তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই পর্ব_৮

0
2776

#তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৮

মাশরাত ভীর ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ভীরের মাঝে চোখ যেতেই অবাক হয়ে বললো- “আধুনিক্তা?”
আধুনিক্তা একটা ছেলের কলার চেপে ধরে ইচ্ছে মতো বকছে। একপাশে মল্লিকা মেহরিনের জাপ্টে ধরে কাঁদছে। আর মেহরিন মল্লিকার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিচ্ছে। মাশরাত দ্রুত হেটে গিয়ে আধুনিক্তার কাছ থেকে ছেলেটাকে ছাড়িয়ে নিল। আধুনিক্তা মাশরাতকে দেখে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। দাঁতে দাঁত চেপে মাথা নিচু করে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে।
“কী হয়েছে তোমার? মারছো কেন ওকে?”
আধুনিক্তা চোখ তুলে ছেলেটার দিকে তাকালো। ছেলেটা ভয়ে এদিক সেদিক দেখছে। আধুনিক্তা চারপাশে চোখ বুলিয়ে চিল্লিয়ে বললো-
“ড্রামা চলছে এইখানে? যান এইখান থেকে আপনারা। আর উল্টা পাল্টা কথা বলা বন্ধ করুন ওর ব্যাপারে।”
আধুনিক্তার কথা শুনে অনেকজন চুপচাও চলে গেল। মাশরাত ধমকের স্বরে বললো-
“আধুনিক্তা কী হয়েছে আমাকে বলো।”
আধুনিক্তা এখনো নিশ্চুপ৷ ছেলেটার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
“যদি আমি শুনি তুই আবার আমার বান্ধবীকে ডিস্টার্ব করিস তোর খবর আছে। একদম এলাকা ছাড়া করিয়ে দিব।”
ছেলেটা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেল। আধুনিক্তা হেটে গিয়ে মল্লিকার সামনে দাঁড়িয়ে বললো-
“কাল থেকে যত পর্যন্ত না আমি কল দিব। তুই বাসা থেকে বের হইবি না। কাল থেকে আমরা তিনজন একসাথে ভার্সিটি যাবো গাড়ি দিয়ে। দরকার নেই একা যাওয়ার।”
মাশরাত হেটে গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো-
“আমি অনেকক্ষণ ধরে কিছু জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিচ্ছো না কেন?”
“স্যার মল্লিকা..কিছুক্ষণ পর বলি। রাস্তাঘাটে এসব কথা না বলাই ভালো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা এখন ভার্সিটি যাও।”
“জ্বী স্যার।”
আধুনিক্তা মল্লিকা আর মেহরিন গাড়িতে বসে ভার্সিটি চলে গেল। মাশরাত দ্রুত হেটে ভার্সিটি পৌঁছালো।

মেয়েদের ক্লাস চলছে তাই মাশরাত ছেলেদের প্র্যাকটিস করাচ্ছে। ছেলেদের প্র্যাকটিস শেষ হলে মেয়েদের প্র্যাকটিস শুরু হবে। প্র্যাকটিস করার সময় রিয়াজ হাতে ব্যাথা পেয়েছে ভীষণ। সে বেঞ্চে বসে আইস ব্যাগ হাতে দিয়ে রেখেছে।
“আর ইউ ওকে?”
“ইয়েস স্যার, আপনি খুব ভালো ট্রেইনার। আমার মন বলছে এইবার আমরা অবশ্যই জিতবো।”
“আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো।”
মাশরাত রিয়াজের পাশে বসলো। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মাশরাত বললো-
“তুমি মেহরিনকে পছন্দ করো?”
রিয়াজ লজ্জা পেল মাশরাতের প্রশ্নে। মাশরাতের দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে হুম বললো।
“কিন্তু ও রাজি হচ্ছে না তাই তো?”
