হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ২৩)

0
1705

হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ২৩)
#নাহার
·
·
·
সকাল থেকেই নিরার মন খারাপ। ঘুম থেকে উঠেই এমন কিছু শুনবে এটা সে একদম আশা করেনি। তাই কারো সাথেই কথা বলছে না। কলেজেও যায়নি। নাস্তা পর্যন্ত করেনি। রাফিন এসে টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেছে। সোফায় বসিয়ে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। নিরা রাফিনের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। রাফিন অন্যদিকে মুখ করে বললো,
— মাত্র তিনদিনের জন্য যাচ্ছি। একেবারের জন্য তো যাচ্ছি না। আর ঘুরতেও তো যাচ্ছি না। কাজে যাচ্ছি। কাজ শেষ হলেই তাড়াতাড়ি ফিরবো।

নিরার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
— প্লিজ নিরুপাখি এভাবে মন খারাপ করে থেকো না। আমার ভালো লাগছে না তোমাকে এভাবে দেখতে। প্রমিজ করছি কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই চলে আসবো। এই ট্রেইনিংটা খুব দরকার আমার।

নিরার চোখ থেকে কয়েকফোটা পানি গাল বেয়ে নেমে এলো। নিচে পড়ার আগেই রাফিন সেগুলো মুছে দিলো।

রাফিন ডাক্তারি কিছু ট্রেনিং- এর জন্য তিনদিনের জন্য ব্যাংকক যাচ্ছে। তাই নিরার মন খারাপ। তিনটাদিন প্রিয় মানুষকে না দেখে থাকা অনেক বড় ব্যাপার। নিরা চাইছে না রাফিন সেখানে যাক। কিন্তু ট্রেনিং যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ তাই যেতে দিতে তো হবে। নিরা নিজেকে সামলে নেয়। রাফিন নিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
— তোমার জন্য চকলেট আনবো নিরুপাখি। তোমার কি চকলেট পছন্দ?

নিরা খুশি হয়ে যায়। খুশি খুশি হয়ে বললো,
— ডেইরি মিল্ক সিল্ক।

— ওকে তোমার জন্য এইটাই আনবো। হ্যাপি?

— হু।

রাফিন ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেয়। আজকেই ঢাকায় যাবে। সেখান থেকে প্লেনে উঠবে। ঢাকায়ও কিছু কাজ আছে তাই আগে সেখানে যাবে। বারোটার ট্রেনে করে প্রথমে যোশর থেকে ঢাকায় রওনা হবে। নিচে নেমে এলো বের হওয়ার জন্য। বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায় রাফিন। কৌশিকও সাথে গেছে। কৌশিক শুধু রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত যাবে।

——————————————————————————–
বিকেলের দিকে বাড়ির সবাই খোশগল্পে মেতেছে। মিসেস তানজুম এবং মোহাম্মদ আনোয়ার সাহেব খুব খুশি। কৌশিক তাদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে লজ্জা পাচ্ছে আর মুচকি হাসছে। মিসেস শায়েলা কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— কৌশিক বাবা এখানে এসে বয় আমরাও তোকে একটু দেখি। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজে একা একা লজ্জা পাচ্ছিস। তোর লজ্জামাখা মুখটা আমরাও দেখি। বড় ভাবি দেখো তোমার ছেলে লজ্জায় লাল হচ্ছে।

কথাটা শুনে কৌশিক এদিন সেদিন তাকিয়ে কয়েকটা ঢোক গিললো। কিন্তু তাদের দিকে এগোলো না। মিসেস তানজুম ছেলেকে এবং নিরার বাবা মোহাম্মদ আফজাল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— বাবা তোর পছন্দের মেয়ের সাথেই তোর বিয়েটা হবে। মেঝো ভাই কি বলেন? কাল না হয় আমরা আফিয়াদের বাড়িতে গিয়ে খোজ খবর নিয়ে আসি?

