হিংস্রপ্রেম পর্ব ১২ +১৩

0
355

Sroty: হিংস্রপ্রেম
পর্বঃ ১২
লেখাঃ Israt Jahan
.

মেহের ফালাককে খুব কাছে টেনে নিয়েছে।এ যেন আজ অন্য মেহের দেখছে ফালাক।মেহেরের দু চোখ আকুল আবেদন করছে ফালাককে কাছে টানার।কিন্তু ফালাক? সে কেন এভাবে থমকে আছে মেহেরের দিকে চেয়ে? ও এটাই ভাবছে এটা মেহেরের আসল রূপ নয়।এদিকে মেহের ফালাককে জড়িয়ে ধরে ওর কানের লতি ঠোঁটের মাঝে চেঁপে ধরেছে।কিন্তু ফালাকের সেদিকে একটুও খেয়াল নেই।আকাশ পাতাল চিন্তাভাবনা তার মনের মাঝে।ফালাক মেহেরের বাহুডোর থেকে ছুটে চলে এল হঠাৎ।মেহের ফালাকের এই ব্যবহার দেখে খুব অবাক হল।মেহেরের থেকে কিছুটা দূরে সরে শুয়ে আছে। মেহেরের দিকে একবারও তাকিয়ে দেখছেনা। মেহের উঠে বসল।

মেহেরঃ সম্রাট আমার কি কোনো অন্যায় হয়ে গেছে?
ফালাকঃ (…..)
মেহেরঃ আমি ওর বুকের ওপর কিছুটা ভর রেখে ওর চোখের উপরে রাখা হাতটা সরিয়ে দিলাম। তখন ও আমার দিকে তাকাল।আমি ওকে বললাম, “প্রতিটা নারীর মত আমিও চাই আমার স্বামীকে একান্ত-ই আমার মত করে পেতে।আপনি আমাকে কি সেই সুযোগখানা দেবেন?”
ফালাক শুধু মেহেরের চোখের ভাষা পড়ছে। শুধু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।কিন্তু কোনো কথার উত্তর দিচ্ছেনা।আর মেহের ফালাকের মুখ দেখেও বুঝতে পারছেনা যে ফালাক ভেতরে ভেতরে
প্রচন্ড রেগে আছে, কিন্তু কেন?
মেহেরঃ কথা বলছেন না কেন সম্রাট?
ফালাকঃ আমি এবার ও ওর কোনো কথার উত্তর না দিয়ে ওকে আমার শরীরের ওপর থেকে সরিয়ে ওর দু’বাহু ধরে ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দিলাম।অনেকটা চমকে গেছে ও। আমি ওর একদম কাছে আসতেই ও চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল।হাত দুটোর মুঠো বন্ধ করে আছে।
মেহেরঃ আমি ওর হিংস্রতার ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।কিন্তু ওর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে যখন চোখ দুটো খুললাম তখন দেখলাম ও সেই আগের মত হিংস্র চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি তাকাতেই ও আমার ঠোঁট দুটো ওর ঠোঁটের মাঝে চেঁপে ধরল।আমার চোখ বেয়ে অঝরে অশ্রু বেঁয়ে পরছে।ওর বুকে ঠ্যালা দিয়ে ওকে আমার কাছ থেকে সরানোর চেষ্টা করছি কিন্তু ও খুব শক্ত করে ধরে আছে আমাকে।
ফালাকঃ আমাকে ও দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে এখন।তাই ওর হাত দুটো চেঁপে ধরে ওর চোখের দিকে তাকালাম।ওকে বললাম, ” এখন কেন কাঁদছো তুমি? আমাকে যদি তুমি একান্তই তোমার করে পেতে চাও তাহলে তোমার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে কেন?তোমার তো উচিত আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখা।” আমি ওকে ছেড়ে দিলাম।তখনো ও কাঁদছে।আমি চুপচাপ বসে আছি।বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত করে ওর হাত ধরে ওকে টেনে ওঠালাম। ” আমি আজ কেন তোমার সম্মতি পেয়েও তোমাকে এড়িয়ে গেলাম জানো?”
আমি চিৎকার করে বললাম, ” আমার কথার উত্তর দাও”।
মেহের মাথা নিচু করে মাথা নাড়িয়ে শুধু না বোধক উত্তর দিল।
ফালাকঃ এক যুগ কাল ধরে আমি জোরপূর্বক প্রতিটা নারীকে গ্রহণ করেছি।তোমাকে বিবাহের পর আমার ইচ্ছাটার পরিবর্তন হয়েছিল।
ভেবেছিলাম যেদিন মন থেকে আমার প্রতি টান অনুভব করবে সেদিনই আমি তোমার কাছে যাব। কিন্তু তুমি যে নাট্যকার্য চালাবে আমার সাথে তা আমার ভাবনা চিন্তার বাহিরে ছিল।তোমাকে আমি একদম অন্যরকম ভেবেছিলাম।তুমিও যে আমার সাথে ছলনা করতে চাইলে।
মেহেরঃ আমি আপনার সাথে ছলনা করছি এটা আপনার কেন মনে হল?আমার ব্যবহার কি ছলনারূপ ছিল?
ফালাকঃ তাই নয় কি? তোমার চোখে কেন পানি? আমি তোমার কাছে আসলে তোমার চোখ থেকে কেন পানি গড়িয়ে পড়ে?ঘৃণা, ঘৃণাবোধ থেকে তুমি তোমার চোখে অশ্রুর ঝরনাধারা সৃষ্টি হয়। আমি চাইলে প্রতিটা মুহূর্তে তোমাকে নিজের করে পেতে পারি।তা কি তুমি অস্বীকার করতে পারো? তোমার নাট্যকার্য আজ আমার ক্রোধের সীমা অতিক্রম করেছে মেহের।তাই আজ থেকে তোমার সাথে যা ঘটবে তা তোমার মনের বিরুদ্ধেই ঘটবে।আর তা প্রতিটা মুহূর্তে মুহূর্তে।
মেহেরঃ না….। আপনি এমন কিছু করবেন না।

