বিপরীতে তুমি আমি (দ্বিতীয়_পরিচ্ছদ) পর্ব ৪

0
444

#বিপরীতে_তুমি_আমি
(দ্বিতীয়_পরিচ্ছদ)
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম
|৪|

ঈদের আমেজ শেষ হয়েছে সপ্তাহ খানেক হলো। কিরণ ঈদ শ্বশুর বাড়িতে কাটিয়েছে। খুব ভোরে রিসোর্ট থেকে রওনা হয়ে সোজা এ বাড়িতেই এসেছে। কিরণের প্রথমত স্বাভাবিকভাবেই অমত ছিল। পণ করেছিল কিছুতেই এতো সহজে ফিরবে না। কিন্তু অর্ণবও যে নাছোরবান্দা। তার তো সবকিছুই পূর্ব পরিকল্পনার অর্ন্তভুক্ত। কিরণ যেখানে ভেবেছিল তার নিখোঁজ হওয়ায় হয়তো বাড়ির সদস্যরা ভীত হয়ে আছে সেখানে সে জানতে পারলো তারা দিব্যি তিন বেলার খাবার সময়মত খেয়ে ঘুমিয়েছে। ব্যপারটা খুবই অবাক হওয়ার মতো হলোও কিরণ অবাক হলো না। কেননা কলকাঠি যিনি নেড়েছেন তিনি তখন তার সামনেই উপস্থিত ছিলেন। ঠোঁট ঝুলে ছিল চেনা পরিচিত সেই হাসি। কিরণের ভ্রু কুচকে তাকানো, অবাক হয়েও অবাক না হওয়ার ভান হওয়ার ব্যপারটায় অর্ণব বেশ মজা লুটছিল। নিরূপায় হয়ে ফিরেছিল সেই স্থানে তারই হাত ধরে, যার হাত ধরে ত্যাগ করে করেছিল। হঠাৎ আপন হয়ে আসা বাড়িটা থেকে মুহুর্তেই পর করে দিয়েছিল অর্ণব। কেন?
কিরণের এ বাড়িতে ফিরে আসার আরো একটি কারণের মধ্যে একটি হলো এই ” কেন” এর উত্তর জানা। এ বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পূর্ব মুহুর্তে অর্ণবের অসম্পূর্ণ অনেক কথার প্রশ্নবোধকটা এখনও প্রশ্নচিহ্ন নিয়েই আছে।

ঈদের ছুটি শেষে সকলেই যার যার বাড়ি ফিরেছে। জান্নাত, মিতু, ঋতু ও রোহান ঈদের রাতেই এসে হানা দিয়েছিল। মেহরাব আসতে দেরি হলেও পরেরদিন ঠিক সকলেই এসে উপস্থিত হয়েছিল। কেবলমাত্র বাকি ছিল জিহাদ। ছুটির অভাবে ঈদের দিন সকালেই ছুটতে হয়েছিল হাসপাতালের রাস্তায়। মানবসেবায় ব্রত হলে আত্মত্যাগ তো আবশ্যক হবেই। সকলে চলে যাওয়ার পর বাড়িটা খুবই শূন্য শূন্য লাগছে কিরণের। বিয়ের পর পর জান্নাতের সঙ্গ তাকে একাকী অনুভব করায় নি। কিন্তু মেয়েটার সামনে পরীক্ষার কারণে থেকে যেতে পারে নি।