মিসেস শায়েলা বললেন,
— না ভাবি কাল নয়। আরো দুদিন পর যাই। রাফিন তো বাড়িতে নেই। তাকে ছাড়া গেলে ছেলেটা পরে ভাববে আমরা তাকে এ বাড়ির সদস্যই ভাবি না। তাই আমি চাইছি রাফিন আসুক সে সহ যাবো।

— হ্যাঁ মেঝো ঠিক বলেছিস। ছেলেটা তো এখন আমাদের বাড়িতে থাকে। আর সে তো এখন আমাদের বাড়িরই সদদ্য। তাহলে আমরা আরো তিন-চারদিন পরেই যাই।

তারা আরো গল্প করছেন। বাকি ভাইবোন গুলোও খুশি। ফায়াজ, ফাহিম, নাঈম এবং ফাতেমা তারা চারজন মিলে এখন থেকেই সব ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। কে কিরকম করে সাজবে। বিয়েতে কেমন মজা করবে আর গায়ে হলুদে কেমন মজা করবে।

কাশফি আজকাল খুব উদাসীন থাকে। আগের মতো সেই চঞ্চলতা আর নেই। নিজেকে খুব একা করে রাখে। কারো সাথে তেমন একটা কথা বলে না। কৌশিক এই মহলে কাশফিকে মিস করছে। উপরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
— হুট করে কি হয়ে গেলো বোন তোর। আগেতো সব তোর ভাইয়ের সাথে শেয়ার করতি তাহলে এখন কেনো নিজেকে একা করে রাখিস? আগের সেই কাশফিকে মিস করি।

কৌশিক কাশফির রুমে গেলো। খাটের এক কোণে উদাসীন হয়ে বসে আছে। কৌশিক গলা খাকারি দিলে কাশফির যেনো হুশ ফিরে আসে। ঠিক হয়ে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়। কৌশিক তীক্ষ্ণ চোখে বারবার তার বোনকে পর্যবেক্ষণ করছে। কেমন যেনো তার সন্দেহ হচ্ছে। কাশফি বলে উঠল,
— কিরে এমনে তাকায় আছোস কেন? কিছু বলবি?

— আজকাল তুই কেমন যেনো হয়ে গেছিস।

— কেমন হইলাম? আমিতো ঠিক আছি।

— তোর ব্যবহার কেমন যেনো বদলে গেছে। নিজেকে একা রাখিস। প্রয়োজন ছাড়া বের হস না। কি হয়েছে বলবি?

কাশফি গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে হেসে বললো,
— একটু বেশিই বলে ফেললি না? আমি ঠিক আছে। কি হবে আমার? তোর কি হয়েছে সেটা বল।

— আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।

— সত্যি নাকি চাপা মারছিস?

— নিচে গিয়ে শুনে আয়। রাফিননার জন্য তিনদিন পিছাইছে। নাইলে কালকেই সবাই আফিয়ার বাসায় যেতো।

কাশফি অনেক খুশি হলো। খুশিতে গদগদ হয়ে তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— ওয়াও ভাই। তাহলে শেষ পর্যন্ত ভাবি আসবে আমাদের বাসায়। তবে তোর সাথে কম থাকতে দেবো আমাদের কাছে রাখবো বেশিরভাগ সময় দেখিস।

— আমার বউরে তোদের কাছে কেন রাখবি?

— হাহা। বলা যাবে না।

কথাটা বলেই কাশফি চোখ মারে। কৌশিক ব্যঙ্গ করে বলে,
— তোর শ্বাশুড়িকে বলবো তোরে যাতে সারাদিন কাজ করায়। তোর জামাইয়ের লগে যাতে একদম ঘুরতে যাইতে না পারোস। হাহ।

দুজনেই হাসে। কাশফি তার ভাইকে আবার বললো,
— কংগ্রাচুলেশন ভাই। এবার থেকে তুই থেকে তোমরা হয়ে যাবি। হিহি।

কৌশিক কাশফির মাথায় হালকা থাপ্পড় মেরে বেরিয়ে আসে। কাশফির হাসি বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলে।

