বিপরীতে তুমি আমি (দ্বিতীয়_পরিচ্ছদ) পর্ব ৭

0
414

#বিপরীতে_তুমি_আমি
(দ্বিতীয়_পরিচ্ছদ)
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম
|৭|

কাচঁ ভেদ করে আসা দিনের আলোয় ঝকঝক করা পরিবেশ হঠাৎই পর্দায় বাঁধা পেয়ে আঁধো আঁধারে ছেয়ে এলো। রেস্তোরাঁয় সব থাকা প্রতিটি ব্যক্তি নিজ নিজ মগ্ন থাকা কাজ ছেড়ে সচেতন হলো। সাদা রঙের আলো পরিবর্তন হলো নীল লাল আলোয়। সকলে হয়ে ওঠলো আরো এক ধাপ উৎসুক। কিন্তু কিরণের চিত্ত প্রবাহিত হলো বিপরীতে। উশখুশ মন নিয়ে অর্ণবের আশার প্রহরই সে গুনছিলো। মন বলছে যে কোনো সময় যা কিছু হতে পারে। আশেপাশে বিপ*দ বেঁজীর মতো ওত পেতে আছে। সুযোগ আর সময়ের ধারা একত্র হলেই ঝাপিয়ে পড়বে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে কিরণের। তার মাঝে এসির হাওয়া ভালো প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। জমে যাওয়াটাই বাকি আছে। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক ভাবে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মন ও মস্তিষ্ক এক তালে যোগ দিয়ে বলছে ‘ অর্ণব আছেন’। দুই থেকে তিন মিনিটের মাঝেই দিনের আলো যেন সন্ধ্যার সূর্যোদয়ের মতো আঁধার হয়ে এলো। রংবেরঙের আলোয় মানুষের উপস্থিত বোঝা গেলেও খুব একটা চেনার মতো অবস্থায় নেই। কিরণর চিত্ত ব্যকুল হয়ে ওঠছে। মৃদু কাঁপা হাতে ফোন অন করে স্ক্রিনে সময় দেখে নেয়। স্ক্রিনের সেই আলো বন্ধ হওয়ার আগেই পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া দ্বিতীয় বারের মতো পরিবর্তন হলো। গিটারের মৃদু ঝংকারেই উৎসুক জনতায় আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়লো। কিরণ না চাইতেও তাকালো সামনে। অাবছায়া এক মানব কায়া। মুখশ্রী দেখা জো নেই। বসে থাকা হাতের ভাজের গিটারটা বুঝিয়ে দিল আসন্ন গানের আসরের আয়োজন। কিরণের মনে কিঞ্চিৎ পরিমাণ যে কৌতুহল জেগেছিল তা ফুরিয়ে এলো। গানের আসরের সাথে তার কোনো লেনদেন নেই। তার সকল লেনদেন কেবলি একটা মানুষকে ঘিরে। সেরার সেরা গায়কের সাথে তুলনায় তার কাছে অর্ণবের কন্ঠস্বরই সেরা। প্রকৃতপক্ষেই অর্ণবের কন্ঠের স্বর আত্মভোলানো বটেই। যদি বর্তমান পেশায় সে নিয়োজিত না থাকতো তবে গায়ক হিসেবে পরিচয়টা উত্তম পর্যায়েই যেত। কিরণের ঠোঁট প্রশস্ত হয়ে এলো সে কথা ভেবে। তার সেকেন্ডখানেক পরই গায়েবি কন্ঠের মতো বন্ধ রেস্তোরাঁ কেঁপে ওঠলো,

আমি যে নিজেই মত্ত
জানিনা তোমার শর্ত
আমি যে নিজেই মত্ত
জানিনা তোমার শর্ত

রেস্তোরাঁর চার দেয়ালে কন্ঠস্বর বারি খেয়ে অদ্ভুত প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করছে। সেই প্রতিধ্বনির আওয়াজ সব পানির মতো শুষে নিল কিরণের কান। বিদ্যুৎতের গতিতে সনাক্ত করে নিল কন্ঠের মালিককে। কিরণ সোজা হয়ে বসে পড়লো। অত্যাধিক পর্যায়ে স্তম্ভিত হয়ে ওঠে দাঁড়াতেই পরিবেশ বুঝতে ওঠতেই পুনরায় বসে পড়লো। সামনের রাখা টেবিলটাকে দু হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে। এ যাবৎ কালের দমিয়ে রাখা সকল অনুভূতি একত্র হয়ে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভূমিকম্প শুরু করে দিয়েছে। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো অর্ণবের অস্পষ্ট কায়ার দিকে।