দুপুরের শেষের সময়। খাবার শেষে রেহনুমা বেগম নিজের ঘরে ঘুমিয়েছেন। কিরণও বিশ্রাম শেষ করেছে। অর্ণব আজ সকাল থেকে বাহিরে। সকাল বললে ভুল হবে। প্রায় ভোর। নিঃস্তব্ধত বাড়িটার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসতে আসতেই হঠাৎ কিরণের মনে পড়লো অর্ণবের বড় বোন, আনিলা আপুর কথা। মনে মনে ভেবে গেল কেমন হতো যদি আনিলা বেঁচে থাকতো? এ বাড়ির চিত্র কতখানি পরিবর্তন হয়ে থাকতো? তার পাশে আরো একটা গাছের ছায়া পেত কি? হয়তো! সিঁড়ির শেষধাপটা পাড় হতে হতেই ভারি নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিল হাওয়ায়। একজন মানুষ কতটা জায়গা জুড়ে থাকে তা কেবল তার অনুপস্থিতিতেই উপলব্ধি করা যায়। সোফায় অলস শরীরটা ছেড়ে বসে পড়ে কিরণ। টিভিটার দিকে তাকাতেই মনে হলো সময় ব্যয় করার উত্তম পন্থা পেয়েছে। টিভি নামক যন্ত্রটার কথা যেন বেমালুম বসেছে কিরণ। না দেখলে মনেই পড়ে না টিভি বলে কিছু আছে। আশে পাশে তাকিয়ে সামনের টি টেবিলটায় দেখা মিললো অযত্নে পড়ে থাকা রিমোর্টাকে। হাত হাতড়ে টিভিটা চালু করেই দেখতে পেলো বিটিভিতে সংবাদ পড়ছে। কাঁচা মরিচের দামে বাজার উত্তপ্ত হয়ে আছে। সিলেটের এক সবজি বিক্রেতার থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে প্রায় ১৩কেজি কাঁচা মরিচ।
কিরণের বিরক্ততে মুখ কুচকে এলো। এসব মূর্খতা বৈ আর কিছুই না। কাঁচা মরিচ পচনশীল দ্রব্য। কতদিন এভাবে রাখা যায়? একটা সময় পর পঁচতে শুরু করলে ক্ষতি ছাড়া লাভের কোনো আশা নেই। আর বাঙালিও বলিহারি! কি হবে যদি কাঁচা মরিচ না খাই? কেবলমাত্র সাতদবনের মাঝেই এর দাম এতো দ্রুতগতিতে নেমে আসবে যতটা না বেড়েছ। বাঙালি যেন ধৈর্যই ধরতে জানি না। কিরণ বিরক্ত হয়ে পরিবর্তন করতে গিয়ে হঠাৎ মন হলো পরিচিত কারো মুখ ভেসে ওঠলো টিভির স্ক্রিনে। পুনরায় চ্যানেল পিছন দিকে ঘুরিযে আনতেই বৈদ্যুতিক শকের মতো চমকে ওঠলো কিরণ। অলস ভঙ্গিতে পড়ে থাকা শরীর ওঠে সোজা হয়ে বসে পড়লো। চোখের কোটর বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম প্রায়। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পড়া মধ্যবয়স্ক লোক পুলিশ, মিডিয়ার ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে ব্যস্ত। পাঞ্জাবী পরিহিত লোকটি তার পরিচিত, অতি পরিচিত।
চ্যানেলের নীচের দিকে নীল রঙ্গের বড় বড় করে ব্রেকিং নিউজ লেখা ওঠছে। কিরণ মনোযোগ দিল সে লেখায়। কিন্তু লেখা পড়ে যে মাথা ঘুরছে তার।
ঘটনার পেছনের পরিচালক কে হতে পারে তা বুঝতে পেরে বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে ছুটে গেল ল্যন্ডলাইনের দিকে। সেকেন্ডের মাঝেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে কল করলো। কিন্তু রিসিভ হলো না। একবার, দুবার, তিনবার কল করেও ফোনে পাওয়া গেল না। কিরণের গলা শুকিয়ে এলো। পুনরায় চতুর্থবারের মতো কল করছে। ল্যন্ডলাইনের তারটা ধরে আছে মুঠোয়। হাত কাঁপছে। পায়ের নিচের মাটিটাও কেমন যেন নড়বড়ে লাগছে। উদ্বিগ্ন দৃষ্টি তার টিভির দিকে। অর্ণব কি সাংঘাতিক কান্ড ঘটিয়েছে তা কল্পনা করেই আত্মা কেঁপে ওঠছে কিরণের। এর ফলাফল যে কি রূপে, কোন দিক থেকে আসবে সেটা ভেবেই শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যাচ্ছে। এবারেও ফোন ধরলো না। কিরণ হতাশ হয়ে ফোন রেখে দিল। কিরণ পুনরায় মনোযোগী হয়ে তাকালো টিভির দিকে। এক নারী কন্ঠ ভেসে এলো কানে,

” বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক মি. রফিকউল্লাহ খানকে আজ দুপুর দুটোর দিকে নিজ বাসভাবন হতে গ্রে*প্তার করা হয়েছে। আমি বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছি কেন্দ্রীয় থানার সামনে। দেখতেই পাচ্ছেন ভিড় ঠেলে মি. রফিকউল্লাহ খান কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পু*লিশ হেফাজতে। আকষ্মিক এ ঘটনায় বিস্মিত সারা দেশবাসী। জানা গিয়েছে এই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বিগত কয়েক বছর যাবৎ জড়িয়ে আছেন নানা রকমের অবৈ*ধ কর্মকান্ডের সঙ্গে। তার ব্যবসা তিনি দাঁড় করিয়েছেন সম্পূর্ণ দু নম্বরি ও কা*লো টাকার উপরে। এছাড়া আরো কিছু ভয়ঙ্কর আরোপও লেগেছে এই নামি-দামি, বিখ্যাত ব্যবসায়ীর উপর। জানা গিয়েছে তার এ ব্যবসা পুরোটাই ছিল কেবল মাত্র লোকদেখানো। প্রকৃতপক্ষে তিনি ব্যবসা করতেন বিভিন্ন রকমের মা*দক দ্রব্যের, যা সম্পূর্ণ তিনি আমদানি করতেন বিদেশ হতে এবং একইভাবে টাকার জোড়েই তিনি এবার ইলেকশনেও দাঁড়িয়েছিলেন। শোনা গিয়েছিলেন এবারের এম পি এর পদটিও এ ব্যবসায়ীই জয় করতে চলেছিলেন। এছাড়া ওঠে এসেছে আরো চাঞ্চল্যকর এক খবর। প্রায় বছর দশেক পূর্বে এক যুবতী নারী ধ*র্ষনের মতো জঘন্য অপরাধের আসা*মি করা হয়েছিল এই ভাবি এমপি কে। কিন্তু ক্ষমতা ও টাকার প্রভাবে ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়। এমন দু*ষ্কৃতির হাতে যদি আসে ক্ষমতা তবে দেশের উন্নয়ন কি আসলেই আশা করা যায়? কি শাস্তি হবে মি. রফিকউল্লাহ খানের? নাকি ক্ষমতার প্রভাবে আবারো ছাড় পেয়ে যাবে? আরো একটি প্রশ্ন এখন সকলের। কে বা কারা আছেন এর পেছনে? এতো বছরের অন্ধকার তথ্যে কারা সুরঙ্গের কেটে আলো পৌঁছালো? এ সকল প্রশ্নের তথয জানতে সাথে থাকুন আমাদের। আমি হৃদিতা রহমান, চ্যানেল ************। ”

হৃদকে পর্দায় দেখে আরেক দফা অবাক হলো কিরণ। হৃদ কি করে ওখানে পৌঁছালো? এতো তথ্য তো হৃদের জানার কথা নয়। কিরণ দ্রুত পায়ে পুনরায় সোফায় সোজা হয়ে বসলো। রিমোর্টটা হাতে ক্রমাগত একের পর একেক চ্যানেল পরিবর্তন করে যাচ্ছে। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো হৃদের মতো এতো বিস্তারিত তথ্য কোনো রিপোর্টারের কাছেই নেই। তার থেকে আরো ভাবনার বিষয় হৃদ কবে এই চ্যানেলের সাথে যুক্ত হলো। চারপাশের পরিবেশটা কিরণের কাছে ভারি হয়ে ওঠছে। মস্তিষ্কে বাজে ভাবে জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে। এ সবকিছুর পেছনের মূলমাথা অর্ণব এ ব্যপারে কিরণ দুই শতভাগ নিশ্চিত। কিন্তু অবাক হওয়ার মতো ব্যপার হলো অর্ণব এতোকিছু করলো কিন্তু এই সাতদিন তা ঘুনাক্ষরেও টের পেলো না কিরণ। আজ সকালে যখন বের হয়ে গেল তখনও অর্ণবের ভাবভঙ্গি ছিল স্বাভাবিক। চোখ মুখে কোথায় চিন্তার রেশের ‘র’ টাও ছিল না। এতো ঠান্ডা মাথায় এরকম সাংঘাতিক পরিকল্পনা কি করে করলো ঐ মানুষটা?