——————————————————————————–
অপেক্ষার প্রহর খুব দীর্ঘ হয়। সেটা এখন খুব করে বুঝতে পারছে নিরা। রাফিন গিয়েছে দশ ঘন্টা হয়েছে। অথচ মনে হচ্ছে কতকাল ধরে দেখে না। যদি এমন হতো রাফিন এক এলাকায় থাকে এবং নিরা অন্য এলাকায় থাকে এবং তাদের মাঝেমধ্যে দেখা হয় তাহলে এমন শূন্যতা অনুভব হতো না। কিন্তু দুইজন একই ছাদের নিচে থাকে এবং প্রতিটা সময় দেখা হয় তাই একটু কষ্ট হচ্ছে।

শীতের চাদর গায়ে জড়িয়ে নিরা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে এই মাতাল হাওয়া গায়ে মাখছে। রাফিনের সাথে কাটানো প্রতিটা মূহুর্ত মনে করছে। আর আনমনে হাসছে। রাফিনের গায়ের ঘ্রাণটা যেনো এখনো নিরার নাকে লেগে আছে। হঠাৎই ফোনের টোন বেজে উঠে। নিরার ইচ্ছে করছে না চোখ খুলতে। ভালোই লাগছে এভাবে দূরে থাকা প্রিয় মানুষকে অনুভব করতে। আবার ভাবলো হয়তো তার ডাক্তার সাহেব মেসেজ দিয়েছে তাই তাড়াতাড়ি চোখ খুলে ফোনের দিকে তাকালো। কিন্তু একটা আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে।

মেসেজটা ওপেন করে পড়তেই নিরার ভেতরে ভয় ঢুকে গেলো। কেউ তাকে থ্রেট দিচ্ছে। কিন্তু কেনো? তাড়াতাড়ি নেমে গেলো ছাদ থেকে। মেসেজে লিখা ছিলো- ” খুব তাড়াতাড়ি তোমার প্রিয় জিনিস হারাবে।”

রুমে এসে বসতেই হাত পা কাপছে। কে হতে পারে? প্রিয় জিনিস হারাবো মানে? আমার প্রিয় তো ডাক্তার সাহেব। তাহলে কি কেউ ডাক্তার সাহেবের ক্ষতি করবে? না, এটা হতে পারে না।

মূহুর্তেই নিরার ঘাম ছুটে যায়। পানির পিপাসা পেলো খুব। তাই ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেলো। রাফিনের নাম্বারে ফোন দেয় কয়েকবার রিং হয়েছে কিন্তু রিসিভ হয়নি। এবার নিরার টেনশন আরো বেড়ে গেলো। তাহলে কেউ তার ডাক্তার সাহেবের ক্ষতি করেছে? নিরা ভয়ে কেঁদে দিয়েছে।

সাড়ে এগারোটার দিকে রাফিন ফোন করে জানিয়েছে সে ঠিক আছে। একটা কাজে ব্যস্ত ছিলো তাই রিসিভ করতে পারেনি কল। নিরার মন হালকা হলো কিন্তু ভয়টা এখনো যায়নি। তবে রাফিনকে কিছু জানায়নি।

রাতে সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। রাফিনের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নিরাও ঘুনিয়ে গেছে।

ঘুমের মাঝেই মনে হচ্ছে নিরার রুমে কেউ আছে। নিরাকে খুব কাছ থেকে দেখছে আর হাসছে। হাসির আওয়াজও হালকা ভাবে কানে আসছে। খুব জোরে আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় নিরার। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে।

আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো রুমে কেউ নেই। কিন্তু সে তো কিছু একটা অনুভব করেছে। স্বপ্ন ভেবে আবার শুয়ে পড়তে যাবে তখন চোখ গেলো বেলকনির দিকে। বেলকনির সামনে লাগানো সাদা পর্দাগুলো বাতাসে উড়ছে। এবং একটু দূরেই সাদা কাগজের মতো মোড়ানো কিছু একটা পড়ে আছে। নিরা তাড়াতাড়ি গিয়ে কাগজটা হাতে নিয়ে বেলকনি থেকে নিচে তাকালো। কেউ নেই। কাগজটা খুলে লেখাগুলো পড়তেই আবার ভয়ে হাত পা কাপতে শুরু করে নিরার। আবার সেই থ্রেট।

