হিংস্রপ্রেম পর্ব ৯

0
399

Story: হিংস্রপ্রেম
পর্বঃ ০৯
লেখাঃ Israt Jahan

মেহেরঃ চোখদুটো বন্ধ করেছিলাম।কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে চোখ দুটো খুলে দেখলাম সেই একই ভাবে তাকিয়ে আছে।আমি চোখদুটো খোলার পর ও কথা বলা শুরু করল।

ফালাকঃ আমি এই মুহূর্তে খুব ই ক্লান্ত।আপনার সংস্পর্শে আসার মত অবস্থা এখন আমার নেই। কক্ষে আলো জ্বালেননি।জানালার সামনে দাড়িয়ে আছেন আর আকাশের ওই চাঁদটার পুরোটা আলো আপনার মুখে এসে পড়েছে।আপনার পুরো অঙ্গে জড়িয়ে গেছে সেই আলো।উজ্জল প্রদীপের মত জ্বল জ্বল করছে আপনার শরীরের হিরা মুক্তার গহনা গুলো চাঁদের আলোতে।হূর দেখতে কেমন তা আমি জানিনা।ছোটবেলাতে আব্বাজানের মুখে শুনেছি শুধু তাদের সৌন্দর্যের বিবরণ।তাই বলতে পারছিনা হূরদের মত লাগছে কিনা আপনাকে।তবে অস্বাভাবিক সৌন্দর্য বিরাজ করছে আপনার মাঝে এই মুহূর্তে।কক্ষে প্রবেশ করে এই অস্বাভাবিক সৌন্দর্য চোখে পড়তেই আমি থমকে গিয়েছিলাম। খুব কাছ থেকে দেখতে এসেছি এই সৌন্দর্য।

চাঁদের দিকে একবার তাকিয়ে আবার মেহেরের মুখের দিকে তাকাল ফালাক।
ফালাকঃ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক সর্বদা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝেই অবস্থান করে।

মেহেরের দুই বাহু ছেড়ে ফালাক বিছানার কাছে চলে গেল।আর মেহের ফালাকের দিকে চেয়ে ঠাঁই দাড়িয়ে রইলো।এভাবে কখনো ওর সৌন্দর্যের বর্ণনা কেউ কখনো করেনি।তাই ফালাকের মুখে ওর এমন সৌন্দর্যের বর্ণনা শুনে খুব অবাক হলো।

ফালাকঃ আলোটা জ্বালালে একটু সুবিধা হতো।
ফালাকের কথা শুনে মেহের দ্রুত কক্ষের আলো জ্বালালো।ফালাক বাইরের পোশাক গুলো খুলছিল তখন মেহের কক্ষের বাইরে চলে গেল।ফালাক মেহেরের চলে যাওয়া দেখেও কিছু বলল না। রাতের খাবার দাসী এসে ফালাকের কক্ষে দিয়ে গেছে।খুব ক্লান্ত থাকার কারণে ফালাক দাসীকে কক্ষে পৌঁছে দিয়ে যেতে বলেছে।আর মেহের পিতাকে খাইয়ে নিজের কক্ষে বসে আছে।পিতার মুখে ফালাকের সকল ঘটনা শোনার পর থেকে মেহের অনেকরকম চিন্তাভাবনা করছে।ফালাকের প্রতি কিছুটা মায়া কাজ করছে ওর।কিন্তু নিজের পিতামাতা,
আপনজনদের কথা মনে পড়তেই সেই মায়া মন থেকে মুছে যাচ্ছে।ও শুধু একটা কথাই ভাবছে।

মেহেরঃ আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি।
তাহলে আমাদের সাথে কেনো এমন করবে ও? হাজারবার পায়ে পড়লেও ও আমার আপনজনদের মুক্ত করতে নারাজ।আমি তো আমার আপনজনদের কষ্টে রেখে নিজে সুখের সংসার করতে পারবোনা।অসম্ভব তা আমার পক্ষে।আজকে আমি ওর কাছে শেষবারের মত অনুরোধ করবো। যদি আজও আমার অনুরোধ ও না রাখে তাহলে আমার যা করার আমি করবো।কার কিসে দুঃখ লাগবে কষ্ট পাবে তা দেখার দায়িত্ব আমার আর থাকবেনা।যেভাবে হোক আমি আমার পিতামাতা আত্মীয়স্বজন সবাইকে রক্ষা করবো।