কিরণের বুক চিড়ে শ্বাস বেড়িয়ে এলো। স্বস্তির শ্বাস। বিগত সাতমাস নিজের অজান্তে করা ভুলের জন্য যে ব্যর্থ পরিকল্পনা ওর দ্বারা হয়েছিল সেই পরিকল্পনার সফলতা দেখে ভয় ছাপিয়ে শান্তিরা ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে। মিথ্যা যতই সত্যের কাপড় পড়ে দুনিয়া ভ্রমণ করুণ, তার ব্যবহার তো তার প্রকৃত রূপ বের করে আনবেই। অদ্ভুত এক আত্মতৃপ্তিতে কিরণের ভিতরটা শীতল হয়ে এলো। টিভিতে রফিকউল্লাহর বিধস্ত মুখের পানে তাকিয়ে ধিক্কার জানালো কিরণ। না জানি কত বাবা মায়ের সন্তানেরা তিমিরে ডুবে গেছে এমন মানুষগুলোর জন্য। যুব সমাজ ধসে পড়ছে এদেরই কারণে।

কিরণ আবারো ওঠে ফোনের কাছে দিকে এগিয়ে গেল। নিজের ফোনটা উপরের রুমে রেখে এসেছে। সেখানে সময় অপচয় করে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে কিরণের নেই। যতদ্রুত সম্ভব অর্ণবকে তার চাই। ল্যন্ডলাইনের ফোন তুলে অর্ণবের নাম ডায়াল করতেই হঠাৎ চোখে পড়লো পাশে রাখা নোট বুক। কিরণ পাতা উল্টে দেখলো বেশ কিছু নাম্বার লেখা, আত্নীয় স্বজন ও জরুরি প্রয়োজনের নাম্বার। চোখে বুলিয়ে পাশের পাতাতেই খেয়াল করলো অর্ণবের অফিয়াল নাম্বার। কিরণ কিছুক্ষণ থেমে সেই নাম্বারেই ফোন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ফোন বাজলো কিন্তু এবারো কেউ ধরলো না। কিরণ নিরাশা হয়ে ঘুরে আসতেই ফোনের ‘ক্রিং’ আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো। ঝড়ের গতিতে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে এক পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসলো,

আসসালামু আলাইকুম! লিয়াকত হোসেন স্পিকিং!

ওয়া আলাইকুমুস সালাম। উয়িং কমান্ডার অর্ণব শাহরিয়ার আছেন?

জ্বি আছেন তবে ব্যস্ত। এ মুহুর্তে কারো সাথে কথা বলতে পারবেন না।

একটু কি কথা বলা যেতে পারে? অনলি ফরটি সেকেন্ডস।

দুঃখিত! আপনার কিছু বলার থাকলে আপনি আমাকে বলুন। আমি স্যারকে জানিয়ে রাখবো।

কিরণের বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো। অর্ণবের কন্ঠ শুনতে ওর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। মানুষটা কেমন আছে তা তার মুখ থেকে না শুনে যে শান্তি নেই কিরণের। কিন্তু উপায়ও যে নেই। ফোনের তার ধরে আঙ্গুলে পেঁচাতে পেঁচাতে পুনরায় বিপরীত পাশ থেকে শব্দ এলো,

আপনার কিছু বলার থাকার বলতে পারেন।

কিরণ দোটানায় পড়ে গেল। কি বলবে সে? এভাবে কি কথা পৌঁছানো যায়? আচ্ছা! ওর পরিচয় জানলেও কি যোগাযোগ করতে দেবে না? কিছুক্ষণ ভেবে কিরণ নরম গলায় বললো,

ধন্যবাদ। বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।

আপনার পরিচয়?

