তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই পর্ব_৩৪+ ৩৫

0
2528

#তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৩৪+ ৩৫

বর্তমান….
কলের টন বাজায় মাশরাতের ঘোর কাটলো। সে আধুনিক্তার সব ঘটনা শুনতে শুনতে যেন হারিয়ে গিয়েছিল। তার মাথা শূন্য লাগছে। সে কিছু ভাবতে পারছে না। তাবাসসুমের মা একপাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। বাবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আধুনিক্তা মাশরাতের পাশে দাঁড়ানো। আধুনিক্তার বাবা মায়ের করছে। মাশরাত যদি ভুল বুঝে সব শেষ। আধুনিক্তা প্রায় পাগল হয়ে যাবে। মেয়ে অনেক ভালোবাসে মাশরাতকে উনারা জানেন। মাশরাত পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে মালিহা কল দিয়েছে। রিসিভ করে কানে ধরলো-
“হ্যাঁ বল”
“ভাই তুই কি বেরিয়েছিস?”
“না বের হবো, কি হলো তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন?”
“আম্মুর প্রেশার লো হয়ে গিয়েছে একদম। আমি ওরস্যালাইন খাইয়ে দিয়েছি তবুও মাথা তুলতে পারছে না। শুয়ে আছে, আর খুব ঘামছে আম্মু। খুব জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। আ..আমি না কিছু বুঝতে পারছি না।”
“তুই টেনশন নিস না আমি এখনই আসছি। আম্মুটর ঔষধ আছে না-কি শেষ?”
“ঔষধ ডাক্তার পাল্টিয়ে দিয়েছে নতুন ঔষধ নেই।”
“তুই নাম মেসেজ কর আমি নিয়ে আসছি।”
“ঠিক আছে”
মাশরাত কল কাটলো। তার জীবন কোন পর্যায়ে আসলো তার মাথা কাজ করছে না। আধুনিক্তা মাশরাতের কাঁধে হাত রাখলো। মাশরাত আধুনিক্তার দিকে তাকিয়ে বলল-
“আম্মু অসুস্থ আমার যেতে হবে।”
“আম্মু অসুস্থ? চলো আমিও যাব।”
“না না তুমি থাকো আমি যাই।”
“আমাকে ছেড়ে যাচ্ছো?”
“পাগল না-কি ছেড়ে যাব কেন? আমি বাসায় পৌঁছে কল দিয়ে তোমাকে জানাবো আম্মু কেমন আছে। আর আমি তো আসবোই পরশুদিন।”
“সত্যি আসবে?”
মাশরাত মাথা নাড়াল। আধুনিক্তার তবুও ভয় করছে। তার ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। মাশরাতকে এখনো সব কথা বলা হয় নি। বাকি ঘটনা জানলে যদি মাশরাত তাকে ভুল বুঝে। মাশরাত আধুনিক্তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি আসছি আজ, পরশুদিন ওকে নিতে আসবো।”
“তোমার আম্মু অসুস্থ তুমি নিশ্চিন্তে যাও আমরা আসছি।”
“শুধু প্রেশার লো হয়েছে বাবা। ইন শাহ আল্লাহ কিছু হবে না। আসি আল্লাহ হাফেজ সবাইকে।”
মাশরাত আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। দ্রুত হেটে বেরিয়ে গেল। পরিস্থিতি হঠাৎ নিরব হয়ে গেল। কেও কিছু বলছে না। আধুনিক্তা ধীরে ধীরে হেটে গিয়ে ধপ করে সোফায় বসলো। মাথা নিচু করে কপালে হাত দিয়ে রেখেছে৷ মাথা ভার হয়ে গিয়েছে তার। মা এসে আধুনিক্তার পাশে বসলেন। আধুনিক্তার মাথায় হাত রেখে বললেন-
“তুমি টেনশন নিও না আম্মু। মাশরাত বুদ্ধিমান মানুষ। সে কখনো তোমাকে দোষারোপ করবে না।”
আধুনিক্তা মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকাল।
“আমি টেনশন করছি না আম্মু। আমি ভাবছি এরপরে কি কি ঘটেছে সেগুলো কিভাবে বলবো? তাকে এখনো সবকিছু বলা হয় নি।”
বাবা এগিয়ে এসে আধুনিক্তার পায়ের সামনে হাঁটু গেঠে বসে বললেন-
“আম্মু শুনো, মাশরাত অলরেডি এতকিছু শুনে ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছে। তুমি ওকে বাকি কথা পরে বইলো।”
“তা ঠিক আছে আব্বু, কিন্তু আমি ভাবছি ও নিজেকে সামলাতে পারবে তো? আমার মনে হচ্ছে আমার যাওয়া উচিত বাসায়।”
“বাবা মা এসেছে, এখন নাহয় উনাদের সাথে সময় কাটাও। আমি আর তোমার আম্মু যাচ্ছি তোমাদের বাসায় তোমার শ্বাশুড়ি মাকে দেখতে। যদি তোমার যেতে ইচ্ছে করে আমি তোমাকে রাতে দিয়ে আসবো।”
আধুনিক্তা আর কিছু বলল না। বাবাকে দাঁড়াতে বলে নিজেও দাঁড়াল। তাবাসসুমের বাবা মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল-
“মা বাবা, আপনারা আমাকে নিয়ে একদম টেনশন করবেন না৷ এখন গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন।”
তাবাসসুমের মা আধুনিক্তার গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেলেন। বাবাও এসে আধুনিক্তার মাথায় হাত রাখলেন। আধুনিক্তা মুচকি হেসে দুজনকে জড়িয়ে ধরলো।

মাশরাত হেলেদুলে হাটছে। বেশ এলোমেলো লাগছে তার নিজেকে। ফার্মেসী গিয়ে মায়ের জন্য ঔষধ কিনে রিকশা নিলো। তার মাথা ঘুরছে। ৩ বছর সে অপেক্ষা করেছিল তাবাসসুমের। কত কিছু ভেবেছিল মেয়েটার সম্পর্কে। এখন সে বুঝলো তার মন কেন মানতে চাচ্ছিল না তাবাসসুম বিপদে আছে। মাশরাতের গলা ধরে আসছে। মেয়েটা এখনো জীবিত লাশ হয়ে পড়ে আছে। আচ্ছা মাশরাত যদি তার সাথে দেখা করে তাবাসসুম তাকে দেখে ঠিক হয়ে যাবে? মাশরাত একবার হলেও তাকে দেখতে চায়। কত বছর হলো সে তাবাসসুমের মায়াবী চেহারা দেখছে না। না, সে কখনো তাবাসসুমকে নিজের জীবনে চাইবে না। এমনটা করলে আধুনিক্তার সাথে প্রতারণা হবে। মাশরাত আপাতত মায়ের কথা ভাবলো। এখন মায়ের তা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। কি হচ্ছে এসব মাশরাতের জীবনে। সে ক্লান্ত এতকিছু সহ্য করতে করতে। মাশরাত বাসায় পৌঁছালো। মা ঘরে শুয়ে আছে। মালিহা মায়ের পাশে খাটে বসে আছে। মাশরাত ঔষধ নিয়ে দ্রুত ঘরে প্রবেশ করলো। মালিহা দাঁড়িয়ে পরলো মাশরাতকে দেখে।
“আম্মু এখন কেমন আছে?”
