হৃদয়ের_কোণে (অন্তিম পর্ব ৪৮)

0
4384

হৃদয়ের_কোণে (অন্তিম পর্ব ৪৮)
#নাহার
·
·
·
নিরাকে খাবার খাইয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে এসে পাশে বসেছে রাফিন। নিরার পেটে মাথা রেখে বললো,
— বাবাই অপেক্ষা করছি তাড়াতাড়ি চলে এসো আমার ছোট্ট নিরু।

নিরা কড়া গলায় বললো,
— নিরু না আমার ছোট্ট পুচকি একটা রাফু চাই।

— কিন্তু আমার তো পুচকি নিরু চাই।

— রাফুই হবে দেখবেন।

রাফিন হেসে নিরার নাক ধরে টান দিয়ে বললো,
— দেখা যাক কি হয়। তবে যেই আসুক আমার দল ভারি হবে বুঝেছো। আমার পক্ষে কথা বলবে তারা। হিহি।

নিরার পেট আগের থেকে অনেকটা বড় হয়েছে। এখন পাঁচ মাস চলছে নিরার। বাবুর অবয়ব নাকি এখন দেয়া হয়। তাই নিরা সারাক্ষণ রাফিনের দিকে তাকিয়ে থাকবে। রাফিন না থাকলে রাফিনের ছবি দেখবে। রাফিন হেসে জিজ্ঞেস করছিলো,
— এভাবে শুধু আমাকে কেনো দেখো?

— কারণ আমি চাই আমার বাবু তার বাবার কার্বন কপি হবে।

রাফিন সেদিন অনেক হেসেছে। নিরার পেটে চুমু দিয়ে সোজা হয়ে বসলো রাফিন। কপালে চুমু দিয়ে বললো,
— আমাকে দেখা হলে এবার কি আমি কাজে যেতে পারি?

— উহু। আজকে না গেলে হয়না? আমার ভালো লাগে না আপনাকে ছাড়া।

— ওহো আমার পাগলিটা। আজকে একটা ইমার্জেন্সি অপারেশন আছে। যেতেই হবে। আর অপারেশনটা আমার দায়িত্বে পরেছে। ইমার্জেন্সি না হলে যেতামই না। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো প্রমিজ।

নিরার কপালে আলত চুমু দিয়ে রাফিন উঠে দাঁড়ালো। নিরা অপলকহীন ভাবে রাফিনের দিকে তাকিয়ে আছে। রাফিন বললো,
— এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি যেতে পারবো না।

নিরা ম্লান হাসলো। রাফিন রেডি হয়ে দরজার সামনে গেলে নিরা ওয়ালেট নিয়ে রাফিনের পেছনে এলো। ওয়ালেট নিয়ে নিরার কপালে আবার চুমু দিয়ে বললো,
— মন খারাপ করো না আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।

রাফিন বেরিয়ে গেলো হসপিটালের উদ্দেশ্য। নিরা রুমে এসে বসলো। তনিমা খানম এসে নিরার পাশে বসে বললেন,
— কিছু খাবি মা?

— না মা।

— আজ এমন মনমরা হয়ে আছিস কেনো?

— ভালো লাগছে না।

তনিমা খানম নিরার কপালে চুমু দিয়ে রান্নার কাজে বেরিয়ে গেলেন। নিরা মোবাইল হাতে নিলো। গ্যালারিতে গিয়ে রাফিনের একটা ছবি ওপেন করলো। আফিয়ার সাত মাসের অনুষ্ঠানের দিন রাফিন কালো খয়েরী রঙের পাঞ্জাবি পরে একটা ছবি তুলেছিলো সেটা দেখছে। বারবার জুম করে দেখছে। মুচকি হেসে ছবিটা তুলেছিলো রাফিন। হাসিটার মধ্যেই জুম করে দেখছে।

——————————
বিকেলে কাশফি তার তিন মাসের মেয়ে বাবুটাকে নিয়ে এসেছে। আর আফিয়া তার হালকা হালকা হাটতে পারে ছেলেকে নিয়ে এসেছে। দুজনে গল্প করছে। এর মধ্যে জানতে পারলো তুহিন বিয়ে করেছে তার এক বন্ধুর বোনকে। মেয়েটা খুবই ভালো। নিরাও শুনে বেশ খুশি হলো যাক এবার অন্তত বিয়ে করেছে। সব সময় মনমরা হয়ে থাকতো তুহিন। এবার অন্তত আনন্দে দিন পার করবে।