মিসেস অর্ণব শাহরিয়ার।

ওকে!

কিরণ বিলম্ব না করে ফোনটা রেখে দিল। মনটা ভার হয়ে গেলো। শীতের রুক্ষতার মতো মন শুকিয়ে আসছে অর্ণবের রৌদ্রতাপের অভাবে।
টিভিতে এখনো সেই সংবাদই চলছে। কিরণ টিভিটা বন্ধ করতে যাবে তখনই পিছন থেকে এক নারী রাশভারি কন্ঠে থেমে যায়। রিমোর্টটা নামিয়ে রেখে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল অর্ণবের মা এসেছেন। ওনার হাতে বইয়ের মতো কিছু একটা। কিরণের পাশে এসে বসতেই কিরণ সামান্য সরে বাঁকা হয়ে বসলো। অর্ণবের মা কিরণের পাশেই মুখোমুখি হয়ে বসলেন। পায়ে কোলের উপর রাখেন বইয়ের মতো ছবির এলবাম। এমন সময়ে এলবাম নিয়ে আসার কারণ জানতে কিরণ নিরবে কৌতুহলী হয়ে ওঠলো। এতোক্ষণে হয়তো ওনিও জেনে গিয়েছেন তার মেয়ের খু*নি অবশেষে শাস্তি পেতে চলেছে। কিরণ পলক তুলে চাইলো রেহনুমা বেগমের দিকে। রেহনুমা বেগমের ফ্যাকাশে মুখটা গভীরভাবে দেখতেই কিরণের বুকটা মোচর দিয়ে ওঠলো। সন্তানের লা*শ দেখা মা ইনি। ওনার ভেতরটা বোঝার সাধ্য কি কারো আছে? কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা কি কেউ আন্দাজ করতে পারবে? তবুও কি শান্ত হয়ে আছেন। ঠোঁটে হাসি, টিপটপ বেশভূষা। কিরণ এক ধ্যানে কেবল তাকিয়েই রইল।
অর্ণবের মা এলবামের মোটা আস্তরণটা খুলে প্রথম ছবিটায় আলতো করে হাত বুলিয়ে নিলেন। ঠোঁটের হাসিটা আরকটু গাঢ় হয়ে এলো। কিরণ সেই হাসির রেশ ধরেই নিচের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেলো ছবিটি ছোট্ট আনিলার । উৎসুক হয়ে রইলো পড়ের ছবির জন্য। কিন্তু তার আগেই রেহনুমা বেগম কিরণের দিকে তাকিয়ে অমায়িক এক হাসি দিলেন। কিরণকে ইশারায় ডেকে নিলেন আরো কাছে। কিরণও বাধ্য মেয়ের মতো একদম ঘেষে বসলো। কিরণের কোলে এলবামটা রেখে পরের পৃষ্ঠা ওটলে দিলো রেহনুমা বেগম। কিরণ সেদিকে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। টকটকে লাল রঙ্গের কাতান শাড়িতে আনিলা। কোমর ছাড়ানো চুলগুলো সামনে একপাশে এনে বসে আছেন। নতুন বউদের মতোন মাথা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা দেওয়া। অর্ণবের থেকে উজ্জ্বল ত্বক। উপন্যাসে কথিত দুধে আলতা গায়ের রং। সরু নাকের জ্বলজ্বল করছে স্বর্ণের নাকফুল। মোনাজাত তুলে রাখা দু হাতটায় মোটা মোটা দুটো বালা । কি অপরূপ এ মানবি! কিরণের চোখ এমন সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এলো। এর আগে কখনোই আনিলাকে দেখে নি। কোথাও কারো কাছে একটা ছবিও সে দেখতে চাওয়ার সাহস করে ওঠে নি। আজ আনিলাকে দেখে অভিভূত হয়ে ওঠছে। তবে বাকরুদ্ধ হয়েছে তার পাশে বসে থাকা সুদর্শন এক পুরুষকে দেখে। সে পুরুষের চোখেও মুগ্ধতার মেলা। না হয়েও থাকে কি করে? অপ্সরি যে তার পাশে। তাদের বেশভূষায় কিরণ বুঝতে পারলো এইটা আনিলার বিয়ের ছবি। আনিলার বিয়ে হয়েছিল ভেবেই অবাক হয় কিরণ। বিষ্ময়ে মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করে নেয়,

আনিলা আপুর বিয়ে হয়েছিল?