“না, আসলে দোষটা আমারই। যখন মেহরিন প্রথমদিন কলেজে গিয়েছিলো আমি ওর র‍্যাগিং করেছিলাম। সেদিন পর থেকেই ও আমাকে দেখতে পারে না। ওর কারণেই আমি বিদেশ যাই নি পড়াশোনা করতে। এই ভার্সিটিতে এসেছি যাতে ওর মনে নিজের প্রতি ভালোবাসা জন্মাতে পারি।”
“তোমার কথা শুনে আমি কনফার্ম হলাম তুমি সত্যি ওকে ভালোবাসো।”
“জ্বী স্যার, কিন্তু মেহরিনের আপনার প্রতি ক্রাশ আছে।”
মাশরাত শব্দ করে হেসে বললো-
“হ্যাঁ আমি জানি। ও আমাকে আগেই বলেছে। কিন্তু আমি ওকে ছোটবোনের মতো দেখি বলেছি। তার কোনো সমস্যা নেই আমি তাকে বোন মানলে।”
“স্যার মেয়েটা পাগল। যাকে দেখে তাকেই ক্রাশ বানিয়ে ফেলে।”
“সে ইচ্ছে করে এইগুলো বলে। যাতে তুমি জেলাস ফিল করো।”
“সত্যি স্যার? ও বলেছে এমন কিছু?”
“না, কিন্তু আমার মনে হয় মেহরিনও তোমাকে পছন্দ করে। কিন্তু তোমার প্রতি তার রাগ আছে তাই মানতে চায় না।”
“হয় তো, ও আমাকে দেখলেই রেগে যায়।”
“যেমন কবির মল্লিকাকে দেখে রেগে যায় ঠিক তেমনই।”
“মল্লিকা, মেয়েটা অনেক ভালো। কবিরকে অনেকবার বলেছি আমি মেয়েটার সাথে রাগারাগি করিস না। কিন্তু ওর একটাই কথা। ও নাকি একদমই পছন্দ করে না মল্লিকাকে।”
“কিন্তু কেন? কাওকে ঘৃণা করার কারণ তো অবশ্যই থাকে।”
“তা আমিও জানি না কী কারণ। কিন্তু কবির একবার বলেছিলো মল্লিকার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো না। তার পরিবারকে নাকি গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছে। এর বেশী কিছু আমি জানি না।”
মাশরাত আর কিছু বললো না। রিয়াজ আরো কিছুক্ষণ রেস্ট করে চলে গেল প্র্যাকটিস করতে। ভার্সিটির ঘন্টা পরতেই তাদের প্র্যাকটিসের সময় শেষ হলো। সবাই চলে গেল ক্লাস করতে। কিছুক্ষণ পর মেয়েরা আসলো। মাশরাতকে সবাই সালাম দিয়ে চলে গেল চেঞ্জ করতে৷ মল্লিকা আর আধুনিক্তাও এসেছে। মল্লিকাকে দেখে এখন ঠিক লাগছে। মেহরিন তাদের বসতে বলে চলে গেল জামা চেঞ্জ করতে। মল্লিকাকে বসিয়ে আধুনিক্তা মাশরাতের পাশে এসে দাঁড়ালো।
“মল্লিকা এখন ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ”
“কী হয়েছিল বলা যাবে? এমন দৃশ্য দেখেছি না জানার পর্যন্ত ভালো লাগবে না। আর যদি বেশী পার্সোনাল হয় বলা লাগবে না।”
“ব্যাপারটা পার্সোনাল হলেও পার্সোনাল না। মল্লিকাদের পুরো এলাকা জেনে গিয়েছে এই ব্যাপারে।”
“কী ব্যাপার?”