সন্ধ্যার দিকে কাশফি এবং আফিয়া চলে যায়। নিরা বারবার ঘড়ি দেখছে আর দরজার দিকে তাকাচ্ছে কখন আসবে তার রাফু। নিরা উঠে ওয়াশরুমে গেলো। ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে সামনে এগোতেই স্লিপ করে নিরা। তখন কলিংবেল বেজে উঠে। তনিমা খানম এসে দরজা খুলে দেন।

কিছুক্ষণ পর নিরা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে। বুকটা এখনো দুরুদুরু করছে। আর একটু হলে পরে যেতো। ঘেমে যাচ্ছে ভয়ে। তখন মনে পরলো কলিংবেল বাজলো কিন্তু এখনো রাফিন রুমে এলো না কেনো? আস্তে আস্তে হেটে ড্রয়িংরুমে আসলো নিরা। এসে দেখলো তার ভাইরা সব একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। নিরা ফাহিমকে ডেকে বললো,
— কিরে তোরা এখন এখানে? তাও সবাই জট বেধে। কোনো গরম খবর দিবি বুঝি?

নিরা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে বললো,
— আমার শ্বাশুড়ি মা কই?

নাঈম, ফায়াজ এবং ফাহিমের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে। কৌশিক এসে বললো,
— তুই এখানে কেন এলি? রুমে যা।

— কেন? তোরা আসলি আর আমি রুমে বসে থাকবো?

নাঈম এসে নিরার পেছনে দাঁড়িয়ে যায়। ফায়াজ এবং ফাহিম নিরার দুইপাশে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে কাশফি, আফিয়া, ফাতেমা এবং তুহিনের বউ ভেতরে এসে নিরার পাশে দাঁড়ায়। নিরা কিছুই বুঝতে পারছে না হঠাৎ সবাই এভাবে এসে ওর পাশে দাড়াচ্ছে কেনো। নিরার বুক এবার ধুকপুক করছে। অজানা আশংকায় মন বারবার কু ডাকছে। বারবার বাহিরের দিকে তাকাচ্ছে। তূর্য, তুহিন সাদা কাপড়ে মোড়ানো একজন ব্যাক্তিকে কোলে নিয়ে ঘরে এলো। এদিকে সবাই ড্রয়িংরুমের সব জিনিস একপাশ করে সরিয়ে ফেললো। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে দিলো। সাদা কাপড়ে মোড়ানো ব্যাক্তিকে সেখানে শুয়ে দেয়া হলো। এরই মধ্যে তনিমা খানম কান্না করতে করতে ভেতরে এলেন। কৌশিকের চোখে পানি। নিরার বাবা, মা, চাচা, চাচি এমনকি তূর্যের বাবা, মা, তুহিনের শ্বশুর বাড়ির লোকেরা পর্যন্ত চলে এসেছে। নিরা কিছুই বুঝতে পারছে না হচ্ছেটা কি। আর তার রাফুই বা এখনো আসছে না কেনো। নিরা বারবার দরজার বাহিরে তাকাচ্ছে। রাফিনের বাবা এসে মেঝেতে শুইয়ে দেয়া ব্যাক্তির পাশে বসে কান্না করছে। নিরা কি বুঝলো কে জানে, সবার মাঝ থেকে বেরিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দেয়া ব্যাক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফাহিম নিরার হাত শক্ত করে ধরে বললো,
— আপু তুই এখানে থাক।

নিরা রোবটের মতো হেটে এসে মেঝেতে বসে। মুখের উপর থেকে কাপড় তুলে দেখলো এটা তার রাফু। নিরা হেসে দেয়। সবাই অবাক হয়ে নিরার দিকে তাকিয়ে আছে। রাফিনের পুরো মাথা ব্যান্ডেজ করা। নিরা বললো,
— এভাবে এসেছেন আপনি? পুরাই চমকে দিয়েছেন আমাকে। দেখুন কত মানুষ এসেছে। আচ্ছা আপনি চোখ বন্ধ করে রেখেছেন কেনো?