“অনেক ঘামছিল তাই গোসল করিয়েছি। মাথা না-কি খুব ঘুরছে তাই ঘুমিয়ে আছে।”
“ঔষধগুলো নে, আম্মুকে খাইয়ে দে। আমি আসছি ফ্রেশ হয়ে।”
“ওকে, কিন্তু তোর চোখদুটো লাল কেন? কিছু হয়েছে ভাই।”
“না, তুই এখন আম্মুর খেয়াল রাখ। আমি একটু গোসল করতে চাই বাহিরে খুব রোদ।”
“আচ্ছা যা।”
মাশরাত তার ঘরে চলে আসলো। জামা নিয়ে বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার অন করে নিচে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি শাওয়ারের দিকে। তার মনে হচ্ছে পানির ফোটা গুলো খুব ধীরে ধীরে চেহারায় এসে পরছে তার। মাশরাত চোখ বন্ধ করে ফেলল। পানিতে মাশরাত ভিজে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। হঠাৎ চোখের কোনা বেয়ে এক ফোটা অশ্রু পরলো। মাশরাত চোখ খুলে তারাতাড়ি চোখ মুছলো। কিন্তু সে তার চোখের পানি চিনতে পারলো না। শাওয়ার থেকে বেরিয়ে আসা শত ফোটার মাঝে হারিয়ে গেল। ঠিক তেমনই যেমন মাশরাত এখন হারিয়ে গিয়েছে। সে যেন নিজেকে খুঁজতে পারছে না। সে একা তবুও মনে হচ্ছে কষ্টের ভীরের মাঝে সে হারিয়ে গিয়েছে।

রাতেরবেলা…..
আধুনিক্তা গাড়ির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। তার চোখ দুটো ফুলে আছে। কাঁদতে কাঁদতে নাকও লাল করে ফেলেছে। বাবা এক নজর আধুনিক্তাকে দেখে আবার ড্রাইভিং এ মনোভাব দিলো। মাশরাতের বাড়ির পাশে গাড়ি থামিয়ে আধুনিক্তার দিকে তাকাল। আধুনিক্তা বাবার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। বাবা ইশারায় বলল গাড়ি থেকে বের হতে। বলে বাবা গাড়ি থেকে বের হলো। আধুনিক্তাও দরজা খুলে বের হয়ে বাবার দিকে এগিয়ে আসলো। আধুনিক্তাকে চুপ দেখে বাবা হেঁসে আধুনিক্তার গাল ধরে টেনে বলল-
“আমার ছোট্ট জেদি মেয়েটা সাংসারিক হয়ে উঠবে খুব শীগগির। আমি তোমার হাতের কান্না খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবো।”
আধুনিক্তা হঠাৎ কেঁদে উঠলো। বাবার হাসি মিশে গেল। মেয়েকে হাসানোর যথেষ্ট চেষ্টা করছেন উনি। আধুনিক্তা বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদছে। বাবা আধুনিক্তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল-
“কান্না করলে তুমি দুর্বল হয়ে যাবে। এখন নিজেকে শক্ত রাখো। যা হবার হবে আম্মু। আর হ্যাঁ, মাশরাত যদি এসব শোনার পর তোমাকে ভুল বুঝে আমি ওকে ছাড়বো না। এসব ঘটনার মাঝে আমার মেয়েটা সবচেয়ে বেশী ইনোসেন্ট। যা করার আমরা করেছি। ভুলে করলেও করেছি। তাই শাস্তি ভোগ করবো আমরা। আমাদের মেয়ে না।”
“আমাকে মাফ করে দাও আব্বু। আমি ভালো মেয়ে হতে পারলাম না।”
“ধ্যাত পাগল আমার মেয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মেয়ে। এখন মুখে হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে যাও। ইউ আর মাই ব্রেভ গার্ল, রাইট?”
আধুনিক্তা বাবার দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। বাবা মুচকি হেসে আধুনিক্তার কপালে চুমু দিয়ে বলল-
“মাই গুড বাচ্চা, এখন ভেতরে যাও। তোমার শ্বাশুড়ি আম্মু এখন সুস্থ আছে আমরা দেখে গিয়েছিলাম।”
“আমার উচিত ছিল তখনই তোমাদের সাথে আসার। এত রাত করে তুমি কষ্ট করে আমাকে দিতে আসলে। সাবধানে যেও আব্বু।”
“ওকে”
আধুনিক্তা আর একবার বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। বাবা মুচকি হেসে মেয়েকে বলল ভেতরে যেতে। আধুনিক্তা বাবাকে বিদায় জানিয়ে ভেতরে ঢুকলো। কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর মালিহা এসে জিজ্ঞেস করলো কে। আধুনিক্তার জবাব শুনে মালিহা দরজা খুলল।
“ভাবী তুমি এত রাতে আসলে?”
“হুম, মা কোথায়?”
