বিপরীতে তুমি আমি (দ্বিতীয়_পরিচ্ছদ) শেষ পর্ব

0
668

#বিপরীতে_তুমি_আমি
(দ্বিতীয়_পরিচ্ছদ)
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম
|৯|

( পর্বটি বেশ বড়। সম্পূর্ণ ফেসবুক লাইট থেকে পড়তে সক্ষম না হলে অরজিনাল ফেইসবুক অ্যপটি ব্যবহার করুণ)

সরু রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে অর্ণব বেড়িয়ে এলো। সামনে বন্যার পানিতে থৈ থৈ মাঠ প্রান্তর। আকাশ ও প্রান্তরের শেষ মিলেছে যেখানে অর্ণবের দৃষ্টি সেখানে স্তব্ধ। দু হাত পকেটে চালান করে দিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ালো। কিরণও নেমে দাঁড়ালো। তার বিষ্ময়ের রেশ তখনও চোখে বিদ্যমান। অর্ণবের ঠিক পেছনে গাড়ির সামনের হুডের সাথে দাঁড়ায়। কিছু সময়ের নিরবতার পর অর্ণবের থমথমে কন্ঠস্বর শোনা গেল,

তুমি কি জানতে হিয়া মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল?

কিরণ চোখে তুলে তাকালো। স্বাভাবিক দৃষ্টি। কারণ কিরণ এ বিষয়ে জানতো। সহজভাবে জানালো,

শুরুতে জানতাম না। ছ’মাস আগে জেনেছি।

অর্ণব ছোট করে শ্বাস ফেললো। আন্দাজ করেছিল কিরণ হয়তো জানে। এখন নিশ্চিত হলো। পিছু ফিরে কিরণের মুখের আদলটা দেখতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সে ফিরে তাকাল না। সেভাবেই সামনে তাকিয়েই বলতে শুরু করলো,

হিয়া কিছুটা সাইকোপ্যাথিটিক ছিল। এ ধরণের মানুষ যাকে ভালোবাসে তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে আর যাকে ঘৃণা করে তাকে সাপের চোখে দেখে। মাত্র পনেরো বছর বয়সী একটা মেয়ের কি সাংঘাতিক, ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা! রফিকউল্লাহ র*ক্ত বলেও কথা। জুনায়েদ ভাইকে হিয়া সম্ভবত দেখে আমার কলেজে। সাধারণত বাবা না থাকায় অভিভাবক আম্মুই ছিলেন। তবে পাশাপাশি ছিলেন জুনায়েদ ভাই। আমাকে ভর্তি করতে এবং একবার আমার অভিভাবক মিটিং এ এসেছিলেন। এছাড়া কলেজে আসার আর প্রয়োজন হয় নি। দ্বিতীয় দিনই হিয়া জুনায়েদ ভাইকে দেখে। ক্ষমতার প্রভাবে পরিচয় বের করতেও ওর খুব একটা কষ্ট হয় নি। জুনায়েদ বিবাহিত জেনেও ওর মাঝে অনুভূতির কোনো পরিবর্তন হলো না। উল্টো আনিলা আপুর প্রতি প্রতিহিংসা জেগে ওঠলো। আনিলা আপু আর জুনায়েদ ভাইয়ার কাবিনের প্রায় এক বছর পর আপুকে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। বিয়ের চার দিন আগে বিকেলে আপু বাসা থেকে বের হলে হিয়া তার বাবার সাহায্যে আপুকে অপহ*রণ করায়। দ্বিতীয় পক্ষের হলেও হিয়া তার প্রিয় ছিল। প্রথম বিয়ে রফিকউল্লাহ বাবার পছন্দে করলেও দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন প্রেমিকাকে। হিয়া ছিল তাদের সেই কলিজা কাটা ধন। মানসিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত হওয়ার কারণে ওকে আরো নাজুকভাবে লালন করেছে। সকল ইচ্ছে তুড়িতেই পূরণ। সেখানে মেয়ে ছেলে পছন্দ করেছে হোক তা বয়সে বেশ বড়। হিয়ার পরিকল্পনা ছিল আপুর শরীরে কালো দাগ দিয়ে ছেড়ে দেবে। তাহলে হয়তো জুনায়েদ ভাই ছেড়ে দেবে। কিন্তু এর মাঝে রফিকউল্লাহ তার জানো*য়ারী বুদ্ধি খাটালো। অপকর্ম তার লোকেরা করেছিল কিন্তু আপুকে ছেড়ে দিলে যদি তার নাম চলে আসতো সেই আশঙ্কায় শ্বাসটাই কেঁড়ে নিল। উন্মাদ হয়ে যাওয়া আমরা দুদিন পর আপুকে পেলাম ব্রিজের নিচটায়। প্রাণহীণ, কলংকিত দেহ।

অর্ণব থামলো। দীর্ঘশ্বাসে বুক ভার হয়ে এসেছে। চেয়েও যেন সব বের করতে পারছে না। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজিয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই কিরণ পেছন থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। কন্ঠে তার অবাক হওয়ার রেশ।

আপনি যে বলেছিলেন রফিকউল্লাহ আপুকে ধর্ষ*ণ করেছেন? ওনাকে তো এই অপরাধেও অভিযুক্ত করে জে*ল খাটানো হচ্ছে।

অর্ণব ঘুরে কিরণের দিকে তাকালো। তার চোখগুলো বিষ্ময়ে বড় বড় হয়ে আছে। কোণায় কোণায় জানার আগ্রহেরা ছুটোছুটি করছে। অর্ণবের থমথমে মুখ সেদিকে তাকিয়ে উত্তর করলো,

হিয়ার জড়িয়ে থাকার ব্যপারটা আমি নিজেই আগে জানতাম না। তোমার সেদিনের সেই অনুষ্ঠানের সাথে ওর লিংকটা ধরতে গিয়েই এতো সব বের হয়েছে। আর রফিকউল্লাহ কি দোষী না কিরণ? কাজটা সে না করলেও পরিকল্পনা তো তারই ছিল। কিভাবে প্রমাণ করতাম সে ধর্ষ*ণ করে নি কিন্তু খু*ন করেছে ঠিকই। এর প্রমাণ খুঁজেছিলাম কিন্তু পাই নি। যা পেয়েছি তাতে সরাসরি প্রমাণ করা গিয়েছে কাজটা তার ছিল। পনেরো বয়সের একটা বাচ্চা মেয়ে এর সাথে জড়িয়ে আছে সেটাই কি প্রমাণ করা সম্ভব ছিল? কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যেরূপ ভাবে সেরূপ ভাবে উপস্থাপন করা যায় না। যার ফলে শাস্তির মাত্রাও কমে আসে। শাস্তির মাত্রা কম মানের তাদের মত প্রভাবশালীরা বেড়িয়েও আসতে পারে। পরোক্ষভাবে রফিকউল্লাহই সকল দোষের জন্য দোষী। বাবা হিসেবে তার উচিৎ ছিল মেয়েকে আটকানো। শুধরে দেওয়া। কিন্তু তিনি তা না করে মেয়ের সাথে তাল মেলালেন। ধ্বংস করে দিলেন আমার হাসি খুশি পরিবার। সে হিসেবে তিনি কি আসলেই সেই শাস্তি পেয়েছেন? তার শাস্তি এ পর্যন্ত আনতে এতটুকু মিথ্যার আশ্রয় আমায় নিতেই হতো যে। অর্ধ যুগ ধরে আমি শুধুই চেয়েছি তার শাস্তি হোক। তার শাস্তি হয়েছে।