নিরা কপালে হাত দিয়ে বললো,
— জ্বর এসেছে আপনার?

কৌশিকের দিকে ফিরে বললো,
— ভাই উনাকে রুমে নিয়ে আয়। উনার শরীর খারাপ হয়ত তাই এভাবে ঘুমিয়ে আছে। এখানে মেঝেতে থাকলে আরো শরীর খারাপ হবে।

নিরার কথায় কান্নার আওয়াজ আরো বেড়ে গেলো সবার। নিরা বিরক্ত হয়ে একটু ধমকের সাথেই বললো,
— এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদছিস কেনো? কি বললাম শুনিস নি? উনার ঘুম অনেক পাতলা তোদের এই কান্নার আওয়াজে উনি উঠে যাবে এক্ষুনি। আর আমাকে বকে দিবে। বললে “নিরু আমি ঘুমাচ্ছি ওদের বলো বিরক্ত না করতে।” তখন দেখিস খামছি দিবো আমি।

কৌশিক এসে নিরাকে জড়িয়ে ধরে আরো কান্নার আওয়াজ বাড়িয়ে দিলো। নিরা দুইগালে হাত রেখে বললো,
— আমার বোন কথাটা শুন, তোর রাফু আর কোনোদিন ঘুম থেকে উঠবে না। তোর রাফু একেবারের জন্য ঘুমিয়ে গেছে।

নিরা কিছুক্ষণ কৌশিকের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে দিলো। বললো,
— ফাইজলামি করছিস? আমি জানি তুই আমাকে খেপানোর জন্যই এতো ফাইজলামি করছিস।

কৌশিক বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কিছু বলার জন্য পেলো না। শুধু নিরাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছে। সবার এতো কান্না দেখে নিরা আর কোনো কথা বললো না শুধু এক দৃষ্টিতে রাফিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ পর বললো,
— ভাইয়া রাফু যাওয়ার সময় বলেছিলো খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। আমার মন খারাপ দেখে বলেছে প্রমিজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। তাড়াতাড়িই ফিরে এসেছে।

নিরা আবারো হেসে দিলো। আর পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো রাফিনের মুখের দিকে। এরই মাঝে সবাই কোর’আন নিয়ে পড়তে বসেছে। ওদের দেখে নিরা বললো,
— ভাই ছাড় ছাড় আমি এখন কোর’আন পড়তে না বসলে রাফু এখন উঠেই আমাকে ধমক দিবে। রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে।

উপস্থিত সবার কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিরার দিকে তাকিয়ে আছে আর শব্দ ছাড়াই চোখের পানি গড়িয়ে পরছে। মিসেস ফিরোজা তুহিনের মা উনিও আজ কাঁদছেন নিরাকে দেখে। নাঈম এবং ফাতেমা ধরে নিরাকে ওয়াশরুমে নিয়ে আসে। নিরা অজু করে কোর’আন নিয়ে একদম রাফিনের মাথার কাছে এসে বসে। বললো,
— উনি বলেছে যেদিন উনি কোর’আন পড়বে না সেদিন যেনো আমি উনার মাথার কাছে বসে কোর’আন পড়ি।

কেউ কোনো কথা বললো না। নিরা হালকা গুনগুন করে পড়া শুরু করে৷ নিরার মা মূর্তির ন্যায় বসে আছেন। তনিমা খানম নিজেকে অনেক কষ্টে সংযত রেখেছেন। সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছেন তিনি। রাফিনের দাফনের কাজ তাদের বাড়িতে সম্পন্ন করা হবে। এম্বুলেন্স যেটায় করে রাফিনকে আনা হয়েছে সেটাতে করেই নিয়ে যাওয়া হবে। পাঁচটা মাইক্রো ভাড়া করা হয়েছে।