ফালাকঃ অনেকক্ষণ হয়ে গেলো এখন পর্যন্ত মেহের কক্ষে এলনা।আজও কি ও অন্য কক্ষে রয়ে যাবে? এভাবে প্রতিদিন ওর সাথে জোড় জুলুম করতে করতে আমি অধৈর্য হয়ে যাচ্ছি।থাক আজ আর কিছু বলবনা।শরীরটা বড্ড ক্লান্ত চোখ জুড়ে ঘুম আসছে।

দরজাটা খোলা রেখেই ফালাক শুয়ে পড়েছে।ঘুমটা তখনো মজবুত হয়নি ওর।কিছুটা জাগ্ন অবস্থাতেই আছে বলতে গেলে।রাত যখন গভীর তখন হঠাৎ কক্ষের ভেতরে কেউ ঢুকে পড়ল।ধীর পায়ে ফালাকের দিকে এগিয়ে আসছে কেউ, কালো রঙের মোটা কাপড়ের এক খানা চাদর গায়ে জড়িয়ে।চোখ বাদে পুরো মুখটা সে ঢেকে রেখেছে।ফালাকের একদম কাছে এসে দাড়িয়েছে সে।ফালাকের মুখের দিকে তাকিয়ে তারপর চারপাশ একবার তাকিয়ে দেখে নিল। চাদরের ভেতর থেকে হাত বের করে কি একটা ফল ফালাকের নাকে চেঁপে ধরল।ফালাক কিছু দেখার আগেই জ্ঞান হারাল।কিছু সময় পর সে ফালাকের শরীরে নাড়া দিয়ে দেখল অচেতন হয়েছে কিনা।কোনো সাড়া না পেয়ে বুঝতে পারল ফালাক অচেতন হয়ে গেছে।তারপর কোমড় থেকে একটা ছুড়ি বের করেই ফালাকের বুক বরাবর আঘাত করতে গেল ঠিক তখনই মেহের কক্ষের আলো জ্বালালো।হাতে ছুড়ি নিয়ে এভাবে ফালাকের দিকে আঘাত করতে দেখে মেহের চমকে উঠল।

মেহেরঃ কে তুমি?
লোকটি মেহেরের দিকে তেড়ে আসল ছুড়ি নিয়ে। কিন্তু এমন আক্রমণের মুখোমুখি মেহের যে হতে পারে তা অবশ্য ওই লোকটির জানা ছিলনা। আত্মরক্ষা করে খুব কৌশলে মেহের তার হাত থেকে ছুড়ি কেড়ে নিল।যার হাতে ছুড়িটি ছিল সে যে একদম অস্ত্রশিক্ষাতে অপারগ তা তার ছুড়ি চালানো দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।মেহের তার গলাতে ছুড়ি আটকে মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে দিল। মুখটা দেখেই মেহের খুব অবাক হল।এ যে একজন নারী।

মেহেরঃ কে তুমি?এভাবে সম্রাটকে মাড়তে চাইছো কেন?তুমি জানো এখন তোমার কি অবস্থা হতে পারে?
রেশমিঃ আমি রেশমি খালিশাবাদ রাজ্যের রাজকন্যা।
রেশমির পরিচয় শুনে মেহের বুঝতে পারলো এ ও হয়তো ফালাকের অত্যাচারের স্বীকার।মেহের রেশমির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বাগানে।