হয়তো তোমারই জন্য
হয়েছি প্রেমে যে বন্য
জানি তুমি অনন্য
আশার হাত বাড়াই

আহা… হুম… আহা…

সুরে মত্ত হয়ে কিরণের হাত গালে এসে ঠেকেছে। শিথিল হয়ে আসছে তার র*ক্তের কম্পন। অস্পষ্ট সেই কায়ার দিকে তাকিয়েই তার অবচেতন মন ভাবছে অর্ণবের চোখ দুটোও নিশ্চয়ই তার দিকে নিক্ষিপ্ত। সে চোখ জোড়ায় সর্বক্ষণের মতো এখনও গহীন প্রণয়ের বিক্ষোভ চলছে। কিরণের চোখ চিকচিক করে ওঠলো। এতো প্রেম তার অংশেও দেওয়া ছিল? এমন প্রেমিক বর তার এই তিন ইঞ্চি কপালে কি করে বসে পড়লে? ভাগ্য বড়ই আশ্চর্য! কিরণের হঠাৎ চোখ পড়লো তার সামনের দিকের এক টেবিলে। লম্বাটে শরীরের এক পুরুষ ডান হাত দিয়ে একটানে দুরত্বে বসে থাকা নারীটির চেয়ার নিজের সন্নিকটে নিয়ে এলো। এক মুহুর্তেই তাদের মাঝের দুরত্ব অদৃশ্য হয়ে গেল। নারীর হাতের ভাঁজে গিয়ে গেল পুরুষের হাত। বলিষ্ঠ কাঁধটায় ঠায় দিল প্রিয় নারীর মাথাটা। এরাই হয়তো প্রেমের বন্য প্রাণী। কিরণ আপনাআপনি হেসে ওঠলো। পুনরায় অর্ণবের দিকে তাকালো।

রেখোনা মনের দন্দ্ব
সব ছেড়ে চলো যাই

হঠাৎই থেমে গেল অর্ণব। কিরণের হাসি হাসি মুখ পরিবর্তন হলো। তাকিয়ে রইলো অর্ণবের দিকে। মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পুনরায় শঙ্কিত হলো মন। ভুলে যাওয়া ভয় পুনরায় ভিড় করলো। কিছু কি হলো?
নিরবতার সেকেন্ড পরেই অর্ণবের কথা শোনা গেল,

এটুকু শুধু তোমারই জন্য..

উপস্থিতির অধিকাংশ দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসিত হয়ে ওঠলো। ভালোবাসা দেখতেও সুন্দর। তৃতীয় ব্যক্তি ব্যতীত এ সৌন্দর্যের শত্রু পৃথিবীতে বিরল।
অর্ণবের কথা কিরণর বোধগম্য হতেই অন্ধকারে থাকা গালটা রক্তিম আভায় নুয়ে পড়লো।

রেখোনা মনের দ্বন্দ্ব
সব ছেড়ে চল যাই…..

হয়তো তোমারই জন্য
হয়েছি প্রেমে যে বন্য
জানি তুমি অনন্য
আশার হাত বাড়াই

যদি কখনো একান্তে
চেয়েছি তোমায় জানতে
শুরু থেকে শেষ প্রান্তে
ছুটে ছুটে গেছি তাই…..

সূর্যের কিরণের মতো সরু এক আলো এসে আঁচড়ে পড়লো অর্ণবের গায়ে। নীল পাঞ্জাবি পরিহিত আপন পুরুষটাকে দেখে কিরণের শিথিল হৃদয় শীতল হয়ে এলো। মানুষের ভীড় লেগে থাকা পুরুষটার অনুভূতির ভীড় তাকে ঘিরে। কি অদ্ভুত এ প্রেম! মাস খানেক আগেই এ প্রমের উত্তপ্ত অগ্নিকুন্ডে যেখানে মন ঝলছে গিয়েছিল প্রায় সেই প্রেমের উত্তাপ আজকাল উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। একটু বেশিই ছড়াচ্ছে বোধ হয়।

অর্ণব সৌজন্যমূলক ছোট্ট এক মুচকি হাঁসি ছুঁড়ে দেয় উপস্থিত সকলের দিকে। গিটারে রাখা হাতটা সামনের দন্ডায়মান মাইকের ওপরে রাখে। অবাধ্য চোখ কিরণের দিকে ছুটে যাচ্ছে বার বার। এক পলক তাকিয়ে ঘুরিয়ে আনে সেই নজর। প্রফুল্ল মৃদু স্বরে এবার বলে,