“আম্মু ঘুম, ভেতরে আসো।”
আধুনিক্তা ভেতরে ঢুকে সোজা তার শ্বাশুড়ি মায়ের ঘরে গেল। মা আধশোয়া অবস্থায় বসে পানি পান করছেন। আধুনিক্তাকে দেখে অবাক হলেন। আধুনিক্তা দ্রুত এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। চিন্তা হচ্ছিল তার খুব। মা মুচকি হেসে আধুনিক্তাকে মুচকি হেসে বললেন উনি ঠিক আছে। মালিহা মায়ের সাথেই ঘুমিয়েছে রুমে। আধুনিক্তা কিছুক্ষণ মা আর মালিহার সাথে কাটিয়ে উঠে দাঁড়াল। মালিহাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো মাশরাত তার ঘরে। রাতে না খেয়ে ঘুমাতে চলে গিয়েছে। আধুনিক্তা রান্নাঘরে গিয়ে মাশরাতের খাবার গরম করে প্লেটে ঢেকে ঘরে নিয়ে গেল। দরজা হালকা খোলা। আধুনিক্তা দরজা ঠেলে ভেতরে গেল। পুরো ঘর অন্ধকার। আধুনিক্তা অবাক হলো। দু’বার মাশরাতকে ডাকলো। কিন্তু মাশরাত জবাব দেয় নি। আধুনিক্তা ঘরের লাইট অন করলো। ঘর আলোকিত হতেই তার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো। মাশরাত খাটের পাশে মাটিতে বসে খাটে এক হাত রেখে মাথা নিচু করে রেখেছে। আধুনিক্তা প্লেট রেখে দ্রুত এগিয়ে গেল মাশরাতের দিকে। মাশরাতের পাশে হাটু গেড়ে বসে মাশরাতের গালে হাত রাখলো। মাশরাত লাইটের দিকে তাকিয়ে আবার আধুনিক্তার দিকে তাকাল।
“বন্ধ করে রাখো মাথা ব্যাথা করছে আমার।”
“নিজেকে এভাবে অন্ধকারে বন্দী করে রাখলে হবে? আমি জানি তুমি আমার উপর রেগে আছো।”
“না, ভুল বুঝছো আমি রাগ করি নি কারো উপর। তুমি এসে পরলে যে?”
“আমার ভালো লাগছিল না বাসায়। খুব চিন্তা হচ্ছিল তোমার জন্য।”
“আমি ঠিক আছি, তুমি খাওয়া দাওয়া করেছ? হয় তো করো নি। তুমি বসো আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি।”
আধুনিক্তার হাত শক্ত করে ধরে চোখে চোখ রেখে বলল-
“তুমি ভালো থাকার নাটক করতে পারবে না আমার সামনে। আমি জানি তোমার উপর দিয়ে কি যাচ্ছে।”
“আমি পরিস্থিতি মেনে নিতে পারি। এটা আমার জন্য ব্যাপার না। হ্যাঁ আমার খারাপ লাগছে তাবাসসুমের জন্য। কারণ এক সময় আমি ওকে ভালোবাসতাম। ওর এমন অবস্থা আমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। ও একদম নির্দোষ ছিল। আমার ভুল হয়েছে জানো, আমার উচিত ছিল তার কথায় রাজি না হওয়া। যদি সেদিন আমি রাজি না হতাম তার এক্সিডেন্টও হতো না। এখন আমার কিছু বলার নেই। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। আমি দোয়া করি তাবাসসুম যাতে সুস্থ হয়ে যায়।”
“মাশরাত শুনো, তোমাকে সব ঘটনা বলা হয় নি।”
“আর কি ঘটনা?”
“আমার দ্বিতীয়বার এক্সিডেন্ট হবার পর আবার যখন সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম।”
মাশরাত তাকিয়ে রইল আধুনিক্তার দিকে। আধুনিক্তা কিছুটা কাছে গিয়ে মাশরাতের গা ঘেষে বসলো। আধুনিক্তা হঠাৎ অপ্রস্তুত হলো। সে কিভাবে কি বলবে বুঝতে পারছে না। মাশরাত আধুনিক্তার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল-
“তুমি চিন্তা করো না, যত কঠিন কথা শুনি তোমাকে দোষারোপ করবো না। তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি আধুনিক্তা। আমি তোমাকে ভালো মতো চিনি। তুমি কখনো জেনেশুনে কাওকে কষ্ট দিবে না।”
আধুনিক্তা মাথা নিচু করে কেঁদে উঠলো। নিচের ঠোঁট কামড় দিয়ে ধরে কাঁদছে সে। মাশরাত আধুনিক্তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল-
“শান্ত হও, বলো যা বলার। আমি সবসময় প্রস্তুত আছি।”
আধুনিক্তা মাথা তুলে মাশরাতের দিকে তাকাল। সে নিশ্বাস নিতে পারছে না কাঁদতে কাঁদতে। মাশরাত আধুনিক্তার মাথায় হাত বুলিয়ে চোখ মুছে দিলো। আধুনিক্তা লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে বলা শুরু করলো।

অতীতের অংশ…..
এয়ারপোর্ট থেকে আধুনিক্তাকে হসপিটাল নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তাররা আধুনিক্তার চেকআপ করে বলল আর্জেন্ট হার্ট ট্রান্সফার করতে হবে নাহলে আধুনিক্তাকে বাঁচানো যাবে না। আধুনিক্তারা এসেছে তাবাসসুমের বাবা শুনে হসপিটাল আসলেন। তাবাসসুমের মা তাবাসসুমের সাথে বাসায়। আধুনিক্তার বাবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাবাসসুমের বাবা এসে উনার কাঁধে হাত রাখলেন। কারো স্পর্শ পেয়ে বাবা ঘাড় ঘুরলেন। তাবাসসুমের বাবাকে দেখে উনি কেঁদে উঠলেন।
“ভাইয়া আমার মেয়েটা, এত তারাতাড়ি হার্ট ট্রান্সফার কিভাবে করাবো? ডোনার খুঁজতে খুঁজতে তো মাস লেগে যাবে।”
“চিন্তা করছেন কেন? যা হবার হবে। আর আধুনিক্তার কিছু হবে না। কয়দিনের মধ্যে অপারেশন করতে হবে।”
“সার্জন বললেন তিনদিনের মধ্যে।”
“ঠিক আছে, চলুন আমরা অন্যান্য হসপিটালে যাই। প্রতিদিন এই দুনিয়ায় মানুষদের মৃত্যু ঘটে। যদি এমন কোনো দয়ালু পেয়ে যাই যে তার পরিবারের মৃত সদস্যের হার্ট ডোনেট করতে চায়।”
“পাবো তো?”
“আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা রাখুন। ইন শাহ আল্লাহ আমরা পাবো।”
সে সময় থেকে দুজন মিলে পুরো এলাকার সব হসপিটালে ডোনার খুঁজে বেরিয়েছে। কিন্তু ডোনার খোঁজা সহজ না। কেও রাজি হয় নি হার্ট ডোনেট করতে। এই তিনদিন আধুনিক্তার বাবা ঠিক মতো বিশ্রাম পর্যন্ত নেয় নি। আধুনিক্তার প্রতিদিন নাক দিয়ে রক্ত বের হয়৷ যা খাবার খায় সব বমি হয়ে যায়। মা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। প্রতিদিন সব হসপিটালে হার্ট সার্জারী হয়ে থাকে। ভাগ্যবান মানুষরা ডোনার পেয়ে যায়। অভাগাদের কপালে দুঃখ-ই রয়ে যায়। ডাক্তাররা নিজে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন ডোনার খোঁজার। কিন্তু সম্ভব হয়ে উঠছিল না। আর মাত্র ১ দিন সময় দেওয়া হলো ডোনার খোঁজার। আধুনিক্তা তার বেডে হেলান দিয়ে বসে আরমানের সাথে গেমস খেলছিল। সে আড়ালে শুনেছে ডোনার খুঁজে পাওয়া যায় নি। তার যদি এইভাবেই মৃত্যু হয় চুপচাপ মেনে নিবে। কিন্তু শেষ বারের মতো একবার মাশরাতের সাথে সে কথা বলতে চায়। বাবা মা চুপচাপ পাশের সিটে বসে আছেন। দাদাই দাদী দিন রাত নামাজে ব্যস্ত থাকেন নাতনির জন্য। শত শত শত দরিদ্রদের টাকা দান করেছেন যাতে উওর ওয়ালা খুশী হয়ে মুখ তুলে তাকায়। আধুনিক্তা বাবার উদ্দেশ্যে বলল-
“আমি একটা রিকুয়েষ্ট করি?”
বাবা মা দুজনই আধুনিক্তার দিকে তাকালেন। বাবা বললেন-
“বলো আম্মু, কিছু লাগবে তোমার?”
“আমি একবার মাশরাতের সাথে কথা বলতে চাই।”
বাবা মা একে অপরের দিকে তাকালেন। আধুনিক্তার মন বলছে বাবা মা রাজি হবে না। বাবা পকেট থেকে মোবাইল বের করে আধুনিক্তার দিকে এগিয়ে দিলো। আধুনিক্তা খুশীতে আত্মহারা হয়ে গেল। মাশরাতের নাম্বার ডায়াল করে কানে ধরলো। নাম্বার বন্ধ বলছে। অনেকবার কল করলো কিন্তু কেও ধরছে না। আধুনিক্তা চুপচাপ বসে রইল মাথা নিচু করে।
“কি হলো আম্মু?”
মায়ের প্রশ্নে আধুনিক্তা মাথা তুলে তাকাল। মায়ের দিকে ভেজা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। মা আধুনিক্তার হাত ধরে বলল-
“চিন্তা করো না হয় তো ব্যস্ত আছে সে।”
“সে কখনো নাম্বার বন্ধ রাখে না আম্মু।”
বাবা রাগী কন্ঠে বললেন-
“আমি জানতাম এই ছেলের মধ্যে গাবলা আছে। কিন্তু তুমি শুনো নি। তুমি অসুস্থ, সে বলেছিল এয়ারপোর্টে আসবে। কিন্তু আসে নি, তুমি ওর জন্য অপেক্ষা করে ছিলে।”
আধুনিক্তা বাবার কথার জবাব দিলো না। তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছে না। একটু জোরে চিৎকার করলেই বুক ব্যাথা করে। আধুনিক্তা গা এলিয়ে দিলো। আপাতত ঘুম আসছে তার। চোখ বন্ধ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার প্রবেশ করলেন।
“মিস্টার মজুমদার আই হ্যাভ এ গুড নিউজ”
“রিয়েলি ডক্টর?”
“ইয়েস উই ফাউন্ড এ হার্ট ডোনার”
বাবা মায়ের চোখে মুখে খুশী ঝলক দেখা গেল। আধুনিক্তা ধীরে ধীরে চোখ খুলে বলল-
“ডক্টর, ফার্স্ট টেল মি হু ইজ শি অর হি?”
ডাক্তার অপ্রস্তুত হলো। কিছুক্ষণ ভেবে বলল-
“আই ক্যান্ট টু টেল ইউ হু হি ইজ”
আধুনিক্তা ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসে বলল-
“আম্মু আব্বু আমি আমি উনি কে। আমি অনেকবার আঙ্কেল আন্টিকে বলতে শুনেছি উনারা চান তাবাসসুম আপুর হার্ট আমাকে দেয়া হোক। কিন্তু আমি এমনটা চাই না। আপু এখনো জীবিত আমি পারবো না আপুর খুনী হতে।”
বাবা বললেন-
“উনি একবার আমাদেরও বলেছিলেন এই কথাটা। কিন্তু আমরা রাজি হই নি৷”
বাবা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন-
“ডক্টর উই ডোন্ট ওয়ান্ট ইজ অপারেশন টু হ্যাপেন”
“হোয়াট আর ইউ সেইং? ইওর ডোটার উইল নট সারভাইভ উইথাউট সার্জারী”
বাবা কিছু বলার আগেই আধুনিক্তা বলল-
“আই ডোন্ট কেয়ার ডক্টর, আই হ্যাভ নো প্রবলেম উইথ ইট ইভেন ইফ আই ডাই”
তখনই তাবাসসুমের বাবা প্রবেশ করলেন।
“আমি জানতাম আপনারা বুঝে যাবেন যে আমি ডাক্তারকে বলেছি সার্জারীর কথা। আর আপনারা রাজি হবেন না তা-ও জানতাম।”
“ভাইয়া আপনি একবারো আমাদের জিজ্ঞেস করেছেন? তাবাসসুম বেঁচে আছে তবুও এমনটা চাচ্ছেন।”
“সত্যি কি আমার মেয়ে বেঁচে আছে? চার বছর হয়ে গিয়েছে আমার মেয়ে উঠে বসতে পর্যন্ত পারছে না। অনেক অপেক্ষা করেছি আমরা। আমরা এখন ক্লান্ত।”
“বাবা হয়ে এমনটা বলতে পারেন না। আপনাদের উচিত আরো অপেক্ষা করা।”
তাবাসসুমের বাবা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন-
“ডক্টর, সে সামথিং এবাউট মাই ডোটার’স হেলথ. উইল শি রিকোভার?”
