখনো এই চিঠিগুলো পেলে বুঝতে পারবি আমি প্রতিদিনই তোকে মনে করেছি।

এবার আরও একখানা কাগজ বের করে সে লিখতে শুরু করে, –

আমি লিসা,
জীবন যে কত বৈচিত্র্যময় তা আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করতে পারছি। আমার ভগবানের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমার সব প্রাপ্তি গুলোই সঠিকভাবে আমার ঝুলিতে দিয়ে আমাকে পরিপূর্ণ করেছে আমার ভগবান। আজ তার প্রমাণ পেলাম।
যখনই জ্ঞানত কোনোকিছুকে আঁকড়ে ধরে ভালোবেসে বাঁচতে চেয়েছি তখনই সেই জিনিসটা আমার থেকে হারিয়ে গেছে। তাই বরাবরই আমার প্রার্থনা ছিল আমি যেন কখনো কোনো সম্পর্কে ভালোবেসে জড়িয়ে পড়ে তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে না চাই। কারণ, ভালোবাসার মানুষেরা হারিয়ে গেলে অনাথ মনের হাহাকার ধ্বনি শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। আজ ভগবান আমার প্রার্থনা শুনেছে ।
আজ প্রথম যখন আমার স্বামী আমাকে জানালো আমাদের বিয়ের অস্তিত্ব একবছরের। আর আমাদের সম্পর্কটা হবে প্রতিবেশীর মত। আমি কথাটা শুনে সত‍্যিই ভীষণ খুশি।
আমার মতে অচেনা সম্পর্ক গুলোই ভালো। যা পথের বাঁকে আসে আবার পথের বাঁকেই মিলিয়ে যায়। যে সম্পর্কে কোনো দায় থাকেনা।
আমারও আর উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা, ভয়ের কোনো কারণ রইলো না।
আমার জীবনের চড়াই উতরাই – এ আজ এক নতুন অধ‍্যায়ের সূচনা হল। আর যা পাঠের মেয়াদ একবছর। আগলে রাখা আর ছেড়ে দেওয়ার মাঝের অংশটুকুই আমার জীবন। আরও নতুন নতুন কী পাঠ অপেক্ষা করছে ,সেটাই দেখার।

—————————–

এ অবধি লিখে চিঠিটা চার ভাঁজ করে রেখে যখন আজকের তারিখ লিখতে ব‍্যস্ত লিসা ঠিক তখনই রান্নাঘরে বাসন পড়ার আওয়াজে সে বুঝতে পারে ‘হ‍্যাংলা’ – র আগমন ঘটেছে।
তাই চিঠি দুটো ঠিক জায়গায় রেখে রান্নঘরের দিকে ছুট লাগায় সে।

পাশের ঘরে ঘুমন্ত রাজীব আচমকা বাসন পড়ার আওয়াজে ধরফরিয়ে বিছানায় উঠে বসে। পরক্ষণে লিসার কোনো বিপদের কথা মনে করে বিচানা ছেড়ে নেমে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ানোর আগেই ডাইনিং রুমের কাছে এসে থমকে যায় রাজীবের পা জোড়া।
এক অদ্ভুত দৃশ‍্য সে দেখতে পায় একবাটি দুধ জামাই আদর করে একটা বেড়ালকে খাওয়াচ্ছে লিসা। আর তার সাথে স্বতস্ফূর্তভাবে ,আনন্দে, উচ্ছ্বাসে কতো কথা বলে চলেছে বাইশ বছরের তন্বী। যার মুখের চঞ্চল অভিব‍্যক্তি রাজীবের মনকেও তার অজান্তেই চঞ্চল করে তুলছে। আর তার পা জোড়া যেন ফেভিকলের আঠায় আটকে গেছে। মন যেন তার সেই স্থান ছাড়তে নারাজ।

(চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here