“মল্লিকার মা সে ছোট থাকতেই মারা গেছেন। মল্লিকার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন মেয়ের জন্য। তাদের একটা ছেলে আছে। ছেলে মল্লিকার থেকে ৭ বছরের ছোট। গত ৪ বছর আগে মল্লিকার বাবা জানতে পারে উনার দ্বিতীয় স্ত্রী কিছু অবৈধ কাজে জড়িত। তাদের গ্রামের ৭ জন মেয়েকে উনি পাঁচার করাতে সাহায্য করেছেন। উনার নিয়ত ছিলো মল্লিকাকেও কোনো মতো পাঠিয়ে দিবে অন্য দেশে৷ মল্লিকা অনেক অসুস্থ হচ্ছিলো দিন দিন কারণ মল্লিকার খাবারে ড্রাগস মিশিয়ে দিতেন ওর সৎ মা। এই নিয়ে অনেক ঝামেলা হয় ওদের পরিবারে। মল্লিকার বাবা উনার দ্বিতীয় স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে চান। এইটা শুনে উনার দ্বিতীয় স্ত্রী ওদের পরিবারের নামে অনেক মিথ্যে অপবাদ ছড়ায়। যেমন মল্লিকার বাবা নেশা করে প্রতিদিন মারধর করেন। আর মল্লিকা.. তার নাকি চ..চরিত্র ভালো না। ওর নামেও অনেক বাজে বাজে কথা ছড়িয়েছে যা মুখে বলতেও লজ্জা লাগে। গ্রামের মাতবরের কাছে এইসব বলায় তাদের গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়। এখন মল্লিকা তার নানুদের সাথে থাকে। ওর বাবা আর ভাই অন্য বাসায় থাকেন। আর ওর সৎ মাকে ডিভোর্স দেওয়ার পর উনি কোথায় গিয়েছে কেও জানে না। মল্লিকার ব্যাপারপ যেসব অপবাদ ছড়িয়েছিল সবাই বিশ্বাস করে নিয়েছে। এখন রাস্তাঘাটে কিছু কিছু ছেলেরা তাকে দেখলে বাজে অফার করে। আজও তাই হয়েছিলো। মেহরিন আমাকে কল দিয়ে বলায় আমি গিয়ে ছেলেটাকে মারি।”
“তুমি আমাকে তখন বলো নি কেন? ওর হাড্ডি ভেঙে দিতাম ওই সময়ই।”
“যা মেরেছি সারাজীবন মনে রাখবে।”
“খুব ভালোবাসো তাদের?”
“হ্যাঁ, খুব কম সময়ের মধ্যেই আমরা বেস্টফ্রেন্ড হয়ে গিয়েছি। এখন ওদের কষ্ট মানেই আমার কষ্ট।”
মাশরাত মুচকি হাসলো আধুনিক্তার কথা শুনে। কিছুক্ষণ পর প্র্যাকটিস শুরু করলো। আধুনিক্তা মাশরাতের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। আধুনিক্তা মেহরিনকে বলে দিচ্ছে কী করতে হবে না করতে হবে। মাশরাত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আধুনিক্তার দিকে। তার মনে হচ্ছে আধুনিক্তা আজ ট্রেইনার। আধুনিক্তা মাশরাতের চাহনি দেখে চুপসে গেল। কী করবে? সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না বাস্কেটবল খেলা দেখলে। মল্লিকার বোরিং লাগছিলো বসে থাকতে থাকতে। তাই উঠে চলে গেল বাস্কেটবল সেকশন থেকে। মাঠে গিয়ে বেঞ্চে বসে রইলো। সবার অতীত ভালোবাসা নিয়ে হয় না। কিছু কিছু মানুষের অতীত তার পরিবার নিয়ে হয়। আর ভালোবাসা থেকে পারিবারিক অতীত গুলো বেশী ভয়ংকর হয়।