মেহেরঃ তোমাকে তো রাজমহলে কখনো দেখিনি। রাজমহলে কিভাবে এলে?
রেশমিঃ তার আগে বলুন আপনি কে?
মেহেরঃ তোমার মতই একজন।শেরপুর রাজ্যের রাজা জাভেদ খানের একমাত্র কন্যা মেহেরুন।
রেশমিঃ ও…..আপনিই বুঝি তাহলে ফালাক তাজের স্ত্রী।যার রূপে আকৃষ্ট হয়ে ফালাক বিবাহ সম্পন্ন করলো।আপনাকে দেখার আমার সত্যি আগ্রহ ছিল যে কি এমন সুন্দরী আপনি যার কাছে অন্যসব রাজকন্যা, সুন্দরী হার মেনেছে।এতদিন ফালাক তাজ যত সুন্দরী নারীদের অসম্মান করেছে তার মাঝে একজন কেও তিনি স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতে চাইনি।
মেহেরঃ তার মাঝে তুমিও একজন তাই তো?
রেশমিঃ হ্যা।আপনি-ই সেই নারী যাকে অসম্মান করার পর সে আপনাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছে।
মেহেরঃ বিবাহের পূর্বে সে একবার ও চেষ্টা করেনি আমার কাছে আসার।আমাকে তুলে আনার পরই সে জানিয়েছে, বিবাহের মাধ্যমে স্বামীরূপে সে আমার কাছে আসবে।
রেশমিঃ অবিশ্বাস্যকর ঘটনা।
মেহেরঃ আমি তোমার কাছে যা জানতে চেয়েছি তা কিন্তু এখনো বলোনি।
রেশমিঃ সেনাপতি ইকরাম আমাকে তার রক্ষিতা করে রেখেছিল।আজ সে বাড়িতে ফিরেনি।সেই সুযোগে আমি পালিয়েছি।পালিয়ে যাওয়ার আগে ভাবলাম ওই শয়তান নরপিশাচকে হত্যা করে যায় যে আমার জীবনটাকে দোযখে রূপান্তর করেছে। তোমাকে কি খুব সুখে রেখেছে ও?তোমার সামনে অন্য কোনো নারীর সাথে সময় কাটায়না?তুমি করেই বলে ফেললাম তোমাকে।
মেহেরঃ এখন পর্যন্ত এমন কিছু দেখিনি।তবে সুখে নেই।জোড়পূর্বক সে স্বামীর অধিকার ফলাতে চায়। আমার পিতামাতা আত্মীয় পরিজনদের সে কারগারে বন্দী করে রেখেছে।
রেশমিঃ ও কোনোদিনও শুধরাবার নয়।কাল তোমার থেকে সুন্দরী নারী ওর চোখে পড়লেই ও তোমাকে কারো রক্ষিতা বানিয়ে দিতে দ্বিতীয়বার ভাববেনা।মেড়ে ফেলছোনা কেন ওকে?তোমার কাছে তো বহু সুযোগ।নাকি তুমি ওকে…..
মেহেরঃ না।ওকে আমি কোনোদিনও ভালোবাসতে পারবোনা।
রেশমিঃ তাহলে শেষ করে দাও ওকে। তোমার পরিবার পরিজন,আমাদের মত আরো বহু মানুষের পরিবার পরিজন সবাইকে রক্ষা করার ক্ষমতা আল্লাহ্ পাক তোমার হাতেই দিয়েছে।সেই সুযোগ তোমার হাতে আছে মেড়ে ফেলো ওকে।এছাড়া তুমি বা তোমার পরিবার কোনোদিনও রক্ষা পাবেনা ওর থেকে।আজ কতগুলো দিন আমাকে অসহ্য যন্ত্রণার মাঝে কাটাতে হচ্ছে।নিজের পরিবার এর খোঁজটাও জানিনা।আদৌ ও তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে কিনা।শরীরে আগুন জ্বলছে আমার।মনে হচ্ছে এক্ষণি গিয়ে শেষ করে আসি।
মেহেরঃ এভাবে ওকে তুমি মাড়তে পারলেও রক্ষা পাবেনা।আমার চোখে তুমি যেভাবে ধরা পড়ে গেছো ঠিক একইভাবে অন্য কারোর চোখে তুমি ধরা পড়ে যেতে।
রেশমিঃ তাহলে তুমি আমাকে কথা দাও তুমি আমার পরিবারের খোঁজ আমাকে জানাবে। ওরা বেঁচে থাকলে ওদেরকে রক্ষা করবে।ওর প্রতি কখনো মায়া সৃষ্টি করোনা।ও কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়।ও কাউকে ভালোবাসতেও পারেরেনা।
যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমার পিতা ওর সাথে সন্ধি করতে চেয়েছিলো। আমাকে বিবাহ দিতে চেয়েছিল ওর সাথে। ও সেই কথা দিয়েও কথা রাখেনি।মনে মনে ওকে নিয়ে স্বপ্ন ও দেখতে শুরু করেছিলাম।আর তার প্রতিদান দিয়েছিল আমাকে এক রাতের ভোগের সামগ্রী বানিয়ে।তাই বলছি বিশ্বাস করোনা ওকে।তুমি ওর সামনে তোমার প্রাণ দিয়ে দিলেও ও তোমার দিকে মুখ ফিরে তাকাবেনা।