আমার বিশেষ মুহুর্তের সাথে আপনাদের সকলের মূল্যবান সময় সমন্বয় করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ। সেই সাথে ক্ষমাপার্থী ত্রুটিপূর্ণ গানের জন্য। আমি নামজাদা কোনো গায়ক নই। আপনাদের থেকেও সাধারণ মানুষ। নিত্যান্তই এক সাধারণ প্রেমিক পুরুষ। প্রিয়তমার মনে অবস্থানকৃত স্থানটি কৌশলে আরেকটু বড় করার চেষ্টামাত্র। নাটকীয় কৌশল! আসলে এ জীবনটাই বড় নাটক। জীবন থেকেটই তো নাটক। জীবন না থাকলে নাটকের অস্তিত্বই থাকতো না। অধমের এই নাটকের নিজেদের সামিল করেছেন। অধম প্রেমিক ধন্য হলো। ধন্যবাদ!

অর্ণব গিটারের লম্বা ফিতাটা গলা থেকে নামাচ্ছিল। সামনে থেকে এক পুরুষালি কন্ঠ বলে ওঠে,

নাটক কি তবে এখানেই শেষ হলো? পর্দার আড়ালে যে কত কিছু রয়ে গেল।

পুরুষটার মুখোমুখি বসে থাকা নারীটিও তাল মিলালো,

অধম প্রেমিকের ভাগ্যবতী প্রেমিকাকে পর্দার সামনে আনা হোক। আমরা দেখি কে সে নারী যার জন্য এতো বড় নাটক রচিত হলো। দেখে একটু হিংসে করি। সেই হিংসা যদি চোখে পড়ে আমার প্রেমিক পুরুষও কিছু শেখে।

নারীটির চোখে স্পষ্ট দেখা গেল অভিমান। সামনে বসে থাকা পুরুষটির চোখেও দেখা মিললো হতাশা। প্রেমিকা অপরের প্রেমিকের কার্যে সন্তুষ্ট হবে কিন্তু নিজ প্রেমিক পুরুষের প্রতি আজন্ম জমে থাকবে অভিযোগ। পর্যাপ্ত ভালো না বাসার অভিযোগ।

অর্ণবের হাত থেমে গেল। প্রশ্ন শুনে সামনে তাকিয়ে পুনরায় হাসলো। হাসি পেলো মান অভিযোগের চাক্ষুষ সাক্ষী হয়ে। যত্নে গিটারটা চেয়ারের সাথে ঠেকালো। মাইকের আরেকটু কাছে গিয়ে বললো,

সে আসলেই বড় ভাগ্যবতী
আমার শূন্য জীবনের সফলতার বুনিয়াদি
সে থাকে অন্তরালে, বড় যত্নে, কোমল তার গড়ন
কালো টিপের বড় অভাব!
অক্ষির বিষে খারাবি ত্রাস
তারে প্রকাশ্যে আনা বারণ…..

বদ্ধ এক রুমে লিয়াকত সহ আরো দুজন লোক এক যুবকে টেনে আনলো। ধস্তাধস্তি করে অজ্ঞাত যুবককে চেয়ারে বাঁধতে তাদের ঘাম ছুটে গেছে। লিয়াকতও হাপিয়ে ওঠেছে। এতো মানুষের ভীড় থেকে একজন সুস্থ সবল যুবকে ওঠিয়ে আনা কি চারটি খানি কথা? জানালা থেকে একটু দূরে বড় একটা টেবিল। তার পাশে বিশাল এক বোর্ড। মাথার উপরে চকচকে পাখা। লিয়াকত সুইচ টিপে পাখা চালু করতেই শান্তি অনুভব হলো। দুজনের মাঝে একজনকে পাঠালো ঠান্ডা পানি আনতে। এ গরমে ঠান্ডা পানি ছাড়া পুরোপুরি শান্তির বিকল্প অন্য কিছু নেই। অন্যজন আট*ক করা যুবকের বাঁধন আরো মজবুত করতে উদ্ভুদ্ধ হয়েছে। কালো রঙের বিশেষ যন্ত্র ঠেকিয়ে যুবকটিকে বেশিক্ষণ দমিয়ে রাখতে অক্ষম হচ্ছিল। উপায়হীন হয়ে হাত পা, চোখ মুখ বেঁধে নিয়ে এসেছে। বিশেষ সুপারিশে আইনের হাতে তুলে দেওয়ার আগে নিজেদের ব্যক্তিগত ডেরায় এনেছে। অর্ণবের আদেশ। ব্যক্তিগতভাবে কথা বের করবে সে। তারপর পাঠাবে সেখানে তার ঠিকানা। ছেলেটির ছটফট লক্ষ করে লিয়াকত কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। এক টানে মুখের বাঁধন খুলে ফেলে। চোখের ইশারায় পেছনে থাকা লোকটিকে চোখের বাঁধন খুলতে আদেশ দেয়। বাঁধন খুলেও গেল। ছেলেটির চোখে মুখে ভয়ের হিমালয় দেখতে পেল লিয়াকত। যেন তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না সে ধরা পড়তে পারে। লিয়াকত ভ্রু কুচকে ছেলেটির দিকে তাকাতেই ছেলেটি ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,