কবিরের ভালো লাগছে না তাই একটা ক্লাস করে বেরিয়ে গেল। মাঠে যেতেই দেখে মল্লিকা বেঞ্চে বসে আছে। কবির বিরক্ত হলো। তাকে দেখলেই মেয়েটা দৌড়ে আসবে। এত অপমানিত হয় কবিরের কাছে সে তবুও হার মানে না। কবির দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পাশ কাটাতেই থতমত খেয়ে গেল। সে কী স্বপ্ন দেখছে? মল্লিকা আজ তার পেছনে আসলো না যে। হয় তো তাকে খেয়াল করে নি। কবিরের ভালো লাগলো না বিষয়টা। ঘুরে ধীরেপায়ে হেটে আবার আগের জায়গায় চলে গেল। মল্লিকা মাথা নিচু করে রেখেছে৷ কবিরের মেজাজ বিগড়ে গেল। মল্লিকা ওকে দেখছে না কেন? কবির কিছুক্ষণ ভেবে আইডিয়া বের করলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে কানে ধরে মল্লিকার কিছুটা কাছে গিয়ে একা একা কথা বলতে লাগলো। মল্লিকা এখনো মাথা নিচু করে রেখেছে। কবির আরো উচু গলায় কথা বলতে লাগলো। এখনো মল্লিকা তাকে ইগনর করছে। কবির মেজাজ এইবার বেশী বিগড়ে গেল। পকেটে মোবাইল রেখে দ্রুত হেটে গিয়ে মল্লিকার সামনে দাঁড়ালো। কারো উপস্থির টের পেয়ে মল্লিকা মাথা তুলে দেখে আবার নিচের দিকে তাকালো। কবির আরো রাগলো। রাগে গজগজ করতে করতে বললো-
“এই মেয়ে সমস্যা কী তোমার?”
মল্লিকা মাথা তুলে কবিরের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো-
“আজ তো তোমার পিছু নেই নি বকছো কেন?”
কবির বুঝতে পারলো মল্লিকার মন খারাপ। চোখ দেখে মনে হচ্ছে কান্না করেছে কিছুক্ষণ আগে। কবিরের ভালো লাগলো না মল্লিকার মন খারাপ দেখে।
“কী হয়েছে তোমার মন খারাপ?”
“না তো”
“মিথ্যে বলছো কেন?”
মল্লিকা দাঁড়ালো। তার ভালো লাগছে না এখন কথা বলতে। কবিরের দিকে তাকিয়ে বললো-
“সত্যি বলছি, আর একটা কথা বলার ছিলো আপনাকে। সরি, এতদিন অতিরিক্ত ডিস্টার্ব করেছি। আর করবো না ওয়াদা রইলো।”
“তোমার মুখে আপনি শব্দ মানায় না। তুমি, তুই খুব মানায়। আর হঠাৎ কী হলো যে এত ভালো হয়ে গেলে।”
“আমি ভালোই। শুধু কেও বিশ্বাস করতে চায় না। ভাগ্যে, চরিত্রে এমন দাগ লেগেছে যা কখনে মুছতে পারবো না। আমি বুঝতে পেরেছি আপনার বিরক্ত হওয়ার কারণ। এইবার সত্যি সত্যি বলছি আর ডিস্টার্ব করবো না। এ..এখন আসি।”
বলেই মল্লিকা দ্রুত হেটে ভার্সিটির ভেতরে চলে গেল। কবির থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার মাথা কাজ করছে না। মল্লিকার কথাগুলো তার বুকে গিয়ে বিঁধছে।

আজকের মতো প্র্যাকটিস শেষ হলো। সবাই এক এক করে জামা পরিবর্তন করে চলে গেল। মাশরাত তার ব্যাগ গুছিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটা ধরলো। হঠাৎ তার পিঠে কিছু এসে বাড়ি লাগলো। বল বাউন্সের শব্দ আসছে। মাশরাত বুঝতে পারলো তার পিঠে কেও বল ছুরে মেরেছে। কিন্তু ব্যাথা লাগে নি। মাশরাত ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে দেখে আধুনিক্তা দাঁড়িয়ে আছে হাতে বল নিয়ে। মাশরাত ভ্রু কুঁচকালো। আধুনিক্তা বল বাউন্স করতে করতে এগিয়ে এসে বললো-
“মিস্টার মাশরাত তোফাজ্জল হোসেন। হয়ে যাক আজ এক ম্যাচ?”
“নিজের মৃত্যু কী নিজে ডেকে আনছো?”