রেশমির কথাগুলো শুনে মেহের কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।কি করবে ও? সত্যিই কি ফালাক কে ওর খুন করতে হবে?নাকি ওর কাছে অনুরোধ করবে ওর পিতামাতাকে মুক্তি দিতে?এমন দোটানার মাঝে পড়ে গেছে মেহের।মেহের অবশেষে মনেমনে একটি সিদ্ধান্ত নিল।

মেহেরঃ ঠিক আছে কথা দিচ্ছি আমি তোমার পরিবারের খোঁজ তোমাকে দেব।তারা জীবিত থাকলে তাদের মুক্ত করবো আমি।এখন তুমি এখান থেকে পালাও নয়তো তোমার জীবন বিপন্ন হয়ে যাবে।
রেশমিঃ ঠিক আছে বোন।তোমার ভরসাতেই আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।তুমি তোমার দেওয়া কথা কিন্তু রেখো।আসছি।
মেহেরঃ সাবধানে যেও।

মেহের রেশমিকে বিদায় দিয়ে ফালাকের কক্ষে এল।তখনো ফালাক অচেতন অবস্থাতে আছে। ফালাকের কাছে গিয়ে কিছুসময় ওর দিকে চেয়ে রইলো।নিদ্রারত অবস্থাতে ফালাকের চেহারার মাঝে হিংস্ররূপটা ফুটে উঠছেনা।ওর চেহারার আসল সৌন্দর্যটা এখন দেখা যাচ্ছে।মূলত ওর ব্যবহার আর অত্যাচার এতোটায় ভয়ংকর যে ওর চেহারার আসল সৌন্দর্যটা ঢাকা পড়ে যায় সেই হিংস্রতার মাঝে।ফালাকের পায়ের তালুটা আবার দেখছে মেহের।

মেহেরঃ কি নির্মম ভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ওর পায়ের তালু।তখন তো খুব ছোট ছিল একটুও মায়া হয়েছিলনা ওদের?

নিজের অজান্তেই ফালাকের পায়ের তালুতে হাত চলে গেলো মেহেরের।অনেক যত্নে হাত বুলিয়ে দেখছে ওই কালো দাগ গুলো।তখন আস্তে আস্তে ফালাকের চেতনা ফিরছে।যখন চোখ খুললো তখন সোজা মেহেরের দিকে ওর দৃষ্টি গেল।ও দেখছে মেহের ওর পায়ের কাছে বসে আছে আর হাতটা ওর পায়ের তালুতে।খুব দ্রুত উঠে বসলো ও।ওর উঠে বসা দেখে মেহের চমকে গিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়াল।

ফালাকঃ তুমি?
মেহেরঃ আমি আসলে…..
ফালাকঃ তুমি আমাকে……উহ্ মাথাটা এত ঘুরছে কেনো?
মেহেরঃ মানে?

ফালাক মাথা কিছুক্ষণ চেঁপে ধরে বসে থাকল। তারপর মেহেরের দিকে তাকিয়ে বিছানা থেকে উঠে কক্ষের আলো জ্বালাল।মেহেরের দিকে এগিয়ে আসতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যেত লাগল।মেহের দ্রুত গিয়ে ফালাককে ধরে নিয়েছে।

মেহেরঃ সাবধানে কি হয়েছে আপনার?
ফালাক মাথাটা ধরে দাড়িয়েছিল।মেহের ওকে ধরতেই নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে মেহেরের হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।তারপর মেহেরের গলা চেঁপে ধরল।বাঘের মত গর্জন করে উঠল।
ফালাকঃ মেহের! তুমি আমাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলে?অচেতন করে আমাকে খুন করতে চেয়েছো।এতবড় সাহস তোমার?