ফালাক আর সেই রাতে মেহেরের আর একটা কথাও শোনেনি।মেহেরের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই মেহেরের কাছে গিয়েছে ফালাক।আর সেই রাত থেকেই মেহেরের সাথে ফালাক এমন ব্যবহার-ই করে।মেহেরের কাছে আসার জন্য কখনো মেহেরের মনের সম্মতির প্রয়োজনবোধ করেনা। আজকাল মেহেরকে নিয়েই রাজসভাতে বসে ফালাক।ফালাকের চোখে যারা অপরাধী তাদেরকে নির্মম ভাবে শাস্তি দিকে থাকে মেহেরের সামনে। আর তা দেখে মেহেরের কষ্টে শেষ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়।
প্রতিদিন রক্ত দেখতে দেখতে মেহের অতিষ্ট হয়ে পড়েছে।কিন্তু কোনো প্রতিবাদ জানায় না।কারণ তারা ওর চোখে অপরাধী।কোনোভাবে তারা ফালাকের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে।তাই সে ব্যাপারে মেহের কিছু বলতে পারেনা।কিন্তু এত রক্ত, কারো এত কষ্ট ও সহ্য করতে পারেনা।একদিন রাজসভাতে কোনো এক নর্তকী কে রক্ষীরা বন্দী করে ধরে আনে।সেদিন ও মেহের রাজসভাতে। তার বিরুদ্ধে ফালাকের কাছে একজন পুরুষ বিচার দিচ্ছে।”মহারাজ ও আমার স্ত্রী। কিন্তু আমার কোনো কথা ও গ্রাহ্য করেনা।আমার নিষেধাজ্ঞার বাহিরে গিয়ে ও অন্য সকলের সামনে নৃত্য করে আর তা প্রতিনিয়ত।প্রতি রাত্রি-ই ওকে জোর করে ওকে ধরে আনতে হয় বাড়িতে।”