“উই ট্রাইড হার্ড ইনাফ, উই স্টিল ডোন্ট নও ইফ শি উইল রিকোভার এট অল”
“দ্যাটস মিন শি হ্যাজ নো চান্স অফ রিকোভারি”
“মেবি”
তাবাসসুমের বাবা আধুনিক্তার বাবার দিকে হেটে এসে বললেন-
“যা হওয়ার হয়েছে। আমরা চাই না আপনারা আর শাস্তি ভোগ করেন। সেটা শুধুমাত্র এক্সিডেন্ট ছিল। হয় তো আমার মেয়ের ভাগ্যে এমনটাই লিখা ছিল। উপর ওয়ালা ভাগ্যে যা লিখেছে সেটা কেও বদলাতে পারবে না। আপনারা এখন প্লিজ রাজি হয়ে যান। নাহলে আমরা দুজনই আমাদের মেয়ে হারিয়ে ফেলবো।”
“কিন্তু ভাইয়া..”
“কোন কিন্তু না, আপনি চিন্তা করছেন কেন আধুনিক্তা আছে তো। তার কাছে আমাদের মেয়ের হার্ট থাকলে আমরা বুঝে নিবো আমাদের মেয়ে জীবিত আছে।”
তাবাসসুমের বাবা আধুনিক্তার দিকে হেটে এসে বললেন-
“আধুনিক্তা, যদি তাবাসসুমের হার্ট তোমাকে দেয়া হয় আমি অনেক খুশী হবো। তোমার মধ্যে নাহলে আমাদের মেয়ে জীবিত থাকবে।”
আধুনিক্তা মাথা নিচু করে কেঁদে উঠলো। পুরো কেবিন নিরব হয়ে গেল। শুধু আধুনিক্তার ফুপিয়ে কান্না করার শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে।

চলবে…….

#তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৩৯

রাত ৩ টায় তাবাসসুম আর আধুনিক্তাকে ওটি এর ভেতরে নেওয়া হয়। আধুনিক্তার মা তাবাসসুমের মায়ের হাত ধরে বসে আছে। অবাক করার মতো বিষয় তাবাসসুমের মা বাবা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে। আধুনিক্তার মা বাবা অবাক না হয়ে পারছে না।
“ভাবী, আপনারা জানেন অপারেশন হলে কি হবে?”
তাবাসসুমের মা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন-
“তাবাসসুমের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। তার হৃদপিণ্ড আধুনিক্তার ভেতরে গিয়ে স্পন্দন দিতে।”
“আপনার জায়গায় আমি হলে এতক্ষণে পাগলের মতো কান্না করতাম। সে সন্তানটাকে নিজে কষ্ট করে জন্ম দিয়ে লালন পালন করেছি তাকে এত সহজে বিসর্জন দেয়া যায় অন্য কারোর জন্য?”
“যায় না, খুব কঠিন নিজের সন্তানকে মৃত অবস্থায় দেখা। কিন্তু আমার সন্তান যদি অন্য কারোর বাঁচার কারণ হয়ে উঠে আমার চেয়ে খুশী আর কেও হবে না। আমার বাচ্চাটা ৪ বছর ধরে জীবিত লাশ হয়ে পড়ে ছিলো। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে তার মরে যাওয়াই ভালো।”
তাবাসসুমের মায়ের চোখ বেয়ে পানি পরলো। আধুনিক্তার না উনাকে জড়িয়ে ধরে ভেজা কন্ঠে বললেন-
“আপনাদের ঋণ শোধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আমরাই আপনার মেয়ের এই অবস্থার কারণ তবুও আপনারা আমাদের সন্তানের জন্য নিজের সন্তানকে মারতে রাজি।”
“মারছি কোথায়? তাকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিচ্ছি।”
তাবাসসুমের মা চোখ দু’টো বন্ধ করে ফেললেন। কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে উনার।

আধুনিক্তার জ্ঞান ফিরলো ৪ দিন পর। ধীরে ধীরে চোখ খুলল সে। চারপাশে ঘোলাটে দেখাচ্ছে। তার বুক বেশ ভার ভার লাগছে। মুছে তার অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। হঠাৎ তার মাথার স্পর্শ করে কাছে আসলো। আধুনিক্তা বুঝতে পারছে না কে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো মানুষটা আরমান। আরমান কিছু একটা বলছে কিন্তু আধুনিক্তা শুনতে পারছে না। হঠাৎ সবাই তার দিকে দৌড়ে এসে ঘিরে ধরলো। আধুনিক্তা চোখ বুলাচ্ছে সবার দিকে। ডাক্তার এসে আধুনিক্তার পালস চেক করে চোখের পাতা উল্টে দেখলেন। হাসিমুখে বাবাকে কিছু একটা বলতেই বাবা ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরলেন। আধুনিক্তা সবাইকে দেখতে দেখতে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। ১৮ ঘণ্টা পর তার ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলে অনুভব করলো তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক নেই। হঠাৎ মা বলে উঠলো-
“মা আধুনিক্তা জেগেছে।”
দাদী দ্রুত হেটে আসলেন। আধুনিক্তার কপালে গালে চুমোয় ভরিয়ে কেঁদে উঠলেন। আধুনিক্তা কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। সবাই এসে তাকে অনেক কিছু বলছে। কিন্তু আধুনিক্তার দৃষ্টি খুঁজছে তাবাসসুমের বাবা মাকে। আধুনিক্তা মায়ের হাত ধরে চোখের ইশারায় কাছে আসতে বলল। মা কাছে যেতে খুব আস্তে জিজ্ঞেস করলো-
“আ..আঙ্কেল আন্টি কো..কোথায়?”