ফালাক এতজোড়ে মেহেরের গলা চেঁপে ধরেছে যে মেহেরের দম পুরো আটকে আসছে।শরীর দিয়ে ঘাম ঝরে যাচ্ছে মেহেরের,চোখ দুটো মনে হচ্ছে কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে।এমন অবস্থা হয়ে গেছে মেহেরের।কথা বলার শক্তিটুকু ও পাচ্ছেনা।
ফালাকের কক্ষের পাশে ওর পিতার কক্ষ।পুত্রের এমন জোড়ে চিৎকার করা শুনে সে ছুটে এল ফালাকের কক্ষে।

পিতাঃ তাজ?কি করছিস তুই?ছাড় ওকে। তাজ আমি কিন্তু ওকে ছাড়তে বলছি।
পিতার কোনো কথা কানে নিচ্ছেনা ফালাক।তাই তিনি এসে ফালাককে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। অবশেষে ফালাক যখন মেহেরকে ছেড়ে দিল তখন মেহের চারপাশ অন্ধকার দেখছিল।মাথা ঘুড়ে মাটিতে পড়ে গেল।ওই সময়েই জ্ঞান হারাল মেহের।পিতা মেহেরুন কে ধরে ওকে বারবার ডাকছিল।আর ফালাক তখনো রাগে শাসাচ্ছিল। মেহেরের এমন অবস্থাতে চোখ মুখ একদম লাল হয়ে গেছে আর ফালাকের রাগে চোখে একদম রক্ত জমে গেছে আর ফর্সা মুখও লাল বর্ণ ধারণ করেছে।

পিতাঃ ওকে দ্রুত শয্যাতে ওঠা।কি বলছি শুনতে পাচ্ছিস না?
ফালাক রেগে ওখান থেকে সরে দরজার কাছে গিয়ে দরজাতে অনেক জোড়ে থাবা দিল।পিতা ভালোভাবে বুঝতে পারল যে ফালাক ওকে বিছানাতে ওঠাবেনা।উনি মেহেরের মাথা কোলে তুলে দ্রুত পানির ছিটা দিতে শুরু করল।অনেকক্ষণ বাদে মেহেরের জ্ঞান ফিরল।
পিতাঃ মেহেরুন মা?ঠিক আছো তুমি?
মেহের ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাসূচক উত্তর দিল।তারপর পিতা ওকে ধরে বিছানাতে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল।তখন ফালাকের রক্তবর্ণ চোখ দুটো মেহেরের দিকে চেয়ে আছে।
তারপর পিতা রাগী কন্ঠে ফালাককে প্রশ্ন করল।
পিতাঃ কি এমন হয়েছিল যে তুমি ওকে প্রাণে মাড়তে গিয়েছিলে?আর কোনোদিনও কি তুমি ভালো হবে না?
ফালাক জোড় গলায় উত্তর দিল।
ফালাকঃ আব্বাজান ও আমাকে অচেতন করে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল।পরিকল্পনাটা অনেক বেশি সময় নিয়ে করছিল বিধায় তার মাঝে আমি আমার চেতনা ফিরে পায় আর তখন দেখি ও আমার পায়ের কাছে বসে আছে।
পিতাঃ তুমি কি দেখেছিলে ও তোমাকে অচেতন করার চেষ্টা করছে?তাহলে তুমি বাঁধা দাওনি কেন?
ফালাকঃ আমি দরজাটা খোলা রেখেই শুয়ে পড়েছিলাম।ভেবেছিলাম ও যদি কক্ষে আসে তাই। তখনো আমি পুরোপুরি ঘুমিয়ে যায়নি।হঠাৎ করেই আমার নাকের উপর কিছু চেঁপে ধরে।তারপর আমি ওর মুখটাও দেখতে পাইনি তার আগেই আমি চেতনা হারায়।আর যখন চেতনা ফিরে পায় তখন দেখি ও আমার পায়ের কাছে বসে আছে।