দাঁত চাপা কথায় কিরণ কেবল তাকিয়ে রইলো অর্ণবের দিকে। চোখের চারপাশে র*ক্ত শিরায় শিরায় ওঠে এসেছে যেন। কষ্ট আর ক্রোধের সংমিশ্রণ চিত্র অর্ণবের চোখে দেখে কিরণের রূহ কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠলো। কিরণের মনে এখনো হাজারো প্রশ্ন। তাদের মাঝে এখনো অনেক জটলা পেকে আছে। তবুও কিরণ সেসব উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় অর্ণবের দিকে। অর্ণব সামনে তাকিয়ে আছে। অর্ণবের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। অর্ণবের চোখের দিকে তাকালে দেখতে পেলো অর্ণবের চোখ ছলছল করছে। পুরুষের চোখে পানি! অভেদ্য এ পুরুষের চোখেও পানি! কিরণের বুক হু হু করে ওঠে। মুখশ্রীতে আঁধার নেমে আসে। কথা বলতে গিয়ে খেয়াল করলো তার কন্ঠস্বর ভারি হয়ে গিয়েছে। সে কি অর্ণবের ব্যথা অনুভব করছে? পারছে কি আদৌও? কেবলমাত্র জমে যাওয়া পানি দেখেই কন্ঠ ভার হয়ে আসছে, তার ভেতরের জ্বালা পুড়াটা দেখলে কি সহ্য হবে? সে ক্ষমতা তার আছে? নেই।
কিরণ তার ভারি কন্ঠেই ডেকে ওঠে অর্ণবের নাম,

অর্ণব!

কিরণের কন্ঠের কম্পন অর্ণবের কানে যেতেই অর্ণবে পাশ ফিরে তাকায়। চুপসে যাওয়া মুখ দেখে অর্ণবের চোখের পানি শুকিয়ে দুঃচিন্তায় ভরে ওঠলো। পকেটে রাখা হাত দুটো দ্রুত বের করে কিরণের দু গালে আলতো করে রেখে নরম করে বলে,

ভেবো না সূর্যরাণী! আমি কাঁদছি না। আমার তো কাঁদার দিন শেষ। এই যে শেষটা সুন্দর হতে যাচ্ছে। এই জমে আসা জল আমার সাফল্যের।

কিরণ ধীরে ধীরে দু হাত অর্ণবে ডান হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,

আপনি এমন কেন, অর্ণব? কেন সেদিন বলেন নি কেন আমাকে ছেড়ে যাচ্ছেন? কেন বলেন নি আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন না, আমাকে আড়ালে রেখে যাচ্ছেন? আমাকে বললে কি আমি বুঝতে পারতাম না? জানেন সেদিন আমি আপনাকে জানাতে চেয়েছিলাম সেই প্রোগ্রামে যাওয়ার কথা। আমারও একটু খটকা লেগেছিল কেন আমরাই নির্বাচিত হলাম? যে মুহূর্তে আপনাকে কল করতে যাবো সেই মুহুর্তেই হিয়ার নাম ভেসে ওঠলো স্ক্রীণে। নিজের অজান্তেই কথার জালে পেচিয়ে সময় ব্যয় করে ফেললাম। সেদিন বুঝিনি আমার উপর নজর ছিল ওর। যখন যখন ফোন করতে গিয়েছি কোনো না কোনো ভাবে আটকে গিয়েছি। ওর ফোনটা রাখার পরই হঠাৎ ফোন এলো রফিকউল্লাহর সংস্থা থেকে। তারা নাকি ড্রাইভার পাঠাচ্ছেন। ড্রাইভার বললেন এইটা নাকি ভার্সিটি কর্তৃপক্ষের থেকে অনুমতি নিয়ে নিরাপত্তার জন্য নিজেদের গাড়ি ব্যবহার করছেন। ড্রাইভার খুবই অদ্ভুতভাবে বললো না পৌঁছানো পর্যন্ত কলেই থাকতে। আমাদের নাকি খুঁজতে অসুবিধা হবে। গাড়ি তে ওঠার পর থেকে আমাদের থেকে ব্যাগ চেক করে ব্যাগ রেখে দেওয়া হলো। পরবর্তীতে তা জমা দিল গেইটে। তখন জানাই ছিল না হিয়া আমার খোঁজ দিয়েছে। ঢাল হিসেবে আমি ব্যবহার হতে পারি তা কখনো কল্পনাই করি নি। হিয়াদের বাড়িতে দুবার গিয়েছিলাম। কখনো কোথাও ওর বাবাকে দেখি নি। সব সময়ই জানাতো ওর বাবা বাহিরে থাকে। নাম শুনলেও খেয়াল ছিল না। কারণ আমার তো সেসবে কোনো লেনদেন ছিলই না। আমি তো শুধু জানতাম হিয়া আল্লাহর দেওয়া মূল্যবান সম্পর্কগুলোর মধ্যে একজন। আমি ভুল ছিলাম। আমার বিশ্বাস ভুল ছিল। আমাকে ও বাড়িতে রেখে আসার কয়েকদিন পর যখন সবকিছুতে রহস্যের ঘ্রাণ পেলাম তখন থেকেই জানার পর্ব শুরু হলো। শুরু হলো আমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা না জানা তথ্যের খোঁজ করা। হিয়ার সবকিছু তখনই জানতে পারলাম। এটাও বুঝতে পারলাম আপনিও এ সম্পর্কে অবগত। তবে কেন আগে আমায় বলেন নি? কেন রেখেছিলেন এতো জটিলতা?

কিরণের গাল বেয়ে গড়িয়ে আসা পানি থেমে গেল অর্ণবের বৃদ্ধা আঙ্গুলে এসে। আদুরে স্পর্শে পানি মুছে দিয়ে কিরণের কপালে গভীরভাবে চুম্বন দেয়। আবেশে কিরণের চোখ বন্ধ হয়ে আসে। সাথে বেড়িয়ে আসে চোখে জমে থাকা অবশিষ্ট অশ্রুটুকু। অর্ণব ঠোঁট ওঠিয়ে কিরণের দিকে তাকায়। দু হাতের মাঝে থাকা এই মুখটা তার বড় প্রিয়। এ মুখে সকল অবতারে সে ভীষণভাবে আসক্ত। সেই ছোট কিশোরী মুখটার সাথে ভর যৌবনের এ মুখটার পার্থক্য হলেও অর্ণবের আকর্ষণের মাত্রার পার্থক্য হয় নি। সেসময়ও এ মুখশ্রীতে চোখ পড়লে ফেরাতে পারতো না, আজও পারে না।

নিরবতায় কিরণ চোখ মেলে তাকায়। সরাসরি চোখ পড়ে অর্ণবের সম্মোহিত চোখে। আজ আর কিরণ চোখ ফেরায় না। বরং চোখে চেখ রেখে ভ্রু খানিকটা উঁচু ইশারায় অর্ণবের উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। অর্ণব প্রাণবন্ত হাসিতে প্রফুল্ল গলায় বলে,

তোমার ত্বকের নিচটা দেখার বড় শখ। বোধ হয় চুম্বক আছে।

অদ্ভুত কথার সাপেক্ষে কিরণ ফিক করে হেঁসে ওঠে বলে,

আপনি এতো অদ্ভুত কথা কোথায় পান? মাথা তো নয় যেন শব্দকোষ।

কথার মাঝেই খুবই আলতোভাবে দু হাতে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরে। পিঠের দিকটায় দু হাত একসাথে বেঁধে শিকলের ন্যায় জড়িয়ে নেয় অর্ণবকে। অর্ণবও আরেকটু টেনে নেয় কিরণকে। দুজনের মাঝের দুরত্ব যখন খুবই কম তখনই কিরণ পুনরায় বলে,

আমি কিন্তু এখনো আমার উত্তর পেলাম না।

তুমি বড্ড জেদি কিরণ!

যেমনই হই, আপনারই তো। আপনি সামলাবেন আমার কি?