“কিছু হবে না আমার। আসুন দেখি আজ কে জিতে ন্যাশনাল এওয়ার্ড জয়ী প্লেয়ার নাকি বাস্কেটবল ট্রেইনার।”
“হেরে যাবে মিস ন্যাশনাল এওয়ার্ড জয়ী।”
“ভবিষ্যত উপর ওয়ালা ছাড়া কেও জানে না। কিন্তু আপনার এই কথাটা প্রমাণ করার জন্য আপনার খেলতে হবে।”
“ওকে, কিন্তু তুমি সাবধানে খেলবে।”
“সেটা আমার উপর ছেড়ে দেন।”
মাশরাত হাসি দিয়ে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামালো।

বল মাশরাতের হাতে। আধুনিক্তা তার বরাবর দাঁড়িয়ে আছে।
“বল আমাদের মাঝে বাউন্স করতে থাকবে। আমরা দুজনই মনে মনে এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুনবো। গুনা শেষ হতেই বল নিবো। তারপর দেখবো কে কাকে হারায়। ডান?”
“ডান”
মাশরাত বল তাদের মাঝে ছুরে মারলো। বল বাউন্স করছে। দুজনের দৃষ্টি বলের দিকে। দুজনই মনে মনে সেকেন্ড গুনছে। ৫ সেকেন্ড হতেই দুজন হামলে পড়লো বলের উপর। আধুনিক্তা বল নিয়েই বাউন্স করতে করতে দৌড়ে গেল। মাশরাত ইমপ্রেস হলো। মেয়েটা খেলায় সত্যি অনেক ভালো। সেও দৌড়ে গেল আধুনিক্তার পেছনে। আধুনিক্তা গিয়ে বল বাস্কেটে ফেলে দিল। কিন্তু লাভ হলো না। মাশরাত এসে বল নিয়ে অন্যদিকে দৌড়ে গেল। আধুনিক্তাও তার পেছনে গেল। দুজনই বল কাড়াকাড়ি করে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু কেও কাওকে জিততে দিচ্ছে না। মাশরাত আধুনিক্তা দুজনের মুখে হাসি ফুটে আছে। আধুনিক্তা দূর থেকেই বাস্কেটে বল ছুঁড়ে মারলো কিন্তু বল ধাক্কা লেগে পড়ে গেল। তা দেখে মাশরাত হাসতে হাসতে শেষ। আধুনিক্তা কোমড়ে হাত দিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে রইলো মাশরাতের দিকে। মাশরাত বললো-
“বলেছিলাম না আমার সাথে পাড়বে না।”
“মাত্র ১০ মিনিট হয়েছে মিস্টার ট্রেইনার। খেলা আরো বাকি আছে।”
“তাহলে আমার থেকে বল নিয়ে দেখাও।”
বলেই মাশরাত দৌড়ে গিয়ে বল নিয়ে নিল। আধুনিক্তাও দৌড়ে গেল মাশরাতের পেছনে। মাশরাত বল হাতে নিয়ে হাত উঁচু করে বললো-
“হাত থেকে বল নিয়ে দেখাও।”
“এইটা চিটিং খেলায় এমন নিয়ম নেই।”
“কাম’অন মিস আধুনিক্তা আমরা আসল খেলা খেলছি না তাই নিয়মের কথা বলতে হবে না।”
“তবুও আমি নিতে পারবো না। মানে আমার হাইট তো দেখুন।”
“তোমার হাইটটা খুব কিউট।”
বলেই মাশরাত হা হা করে হেসে উঠলো। আধুনিক্তা মুখ লটকালো। আজ সে খাটো বলে। দ্রুত গিয়ে মাশরাতের হাত থেকে বল নেওয়ার চেষ্টায় জড়িয়ে গেল। মাশরাত এখনো হাসছে। আধুনিক্তা হঠাৎ মাশরাতকে কাতুকুতু দিতে শুরু করলো। মাশরাতের প্রচুর কাতুকুতু আছে। সে তার থেকে বল ফেলে হাসতে হাসতে বললো-
“চিটিং করছো এটা খেলার নিয়ম না।”
“যেহেতু আমরা আসল খেলা খেলছি না তাই নিয়মের কথা বলতে হবে না।”
“বলেই আধুনিক্তা দৌড়ে গিয়ে বল নিয়ে নিলো।
“তবে রে আমার ডায়লগ আমাকেই?”