রেহনুমা বেগম কিরণের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে বললো,

হয়েছিল তবে সম্পূর্ণ নয়। কেবল কাবিন হয়েছিল। সেইদিনেরই ছবি।

আপুর বরকে কেমন যেনো চেনাচেনা লাগছে। মনে হয় কোথায় যেন দেখেছি।

অর্ণবের মা পুনরায় হাসলেন। হেসে পরবর্তী পৃষ্ঠা ওল্টাতেই আনিলার বরের মুখটা এবার স্পষ্ট হয়ে এলো। কিরণের আজ মনে হলো তার বুঝি অবাক হওয়ার দিন। ছবিটা আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে এসে বললো,

জুনায়েদ ভাইয়া! আপুর বর! আপুই তাহলে সেই মেয়ে যার জন্য ভাইয়া আর বিয়ে করে নি?

হ্যা। জিহাদের বড় ভাই। জিহাদকে যেমন চুপচাপ দেখো না? জুনায়েদ ছিল ঠিক ওর উল্টোটা। খুবই প্রফুল্ল। অর্ণবের থেকে বয়সে বড় হলেও ওদের স্বভাব ছিল প্রায় একই। তাই বেশ মাখোমাখো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু….

রেহনুমা বেগম থেমে গেলেন। বুক ভারি হয়ে আসলো তার। কন্ঠ কেঁপে ওঠলো। মিনিট খানেক চুপ রইলো। কিরণ মনে অবস্থা বুজতে পারলো কিন্তু বুঝতে পারছিলো না কিভাবে পরিস্থিতি সামলে নেবে। ঠোঁট কামড়ে বসে থেকে হুট করে এলবামটা বন্ধ করে সামনের টেবিলটায় রেখে দিল । রেহনুমা বেগম কিরণের এহেন কাজে চমকে ওঠলেন। জিজ্ঞাস্যু দৃষ্টিতে তাকাতেই কিরণ হেসে চট করে রেহনুমা বেগমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। রেহনুমা বেগমের হাতটা নিজেই টেনে চুলে হাত রেখে আদুরে গলায় বলে,

মা! কষ্ট পাবেন না। আনিলা আপুর আত্মা আজ শান্তি পেয়েছে। আল্লাহ আনিলা আপুকে জান্নাত নসিব করবেন আমিন। এখন আপনার কাছে আরেকটা মেয়ে আছেন ভুলবেন না যেনো। আমি কিন্তু মায়ের আদর না পেলে আদায় করে নেবো।

ছলছল চোখের অশ্রুকণা এ পর্যায়ে এসে কপল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। ফাঁপিয়ে ওঠা বুকটা ভেঙ্গে কান্না চলে আসলো। কিরণ ধীরে ওঠে বসে জড়িয়ে রইলো রেহনুমা বেগমকে। বহুদিন পর মেয়ের মতো কেউ জড়িয়ে থাকাতে সেও জড়িয়ে ধরে ভেঙ্গে পড়লো কান্নায়। তার ভেতর যে যন্ত্রণার হিমালয়। বরফ গলে পানি হয়ে বয়ে যাক সব। নতুন উর্বর জমির সৃষ্টি হোক।

অফিস এবং রফিকউল্লাহ সংঘটিত কাজের চাপে অর্ণবে আজ নাওয়া খাওয়া ভুলতে বসেছে প্রায়। তবুও তার শরীরে যেনো কোনো ক্লান্তিভাব নেই। অফুরন্ত এক সজিবতা প্রাণে খেলে যাচ্ছে। সে আজ জয়ী হয়েছে। বছরের পর বছর যে যন্ত্রণা, আফসোস জমে ছিল তা আজ খাঁচা ছেড়ে মুক্ত আকাশে উড়ছে।