অর্ণবের মুখশ্রী জুড়ে খেলা বেড়ায় প্রসন্নতা। আজ সত্যি কি তবে সব পাওয়া তার হবে? এই যে যেমন কিশোর সেই কিরণ ফিরে আসছে ক্ষণে ক্ষণে। অভিমান অভিযোগ পালাক্রম শেষে অতীতের অপূর্ণ সেই প্রেমিকা রূপে।
হঠাৎই অর্ণবের গায়ে এক ফোঁটা পানি পড়তেই বুঝতে পারলো বৃষ্টি আসবে হয়তো। বিলম্ব না করে তৎক্ষনাৎ কিরণকে তুলে নিলো নিজের বাহুতে। কিরণ অপ্রস্তুত হলেও পরে নিজেকে সামলে নেয়। কিরণকে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও বসে পড়ে নিজের স্থানে। বেল্ট লাগিয়ে কিরণের দিকে তাকিয়ে বলে,

সব কিছু তোমায় জানালে তোমার কৌতুহল মন ও আট ইঞ্চির এই পা কিছুতেই অলস বসে থাকতো না। অদৃশ্য সুতোর টানে তুমি ছুটে যেতে আমার পিছু পিছু। না চাইতেও তুমি জড়িয়ে গিয়েছিলে, জানলে তোমায় হারিয়ে ফেলতাম এ ষড়যন্ত্রের খেলায়। তুমি আমার বড় শখের মানুষ কিরণ! তোমার দিকে অন্য কারো ফুল তোলাটাই সহ্য হয় না, অ*স্ত্র ওঠলে আমি নিঃস্ব হয়ে যেতাম যে।

কিরণ অপলক তাকিয়ে রইলো অর্ণবের দিকে। অর্ণবের ভালোবাসার সীমানা যতটুকু সে ভাবে, অর্ণবের সামনে এলে সেই সীমানা ততবারই ভেঙ্গে যায়। মাঝে মাঝে বুকের মাঝটায় পুড়ে ওঠে। কেন অর্ণবের মতো ভালোবাসতে সে পারে না? কেন অর্ণবের ভালোবাসার তীব্রতা এতো বেশি? সেও তো চায় পৃথিবী একদিকে ছুঁড়ে রেখে বিপরীতে কেবল সে আর অর্ণব থাকতে। অর্ণবের ভালোবাসার কাছে নিজের ভালোবাসার পরিমাণ ভিষণ কম লাগে কিরণের। তবুও সে খুশি হয়ে যায়। এমন হার প্রতিবার হোক। এমন হিংসায় প্রতি মুহুর্ত জ্বলতে চায়। যে হিংসা ভালোবাসা বাড়াবে সে হিংসা কিরণ প্রতি মুহুর্তে চায়।

সন্ধ্যার আযানের ধ্বনি কানে পৌঁছিয়েছে কেবল। কিরণ ধীরে ধীরে চোখ খুলে। ঘুম ঘুম ঘোরে চেনা অচেনার দ্বন্দ্বে পড়ে। চারপাশটা ভালো করে চোখ ঘুড়িয়ে চিনতে পেরে ধপ করে উঠে বসে। সেদিনের নেই রিসোর্টের রুম। বাহিরের থেকে বৃষ্টির ঝুম আওয়াজ কানে বাজছে। আজও কি তবে তেমনই বৃষ্টি? গাড়িতে বেঘোরে ঘুমিয়ে কখন এখানে এসেছে সে সম্পর্কে কিরণ অজ্ঞ। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয় পুনরায়। অর্ণবকে খুঁজছে দু চোখ। কোথায় সে? গায়ের চাদর ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। একে একে সব জায়গা দেখে নেয়। কোথাও অর্ণবের দেখা মিললো না। বাকি থাকা সুইমিং পুলের দিকে যেতেই হঠাৎ চোখের ওপর হা*মলা হলো। অকষাৎ এ ঘটনায় কিরণ ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। সাথে সাথেই কানের কাছে অর্ণবের মৃদু কন্ঠস্বর বারি খায়,

হুস! আমি! চিল্লাবে না।

শতকের ঘর পার করে যাওয়া হৃৎস্পন্দন অর্ণবের কন্ঠে নিচে নেমে এলো। তবুও স্বাভাবিক হলো না। এখনো তার শরীরের বাহ্যিক অঙ্গসমূহ কাঁপছে। কিরণ রেগে ওঠে,

ডাকাতের মতো হামলা করলে চিৎকার করবো না?

ডাকাত? হ্যা অবশ্য তোমায় ডাকাতি করতেই এসেছি বলতে পারো।

কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

ওই যে বললাম ডাকাতি করে নিয়ে যাবো। তাই এখন বিনাশব্দে কেবল হাঁটবে। কোনো প্রশ্ন না।

কিরণ বাধ্য মেয়ের মতো অর্ণবের কথায় চুপ হয়ে গেল। অর্ণবের দিক নির্দেশনা অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। হঠাৎ সিঁড়ি বাজলো পায়ে। অর্ণব কিরণের হাতটা ছেড়ে দিল। কিন্তু কিরণ ভড়কে গেল না। সে জানে অর্ণব তার হাত ছেড়ে তাকে আরো বেশি আঁকড়ে ধরতে। বন্ধুর পথে একা সে নয়। চোখের থেকেও হাত সড়িয়ে ফেলার সাথে সাথে কাপড়ের বাঁধন টের পেলো। তার কিছু সেকেন্ড পরেই কিরণ বুঝতে পারলো সে হাওয়ায় ভাসছে। দু হাত দিয়ে অর্ণবের গলা আঁকড়ে ধরে। নিরবতার মাঝে অর্ণবের ভারি নিঃশ্বাস বরাবর কিরণের বুকে আঁছড়ে পড়ছে। নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় কিরণের লোমকূপে কাটা দিয়ে ওঠে। এ অনুভূতি আরো গভীর হওয়ার আগেই কিরণ তার পায়ের নিচে ভূমির অস্তিত্ব খুঁজে পায়। বৃষ্টির আওয়াজটা আরেটু গাঢ় হয়ে কানে বাজছে। কিরণের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে তারা হয়তো খোলা ছাদে। চোখের বাঁধন খুলতেই নিজের অনুমান সঠিক হলো বুঝতে পেরেছে। ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে কিন্তু দরজা বন্ধ। পেছন ফিরে অর্ণবের উপস্থিতি না পেয়ে এবার একটু চমকে ওঠে। ভুতের মতো কোথায় উধাও হয় লোকটা? আশেপাশে তাকিয়ে কেবল ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই খুঁজে পেল না। সাহস করে দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। প্রকৃতি ও কৃত্রিমের অসম্ভব সুন্দর সংমিশ্রণে কিরণ বাকরুদ্ধ হয়ে রইলো। বিশাল ছাদ জুড়ে বাগান বিলাশের সাজানো ছড়াছড়ি। ফুলে ঢেকে রয়েছে ছাদের কিনারা। মাঝখান বরাবর ছাদের মতো নেমে এসেছে বাগান বিলাশ। এ যেনো ছাদের ওপর ছাদ। প্রকৃতির বাধ্য রূপে কিরণ চোখ আত্মভোলা হয়ে এক পা ছাদে বাড়াতেই বৃষ্টির ঝুম আওয়াজ ভেদ করে কানে পর্দায় কড়া নাড়ে চিরচেনা গিটারের স্বর। হলদেটে মরিচ বাতির আলোয় ছাদের রং পরিবর্তন হয়ে আসে। মাঝখানটায় বিলুপ্ত প্রায় হলুদ বাতি জ্বলে ওঠে। পরিষ্কার হয় ছাদের সম্পূর্ণ চিত্র। আবছা অন্ধকারে বাগান বিলাশের ভেসে থাকাটা বুঝতে অসুবিধে হলেও এখন বুঝে ওঠলো এতো খড়কুটোর ছাউনি। তার নিচেই দোলনা। লতায় পাতায় মুড়ানে দোলনা। ধুলোবালির শহরে এ যেন ছোট্ট এক পাহাড়ি গ্রাম। মোহে কিরণ ছাদে প্রবেশ করে। বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় শরীর আধভেজা হলো। গিটারের শব্দটা আরেকটু গাঢ় হলো। পাশ ফিরে তাকালো কিরণ। দেখা মিললো তার মতোই আধভেজা হয়ে গিটার হাতে এগিয়ে আসছে অর্ণব। নীল পাঞ্জাবিটা শরীরের সাথে ধীরে ধীরে লেগে পড়ছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতেই গলা ছেড়ে গেল অর্ণবের,

তবু এভাবে সময় আমার কেটে যাবে তোমাকে ভেবে
তোমায় নিয়ে স্বপ্নগুলো ভোর হলে যায় যে ভেঙে
আকাশ মেঘে বৃষ্টি হয়ে স্বপ্নগুলো দেয় ভিজিয়ে
তুমিও কি আমার সাথে ভিজবে পথে হাত জড়িয়ে?