“খেলার জন্য বুদ্ধি দরকার। লম্বা তো জিরাফও হয়।”
বলেই আধুনিক্তা দৌড়ে গেল। মাশরাত হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। আধুনিক্তা বল বাস্কেটে ফেলে লাফিয়ে উঠলো। আধুনিক্তার আনন্দ দেখে মাশরাতেরও খুব আনন্দ হলো। আধুনিক্তার হাসি দেখে তার বুকে তুফান উঠে গেল। আধুনিক্তা নাচতে নাচতে এসে মাশরাতের সামনে দাঁড়ালো।
“তো এখন বলুন মিস্টার ট্রেইনার কেমন লাগছে?”
“একটা মেয়ে আজ আমাকে হারিয়ে দিলো। সত্যি অবাক না হয়ে পারলাম না। কথাটা লুকিয়ে রাখতে হবে। কাওকে বলো না এটা আমার সম্মানের ব্যাপার স্যাপার।”
আধুনিক্তা শব্দ করে হেসে উঠলো। মাশরাতের দৃষ্টি আধুনিক্তার হাসির দিকে৷ মেয়েটা আজ প্রথম এত হাসতে দেখছে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ আসলো। দুজনই দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে ভার্সিটির দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে।
“সাব পনে যান নাই?”
“না আমার স্পেশাল ছাত্রীর খেলা দেখছিলাম।”
দারোয়ান কিছু বুঝলো না। আধুনিক্তাকে দেখে অবাক হয়ে বললো-
“আরে আপনেও এখানে? চেয়ারম্যান সাব আপনেরে পাগলের মতো খুজতাছে।”
“দাদাই এমনই, চলে যাবো এখন আমরা। চলুন স্যার যাওয়া যাক।”
“আমি তোমার ট্রেইনার নই। তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারো।”
“নাম ধরে ডাকার জন্য হলেও একটা সম্পর্কের প্রয়োজন হয়।”
“ঠিক বললে তাহলে আমাদের একটা সম্পর্কের প্রয়োজন।”
মাশরাত কিছুক্ষণ ভাবলো। ভেবে হাসিমুখে আধুনিক্তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো-
“ফ্রেন্ডস?”
আধুনিক্তা হেসে দিলো মাশরাতের কথা শুনে। হাসিমুখে হাত মিলিয়ে বললো-
“ফ্রেন্ডস”

রাতেরবেলা…..
আধুনিক্তা পড়ছিলো। আজ ম্যাডাম বলেছে আগামী সপ্তাহে এক্সাম নিবে। যত ছোট এক্সাম হোক তার পাশ হতে হবে। নিজের জন্য না দাদাইর জন্য। দাদাই চেয়ারম্যান। যদি আধুনিক্তা ফেইল হয় দাদাইর সম্মান ডুববে। সবাই তো বলবে চেয়ারম্যানের নাতনি ফেইল করেছে। হঠাৎ মোবাইলের মেসেজ টন বেজে উঠলো। আধুনিক্তা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট নোটিফিকেশন। ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেল৷ মাশরাত ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে। আধুনিক্তা খুশীতে আত্মহারা। প্রায় পাঁচ মিনিট পর ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করলো। তার বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে। তখনই মেসেজ আসলো। কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজ অন করে দেখে মাশরাত লিখেছে-
“ফ্রি আছো?”
আধুনিক্তা রিপ্লাই করলো-
“হ্যাঁ”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“করো”
“তোমার কী সত্যি কোনো কষ্ট হয় নি খেলে? মানে আমার খুব টেনশন হচ্ছে। যদি তোমার হার্টে আবার সমস্যা দেখা দেয়?”