মা কিছুটা মন খারাপ করে বললেন-
“উনারা কিছুক্ষণ আগে বাসায় গেলেন। ভাবীর শরীর খুব খারাপ। উনি প্রতিদিন এক কোনায় বসে কান্না করে।”
“আমি তাই বলেছিলাম অপারেশন করতে চাই না।”
“এখন এসব বলে কি লাভ আম্মু? তুমি রেস্ট নাও এসব না ভেবে।”
“কিভাবে না ভাবি আম্মু? একটা জীবিত মানুষকে মেরে ফেলা হলো আমার কারণে। নিজেকে খুনী মনে হচ্ছে।”
“একদম চুপ, ভাগ্যে যা ছিল হয়েছে। তুমি এভাবে নিজের উপর দোষ নিতে পারো না।”
আধুনিক্তা আর কিছু বলল না৷ সেই দু’টো মানুষের জন্য তার মন ফেটে কান্না আসছে। তার ইচ্ছে করছে একবার উনাদের দেখতে। একবার তাদেরকে জড়িয়ে ধরতে। হয় তো তার দেহে থাকা হৃদপিণ্ডটা উনাদের মেয়ের তাই এমনটা হচ্ছে।

আধুনিক্তার ঔষধগুলো খুব পাওয়ারফুল ছিল৷ সে ২৪ ঘন্টায় ২০/২১ ঘন্টা ঘুমিয়ে কাটাতো। যে কিছুদিন আধুনিক্তা হসপিটালে ছিল তাবাসসুমের মা বাবা প্রায়ই ওর সাথে দেখা করতে আসতো। বেশীর ভাগ সময়ই আধুনিক্তাকে ঘুম পেতেন উনারা। হসপিটাল থেকে রিলিজ করার আগে ডাক্তার আধুনিক্তার জন্য লম্বা খাবারের মেনু বানিয়ে আধুনিক্তার মায়ের হাতে ধরিয়ে দিলো। আধুনিক্তাকে খুব বেছে চলতে হবে। ১ বছরের ঔষধের কোর্স দিয়েছে। তাবাসসুমের হার্ট ৩ বছর ঔষধের উপর ছিল। কারণ ওর ব্রেইন আগেই ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিল এক্সিডেন্টের কারণে। বলা যায় তাবাসসুম একমাত্র তার হৃদয়ের কারণেই বেঁচে ছিল। আধুনিক্তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। এসে সে জানতে পারে তাবাসসুমের মা বাবা এই বাসা ছেড়ে অন্য বাসায় ভাড়া গিয়েছেন। আধুনিক্তার বেশ মন খারাপ হলো। তিন মাস আধুনিক্তা বেড রেস্টে ছিল। সপ্তাহে একবার সে সবার সাথে ড্রইংরুমে বসে কথা বলতো। এই তিন মাসে তাবাসসুমের বাবা মা একবারো আসে নি। শুধু কল দিয়ে আধুনিক্তার খোঁজ খবর নিয়েছে। একদিন আধুনিক্তা উনাদের কল দিয়ে বাসায় আসতে বলে। আধুনিক্তা ড্রইংরুমে হেলান দিয়ে বসে ছিল। কিছুক্ষণ পর আসলো তাবাসসুমের মা বাবা। আধুনিক্তা উনাদের দেখে দাঁড়িয়ে দ্রুত উনাদের দিকে হেটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। তার মনে হচ্ছে অনেকদিন পর তার মনটা শান্তি পেয়েছে। আধুনিক্তা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তাবাসসুমের মা-ও কাঁদলেন। আধুনিক্তার চেহারায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে আবার জড়িয়ে ধরলেন। উনার মনে হচ্ছে উনি আধুনিক্তাকে না তাবাসসুমকে জড়িয়ে ধরেছে। আধুনিক্তা তাবাসসুমের বাবার দিকে তাকাল। বাবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আধুনিক্তা উনাকেও জড়িয়ে ধরলেন। অপারেশনের পর তাবাসসুমের বাবাকে কেও কাঁদতে দেখেনি৷ উনি আজ কেঁদে উঠলেন। আধুনিক্তার স্পর্শ একদম তাবাসসুমের মতো৷ আধুনিক্তা উনাদের হাত ধরে এনে সোফায় বসালো। অভিমানী কন্ঠে বলল-
“আপনারা আমার সাথে দেখা করতে আসেন নি কেন?”
তাবাসসুমের বাবা চোখ মুছে হাসি মুখে বললেন-
“আমার কাজ ছিল কিছুটা তাই আসে নি।”
“মেয়ের থেকে বেশী জরুরি এখন কাজ হয়ে গেল?”
“না না এটা কখনো হতে পারে না। মেয়ে জরুরি তাই তো আমরা প্রতিদিন কল দিতাম।”
“থাক থাক আর মিথ্যে বলতে হবে না। আমি জানি আপনারা আমাকে একটুও ভালোবাসেন না। আপনারা আমাকে অপছন্দ করেন।”
তাবাসসুমের মা বললেন-
“কে বলেছে? এমনটা কখনো হতে পারে না।”
“রাগ করে আছেন আমার উপর?”
“রাগ কেন করবো?”
“আমার কারণে আপনারা আপুকে হারালেন।”
তাবাসসুমের বাবা আধুনিক্তার হাত ধরে উনাদের দুজনের মাঝে বসিয়ে বললেন-
“তোমার কারণে কেন হবে? আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম আমার মেয়ের জীবিত লাশ দেখতে। মনে হচ্ছিল আরো কিছুদিন এমনটা চললে আমি মরে যাব। তাই ভাবলাম আমাদের মেয়েকে বাঁচানোর একটাই রাস্তা আছে। তার দেহকে না কিন্তু তার হৃদয়কে আমরা বাঁচাতে পারবো।”
“তাহলে আপনারা মানেন আমার মধ্যে আপু জীবিত আছে?”
তাবাসসুমের মা মুচকি হেসে বললেন-
“হ্যাঁ মানি, এখন আমরা চাই তুমি এবার নিজের মতো বাঁচো। সবসময় ভালো থাকো। তোমাকে দেখে আমরা দু বুড়ো বুড়ি জীবন কাটিয়ে ফেলতে পারবো।”
“বুড়ো বুড়ি? আরে বুড়ো হবে আপনাদের শত্রু।”
তাবাসসুমের বাবা মা হেসে উঠলেন। আধুনিক্তা উনাদের হাসি দেখে মুচকি হেসে বললেন-
“বাবা মা, আমি চাই আপনারা আমাকে তাবাসসুম বলে ডাকেন।”
তাবাসসুমের বাবা মা অবাক হলেন। দুজনই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আধুনিক্তার দিকে। আধুনিক্তা উনাদের বাবা মা বলে ডাকলো উনারা যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। মা হঠাৎ কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন-
“তুমি কি সত্যি বলছো?”
“একদম সত্যি বলছি। যেহেতু আপনারা মানেন আমার মধ্যে আপু জীবিত আছে তাহলে আমাকে তাবাসসুম ভাবতে অসুবিধা কিসের?”
আধুনিক্তার মা বাবা একে অপরের দিকে হাসিমুখে তাকালেন। মেয়ের কথা শুনে উনারা খুব খুশী হলেন। তাবাসসুমের মা বাবা রাজি হয়ে আধুনিক্তাকে জড়িয়ে ধরলেন। সেদিন থেকেই আধুনিক্তা তাবাসসুমের বাবা মায়ের জন্য তাবাসসুম হয়ে উঠেছে।

বর্তমান…..