এক গুচ্ছ কদম হাতে ভিজতে চাই তোমার সাথে
এক গুচ্ছ কদম হাতে ভিজতে চাই তোমার সাথে

অর্ণব থেমে একহাতে গিটার নিচে রেখে দেয়। পকেটে থেকে তিনটে কদম বের করে কিরণের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে,

তুমিও কি আমার সাথে ভিজবে পথে হাত জড়িয়ে?

বাকহারা কিরণ সত্যিই যেন কথা বলতে ভুলে বসেছে। আনন্দ অশ্রু বৃষ্টির পানিতে মিশেছে। তবুও চোখ চকচক করছে তার। অতিরিক্ত আনন্দে শরীর কেঁপে ওঠছে তার। কাঁপা হাতেই কদমগুলো হাতে নিয়ে বিদুৎতের গতিতে মাথা নাড়াতেই অর্ণব ওঠে দাড়িয়ে কিরণের কোমর পেচিয়ে মাঝের সকল দুরত্ব অদৃশ্য করে দেয়। এ যাবৎকালের মাঝের সকল দেয়াল গুড়িয়ে পড়েছে। আজ কেবল তাদের মাঝে উষ্ণ নিঃশ্বাস। ধীরে ধীরে দুই হাত দুই পাশের কোমরে রাখলো অর্ণব। ভিজে যাওয়া শরীরে অর্ণব ভেজা ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেটের দু পাশে অনুভব করতেই শরীর কেঁপে ওঠলো কিরণে। দু হাত দিয়ে দুই পাশের কাঁধের পাঞ্জাবি খামছে ধরে। দুজনেই ভিজে একাকার। শাড়িটা লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। আস্তে করে কিরণের কপালের সাথে ঠেকিয়ে দিল অর্ণবের কপাল, নাকের সাথে লাগিয়ে দিলে নাক। দুটি আলাদা দেহের নিঃশ্বাস এক হয়ে বুকে এসে আছড়ে পড়ছে। বৃষ্টির পানির ফোটাগুলো গড়িয়ে নাকজোড়ায় এসে মিলিত হয়ে আবারো মিশে যাচ্ছে শরীরে। বৃষ্টির ঝম ঝম আওয়াজেও তার হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ তোড়পাড় করে দিচ্ছে দুটি হৃদয়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিরবতায় আজ মুখের ভাষা। এতো নিরবতার মাঝে অর্ণবের কন্ঠ শুনতে পেলো,

ভালোবাসি প্রিয়তমা!

কিরণের ঢেউরের মতো বুকের উঠানামা হঠাৎ থমকে গেলো। চোখ মিটমিট করে খুলতে চাইলো কিন্তু খুলতে পারলো না। বরং আরো খিচে বন্ধ করে রাখলো। কাঁধে হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে ধরে। ঠোঁট জুড়ে হাসি। কিছু সময় পর লম্বা এক নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ খুলে কিরণ বলল,

মন খুব করে মিথ্যা বলতে চাইছে।

অর্ণব চট করে চোখ খুলে তাকায়। কিরণও ততক্ষণে চোখের পলক ওঠিয়েছে। কিরণের চোখে নিবন্ধন রেখে অর্ণব প্রতুত্তরে বলে,

মিথ্যা যদি “না” হয় তবে বিলম্ব করো না। আজ উন্মাদ হতে প্রস্তুত।

কিরণের হাসি আরো গাঢ় হলো। কাঁধ টেনে মুখটা আরেকটু কাছে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

একটুও ভালোবাসি না…

কিরণের কন্ঠ অর্ণবের কর্ণগোচর হওয়ার সেকেন্ড পরেই কিরণের ঠোঁটের উষ্ণতায় মিশে গেল অর্ণব। অর্ণবের ঘন হয়ে আসা নিঃশ্বাসে কিরণের মস্তিষ্কও শূন্য হয়ে আসলো। যেন বায়ুতে ভাসছে সে। অসাড় হয়ে আসা শীতল দেহ ছেড়ে দিল অর্ণবের উষ্ণতায়। অর্ণব দু হাতে কোমর পেচিয়ে নিলো পরগাছা লতার মতো। আজ দুজনের মাঝে বাতাসেরও প্রবেশ নিষেধ।

শীত শীত অনুভূতিতে কিরণের ঘুম হালকা হয়ে এলো। চোখ খুলে মস্তিষ্ক সচল হতেই শরীর ভার অনুভব হলো। গলার মাঝটায় একটা মানুষ আস্ত মুখটা গুজে রেখেছে। হাত দিয়ে দড়ির মতো বেঁধে আছে পেট। গলায় গরম নিঃশ্বাসে কিরণের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কেটে যাওয়া রাতের দৃশ্য মস্তিষ্কে পুনরাবৃত্তি হতেই কান গাল পুনরায় লজ্জায় লাল হয়ে এলো। এখন আর থাকছে পারছে না কিরণ। এ অবস্থা তার পরিবর্তন করতেই হবে। এ অবস্থায় থাকলে তার হৃৎস্পন্দনের উর্ধ্বেগতির ফলে অ্যটাক করে ফেলবে। সময় নিয়ে অর্ণব থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা শাড়ি পেচিয়ে ডুকে গেল গোসলে।

সারারাত বৃষ্টির পর সকালের আকাশ কাঁচের মতো স্বচ্ছ। মেঘগুলো যেন একটু বেশিই শুভ্র মনে হলো কিরণের। গোছল করে এসে রুমের রাতের জামা পগে বেরিয়ে সোফাতে থাকা একটা প্যকেটের দিকে নজর যায়। গতকাল সোফায় এমন কিছুই দেখে নি কিরণ। হয়তো ওরা ছাদে যাওয়ার পর রেখে গিয়েছে কেউ। সেখানে থাকা বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়েছে। বারান্দায় দাড়িয়ে হাতের গরম ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিয়ে পিছন ঘুরে তাকালো। অর্ণব এখনো ঘুমে। কেমন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে! কিরণ বারান্দার চৌকাঠে এগিয়ে এসে দেয়ালে শরীর ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। কফির কাপে এক একটা চুমুকে একবার করে পলক পড়ছে। বাকিটুকু তার দৃষ্টি নিবন্ধন অর্ণবের ঘুমন্ত মুখে। এ অসাধারণ মানবটা পুরোপুরি তার। তাদের সম্পর্কের সকল জটিলতা পানির মতো সরল হয়ে গিয়েছে। হৃদয়ের কোণে জমিয়ে রাখা কাল্পনিক ভোরটায় আজ বাস্তবত নিঃশ্বাস নিচ্ছে। জীবনটা অদ্ভুত। অতীতে কল্পনা করা কাল্পনিক ভবিষ্যৎ আজ সত্য, বাস্তব।