তূর্য, তুহিন এবং নাঈম তিনজনে ধরে রাফিনের লাশ এম্বুলেন্সে তুলে দিয়েছে। রাফিনের লাশের পাশে কৌশিক বসেছে। নিরাকে বোরকা নেকাপ পড়িয়ে ধরে ধরে নিচে আনা হয়েছে। নিরাকে মাইক্রোতে বসাতে চেয়েছে কিন্তু নিরার একটাই কথা সে তার রাফুর পাশে বসে যাবে। রাফুকে ছাড়া সে কখনো একা বসে কোথাও যায়নি। অনেকে মানা করায় নিরা রেগে গেছে। সাথে সাথে নিরার পেট ব্যাথা শুরু হয়। নিরার ব্যাথায় কুকড়ে উঠে। কৌশিক সবার কথা উপেক্ষা করে আফিয়াকে নিয়ে নিরাকে এম্বুলেন্সে তুলে দেয়। নিরা রাফিনের মাথার কাছে বসে। আবারো গুনগুন করে সূরা ইয়াসিন, আর রহমান পড়তে শুরু করে। নিরা এখনো বুঝতে পারছে না তার রাফু একেবারের জন্য ঘুমিয়ে গেছে। নিরা মনে মনে ভাবছে গ্রামে গেলে রাফু জেগে উঠবে তারপর সবাইকে চমকে দিবে।

এশার আগেই সেখানে পৌছে গেছে। নিরার কাপড় বদলে সাদা কাপড় পড়িয়ে দেয় আফিয়া, কাশফি এবং তুহিনের বউ নাদিয়া মিলে। গ্রামের মুরব্বিরা নিরার নাকফুল খুলে নেয়। কানের, গলার সব জিনিস খুলে ফেলে। হাতের আংটি খুলতে গেলেই নিরা চিৎকার চেচামেচি শুরু করে। তনিমা খানম এলে নিরা তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— মা দেখো না ওরা সবাই মিলে রাফু দেয়া আংটিটা খুলে ফেলতে চাইছে। উনি এটা পরিয়ে দেয়ার সময় জোর গলায় বলেছে এই রিং খুললে আমাকে অনেক বকবে। আমি এটা খুলবো না মা।

তনিমা খানম বললেন,
— ওর সব জিনিস ওকে পরিয়ে দিন। ইসলামে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী স্বর্ণ পড়তে পারবে না এমন কোনো বিধান নেই।

কেউ আর কিছু বললো না। এশার নামাজের পর রাফিনের জানাজা পড়ানো হবে। রাফিনকে খাটে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। একপাশে রাফিনের বাবা ধরেছে, একপাশে কৌশিক, একপাশ নাঈম এবং অপর পাশে নিরার বাবা ধরেছে। সব ছেলেরা পেছনে যাচ্ছে। মহিলারা সবাই দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। নিরাকে তার ভাবি এবং বোন ধরে রেখেছে। রাফিনের লাশের খাটি নিয়ে একপা একপা করে যত এগিয়ে যাচ্ছে নিরার মনের ভেতর বেদনা বাড়ছে। এতক্ষণ স্বাভাবিকই ছিলো কিন্তু এখন বেদনা বাড়ছে। নিরা মিনমিনে গলায় বললো,
— তাড়াতাড়ি আসবেন বলেছেন। এসেছেন। এখন আবার চলে যাচ্ছেন। কেনো রাফু? আপনি জানেন না আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারি না। রাফু রাফু রাফু!

নিরাকে সবাই ধরে ফেলে। নিরা জ্ঞান হারিয়েছে। তনিমা খানম আহাজারি করে বললেন,
— আমার ছেলে চলে গেছে কিন্তু আমি চাই না আমার মেয়েটার কিছু হোক। প্লিজ তোমরা আমার মেয়েটাকে দেখো। দেখো ওর কি হয়েছে।

—————————————-
পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো নিরা। চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখছে। আবার চোখ বন্ধ করে নেয়। আবারো হালকা করে চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে দেখে রাফিন ওকে সাপের মতো করে পেচিয়ে ধরে রেখেছে। নিরা এক ঝটকায় জড়িয়ে ধরে বললো,
— প্লিজ বলুন আপনি আর আমাকে ছেড়ে যাবেন না।

রাফিন হাসছে। মুখে কি মায়া। কেমন যেনো জ্বলজ্বল করছে চেহারাটা। নিরার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতেই কোথায় যেনো বিলিন হয়ে গেলো। ধড়ফড় করে উঠে বসে নিরা। কৌশিক ধরে ফেলে৷ পাশের লেডি ডাক্তার বললো,
— ম্যাম আস্তে। আপনার পেটে চাপ পড়বে।

নিরা আশেপাশে তাকালো। এরপর কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমার রাফু কই? আমি দেখেছি আমার রাফুকে আমার পাশে। হঠাৎ কোথায় যেনো বিলীন হয়ে গেছে। কোথায় রাফু?