হাতের শেষ ফাইলটা রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ধীরে ধীরে শরীর ছেড়ে দিল চেয়ারের গায়ে। জানালা ভেদ করে বৃষ্টির পরবর্তী স্বচ্ছ আকাশটায় চোখ পড়লেই কাল্পনিক ভাবে মনর হলো এ বুঝি আনিলার হাসি মুখ। স্মৃতি আঘাত করলো। জুনায়েদের সাথে আনিলার বিয়ে যেদিন ঠিক হলো আনিলার লজ্জায় লাল হয়ে আশা মুখটা, আনন্দে ভরে আশা চোখটা বারবার পুনরাবৃত্তি হতে থাকলো। জুনায়েদের সাথে যেদিন কাবিন শেষ হলো অর্ণবে সেদিন বেশ কান্না করেছিল। বড় আপু চলে যাবে। সে মায়ের বকা খেয়ে কার কাছে ঘুমাবে সেই চিন্তায় আনিলাতে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিল। আনিলা তার থেকে বছর ছয়েক বড়। অর্ণবের তখন ১৯বছর। বড় হয়েও কি বাচ্চামো সেই কান্নাগুলো।
সেসব স্মৃতি ছবির মতো মানসপটে ভেসে উঠতেই হেসে ওঠলো অর্ণব। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা পানি।
দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হতেই অর্ণব চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হয়ে বসে গম্ভীর গলায় বলে,

কামিং

লিয়াকত অনুমতি পেয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে। ব্যতিব্যস্ত লিয়াকতকে দেখে অর্ণব ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেসা করে,

এতো অস্থিরতার কারণ কি লিয়াকত?

লিয়াকতের ঝটপট উত্তর,

ম্যম! ম্যম ফোন দিয়েছিলেন। আপনার ফোন না পেয়ে অফিসের ফোনে দিয়েছিলেন।

অর্ণব চকিতে লিয়াকতের দিকে তাকিয়ে বলে,

কিরণ ফোন দিয়েছিল? কখন?

অর্ণব চেয়ার থেকে ওঠতে ওঠতে এরই লিয়াকত এবার একটা ঢোক গিলে ধীর কন্ঠে,

আধাঘন্টা আগে।

অর্ণব পা থামিয়ে ফট করে লিয়াকতের দিকে তাকিয়ে রেগে বলে,

আধা ঘন্টা আগে তোমার ম্যম ফোন দিয়েছিল আর সেই খবর তুমি এখন বলছো আমাকে?

সরি স্যার। আমি আসলে বুঝি নি ম্যম ফোন দিয়েছে।

অর্ণবের দু ভ্রু আরো কুচকে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

ওয়াট ডু ইউ মিন বাই বুঝতে পারো নি?

স্যার রাগবেন না। আসলে ম্যম বললেন কথা বলতে চান। আপনাকে ফোনে পাচ্ছেন না। তারপরই..

অর্ণব কথা শুনেই শুনতেই সেলফে রাখা ফোনটা হাতে নেয়। চারটা মিসডকল! এতোগুলো কল দেখে বেশ অন্যরকম অনুভূতি হয়। অর্ণব আন্দাজ করতে পারছে কিরণ কেন ওকে কল দিয়েছে। সাইলেন্ট করেছিল বিশেষ এক কারণে। পরবর্তীতে তা জেনারেল করতে বেমালুম ভুলেছে। কিরণের নামটা তার ফোনের স্ক্রিনে যতবার জ্বলজ্বল করে ততবারই অর্ণবের নতুন করে মনে হয় কিরণ এখন তার! মাঝে মাঝে কিরণকে বিয়ে করার ব্যপারটা ওর কাছে স্বপ্নের মতো লাগে।
লিয়াকত তখনও কথার বিবরণ দিতে ব্যস্ত। শেষের দিকে এসে বললো,

রাখার আগে শুধু বললো আমি মিসেস অর্ণব শাহরিয়ার। তখন আসলে স্যার আমি বুঝি নি কি নাম বলেছে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো আ্নার কোন কাজিন। তার কিছুক্ষণ পর নামটা মাথায় আসতেই বুঝতে পারলাম যে..