——

দুপুরের রোদ গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে মাত্রই। কিরণ ও অর্ণব দ্রুত গাড়ি নেমে বাড়ির ভেতরে যাচ্ছে। যোহরের আযান শেষ হতেই মেহরাবের ফোন আসে। হুট করে বলে সে নাকি বিয়ে করবে এবং আজ রাতের মাঝেই মেয়ের পরিবারের সাথে কথা বলতে হবে এবং তার দায়িত্ব অবশ্যই অর্ণবের। মেয়ের পরিচয় শতবার জিজ্ঞাসা করেও খুব একটা উপায় করতে পারি নি অর্ণব। কিছুতেই বলে নি। যা বলার সব সরাসরি বলতে চায়। উপায় না পেয়ে তৎক্ষনাৎ বেড়িয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে। পৌঁছোতে পৌছোতে বিকেল গড়ালো। বাড়িতে ঢুকতেই সব ভাই বোনদের উপস্থিতি অর্ণবকে খানিকটা অবাক করলো। জিহাদ, রোহান, ঋতু, মিতু, জান্নাত সকলেই উপস্থিত। সোফায় বসে সবাই নিজেদের মধ্যে খুবই জরুরি আলোচনা করছে। কিরণও সবাইকে লক্ষ করলো। তবে জান্নাতের উপস্থিতিতে ভ্রু কুচকে এলো তার। কিরণের অনুমান হিসবে জান্নাতের এ আলোচনায় থাকার প্রশ্নই আসে না। তবে কি জান্নাত নিজেও ঘটনা থেকে অজ্ঞ। কিরণ ও অর্ণব এগিয়ে যেতেই ওদের দেখতে পায় সকলেই। মিতু দৌড়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,

শুনেছো ভাইয়া কান্ড? মেহরাব ভাইয়া নাকি বিয়ে করবে। কোন মেয়ে নাকি পছন্দ হয়েছে তার তাই তাকে তিনদিনের মাঝেই বিয়ে করবে। বিয়ে কি ছেলেখেলা বলো? পাগল হয়েছে তোমার ভাই। সামলাও।

অর্ণব কিছু বলতে যাবে তার আগেই জিহাদ বলে,

পাগল বলছিস কেন? প্রেমে মজনু হয়েছে বল। ভাবতে পারছিস ও ডুবে ডুবে কতখানি পানি খেয়ে নিয়েছে?

রোহানও আফসোসের স্বরে বলে,

শালায় কি চালাক দেখেছিস? পছন্দ করলো, প্রেমে পড়লো, মেয়ে পটিয়ে এখন বিয়ে পর্যন্ত এগিয়ে গেলো। আর আমরা ভাই হয়ে ঘুনাক্ষরেও টের পেলাম না? অর্ণব ভাই! তোমাকে তো অন্তত বলা উচিৎ ছিল। কি ধুরন্ধর দেখেছো?

অর্ণব রোহান ও জিহাদকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

কোথায় সে?

ঋতু জানালো,

উপরের ঘরে। কি যেন কাজ করছে। বলেছে তোমরা না আসা পর্যন্ত তাকে বিরক্ত করতে না।

অর্ণব রেগে ওপরে ওঠতে ওঠতে বিরবির করে বলে ,

ওর বিরক্তি ছুটাচ্ছি আমি।

এদিকে কিরণ আড়চেখে জান্নাতের আঁধার হয়ে আসা মুখটা দেখে। কিরণ বুঝতে পারছে ওর অনুমান নিরানব্বই দশমিক নয় নয় ভাগ সঠিক। সে হিসেবে কিরণের মুখটা দেখে বেশ হাসিই পাচ্ছে। জান্নাতের অনুভূতিটা আরেকটু বাজিয়ে দেখতেই কিরণ গিয়ে মিতু ও জান্নাতের মাঝের দুরত্বে বসে জান্নাতের উদ্দেশ্যে বলে,

কি ব্যাপার মন খারাপ কেন? আনন্দের মহল বাড়িতে। সামনে ভাইয়ের বিয়ে। কোথায় হইচই করবে তা না করে এমন কালো করে বসে আছো কেন মুখটা? তোমার কি মন খারাপ জান্নাত?

কিরণ আচমকা তাকে এমন কথা জিজ্ঞাসা করবে জান্নাত তা কল্পনাই করে নি। অপ্রস্তুত হয়ে মিথ্যা বলতেও আটকিয়ে যায়,

আব কিছু না। মানে না । মানে মন খারাপ কেন হবে খামোখা? তুমি যে কিসব বলোনা না ভাবি। বিয়েতে কেউ মন খারাপ করে?

জান্নাতের মুখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেলো কিরণ। জান্নাতের মনে যে অনুভুতির সঞ্চার হয়েছে তা বুঝতে ব্যর্থ হলো না কিরণ। তাই মুখ চিপে হেসে নিল। কিরণ ঠিক করলো সে যে করেই হোক জান্নাতের মুখ থেকে এ ব্যপারে কিছু একটা শুনেই ছাড়বে। তাই মিতু ঋতুকে ছেড়ে জান্নাতের হাত ধরে ওঠে বললো,

আচ্ছা! তাহলে চলো তো আমার সাথে রুমে। একটু হেল্প করবে। তারপর মায়ের কাছে যাবো মেহরাব ভাইয়ের বউকে কি উপহার দিবো প্রথম দেখায় ভাবতে হবে না? মিতু-ঋতু তোমরা মেয়ে নিয়ে গবেষণা করা বাদ দাও। নিজেদের সাজ সজ্জা নিয়ে ভাবো তো। মেয়ে যখন দেখবে তখন এই সময় অপচয় করা নিয়ে কিন্তু খুবই আফসোস করবে। তাই কাজে লেগে পড়ো তো।

জান্নাত অসহায় হয়ে কিরণের অদ্ভুত আচরণ কেবল দেখেই গেলো। তার মনের ভেতরের জ্বলন কিরণের কথার সংঘর্ষ স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করে দিল। এমন যন্ত্রণা কেন হচ্ছে তার? এমন যন্ত্রণা হবে জানলে সে কি তার কদম বাড়াতো এই পথে?

—-

রাত গভীর হওয়ার পূর্বেই বাড়িতে পারমানবিক বো*মা পড়ে যায়। মেহরাব ডুবে জল খেয়েছে তারা জানে, তবে এতোটা খেয়ে যে নাকের দগা দিয়ে বোনের প্রেমে মজনু হয়ে বিয়ের জন্য উন্মাদ হয়েছে তা হয়তো দূর দূর পর্যন্ত কল্পনা করতে পারে নি। জান্নাতের পরিবার রাজি হয়ে যাওয়ার পর সকলের অবগত হওয়ার পর জান্নাত আর ভাই বোনদের আড্ডা মহলে আসে নি। সে তো লজ্জায় লাল নীল হয়ে দরজা দিয়েছে। কিভাবে যাবে সে তা ভেবেই কূল পাচ্ছে না। সবাই তো ভাবছে তারা প্রেম করেছে। কিন্তু তাদের কে বোঝাবে প্রেম শুরুর আগেই যে তার মেহরাব ভাই বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে। বড় ভাই বোনদের মাঝে নিজের এ কাটা মাথা নিয়ে কিভাবে দাঁড়াবে সেই চিন্তাতেই জান্নাতের প্রাণ ওষ্ঠাগত। মনে মনে বকে মেহরাবের গোষ্ঠী শুদ্ধ করে যাচ্ছে।

রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। মেহরাব ল্যপটপে কাজ করে যাচ্ছে। দরজার খুটখুট শব্দে মনোযোগ ভেঙে যায়। দরজা খোলা আসে তবুও দরজার আওয়াজে তাকিয়ে দেখলো কিরণ দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে তার মুচকি হাসি। কিরণকে দেখে মেহরাব ল্যপটপ বন্ধ করে ওঠে দাঁড়িয়ে ভেতরে আসতে বললো। মেহরাব বরাবরই কিরণকে বড্ড সম্মান করে। বয়সে কিরণ তার ছোট হলেও সম্পর্কর মূল্যে কিরণের প্রতি তার অগাধ সম্মান।
কিরণ সোফায় বসতেই মেহরাবও বিছানায় বসে জিজ্ঞাসা করে,

কোনো দরকার ভাবি?