কৌশিক কিছু বললো না। শুধু নিরবে চোখের পানি ফেলছে। নিরা আশেপাশে আবার তাকালো। চিৎকার দিয়ে বললো,
— তুই আমাকে আমার রাফুর কাছ থেকে নিয়ে এসেছিস। আমাকে দিয়ে আয় আমার রাফুর কাছে।

নিরা উঠে দাঁড়িয়ে যায়। জিনিসপত্র ছুড়ে মারছে এদিক সেদিক। আর বারবার বলছে,
— আমাকে আমার রাফুর কাছে দিয়ে আয়। নাইলে আমি খুন করবো তোকে।

অবস্থা বেগতিক। নিরার পেইন উঠে গেছে। পেট ধরে রেখেছে। লেডি ডাক্তার উপায় না পেয়ে নিরাকে ঘুমের ইনজেকশন পুস করে দেয়। মূহুর্তেই নিরা নেতিয়ে পরে। নিরাকে ধরে শুয়ে দেয়। লেডি ডাক্তার বললো,
— এভাবে আর কতদিন উনাকে রাখবেন। গত চার মাস ধরে উনাকে ঘুমের ইনজেকশন পুস করে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। এভাবে হলে উনার মানসিক ভারসাম্য হারাবে সাথে উনার বাবুদের অবস্থাও খারাপ হয়ে যাবে। আর আপনাকে জানানো হয়নি উনার টুইনবেবি হবে। আগের থেকে উনার পেট আরো বড় হয়ে গেছে। এভাবে হলে উনার ক্ষতি হবে সাথে বাচ্চাদের বাঁচানো যাবে না। আমি আপনাকে একটা বিষয়ে সাজেস্ট করবো উনাকে ড. রাফিনের বাসায় নিয়ে যান। সেখানে গেলে পুরোনো স্মৃতি মনে করে হয়ত তিনি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে যাবেন। এটা ছাড়া আর পথ নেই। আর ড. রাফিনকেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তাই এটাই করুন।

লেডি ডাক্তার নিরার পাশে এসে বসেছে। পকেট থেকে টিস্যু বের করে চোখ মুছে নেয়। নিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। গত চারমাসে নিরার দেখবাল করেছেন উনি। প্রতিদিন কেঁদেছেন নিরার জন্য। এভাবে কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে এটা উনার মাথায় ধরে না। পুরোই লাভ বার্ডের মতো। একজন মারা গেলে আরেকজন সঙ্গীর জন্য শোকে কাতর হয়ে যায়। নিরাকেও তেমনই মনে হয় উনার।

কৌশিক দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে নিরার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ফিরে গেলো সেই দেড় বছর আগে। দেড় বছর আগের রাফিনের বলে যাওয়া কথাটা বারবার কানে বাজতে লাগলো কৌশিকের। রাফিনের কথাটা ছিলো, “মাত্র তিনমাস আমি দূরে ছিলাম তার মধ্যেই মেয়েটার এই অবস্থা। যদি আমার কখনো কিছু হয়ে যায় তখন ওর কি অবস্থা হবে এই একটা টেনশন সবসময় আমার মাথায় ঘুরে। ভাই তোর হাত ধরে বলছি, যদি কোনোদিন আমার কিছু হয়ে যায় প্লিজ আমার পাগলিটাকে একটু দেখে রাফিন। আমার পাগলিটা যে নিজেকে সামলাতে পারবে না। পাগল হয়ে যাবে। শুধু তুই একজন যাকে আমি ভরসা করতে পারি। প্লিজ আমার পাগলিটাকে সামলে নিস।” কৌশিকের বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়। চোখের পানি বাধ মানছে না। মনে মনে বললো,
— রাফিন তুই ঠিক বলেছিস। তোর পাগলি তোকে ছাড়া পাগল হয়ে গেছে। যতটুকু পারি সামলে নিবো আমি, প্রমিজ।