আধুনিক্তা মাশরাতের বুকে মাথা রেখে বসে আছে। তার ভয়ে জান বেরিয়ে যাচ্ছে। পুরো কথা শোনার পর মাশরাত টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। আধুনিক্তা মাথা তুলে মাশরাতের দিকে তাকাল। মাশরাত শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। আধুনিক্তা মাশরাতের গালে হাত রেখে বলল-
“কিছু বলো মাশরাত। তোমার নিঃশব্দ আমাকে মেরে ফেলবে।”
মাশরাত একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে আধুনিক্তার দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি আগেউ টের পেয়েছি তাবাসসুম বেঁচে নেই।”
আধুনিক্তা দু’বার চোখের পলক ফেলল। মাশরাত আবার বলা শুরু করলো-
“আমি এতক্ষণ বসে বসে সব কথা মেলাচ্ছিলাম। আঙ্কেল আন্টি তোমাকে তাবাসসুম ডাকে এর কারণেই আমি বুঝতে পেরেছি তাবাসসুম আর বেঁচে নেই। তার হার্ট ট্রান্সফার করা হয়েছে তোমার মধ্যে।”
আধুনিক্তা আর একটু কাছে গিয়ে মাশরাতের গা ঘেষে বসলো। তার ভয় আরো বেড়ে গেল। মাশরাত আবার বলল-
“জানো ও বলেছিল ও অনেক বড়ো হার্ট সার্জন হতে চায়। দুনিয়ায় যত মানুষ আছে যাদের মন অসুস্থ তাদের সবাইকে সুস্থ করতে চায়। সে একটা কথা বলেছিল ‘ভবিষ্যতে একজনের হলেও হৃদয় সুস্থ করতে চাই আমি’। আর দেখো সে সত্যি আজ একজনকে সুস্থ করে চলে গেল। প্রমাণ করে গেল সে সত্যি খুব বড়ো হার্ট সার্জন।”
মাশরাত গলা ধরে আসলো। আধুনিক্তা মাশরাতকে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল-
“আমি কখনো চাই নি আমার হার্ট ট্রান্সফার সার্জারী হোক। কিন্তু…”
মাশরাত আধুনিক্তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল-
“এখন এসব ভেবো না। যার যাওয়ার সে চলে গিয়েছে। যার চলে যাওয়ার সময় হয়ে যায় তাকে থামানো যায় না। আর আমার ভাগ্য খুব ভালো। আমি আমার প্রথম আর শেষ, দুই ভালোবাসাই পেয়েছি।”
“হ্যাঁ তাবাসসুম আপু তোমাকে অনেক ভালোবাসে মাশরাত। আমার দেহে থাকা হৃদপিণ্ডটা তোমাকে দেখলে কি পরিমাণ স্পন্দন দেয় তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।”
আধুনিক্তা মাশরাতের দিকে তাকিয়ে মাশরাত এক হাত ধরে নিজের বুকের বা পাশে রেখে বলল-
“অনুভব করতে পারছো? এই সেই হৃদয়, যার ভেতর তুমি ছাড়া আর কেও নেই।”
মাশরাত হাসলো, তারাতাড়ি চোখ দু’টো মুছে হাত সরিয়ে বলল-
“আমি আর ইমোশনাল হতে চাই না। আমি সবসময় তাবাসসুমের জন্য দোয়া করবো। যদি আমাদের দেখা সেই হাশরের ময়দানে তাকে শুধু ধন্যবাদ দিব। সে মরার আগে আমাকে বাঁচার কারণ দিয়ে গিয়েছে।”
“আমিও আপুকে ধন্যবাদ দিব। সে আমাকেও আমার বাঁচার কারণ দিয়ে গিয়েছে।”
মাশরাত মুচকি হেসে আধুনিক্তার কপালে চুমু খেল। আধুনিক্তা আবার বলল-
“জানো খেলার দিন কি হয়েছিল?”
“কি?”
“আমি বেঞ্চে বসে তোমার মোবাইল দেখছিলাম। গ্যালারিতে তাবাসসুম আপুর ছবি দেখে আমি যেন আকাশ থেকে পড়েছিলাম। আমি না প্রায়ই ভুলো যেতাম সব কিছু। আমি তাবাসসুম আপুর নাম ভুলে গিয়েছিলাম তাই যখন তুমি তোমার অতীতে থাকা মেয়েটার নাম বলেছিলে আমি ধরতে পারি নি বিষয়টা। ছবিটা দেখার পর আমার কাছে সব ক্লিয়ার হয়ে গিয়েছিল। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তুমি যার অপেক্ষায় ছিলে জীবিত লাশ হয়ে সিঙ্গাপুরে পড়ে আছে। আমি সহ্য করতে না পারি নি এই সত্যিটা। তাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম সেদিন।”
“ছবিটা পার্সোনাল ফোল্ডারে রেখেছিলাম। ফোল্ডারটা ইচ্ছে করে ডিলিট করেছিলাম। কারণ আমি ভেবে নিয়েছিলাম তোমার সাথে জীবন কাটানোর কথা। কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না ছবিটা ছাড়া। তাই ছবিটা আবার সেভ করেছিলাম ফেসবুক থেকে৷ পার্সোনাল ফোল্ডারে রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। যাক ভালোই হলো, এতে সব সত্যি সামনে আসলো।”
“জানো আমি যখন ডায়েরিতে তোমার সম্পর্কে পড়োছিলাম আমার মন এমনই একজন চেয়েছিল। তোমাকে প্রথম দেখায় আমার মনে হয়েছিল আমি তোমাকে চিনি। খুব চেনা চেনা লাগছিল তোমাকে। এত তারাতাড়ি তোমাকে ভালোবেসে ফেলব কল্পনাও করি নি।”
“আমি মানুষটাই এমন সবাই ভালোবেসে ফেলে।”
আধুনিক্তা হেসে উঠলো। মাশরাতও মুচকি হাসলো আধুনিক্তার হাসি দেখে। আধুনিক্তাকে কোলে তুলে দাঁড়াল। বিছানায় তাকে বসিয়ে বলল-
“এখন বিশ্রাম করো, বাকি কথা পরে হবে।”
“কিন্তু আমি তোমাকে সব কিছু আজই বলতে চাই।”
“আরো কথা আছে?”