কিরণ মুচকি হেসে ঘাড় নেড়ে জানায়। হাতে থাকা কফির দুটো কাপের একটা মেহরাবের দিকে এগিয়ে দেয়। মেহরাবও কৃতজ্ঞ হাসিতে হাতে নেয়। কিরণ কফিতে চুমুক দিয়ে বলে,

হ্যা! তা একটু দরকার বটেই। তবে কোনো কাজ নয়। কিছু প্রশ্ন করবো আপনি শুধু উত্তর দেবেন।

কিরণের কথায় মেহরাবের ভ্রু কুচকে এলো। হয়তো কিছুটা অনুমান করতে পারছে। তবুও জিজ্ঞাসা করলো,

কি ব্যপারে ভাবি?

আপনার ভাই বিগত দিনে আপনাকে যে কাজ দিয়েছে তার মধ্যেই কিছু কিছু।

ভাই? ভাই আমাকে দিয়ে কি করাবে?

কিরণ প্রফুল্লভাবে হেসে বলে,

ডিটেকটিভ দেবর সাহেব! কেন শুধু শুধু লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছেন? আমি জানি আমি যা জানতে চাই অর্ণব এবং লিয়াকত সাহেবের পর কেউ যদি জানে তবে সে ব্যক্তি আপনি। তাই সময় ব্যয় করো না। আপনার হবু বউ কিন্তু আমার হাতে।

মেহরাব গাল ফুলিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বলল,

ভাবি এইটা ঠিক হল না। আমার কাঁচা মাথার বউটাকে হাতিয়ার বানিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছেন এইটা ভাইকে জানাবো।

হা হা। সমস্যা নেই জানিয়ো। আজকে আমাকে বলেন কালকে আপনার ভাইকে জানিয়েন।

মেহরাব বুঝতে পারলো কিরণ আজ পণ করে এসেছে। আজ না হয় কাল সবকিছু জানবেই। কেন নয় আজই? তাই মেহরাব আর কথা না বাড়িয়ে বলে,

আচ্ছা! বলুন কি জানার আছে?

কিরণের মুখে এখনও হাসি। হাসি হাসে মুখেই বলে,

বেশি কিছু না। অর্ণব অনেক কিছুই বলেছেন। এসবও বলতেন যদি জিজ্ঞাসা করতাম। কিন্তু আমি চাই নি ওনাকে এসব নিয়ে আর ঘাটাতে। মূলত ওনি যা বলেছেন সেখান থেকেই এই প্রশ্নগুলো জেগেছে। প্রথম কৌতুহল হিয়া এখন কোথায়?

মেহরাব সকল ধরণের প্রশ্নের উত্তরের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে বসেছে। কিরণের প্রশ্ন শুনে কফিতে চুমুক দিয়ে সাবলিলভাবে বলে,

কানাডার জে*লে।

কিরণ আঁচ করেছিল এ ব্যপারে। সে বুঝতে পেরেছিল হিয়ার শাস্তির ব্যবস্থাও হয়েছে। কিন্তু কোথায় কিভাবে তা জানতেই পুনরায় প্রশ্ন করে,

জে*লে কিভাবে?

জুনায়েদ ভাই কানাডায় যাওয়ার পরই হিয়াও এসএসসি শেষ করে কানাডায় চলে যায়। জানেন হয়তো। ওখানে থেকে ভালোবাসার মানুষকে দেখছিল এবং পাশাপাশি সাহায্য করছিল বাপের অবৈ*ধ ব্যবাসাকেও। এ ব্যবসায় অবদান রাখা শুরু করেছে এই বছর তিনেক ধরে। আগে যে বয়স ছিল সে হিসেবে এসব রাস্তায় কাজ করার বয়স ওর ছিল না। ওই ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই অর্ণব ভাইয়ের পরিকল্পনা অনুসারেই জুনায়েদ ভাই কাজ করে। হিয়ার ব্যগে ড্রা*গস ও হিরো*ইন পায় স্থানীয় পুলিশ। আর জানই তো বাহিরের দেশগুলোয় এসবে ধরা খেলে শাস্তি কি কোঠর হয়। ও দেশের বাহিরে থাকায় বেশি পরিশ্রম করতে হয় নি। নিজেই আমার পথ সোজা করে দিয়েছে।

কিরণ কফিতে চুমুক দিয়েই যাচ্ছে তখনও। নিচের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে দ্বিতীয় প্রশ্ন করে,

আমাকে ও বাড়িতে রেখে মিশনে যাওয়ার কারণ?

অর্ণব ভাই নিজের পর আপনার নিরাপত্তা নিয়ে ভরসা করেন আপনার বাবার উপর। মিশনে যাওয়ার আগেই এ সমস্ত কিছু ভাই জেনে যান। মূলত আপনাকে অনুষ্ঠানে দেখার সাথে সাথেই আমাকে জানায়। আমিই আপনার কল লিষ্ট খুঁজে বের করি এর পিছনে হিয়ার অবদানটা। তারপর ওর পুরো জীবনবৃত্তান্ত বের করা আমাদের কাছে কয়েক মিনিটের ব্যপার। বুঝতে পারি ভাইয়া চলে যাওয়ার পর এ বাড়িতে আপনাকে একা রাখা বিপদজনক। হাতিয়ার হিসেবে আপনাকে ব্যবহার করবে শতভাগ নিশ্চিত। আমি মাঝে মাঝে আসলেও সবসময় থাকা সম্ভব হতো না। আপনার সাথে বিপদে জড়িয়ে পড়তো এ বাড়ির বাকি সদস্যরাও। তারমাঝে আরও একটা বাড়তি ঝামেলা যুক্ত হয়। সেও যুক্ত ওই রফিকউল্লাহর সাথেই। শালার পুরো গোষ্ঠীই কেন আপনার সাথে জড়িত বুঝলাম না ভাবি।

কিরণের কপালে সূক্ষ্ণ ভাজ পড়ে গেল। আর কে ওর সাথে জগিয়ে ভেবে পায় না। বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে,

আর কে?

কফির শেষটুকু চুমুক দিয়ে মেহরাব উপহাসের স্বরে বলে,

রফিকউল্লাহর প্রথম পক্ষের ছেলে। আপনার ডিপার্টমেন্টের। রনিত ইফরান উরফে রনি। আপনার সাথে সম্ভবত কোনো ঝামেলা হয়েছিল। সেই সূত্র ধরে আপনার দিকে নজর পড়ে। আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। এক দুবার তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল ভাইয়া থাকতেই কিন্তু পারে নি নিজের বাপের জন্যই। নমিনেশন পাওয়ার আগে ঝামেলায় জড়াতে চান নি। পরবর্তীতে আপনাকে নিজে তুলে ছেলের হাতে দেবেন বলেছিলেন। এ বাড়িতে থাকলে ওর থেকে বাঁচিয়ে রাখাও সমস্যা হতো। তাই ও বাড়িতে পাঠানে হয়। আংকেল এ বিষয়ে সব জানতেন। এছাড়া ভাই আপনার নিরাপত্তার জন্য রক্ষি রেখেছিলেন। যখন বাহিরে বের হতেন তখন তারা আপনাকে সিকিউরিটি প্রভাইড করতো। আর আমি তো ছিলামই আপডেট নিতে। ওই ছেলে এখন হাসপাতালে। শেষ একমাস আগে আনার পিছু নিয়েছিল। ভাই মিশন থেকে আসার পর পরই সর্বপ্রথম দিনই ওর জন্য হাসপাতালের একটা সিট বুকিং করে আসে।

তার অগোচরে এতো ঘটনা অথচ সে জানেই না? কিরণ নিরব হয়ে বসে থাকে। লোকটা দূরে থেকেও তার ভালোবাসা, দায়িত্ব থেকে এক বিন্দু কখনো পিছ পা হয় নি। এত কেন ভালবাসে?