সন্ধ্যার দিকে ভাংচুরের আওয়াজে কৌশিক দৌড়ে আসে নিরার ঘরে। নিরাকে শান্ত করে বললো,
— তৈরি হয়ে নে। তোকে আমি তোর রাফুর বাসায় নিয়ে যাবো।

নিরা খুশি হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি করে বোরকা পরে নেয়। লেডি ডাক্তারও আছে তাদের সাথে। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌছে যায় তারা রাফিনের ফ্ল্যাটে। দরজা খুলে তনিমা খানম নিরাকে দেখে খুশিতে কেঁদে দেন। জড়িয়ে ধরেন নিরাকে। আজ যেনো মরা রুহটা কিছুটা সজীব হয়েছে উনার। নিরাও বেশ স্বাভাবিক আচরণ করছে। লেডি ডাক্তারকে কৌশিক বললো,
— ওর ডেলিভারি পর্যন্ত আপনি এখানে থাকুন প্লিজ।

লেডি ডাক্তার খুশি হয়ে বললেন,
— হ্যাঁ আমি আছি।

——————————
নিরার দুইটা টুইন বেবি হয়েছে। একটা মেয়ে একটা ছেলে। দুইটাই বাবার মতো হয়েছে। ছেলেটার রাগ একদম বাবার মতো। নিরা দুইটাকে খাইয়ে দিয়ে পাশে বসেছে। ড্রয়িং রুমে কৌশিক, তূর্য, তুহিন তনিমা খানমের সাথে কথা বলছেন। কৌশিক বললো,
— রাফিনের গাড়ি ব্রেকফেল করে বড় গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে এক্সিডেন করেছে। স্থানীয়রা ফোন করায় আমি দ্রুত সেখানে গিয়ে ওকে ওর হসপিটালে নিয়ে গেছি। পুলিশ কেস না হওয়ার জন্য ডাক্তারদের বলিছি যাতে কাউকে কিছু না জানায়। ডাক্তাররা বললো ওর মাথায় এবং বুকে অনেক পেরেক গাথা ছিলো। আমরা ওটিতে ঢুকলে বারবার শুধু একটা কথাই বলেছে নিরাকে মায়ের কাছে থাকতে বলিস। আর আমার পাগলিকে দেখে রাখিস।

তনিমা খানম আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নেয়। নিরা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে।

——————————
এই নিরুপাখি উঠো৷ নামাজ পড়বো দুজন। একসাথে জান্নাতে যাওয়ার জন্য আল্লাহকে বলবো। নিরা একলাফে উঠে বসে। প্রায় রাতেই কানের কাছে রাফিনের বলা কথাটা নিরার কানে বাজে। নিরা উঠে অজু করে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। নামাজ পড়ে মনে মনে বললো,

-“এখনো গভীর রাতে ঘুম ভাঙে। মনের মাঝে আঁচড় কাটে। দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আপনি আমার মোহ নয় মায়া ছিলেন। মোহ কেটে যায়, মায়া থেকে যায় আজীবন।”

——————————
নিরার দূরসম্পর্কের চাচা,চাচি এসেছে আজ। তারা ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। নিরা দাঁড়িয়ে আছে। চাচা বললো,
— আমি শুধু মাফ চাইতে এসেছি। কারণ পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না।

নিরা অবাক হয়। উনি আবার বললেন,
— আমার ছেলের জন্য প্রস্তাব নিয়ে তোমাদের বাড়িতে গেছিলাম। তোমার মা বললো তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি জানতে না। এর আগেও একবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম কিন্তু রাজি হয়নি। প্রতিশোধের নেশায় বুদ হয়ে যাই। রাফিনকে আমি ডেকে নিয়ে গেছিলাম আমার গোডাউনে। ওকে বেধে রেখেছিলাম। ও বারবার শুধু তোমার নাম নিচ্ছিলো। রাগের বসে ওর মাথায় এবং বুকে পেরেক গেথে দিয়েছি। তারপরেও তোমার কাছে আসার জন্য ও সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। আমি আগেই গাড়ির ব্রেক নষ্ট করে দিয়েছিলাম। তাই বেশিদূর যেতে পারেনি। এক্সিডেন্ট হয়ে যায়। আজ আমার ছেলেকেও কেউ আরো নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। এখন বুঝতে পারছি এটা আমার পাপের ফল।”