“হ্যাঁ”
মাশরাত হেসে আধুনিক্তার পাশে বসলো। ইশারায় বলল বলতে। আধুনিক্তা আবার বলা শুরু করলো-
“যে গাড়ি দিয়ে এক্সিডেন্ট হয়েছিল। সে গাড়ি কখনো কেও ব্যবহার করেনি। আমি বাংলাদেশে ফেরার পর গ্যারেজে যাই। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে চোখ বুলাই। গাড়ির পেছনের সিট রক্তে ভরা ছিল। আপুকে এই গাড়িতেই হসপিটাল নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি গাড়ির ভেতর থেকে একটা ব্যাগ পাই। সেটায় দু’টো জিনিস ছিল। একটা ছবির ফ্রেম আর একটা ভাঙ্গা মোবাইল৷ ছবিটা তোমার ছিল। হয় তো বাবা তোমার ছবিটা ছিঁড়ে ফেলেছিল। তবুও তাবাসসুম আপু যত্ন করে রেখেছিল। আর তাবাসসুম আপুর মোবাইল এক্সিডেন্টের সময়ই ভেঙে যায়। জিনিসগুলো গাড়িতেই পড়েছিল ৪ বছর।”
“তুমি যত্নে তুলে রেখেছো সেগুলো?”
“হ্যাঁ, সেই জিনিসগুলোর সাথে তোমাদের স্মৃতি জড়িত। আমি চাই না তুমি তোমাদের স্মৃতি ভুলে যাও। আর তুমি চিন্তা করো না। আমি কখনো তোমাকে স্মৃতিগুলো ভুলতে দিব না।”
মাশরাত শব্দ করে হেসে উঠলো। আধুনিক্তা-ই কি দুনিয়ার প্রথম বউ যে চায় আর স্বামী তার প্রথম প্রেমিকাকে না ভুলুক? হয় তো। মাশরাত আধুনিক্তার হাত ধরে টেনে বুকের মাঝে নিয়ে নিলো। স্মৃতি না ভুললেও সে এই স্মৃতি গুলো প্রতিদিন মনে করবে না। কারণ স্মৃতি হৃদয় পুড়ায়। আধুনিক্তা আবার মাথা তুলে বলল-
“মাশরাত আর একটা বিষয়ে তোমাকে জানাতে চাই।”
“কি বলো”
“এটা কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। আমি জেনে অবাক না হয়ে পারি নি।”
“বলো কি হয়েছে”

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা……
আধুনিক্তা অনেকক্ষণ যাবত মাথা নিচু করে বসে আছে। তার মনে হচ্ছে মাশরাত তাকে কোনো মতে ভুল বুঝবে। তাদের সম্পর্কের সমাপ্তি হয় তো ঘটবে এইবার। আধুনিক্তার হঠাৎ রাগ হলো। কেন সে নিজেও জানে না। চুপচাপ বসে আছে যাতে রাগের মাথায় উল্টা পাল্টা কিছু না করে বসে। হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেল। মাথা তুলে বাবাকে দেখে আধুনিক্তা আবার মাথা নিচু করে ফেলল। বাবা আধুনিক্তার পাশে বসে বললেন-
“কি হয়েছে আম্মু? তুমি এইভাবে চুপ করে বসে আছো যে?”
“তুমি জানো না কেন?”
“কি হলো হঠাৎ রেগে গেলে যে।”
আধুনিক্তা বাবার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল-
“তুমি ভালো মতো জানো আমার জীবন কোন পর্যায়ে এখন। তবুও জিজ্ঞেস করছো।”
“তোমার জীবন কোন পর্যায়ে যায় নি। নিশ্চিন্তে থাকো, আর হ্যাঁ এসে ডিনার করে নাও।”
“খাবো না আমি কিছু। আমার ভালো লাগছে না।”
বাবা দাঁড়িয়ে বলল-
“এটা বললে হবে না। এখন কিছু খেয়ে ঘরে যাও। মাশরাতকে কল করে কথা বলে নাও ভালো লাগবে।”
“বললাম তো আব্বু আমি খাবো না এখন।”
বাবা আধুনিক্তার হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে বললেন-
“আমি তোমার একটা কথা শুনবো না। তুমি এখনই..”
বাবা পুরো কথা শেষ করতে পারলেন না। আধুনিক্তা এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাগী কন্ঠে বলল-
“তুমি সবসময় এমন করো কেন? একবার বললে শুনো না? আমার জীবন তো অলরেডি সমাপ্তির পর্যায়ে এসে পড়েছে।”
মা তেড়ে এসে আধুনিক্তার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন-
“তুমি সবসময় এইভাবে কথা বলো কেন? আমরা আছি না তোমার সাথে? তোমার জীবন সমাপ্তির পর্যায়ে চলে গিয়েছে? কি আজেবাজে বকছো?”
“আম্মু প্লিজ আমার ভালো লাগছে না। তোমরা গিয়ে খেয়ে নাও আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
আধুনিক্তার মা উনার স্বামীকে বললেন-
“ও বেয়াদব হয়ে গিয়েছে। এখন ওর সাথে তর্ক করে লাভ নেই। চলো আমরা খেয়ে ঘুমাতে যাই।”
“হ্যাঁ যাও যাও আমার এখন তোমাদের প্রয়োজন নেই। বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েরা পর হয়ে যায় তোমরা এটাই ভাবো।”
মা কিছু বলার আগে বাবা বললেন-
“কোন কোন বাবা মা এমনটা ভাবে আমি জানি না। কিন্তু আমরা এমন বাবা মা না।”
“ওহ প্লিজ আব্বু তুমি ভালো মানুষিক ভাসান দিও না।”
মা রেগে আগুন হয়ে গেলেন। আধুনিক্তার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললেন-
“তুমি যদি আর একবার তোমার বাবাকে উল্টা পাল্টা কিছু বলো আমার থেকে খারাপ কেও হবে না।”
“আমি উনার সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। অলরেডি দেখে ফেলেছি ৪ বছর আগে।”
“তুমি কি বলতে চাচ্ছো আমি ভালো মতো বুঝতে পারছি। তোমার বাবা তাবাসসুমের এক্সিডেন্ট করায় সে প্যারালাইজ হয়ে গিয়েছিল তাই বলতে চাচ্ছো না?”
“বুঝে তো গেলেই আর কি বলবো?”
মা রাগে চিল্লিয়ে বললেন-
“আজ যেহেতু সব সত্যি মাশরাত জেনে গিয়েছে। তাহলে তুমিও আজ একটা সত্যি শুনে নাও। সেদিন তাবাসসুমের এক্সিডেন্ট তোমার বাবা না, আমি করেছিলাম।”

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here