বুক চিড়ে নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে কিরণের। শেষ প্রশ্নটার জন্য মুখ তুলতেই মেহরাব নিজ থেকেই বলে,

আমি জানি ভাবি এর পরের প্রশ্নটা কি। গত কালকের ঘটনা তাই তো?

কিরণ মলিন হেসে সম্মতি জানায়। মেহরাবও হেসে দিয়ে বলে,

একদম কাঁচা খেলোয়ারের কাজ। বিদেশ বসে পাতি গু*ন্ডাদের দিয়ে আপনার আদরের ননদ মিহু এসব করায়। ভেবেছিল ল্যন্ডফোন থেকে কল করলে জানতে পারবো না। গোবর মাথায় একদম বুঝেছো? নাম্বারটা পাওয়ার ঠিক বিশ মিনিটের মাথায় ওর পরিচয় বের করেছি। দেশের গোয়েন্দা বিভাগ এবং আইসিটি যে কতটা উন্নত হয়েছে তা ওই গর্দভটা জানেই না হয়তো। তাই এমন কাজ করেছে। এই তো ঘন্টাখানেট আগে ওর আগে যেখানে চিকিৎসা করা হতো সেখানে খোঁজ নিলাম। দুদিনের মধ্যে আবারো ট্রিটমেন্ট শুরু করবে। ও যে অর্ণবের কাজিন এইটা আমার মানতেই শ্বাসকষ্ট হয়। ওইরকম তুখোর একটা ছেলের কাজিন কিনা দেড় ইঞ্চির ব্রেনসম্পন্ন?

মেহরাবের শেষ কথায় কিরণ হেঁসে ওঠে। হাসতে হাসতে সোফার হাতলে হাতের কুনই ঠেকিয়ে মাথায় হাত রাখে। তারপর রসিকতার স্বরে বলে,

তো এখন বলেন দেখি আমার সিধেসাদা বোনটাকে পটালে কি করে?

মেহরাব এতক্ষণে যেন মন মত কোনো প্রশ্ন পেলো। এই একটা কথা সে কাউকে বলতে পারে নি। কেউ তো তাকে জিজ্ঞাসাই করলো না। তাই প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথে উত্তেজিত হয়ে বলে,

এতক্ষণে একটা জুতসই প্রশ্ন করলেন। তবে একটু ভুল হয়ছে। পটাই নি তবে বুঝতে পেরেছি সে নিজে নিজেই পটেছে।

কিরকম?

সেদিন ওদের কলেজের বর্ষাবরণ অনুষ্ঠানে ওকে আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম। কাকতালিয়ভাবে আমাদের পোষাকের রং মিলে গিয়েছিল। আর ওকেও শাড়িতে দেখার লোভটা ঠিক সামলাতে পারি নি। গাড়িতে বসেই এক বন্ধুকে জানাই ক্যামেরা নিয়ে আসতে। ওকে বলেছিলাম কোনো ছবি না, শুধু ভিডিও করবে। আমি ওর কলেজ গেইটের কিছুটা দূরেই গাড়ি পার্ক করেছিলাম। গেইট পর্যন্ত পুরো রাস্তা টুকু ভিডিও হয়েছিল দূর থেকেই। পরবর্তীতে গতকাল রাতে সেই ভিডিও দেখি। তার আড়চোখে আমাকে দেখা, মুখ ঘুড়িয়ে মুচকি হাসি, আমি গাড়িতে ওঠে আসার পর আপনার ননদের আবারও বাহিরে আসা সবকিছু ক্যমরার চোখ দিয়ে দেখি। না হলে তো আপনার দেবরটা ধরতেই পারতো না আপনাদের ছোট মরিচ আর ছোট নেই, বড় হয়েছে। দীর্ঘ কয়েক বছর অপেক্ষা করেছি জান্নাতের মনে আমার জন্য একটু অনুভূতি তৈরির আশায়। সে সময় যখন এসেই গিয়েছে তবে আর দেড়ি কেন?

মেহরাবের চোখের আকুলতায় কিরণ মুচকি হাসলো। মজার ছলে বললো,

তোমরা সব ভাইয়েরা দেখা যাচ্ছে ভালোবাসায় পিএইসডি করা।

মেহরাব হেসে বলে,

যতই পিএইসডি করি অর্ণব ভাইয়ের মতো ভালোবাসায় ওতো ধৈর্য হয়তো আমার হতো না। ভাই যে কি কি করেছে তা কি জানেন ?

কিরণ মুচকি হেসে আরেকটু আয়েশ করে বসে বলে,

আপনার ভাই কি করেছে তা যে আমি জানি সেইটা আপনার ভাই জানে না।

মেহরাব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

মানে? চাকরিতে চলে যাওয়ার আগের ঘটনাগুলো আপনি জানেন?

কিরণ মাথা উপর নিচে করে নাগিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে,

এ কথা বাবা নিজেই আমাকে জানিয়েছেন ছ মাস আগে। আমি যখন বিষণ্ণতায় দিন কাটাচ্ছিলাম তখনই একদিন বিকেলে সব জানায়। অর্ণব যেদিন বিদায় নেয় আমার থেকে তার আগের দিনের সাথে সেদিনের কথা মোটেও মিল ছিল না কেন আমি সেই দোটানাতেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম ছ’টা বছর। তার কয়েকদিন আগেই অর্ণবের নৌবাহিনীতে চাকরির জয়েন্ট লেটার এসেছিল। সেই চাকরির ভিত্তিতে যখন বাবার কাছে সাহস করে যায় বাবা বাংলা সিনেমার বাবাদের মতো কিছুটা দাবি করে বসে। আমরা আসলে বুঝি না মা বাবা সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠটাই চান। বাবাও সেদিন তাই চেয়েছিলেন। তাই অর্ণবের সাধারণ পদে চাকরিটাতে আপত্তি জানান। মুখ ফুটে বলেই দিয়েছিলেন, ” একজন সাবেক ভাইস এডমিরালের মেয়েকে বিয়ে দেবো তার সাথে যে কিনা সর্বোচ্চ হলেও মাস্টার্স চিফ পেটি অফিসার হতে পারবে। সময় আছে এখনো। আবারো চেষ্টা করো। অফিসারে ডুকতে পারলে আমি শফিকউদ্দিন তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমার জন্য আমি আমার মেয়েকে সযত্নে নিজের কাছেই আমানত হিসেবে রেখে দেব। হোক তা যত বছরই। কিন্তু আমার মেয়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করতে হবে। তোমার কথা মতো কিরণও যদি তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে থাকে তবে তার অনুভূতিও আমি যাচাই করে দেখতে চাই। এইটা তোমাদের সাময়িক আকর্ষণ নাকি সত্য প্রেম। বল পারবে? ”
বাবা আসলে জানতেন অর্ণব খুবই মেধাবী ছাত্র। আইন বিভাগে পাবলিকে পগা একজন ছেলের নিশ্চয়ই আরো ভালো স্থান প্রাপ্য। তাই ওভাবে বলেছিল। আমি খেয়াল করতাম বাবা কখনোই আমার বিয়ের সম্পর্কে বলতো না। মা বলতো বিয়ের কথা কিন্তু সেই বিয়ের প্রস্তাব প্রতিবার আমিই ভেঙ্গে আসতাম। অথচ আমি জানতামই না আমি না ভাঙ্গলেও সে প্রস্তাব এমনিও ভাঙ্গবে। আমি সত্যি বড় ভাগ্যবতী। তার বলা ‘ভাগ্যবতী’। এর মাঝে চাকরিতে যাওয়ার পর পরই দুই নম্বরির জন্য রফিকউল্লাহকে তার প্রমোশনের দিনই ধরা খাইয়ে সাসপেন্স করায় সেটাও জানি। এসবের চক্করে বিয়েটা পিছিয়ে গেলেও দুজন পুরুসের কেউই কারো কথার খেলাপ কিন্তু করে নি। প্রকৃত পক্ষেই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ দুই পুরুষ আছেন। একজন বটবৃক্ষ, অন্য জন বিশাল আকাশ।

