#বিপরীতে_তুমি_আমি
(দ্বিতীয়_পরিচ্ছদ)
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম
|৫|
পরিপাটি ঘর সেকেন্ডের মাঝেই উলোট পালোট হয়ে গেলো। মেসেজটি পাওয়ার সাথে সাথে অর্ণব মরিয়া হয়ে যায়। গাড়িতে ওঠে বসতেই খেয়াল হলো সে চাবি আনে নি। রাগে কপালের রগ ফুলে ওঠলো। সময়ের স্বল্পতাতেই সময়ের টান পড়ে। ক্ষোভে স্টিয়ারিং এ জোড়ে আঘাত করে বসে। পুনরায় দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় রুমে দিকে। রুমে এসেই মাত্র মিনিট খানেকের মাঝেই সব এলোমেলো করে ফেলে। বিছানার পাশের ছোট টেবিলের প্রতিটি ড্রয়ার খুলে রয়েছে। ড্রেসিং টেবিলের উপরে কিরণের যত্নে সাজানো সকল সাজগোজ এদিক ওদিক পড়ে আছে। সেখানকার ড্রয়ারগুলোও এমনভাবে খুলেছে যেন কেউ ছুঁলেই পড়ে যাবে। সোার কুশনগুলো অবস্থান চ্যুত হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। বালিশের নিচে কি গাড়ির চাবি যাওয়ার কথা? কিন্তু তবুও সেই বালিশও পড়ে আছে বিছানার কোণায়। বিছানার নিচটাকেও ছাড়ছে না। কাবার্টের তাকে সাজানো জামাকাপড়ও অগোছালো হয়ে রইলো। সোফার সামনে রাখা টেবিলটার তাকটাও খোঁজা শেষ। কিন্তু তাতেও বিশেষ কোনো লাভ হয় নি। কোথাও চাবির নিশানা নেই। অদ্ভুত! চাবির কি হাত পা গজালো? উদ্বিগ্নের মাত্রা হুহু করে বেড়ে ওঠছে। মস্তিষ্ক বুদ্ধি শূন্য হয়ে আসছে। শূন্য মস্তিষ্কে কেবল প্রতিধ্বনি হয়ে বেড়াচ্ছে কিরণের সুরক্ষার চিন্তা। পুরো রুম ভালো করে তাকিয়ে দেখে নিল। কোনো জায়গায়ই তো বাদ রাখলো না। তবে গেল কোথায়? অর্ণব বুঝতে পারলো সে মাত্রাতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় মানুষের ভুল বেশি হয়। তার মাথা ঠান্ডা করতে হবে। এমন হুটহাট মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারানো তো তার স্বভাব নয়। মনকে বুঝালো কিরণের গায়ে একটা আঁচও লাগতে সে দেবে না। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন নিজের মস্তিষ্ক স্বাভাবিক করা। স্বাভাবিক মস্তিষ্কে সে তো যে কোনো পরিস্থিতিতে মাত দেবার ক্ষমতা রাখে। অর্ণব শির দাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালো। কোমরে দু হাত রেখে মেডিটেশন করতে শুরু করতেই ডান হাতের চাপে কিছু অনুভব করলো। তৎক্ষনাৎ পকেটে হাত ঢুকিয়ে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে গেলো। পাঞ্জাবির পকেট থেকে চাবিটা বের করে চোখের সামনে আনতেই চোখ খিচে বন্ধ হয়ে এলো। চোখ মেলে চাবিটার দিকে তাকিয়ে লম্বা এক নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো ভেতর থেকে। শুকিয়ে আসা গলাটায় একটা ঢোক গিলে বেড়িয়ে পড়লো গন্তব্যে। অতি দ্রুততায় কোনো কাজ সম্পন্ন করতে গেলে সে কাজে আরো বেশি দেরি হয় যায়। অর্ণব এ কথার প্রমাণ আবারো পেলো। গাড়িতে বসে স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে পর পর তিনবার শ্বাস প্রশ্বাসের কাজ সম্পন্ন করে। দৃঢ় দৃষ্টি তার বাহিরের দিকে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে রেখে দিল পাশের সিটে। কানে ব্লুটুথ ডিভাইস কানেক্ট করে নিল। গাড়ি চালু করতে করতেই ফোন লাগালো কিরণের কাছে। যা করার দূরে থেকেই শুরু করতে হবে। অর্ণব জানে এইটা কেবলমাত্র একটি হু*মকি ছিল। কিন্তু তবুও কিরণকে নিয়ে বালুকণাও ঝুকি নিতে সে নারাজ। অর্ণবের আক্ষেপ হলো কিরণকে একা ছাড়ানোর ব্যপারে। গার্ডের মেয়াদ আরো কিছুদিন বাড়ানো উচিৎ ছিল। সে যাকে ধ্বং*সের পথে নিয়েছে সে যে এতো সহজে দমে যাওয়ার পাত্র নন তা তো অর্ণবের অজানা নয়। তবুও ভুল হলো। গাড়ি গেইটের বাহিরে চলে যেতেই কিরণের ফোন রিসিভ হলো। অর্ণবের কানে এসে পৌঁছালো প্রেয়সীর নরম কন্ঠস্বর,
হ্যালো!