নিরা জমে গেছে শক্ত বরফের ন্যায়। হার্টবিট যেনো থেমে যাচ্ছে। তখনই পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরে বললো,
— মাম্মাম৷

নিরা পেছন ফিরে দেখে নিরার ছেলে। ওকে কোলে নিয়ে দুই গালে চুমু দিয়ে বললো,
— আপনাকে আমি মাফ করে দিয়েছি। বাসায় যান আপনি।

ছেলেকে নিয়ে রুমে চলে আসে। এই ছেলে মেয়ে দুটোই নিরার বেঁচে থাকার কারণ। রাফিন হয়ত জানতো খুব তাড়াতাড়ি সে চলে যাবে। তাই নিরাকে এই দুটো মহা মূল্যবান উপহার দিয়ে গেছে।

——————————
রাফিনের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিরা। অনেক বছর রাফিনকে আর স্বপ্নে দেখে না। এখন প্রায় সময়ই স্বপ্নে দেখে রাফিনকে। সেই আগেই স্বপ্নটাই দেখে। পেছন থেকে ছেলেটা এসে জড়িয়ে ধরলো। নিরা পেছন ফিরলে মায়ের কপালে চুমু দিয়ে বললো,
— মা কংগ্রেস। ইউ আর গোয়িং টু বি গ্র‍্যান্ডমাদার। আর সাথে নানিও হবে। তোমার মেয়েও কনসিভ করেছে।

নিরা খুশিতে ছেলের কপালে চুমু দেন।বললো,
— বাবা তুমি যাও। আমি এক্ষুনি আসছি।

নিরা ছেলের রুমে যায়। বউ উঠে বসে। নিরা বউমায়ের কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
— দীর্ঘজীবী হও মা।

সবাই খুব খুশি। নিরা রুমে এসে আবারো ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
— আপনার ছেলেমেয়ে দুটোকেই আপনার মতো করে দ্বীনি শিক্ষায় গড়ে তুলেছি। আমার দায়িত্ব শেষ। এবার এসে নিয়ে যান আমাকে আপনার কাছে।

নিরার কপালের দিকে প্রায় চুল সাদা হয়ে গেছে। মেয়েটাকে দেখতে গেছে নিরা। কৌশিকের ছেলে আবরার ওকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। মেয়ের মাথায় চুমু দিলেন।

গভীর রাত। আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে। নিরা রাফিনের কবরের পাশে বসে গুনগুন করে কোর’আন পড়ছে। এদিকে একটা লাইট লাগানো হয়েছে। সপ্তাহে তিনদিন নিরা গ্রামের বাড়িতে আসে এবং স্বামীর কবরের কাছে এসে দিনের বেশিরভাগ সময় কোর’আন পড়ে।৷ রাতের অর্ধেক সময়ও কবরের পাশে বসে কোর’আন তেলায়ত করে। বাকি চারদিন ছেলে মেয়ে দুজন এসে বাবার মাথার পাশে বসে কোর’আন পড়ে৷

আকাশের দিকে তাকিয়ে নিরা বললো,
— “অনেকদিন একসাথে আকাশ দেখা হয় না। চাঁদ দেখা হয়না। জোছনা গায়ে মাখা হয় না। একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা হয়না। ভালোবাসি আপনাকে। খুব ভালোবাসি। আপনি চলে যাওয়ায় আমার হৃদয়টা ভেঙে খন্ড বিখন্ড হয়ে গেছে। সেই খন্ড খন্ড “হৃদয়ের কোণে” আপনি ছিলেন, আছেন থাকবেন। মৃত্যুর পরেও আমি আপনাকেই ভালোবাসবো।”

—(সমাপ্ত)—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here