অর্ণবের কানে বাকি কথার কোনো রেশই রইলো না। কেবল শুনতে পেলো কিরণ তার পরিচয় নিজের করে নিয়েছে। কিরণের নাম্বারটা ততক্ষণে ডায়ালেও ছিল। অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে তার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে এলো। এতো পাওয়া একদিনে!
ওপাশের ফোনটাও রিসিভ হয়ে গেল কিরণের সামান্য ‘ হ্যালো ‘ তেই অর্ণব বুঝতে পেলো উদ্বিগ্নতার মাত্রা। কিরণের লাল টকটকে শাড়ি পরিহিত ছবিটার দিকে ঠিক উপরে ভাসছে,
Mrs. Arnab Shahriar
017*********। Bangladesh
00:17 sec

—-

সময় যেন সময়কেই টেক্কা দিয়ে চলে। সে ঘটনার পর আজ প্রায় পাঁচদিন। আজ রফিকউল্লাহ খানকে আদালত মৃ*ত্যুদ*ন্ডে দ*ন্ডিত করেছেন। অর্ণব নিজের রুমের জানালার কাছটায় বসে দাড়িয়ে আছে। খোলা আকাশটায় মাঝে খোলা খাতার মতো চিন্তা আকিবুকি করা যায়। বিগত বছরের সকল জট আজ কিরণের সামনে খুলে দেবে। আর কোনো অদৃশ্য অথবা দৃশ্যমান দেয়াল দুজনের মাঝে রাখবে না। সময় ঠিক ঠিক শব্দে বার বার জানিয়ে দিচ্ছে এইতো সঠিক সময়। এবার সময় হয়েছে সবকিছু থেকে পর্দা ওঠানোর। কিরণ দুদিন যাবৎ বাবার কাছে রয়েছে । গতকাল রাতেই পছন্দের লাল রঙের এক পার্সেল পাঠিয়েছে কিরণকে। অর্ণবের তীব্র আকাঙ্খা শুরুটা রঙ্গিন হোক। সাদা কালো ব অতীত হয়ে থাকুক। ঘড়ির কাটার ঢং ঢং শব্দ নিরবতা ভেঙ্গে দিয়েছে। অর্ণবও নড়েচড়ে ওঠে। আয়নায় নিজেকে আরেকবার পরোখ করে নেয়। নীল রঙ্গের পাঞ্জাবিটা কি দারুণ বসেছে ওর শরীরে! চুল ঠিক করতে করতেই হঠাৎ ফোনের ম্যসেজ নোটিফিকেশনের শব্দে মনোযোগে ব্যঘাত ঘটলো। ফোনটা সামনেই ছিল। চুলের থেকে হাত সরিয়ে ফোনটা কাছে এনেই টেবিলে রেখেই ম্যসেজটা দেখতে ক্লিক করে। ম্যসেজটা সামনে আসতে আসতে হাত ঘড়িটা হাতে পড়ে নেয়। ম্যসেজটা পরতে গিয়ে ঘড়ির বেল্ট লাগানোটা থেমে গেল। অজানা নতুন আশঙ্কে বুক কেঁপে ওঠলো অর্ণবের। ঘড়িটা একটানে খুলে রেখে দিল টেবিলের উপর। হন্তদন্ত হয়ে পুনরায় আবারোও ম্যসেজটা পড়লো,

লাল শাড়ি, লাল চুড়ি, আর খোঁপার লাল ফুলটায় একদম লাল গোলাপ লাগছে। ঠোঁটের লালটার কথাটা নাইবা বলি। উফ্! বাগানের তরতাজা সদস্য ফুটিত লাল গোলাপ। কিন্তু আরো একটা জিনিসের কমতি আছে। এতো সব লালে আসল লাল রঙটা না থাকলে কি চলে? লাল র*ক্তটা থাকলে খাপেখাপ। হাত কেমন নিশপিশ করছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here