পিতা ফালাকের কথাগুলো শুনে কিছুটা ভেঙ্গে পড়ল।ভেবেছিল মেহের-ই হয়তো ফালাকের জীবনটা নতুন করে সাজাবে।পিতা মেহেরের কাছে গেল।
পিতাঃ আমি তোমার থেকে এমন কাজ আশা করিনি মেহেরুন।শেষ পর্যন্ত তুমিও আমার তাজ এর শত্রু হয়ে গেলে?একটাবার ওকে সুযোগ দিলে না?
মেহের শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসল।
মেহেরঃ আমার সৃষ্টিকর্তা জানেন আমি ওনাকে অচেতন করিনি,ওনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা ও করিনি।এমন পরিকল্পনা করার প্রয়োজন হলে আমি কাল-ই ওনাকে হত্যা করতে পারতাম। যখন উনি নিজে থেকেই অচেতন হওয়ার মত পড়ে ছিলেন।ওনাকে সুস্থ করার প্রয়োজনবোধ করতাম না।
মেহেরের এই উত্তরের পর পিতা পুত্র দুজনেরই ভুল ভাঙ্গলো।ফালাক রাগ উধাও করে দিয়ে অবাক চোখে মেহেরের দিকে তাকালো।ও নিজেও জানেনা গতরাতে ও কি অবস্থাতে ছিল আর মেহের কিভাবে ওকে সুস্থ করেছিল।
পিতাঃতাইতো…..এই কথা তো আমার মাথাতেই আসেনি।কাল রাতে ওর অসুস্থ অবস্থাতে তুমি-ই ওকে সেবা দিয়ে সুস্থ করেছো।তোমার দ্বারা তো তাহলে এই কাজ সম্ভব নয়।দুঃখিত মেহেরুন কিছুসময়ের জন্য হলেও আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি।
মেহেরঃ এভাবে দুঃখ প্রকাশ করে আমাকে লজ্জা দিবেন না।পিতা আমি একটু বিশ্রাম নিতে চাই।
পিতাঃ নিশ্চই তুমি শুয়ে পড়ো মা।
মেহেরঃ এখানে নয় পিতা।আমি আমার কক্ষে যেতে চাই।
মেহের বিছানা থেকে নেমে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেল অন্যকক্ষে ফালাকের সামনে দিয়ে।ফালাক ওর যাওয়ার দিকে শুধু চেয়ে রইল।
পিতাঃ সবসময় চোখের দেখা ঠিক হয়না তাজ। কিছু সময় চোখ যা দেখে আর মন যা বুঝে তা সবসময় ঠিক হয়না।
ফালাকঃ তাহলে পিতা মেহের কক্ষে প্রবেশ করার আগে কে এসেছিল আমার কক্ষে?
পিতাঃ নিজেকে বীরপুরুষ ভাবো তুমি।কক্ষের দ্বারে রক্ষী নিয়োগ না করলে এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।এই পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা শত্রু সৃষ্টি হয়েছে তোমার।এভাবে ওকে ভুল বুঝে আরো দূরে সরিয়ে দিলে।তোমার ক্রোধ তোমাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যার জন্য তুমি তোমার প্রেম-ভালোবাসা, আপনজন সবকিছুর স্থান ভুলে যাও।

কথাগুলো বলে পিতা নিজের কক্ষে চলে গেল।
ফালাক দাঁড়িয়ে চিন্তা করছিল।
ফালাকঃ এমন দুর্ব্যবহার আমি ওর সাথে কি করে করতে পারলাম?যেদিন আমার শরীরে ও আঘাত করেছিল সেদিন ও আমি আমার রাগ সংবরণ করেছি।কিন্তু আজ আমার কাছে এক মুহূর্তের জন্য হলেও মনে হয়েছিল মেহেরও আমাকে আর সকলের মত সুযোগে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে।আর এই ভাবনায় আমাকে এত রাগিয়ে তুলেছিল।নিজের ভালোবাসা,কাছের মানুষ সবকিছুকে ভুলে গিয়েছিলাম।এখন পর্যন্ত মেহের আমাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি।এই ঘটনার পর না জানি ও আমার থেকে আরো কতদূরে সরে যাবে।