কোনো প্রশ্ন না করে কেবল মনোযোগ দিয়ে শুনবে কি বলছি। যেখানেই থাকো সেখান থেকে ওঠে এমন কোথাও যাও যেখানটা সিসি ক্যমেরায় ঘিরে রাখা। ভালো হবে এমন কোথাও গেলে যেখানে দূর থেকে দেখা যাবে না। দেখতে হলে কাছে যেতেই হবে।
ভেতরে রেস্টুরেন্ট আছে। বাহির থেকে দেখা যাচ্ছে না। নজর রাখতে হলে ভেতরে গিয়েই বসতে হবে।
অর্ণব বুঝতে পারলো কিরণ ইতিমধ্যেই আন্দাজ করে ফেলেছে তার উপর কেউ নজর রাখছে। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে না তো? অর্ণবের বুক আরো তীব্রভাবে অশান্ত হয়ে পড়লো। যত দ্রুত সম্ভব তাকে পৌঁছাতে হবে। ফোনে আর সময় অপচয় না করে অর্ণব ফোনটা কেটে দিল। সাথে সাথে ডায়াল করলো লিয়াকতের নাম্বারে। দুবার রিং হতেই রিসিভ হলো ফোন। বন্ধের দিনে স্যারের ফোন পেয়ে হুড়মুড়িয়ে ওঠে লিয়াকত। ফোন রিসিভ করেই সালাম দেয়। অর্ণব উত্তর নিয়ে বলে,
যেমনভাবে আছো সেভাবেই কাজে লেগে পড়ো লিয়াকত। খুবই জরুরি প্রয়োজন। লুঙ্গি পড়ে থাকলেও চেন্জ করার প্রয়োজন নেই। তবে পাঁচ সেকেন্ডের মাঝে করতে পারলে করতে পারলো।
লিয়াকত ভেবাচেকা খেয়ে গেল। সত্যিই সে লুঙ্গি পড়েই সোফায় পা তুলে বসে আছে। কিন্তু অর্ণবের কন্ঠস্বরের গাম্ভীর্যতা বুঝিয়ে দিচ্ছে সিরিয়াস কোনো বিষয়। তাই বিলম্ব না করেই বললো,
জ্বি স্যার বলুন। কি করতে হবে?
তোমাকে একটি লোকেশন পাঠাচ্ছি। সেখানকার সিসি ক্যামেরা নিজেদের আয়ত্ত্বে আনো। তোমার ম্যম আছেন। ওর ওপর কেউ নজর রাখছে। আই ওয়ান্ট দিজ ম্যান এলাইভ। গট ইট?