কাগজে লিখা-” খুব শীঘ্রই তোমার মূল্যবান জিনিস হারাবে নিরা।”

থরথর করে কাপছে নিরার সমস্ত শরীর। তখনই ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। কোনোরকম রুমে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে আননোন নাম্বার। কাপা কাপা হাতে রিসিভ করতেই এক ভয়ংকর কণ্ঠের হাসির আওয়াজ শুনতে পায়।

নিরার হাত থেকে মোবাইল পড়ে যায়। ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না নিরা। ধপ করে বেডে বসে যায়। বেডের পাশের টেবিল থেকে পানি নিয়ে পানি খায়। নিজেকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক করতে পারছে না।

নিরা ভাবছে তার কি মূল্যবান জিনিস সে হারাতে চলেছে? ডাক্তার সাহেব? ভয় করছে নিরার খুব ভয়। কি হবে ভাবতে পারছে না। কে করতে পারে এই কাজ কিছুতেই কোনো কিছু মাথায় আসছে না।

তার সাথে তো কারো শত্রুতা নেই। তাহলে কে? আচ্ছা ডাক্তার সাহেবের সাথে কি কারো শত্রুতা আছে? উনার সাথে থাকলে থ্রেট আমাকে কেন দিবে? নাহ কিছুই ভাবতে পারছে না নিরা।

সকালে নিজেকে স্বাভাবিক করে কোনোরকমে নাস্তা করে নেয়। ভয়ে কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। নিজেই বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। রাফিনের সাথে কথা হয়েছে সে একটু পর প্লেনে উঠবে। সব ঠিকঠাক আছে।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিরা কলেজের উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায়। ক্লাশ শেষে নিরা একটা পড়া নোট করছিলো। কারণ তিনদিন কলেজে যায়নি তাই। ঝুমুর এবং নুপুরের বাসায় কিছু কাজ ছিলো তাই আগে আগেই চলে গেছে। প্রভা আজ কলেজে আসেনি। নুপুর তার নোটটা দিয়েই চলে যায়। বলেছে লাইব্রেরিতে জমা দিয়ে যেতে খাতাটা। তাই ক্লাসে বসেই নোট করছে। অল্প সময়ের মধ্যেই কলেজ খালি হয়ে যায়। শুধু রাজনৈতিক দলের ছেলেমেয়েরা আছে।

নিরা কাজ শেষে ওয়াশরুমে যায়। ওয়াশরুমে ঢুকার সাথে সাথেই লাইট বন্ধ হয়ে যায়। নিরা দরজা খুলে বের হতে গেলেই দেখলো দরজা বন্ধ। খুলতে পারছে না। পেছন থেকে কেউ নিরাকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে নিরার কোমড় চেপে ধরে।

মুহুর্তেই নিরা ভয়ে কাপতে শুরু করে। কেউ ঘাড়ে, গলায়, বুকে খুব বাজে ভাবে ছুয়ে দিচ্ছে। নিরা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মস্তিষ্ক শুণ্য হয়ে গেছে। কিছুতেই কিছু ভেবে পাচ্ছে না। হিজাবটা টান দিয়ে খুলে ফেলে। হিজাবের পিনে আঁচড় লেগে গলার দিকে আর মুখের ডান সাইডে। দুইহাত চেপে ধরে গলায়, ঘাড়ে বাজেভাবে ঠোঁট দিয়ে ছুয়ে দিচ্ছে। নিরার ঠোঁটের কাছে আসতেই নিরার জ্ঞান ফিরে। দস্তাদস্তি শুরু হয়। নিরা চিৎকার করা শুরু করলে নিরাকে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে সেই ব্যক্তি দরজা খুলে চলে যায়। সেদিন খুব বাজে ভাবে মলেস্ট হয়েছে নিরা। ফোনে একটা মেসেজ আসে। সেই আননোন নাম্বার।

মেসেজে লিখা ছিলো,” আজকের এটা সামান্য ছিলো। পুরো ফিল্ম এখনো বাকি। তোমাকে আমি কখনই শান্তিতে থাকতে দিবো না। তোমার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটাই কেড়ে নেবো আমি।”
·
·
·
চলবে……………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here