আমি কিছু করি নাই। বিশ্বাস করেন আমি কিছু জানিও না। আমাকে কেন ধরে আনছেন?

লিয়াকত তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। মানুষ ভয়ে সত্য স্বীকার করে। লিয়াকত ঠোঁটে সেই হাসি রেখেই বলে,

আমি কি তোকে জিজ্ঞেস করছি তুই কিছু জানিস? করি নি। তার মানে তুই অবশ্যই কিছু জানিস। বোকার মতো বলিস না আবার আমরা ভুল মানুষকে ধরেছি। ওতো অকাজের সময় আমাদের নাই। তাই যা যা জিজ্ঞেস করবো সুন্দর করে সত্য বলবি। নতুবা ঢান্ডার বারি খেয়ে ওগলাতে হবে। বল! অর্ণব শাহরিয়ারের সাথে তোর কিসের শত্রুতা? ওনার স্ত্রীর ক্ষতি করতে চাইছিস কেন?

ছেলেটি ভয়ে ঢোক খেল। মিথ্যা বলে পালানো সম্ভব নয়। এখানে আসার পথেই সে বুঝেছে । তাই বিলম্ব না করে সহজ স্বীকারোক্তি দিল,

বিশ্বাস করেন আমি আসলেই কিছু জানি না। আর শত্রুতা আমার কারো সাথেই নেই সেখানে যাকে চিনি না তার সাথে তো না ই।

উত্তর শুনে লিয়াকত অবাক হলো। পরক্ষণেই মনে হলো ছেলে বোকা বানাতে চেষ্টা করছে। তাই চোখ গরম করে জোর গলায় বলে,

মজা করছিস? বোকা পেযেছিস আমাদের? যা বলবি তাই বিশ্বাস করবো?

ছেলেটির আকুল কন্ঠ,

সত্যি বলছি। মায়ের দিব্যি। মিথ্যা বললে ভগবান আমার চোখ নিয়ে নেবেন। আমার সত্যিই তাদের সাথে কোনে শত্রুতা নেই। আমাকে গতকাল রাতে এক নাম্বার থেকে ফোন করা হয়েছিল। লাল শাড়ি পড়া মেয়েটার ছবি দিয়ে বলেছিল আজকে মেয়েটাকে কয়েক ঘন্টা নজরে রাখতে। আমি পাতি গু*ন্ডা। অল্প স্বল্প টাকার জন্য ছোট খাটো কাজ করে দেই। চাঁদা তুলা, ভয় দেখানো এইটুকুতেই আমার সাহস। এর থেকে বেশি আমি কিছু করি না। এলাকায় খবর নিয়ে দেখেন।

কিসের নাম্বার? নাম্বার দে।

বিদেশি নাম্বার স্যার। একেক সময় একেক নাম্বার দিয়া দিছে। কালকে রাত থেকে যতবার ফোন দিছে নতুন নতুন নাম্বার খালি।

ছেলে না মেয়ে?

তাও জানি না। কেমন জানি কন্ঠ। কার্টুনের মতো।

লিয়াকতের কপাল ভাজ পড়ে গেল। টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারটায় গিয়ে বসে। মাথায় ঘুরতে থাকে নতুন চিন্তা। নতুন ষড়য*ন্ত্রের পূর্বাভাস। পর মুহুর্তেই মাথায় খেলে ভিন্ন কথা। এইটা নতুন ষড়য*ন্ত্রের ছক নাকি পুরোনো হিসাবের অমীমাংসিত রেশ?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here