“আমি সত্যি বলছি আমি ঠিক আছি। টেনশন নিও না। আমি তিন বছর রেস্ট নিয়েছি। ঔষধ, খাবার সব টাইম মতো খেতাম। তাই এখন সুস্থ আছি।”
“জেনে ভালো লাগলো।”
“একটা কথা বলি?”
“বলো”
আধুনিক্তা কী লিখবে বুঝতে পারছে না। কী বলতে চেয়েছিলো সে নিজেও জানে না। কিছুক্ষণ ভেবে লিখলো-
“তুমি এখন একজন বাস্কেটবল ট্রেইনার। তার মানে তুমি অনেক খেলোয়াড় ছিলে।”
“সবাই এইটাই বলে।”
“তার মানে তোমার কাছে মেডেলের অভাব নেই।”
মাশরাত হাসলো আধুনিক্তার মেসেজ দেখে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকালো। মাশরাতের ঘরের একটা দেয়াল জুড়ে সব মাশরাতের মেডেল আর কাপ সাজানো। মাশরাত মোবাইলের দিকে তাকিয়ে লিখলো-
“৫ বছর আগে ইন্টারন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন সিলেকশনে আমি ছিলাম।”
“হেই তখন তো..তার মানে তুমি ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেটবল প্লেয়ারের খেতাব পেয়েছো।”
মাশরাত উত্তর দিলো না। তার হাসি আসছে খুব। আধুনিক্তা হয় তো তখনকার নিউজপেপার দেখেনি। মাশরাতের ছবি ফ্রন্ট পেইজে ছাপানো হয়েছিলো। আধুনিক্তা আবার মেসেজ দিলো-
“বাহ বাহ আমার গর্ব হচ্ছে তোমার প্রতি। আই এম প্রাউড অফ ইউ মাই বয়।”
মাশরাত আবার হেসে উঠলো। মেয়েটা এড কমেডি কিভাবে করতে পারে? মাশরাত হাসি থামিয়ে লিখলো-
“আপনাকে ধন্যবাদ ন্যাশনাল এওয়ার্ড জয়ী। রাত হয়ে গিয়েছে এখন ঘুমান। আগামীকাল দেখা হবে আল্লাহ হাফেজ।”
“ওকে বাই আল্লাহ হাফেজ।”
মাশরাত মুচকি হেসে মোবাইল পাশে রেখে লম্বা নিশ্বাস ফেললো। ইদানীং অতিরিক্ত আনন্দ অনুভব হচ্ছে তার। এখন এতকিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না তার। হেলান ছেড়ে বালিশ ঠিক করে শুয়ে চোখ বন্ধ করলো।

আধুনিক্তা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোনায় মুচকি হাসি। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে ভ্রু কুঁচকালো। তার কাছে সবকিছু নতুন মনে হচ্ছে। আনন্দের বরফ জমে যাচ্ছে মনে। পড়ার টেবিলে একটা ফুলদানি রয়েছে। ফুলদানিতে আধুনিক্তা ২ টো কাপড়ে তৈরী গোলাপফুল রেখেছে। গোলাপফুল গুলো হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর কী যেন ভেবে দৌড়ে গিয়ে আলমারি খুলে লকআপ থেকে একটা ডাইরি বের করলো। ডায়েরিটা খুলে শেষ পৃষ্ঠায় চোখ বুলালো-
“প্রশ্ন,
ভালোবাসার অনুভূতি কেমন হয়?
উত্তর,
এই প্রশ্নের উত্তর অনেক রকমের আছে। যদি সহজ ভাষায় বলা যায়, তাহলে ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি যা মানুষকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়। কেও প্রথমবার প্রেমে পড়লে তার কাছে পুরো দুনিয়া নতুন মনে হয়। অকারণে কারো কথা ভেবে মুচকি হাসিকেই বলা হয় ভালোবাসার অনুভূতি।”

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here