ইয়েস স্যার।
অর্ণব এ ফোন রেখে পুনরায় আবারো ফোন দিল অন্যত্র। দৃষ্টি তার সামনের দিকেই। গাড়ি স্পিড প্রায় ৭০ ছাড়িয়েছে। সৌভাগ্য বশত রাস্তা ফাঁকা পেয়েছে। বড়জোড় আর পনেরো মিনিট। চল্লিশ মিনিটের রাস্তা প্রায় বিশ মিনিটের মধ্যে শেষ করতে চলেছে। ফোন রিসিভ হয়েছে। রাশভারি কন্ঠে সালাম দিল অর্ণব,
আসসালামু আলাইকুম। দিস ইজ অর্ণব শাহরিয়ার। আই নিড টু বডিগার্ড এট ********** রিসোর্ট উইথইন ফাইভ মিনিটস। ইট’স ভেরি আর্জেন্ট। এ’ম সেন্ডিং ইউ আ ফোটো। আই হোপ ইউ উইল এবোল টু গিভ হার হাই প্রোটেকশন।
ফোন ছেড়ে নির্দিষ্ট স্থানে কিরণের ছবি পাঠিয়ে অর্ণব ধাতস্ত হয়ে বসলো। ব্লুটুথটা বাম হাত দিয়ে সড়িয়ে পাশের সিটটায় রেখে দিল। সব ধরণের ব্যবস্থা করা সম্পন্ন। এখন শুধুমাত্র এ পথ ফুরানোর অপেক্ষা।
—
জান্নাতের আজ কলেজে বর্ষা বরণ অনুষ্ঠান। তবে সেই আনন্তের কোনো চিহ্নই না আছে পোষাকে আর না আছে মুখশ্রীতে। দেখে মনে হচ্ছে জেলখানায় টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে । আর এই শোকের কারণ শাড়ি। শাড়ি পড়াটা বান্ধবীদের পরিকল্পনার চাপে। নতুবা তার ইচ্ছে ছিল চুড়িদার পড়ে একদম নম্রভদ্র সেজে যাবে সে। শাড়ি পড়ার ইচ্ছে যে একদম ছিল না তা কিন্তু নয়। শাড়ি পড়ার লোভটা বাঙালি মনের প্রতিটা মেয়েরই রয়েছে। কিন্তু হাঁটাচলাই মসিবতের। কুচি নষ্ট হলে কে ঠিক করে দেবে পেট দেখা গেলে কিভাবে ঢাকবে, হাঁটার সময় পেছনে শাড়ি ওঠে গেলে কিভাবে নামাবে নানান চিন্তায় আনন্দ বন্যায় ভেসে যাওয়ার অভিপ্রায়। সেসব মুসিবতকেই মাথায় নিয়েই জান্নাত আকাশি রঙ্গের এক শাড়ি পড়ে বেরোচ্ছে কলেজের উদ্দেশে। হাতের কব্জি পর্যন্ত সাদা রঙের ব্লাউজ। জান্নাতের চুল কোমরের কিছুটা উপরে। তবে বেশ ঘন। খোপা করতে চেয়েছিল। কিন্তু নিজেকে বেশ বড় বড় লাগে বিধায় ছেড়ে দিয়েছে। মাঝখান বড়বড় সিঁথি করে সামনের কিছু চুল দুপাশে বেনি করে পিছনে নিয়ে আটকিয়েছে। কানে ছোট ঝুমকা ব্যাতিত সারা অঙ্গে আর কোনো গহনা নেই। কলজ অনুষ্ঠানে গহনা পড়তেও জান্নাতের ভালো লাগে না। জান্নাতের কলেজটা গার্লস কলেজ। তাই পরিবার থেকেও আপত্তি করে নি। জান্নাত ফোনটা নিয়ে দ্রুত সিড়ি বেয়ে নামছে। তার বাবা মা দুজনেই খেতে বসেছে। তার খাওয়ার সময় নেই। বান্ধবিগণ লাগাতার ফোন দিয়ে বিপ*দ সংকেতের জানান দিচ্ছে। তাই তাড়াহুড়ো করে সকল ডাক উপেক্ষা করে বেড়িয়ে এলো। বেড়িয়ে এলো ঠিকই কিন্তু সামনে আর এগোলো না। হঠাৎ আজ থমকে গেল জান্নাতের চোখ পরিচিত কিছুর অপরিচিত রূপে। ঘোর বর্ষা কালের প্রেমের বর্ষনের দেখা মিললো বুঝি!
চলবে ~~~~