অদ্ভুত এক প্রশান্তির শ্বাস বেড়িয়ে গেল কিরণের শ্বাসনালি বেয়ে। মেহরাবের দিকে তাকিয়ে সেই অমায়িক হাসি দিয়েই বললো,

আমার ছোট্ট বোনটাকেও এমন ভাগ্যবতী অনুভব করানোর দায়িত্ব আপনার। সে যদি কষ্ট পেয়েছে আপনার কপালে শনি আছে। আপনার বাড়ি ছাড়া তার বাড়ি কিছু আরো দুটো আছে মনে রেখো। একেবারের জন্য এনে বসিয়ে রাখবো তবুও আপনার কাছে পাঠাবো না।

এইটা ভারি অন্যায়। ও আপনার ননদ আমি কিছু না? আমিও আপনার দেবর। এইটা ভুললে চলবে না। আমাকে ননদ জামাই হিসেবে দেখছেন অথচ ওকে তো জা হিসেবে একবারও বলছেন না।

কিরণ ওঠে দাঁড়ায়। রাত অনেকটা হলো। এবার ঘরে যাওয়া প্রয়োজন। যাওয়ার আগে হেসে বলে যায়,

ও আমার ননদ না তাই জা ভাবতে পারছি না। ও আমার বোন। তাই আপনাকে বোন জামাই ভাবছি।

—-

উৎসবের আমেজে পুরো বাড়ি গমগম করছে। বাড়ির প্রতিটি কোণায় কোণায় মানুষের আনাগোনা। জান্নাত ও মেহরাবের আংটি বলদের অনুষ্ঠান অর্ণবদের বাড়িতেই হচ্ছে। তাই কিরণের কাজেরও অবকাশ নেই। আধ ঘন্টা আগেই আংকি বদলের পর্ব শেষে করে সকলে ছবি তোলায় ভিষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাড়ির গুরুজনেরা ব্যস্ত অথিতি আপ্যায়নে। সেখানে বাগির একমাত্র বউ কিরণ। তার দায়িত্ব ছেড়ে হাফ ছেড়ে বসার এতটুকু সময় নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবদি সে কেবল ছুটোছুটিতেই মত্ত। হালকা কাজের কালো রঙ্গের শাড়িতও কাজের ও হাতের জিনিসের চাপে হাঁটতে পারছে না। ক্লান্ত হয়ে আসা শরীরটা খুব করে বিশ্রাম চাইছে। হাতের থাকা উপহারের বক্সগুলো নামিয়ে সোফায় বসতেই ডাক এলো মায়ের। সেদিকে যেতে উদ্ধত হতেই হঠাৎ টান পড়লো হাতে। পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলো কালো শার্ট প্যান্ট পরিহিত অর্ণবকে। কোটটা খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছে। গলার টাইটাও ঢিলে হয়ে বুকে পড়েছে। বেচারা অর্ণবও সারাদিন বেশ খেটেছে। ছেলেদের দিকের দেখাশুনা তাকেই বেশি করতে হয়েছে। জিহাদ -রোহান মেহরাবকে ঘাড় ছেড়ে ওঠার সময়ই পাই নি। ক্লান্তি তার চোখে মুখেও বিদ্যমান। অর্ণবের এ দশা দেখে কিরণের বেশ মায়া হলো। চোখ জুড়ে মায়ারা নেমেও এলো। সে মায়া ভরা মুখেই আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেসা করলো,

আপনার কিছু চাই? ঠান্ডা শরবত খাবেন? দিন কোর্ট টা আমার কাছে দিন। এখন আর পড়তে হবে না।

কিরণ অর্ণবের কাছে এসে কোর্টটা হাতে নিতে প্রস্তুত হতেই অর্ণব ক্লান্ত স্বরে বলে,

হুম! আমার এখন তোমাকে চাই।

কিরণ ভ্রু কুচকে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই অর্ণবে কিরণের হাত টেনে নিয়ে আসে উপরে। ছাদের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পুনরায় ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। কিরণ পেছন দাড়িয়ে অর্ণবের কাজ দেখে ভ্যবাচেকা খেয়ে যায়। দরজা কেন বন্ধ করে এ লোক ?

আপনি দরজা বন্ধ করছেন কেন?

অর্ণব কিরণের দিকে ঘুরে বলে,

ঘুমাবো।

এখানে? এই ফ্লোরে?

অর্ণব মুচকি হেঁসে কিরণের দিকে তাকিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। সামনের দিকে তাকাতে বলে। কিরণও কথা অনুযায়ী তাকিয়ে দেখে তোশক বিছানো সুন্দর গোছানো এক বিছানা। অবাকে কিরণের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

এখানে ঘুমাবো আমরা? মানুষ কি বলবে? আর… আর এখন এভাবে যে নিয়ে এলেন সবাই কি ভাববে?

অর্ণব কিরণকে ছেড়ে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত টেনে কাছে এনে দাঁড় করায়। ডান হাতে কোমর জড়িয়ে নেয়। বাম হাত চুলের ভেতরে দিয়ে মুখশ্রী আরেকটু কাছে আনে। সারাদিনের ব্যস্ততার পরও কিরণ যেন তার নাম গুণে এখনও আলোকিত। চোখের উপর নিচের কাজলের মাঝে মায়া ভরা চোখের গভীরতা মাপযোগ্য হলে হয়তো অর্ণব ঠিক মেপে মেপে ডুব দিত। সে যে এখন তল পায় না। কত যে গভীর তার ঠাঁইও পা না। ক্লান্তিমাখা মুখটায় দেখে অর্ণবের যেন দ্বিগুণ আদর আদর ভাব জাগছে। নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পেরে নাকের মাথায় চুমু দিয়েই দিলো। মুচকি হেসে মৃদু স্বরে বলে,

কে কি বলবে তার পরোয়া কি কখনো করেছি? তুমি বুঝো না আমার কাছে এই পুরো পৃথিবীটা এক দিকে আর তার #বিপরীতে_তুমি_আমি।

পৃথিবী ধ্বংস হোক তবু তুমি রও আমার হয়ে,
বেহেস্তে হুর নাহি চাই, তোমারেই যেন পাই অনন্তরূপে!

আবেশে কিরণের গাল বেয়ে পানি ঝড়ে পড়ে। দুহাতে জড়িয়ে ধরে অর্ণবে আষ্টেপৃষ্টে। সুখের কান্নাগুলো এতো বাঁধভাঙ্গা হয় কিরণের জানা ছিল না। আবেগগুলো উপকূলে আছড়ে পড়ে। সেই আবেগ, প্রেমের জোয়ারেই কিরণ বারংবার ভাসতে চায়। বেঁধে রাখতে চায় নিজেকেই এমন মানুষের খাঁচাতে । সঁপে দেয় আপন আত্মা, আপন মানুষেরই তরে।

সমাপ্তি ~~~

অবশেষে শেষ করতে পারলাম। জানি না কতটুকু আপনাদের দিতে পেরেছি কিন্তু আমি আমার সর্বোস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছি। ইনশাআল্লাহ সামনে নিজেকে, নিজের লেখা আরো উত্তমরূপে আপনাদের দেয়ার চেষ্টা করবো। এ গল্পের অবশিষ্ট ভুলত্রুটি গুলো নতুন লেখিকা হিসবে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। এতোদিন যারা সাথে থেকেছেন তাদের প্রতি আমি অসীম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আপনার সকলকেই অসংখ্য ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here