আর এদিকে মেহের ভাবছে,
মেহেরঃ রেশমি ঠিক-ই বলেছে।ও কোনোদিনও কাউকে ভালোবাসতে পারেনা কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ও না। আগে পিছে কোনো কিছু না জেনে না দেখে ও ধরে নিল আমি ওকে হত্যা করতে চেয়েছি।আর তাই সেই মুহূর্তে-ই আমাকে মেড়ে ফেলতে চাইল।কি ভয়ংকর-ই না দেখাচ্ছিল ওকে। ও চাইলে যে কোনো সময়ে আমাকে হত্যা করতে পারে।আমার স্বাদ ও তো ওর গ্রহণ করা হয়ে গেছে। তাই এখন আর আমাকে হত্যা করতে ওর বাঁধবেনা।আর আমি অপেক্ষা করবোনা।আজকে যা না করে আমাকে শাস্তি পেতে হচ্ছিল কাল ঠিক তাই করেই দরকার হলে শাস্তি ভোগ করবো। ওকে যত দ্রুত সম্ভব আটক করতে হবে।আর তা যদি না পারি তবে হত্যা করাই হবে আমার চূড়ান্ত পরিকল্পনা।

ফালাকঃ কি করবো আমি এখন?ওর কাছে আমি ক্ষমা চাইব।হ্যা ক্ষমা চাইতে হবে আমাকে। কোনোদিন কারো কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইনি।কিন্তু মেহেরকে আমার কাছে রাখার জন্য আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইতেও প্রস্তুত।কাল সকালেই আমি ওর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবো।

মেহের ফালাককে বন্দী করার বিভিন্ন উপায় চিন্তা চিন্তা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।আর ফালাক সে তো তার অপরাধবোধে দু চোখ বন্ধও করতে পারছেনা।স্থির থাকতে পারছেনা ও। ওর ইচ্ছা করছে এখন-ই মেহেরের কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইতে।কোনোভাবে শান্তি না পেয়ে ফালাক বিছানা ছেড়ে উঠে মেহেরের কক্ষের সামনে গেল।দরজাতে ধাক্কা দিতেই বুঝতে পারল দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো।ও আবার নিজের কক্ষে চলে এল।পায়চারী করছে শুধু। তারপর আবার ভাবল পেছনের দরজা দিয়েই ঢুকবে ও মেহেরের কক্ষে।আর সেটাই করল।পেছনের দরজা দিয়ে মেহেরের কক্ষে ঢুকল ও।মেহেরের কাছে গিয়ে বসলো।

ফালাকঃ মেহের তো ঘুমিয়ে পড়েছে।আমি কি ডেকে তুলব?না থাক।অনেক ব্যাথা পেয়েছে তখন ও।রাগের বশে তখন একটুও মনে হয়নি ও কতোটা কষ্ট পাচ্ছে।গলাতেও আমার আঙুলের দাগ বসে গেছে।

ফালাক ঘুমন্ত মেহেরের গলার দাগ ছুঁয়ে দেখছে।
ফালাকঃ কিভাবে রক্ত জমে দাগ হয়ে গেছে ফর্সা গলাতে।আচ্ছা ও তখন আমার পায়ের তালুতে হাত দিয়ে কি দেখছিল?আমার পায়ের নিচের কালো দাগ গুলো?আর গতকাল রাতে আমার অসুস্থ অবস্থায় ও আমাকে সেবা করে সুস্থ করেছিল সেই আমি সাথে কি ব্যবহার করলাম আজ।

মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে ফালাক এইসকল কথাগুলো ভাবছে বসে।আবেগ আর ভালোবাসার সংমিশ্রণে ফালাক মেহেরের কষ্ট দেওয়া জায়গাটাতে চুমু দিয়ে কষ্টটা কমাতে চেষ্টা করতে চাইল।মেহেরের গলার কাছে ঝুঁকে পড়ে রক্ত জমে থাকা যতগুলো আঙুলের দাগ পড়েছে ঠিক ততগুলো দাগের উপর ততবারই চুমু খেল।ঘুমন্ত মেহের ফালাকের নরম ঠোঁটের চুমু পেয়ে আজও সেই আগের রূপে কেঁপে উঠল।আর ফালাক তা বুঝতে পেরেই ওর কাছ থেকে সরে এল।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here