ফালাকঃ তুমি কি ওকে ত্যাগ করেছো এর জন্য?
প্রজাঃ না মহারাজ।আপনি ওকে এমন শাস্তি দিন যার পরে ও আর কোনোদিন অন্য পুরুষের সামনে নৃত্য করতে না পারে।তাদের সাথে রাত্রিযাপন না করতে পারে।
ফালাকঃ তোমার কোনো উপার্জন নেই?
প্রজাঃ আছে মজারাজ। আমি একজন কর্তনকারী। গ্রামে বহু মানুষ আমার থেকে জামা তৈরি করে। তাতে আমার অনেক উপার্জন হয়।
ফালাকঃ হুম।রক্ষী! দাসীদের বলো ওর শরীরে ফুটন্ত গরম পানি ছুড়তে।
রক্ষীঃ জ্বী মহারাজ।
মেহেরঃ দাঁড়ান মহারাজ। আমার কিছু কথা আছে।
মেহেরের চড়া কন্ঠস্বর শুনে ফালাক ওর দিকে তাকাল চোখে প্রশ্ন নিয়ে।
মেহেরঃ আপনি একতরফা শুনে বিচার করছেন কি করে? ওই নারীর মুখের কথাও আপনার শোনা উচিত।
ফালাকঃ যে স্ত্রী স্বামীর বারণ কে উপেক্ষা করে অন্য পুরুষের নিকট নিজেকে উপস্থাপন করে তার মুখের কি কথা শুনতে হবে?
মেহেরঃ হুহ।কিছুদিন আগেও যে কোনো নারীকে নারী মনে করতোনা সে আজ স্বামী-স্ত্রীর অধিকার নিয়ে কথা বলে কি করে?
ফালাকঃ তুমি কি আমার সাথে সবার বাকবিতন্ডায় মশগুল হতে চাইছ?
কথাগুলো ফালাক রাগে দাঁতে দাঁত চেঁপে কথাগুলো বলছিল।তবে এই কথাগুলো ওদের দুজনের মাঝেই চলছে শুধু।অন্য কেউ কথাগুলো শুনছেনা।
মেহেরঃ দোষ কখনো এক দিক থেকে হয়না মহারাজ।আমি এটাই বলতে চাইছি।
মেহের নর্তকীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমি কিছু বলতে চাও”? নর্তকী কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল, “জ্বী মহারানী”।
মেহেরঃ বলো তাহলে।
নর্তকীঃ আমাকে যখন উনি বিবাহ করে তার কিছুদিন পর থেকেই উনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে থাকে।আমাকে উপার্জন করে আনতে বলে।ওনার নাকি কোনো কর্ম করার সংস্থান নেই আর এত কষ্ট করেও উনি কোনো উপার্জন করতে পারবেনা।প্রথমদিকে আমি বুঝতে পারতাম না উনি কেন এমন করতো। তারপর যেদিন ওনার এক মনিব আমাদের বাড়িতে এল সেদিন উনি আমাকে তার সেবা করার কথা বলল। আমি তাতে নারাজ হলে আমাকে ওনার সামনেই খুব মারধোর করলো।তাকে সেবা করতে আমাকে বাধ্য করল।সে আমার সেবা পেয়ে খুব খুশি হয়ে কিছু অর্থ ওনাকে দিয়ে যায়।আর তারপর উনি আমাকে সরাসরি বললেন প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে ওই মনিবের বাড়িতে গিয়ে তাকে সেবা করতে প্রয়োজন হলে তাকে গানবাজনা, নৃত্য সবকিছু দেখাতে। এভাবেই উনি আমাকে বাধ্য করে। আর আজ যখন ওই মনিবের এক বন্ধু আমাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছে ও তখন তাতে বাঁধা প্রয়োগ করছে। আমি ওকে ত্যাগ করতে চেয়েছি কিন্তু ও রাজি নয়। উল্টে মহারাজের কাছে বিচার নিয়ে এসেছে।

নর্তকীর মুখে সব কথা শুনে এমনকি ওই মনিবের বন্ধুকে উপস্থিত করে তার থেকে সকল কথা শুনে ফালাক ওর বিচার পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। ওই নর্তকীর স্বামীকে কঠোর শাস্তি প্রয়োগ করে ফালাক রাজসভা ছেড়ে কক্ষে চলে গেল।এই প্রথম কেউ ফালাকের বিচারে ত্রুটি দেখিয়েছে।আর সেটার কারণে ফালাক সকলের সামনে অপমানবোধ করেছে।মেহের যখন কক্ষে এল তখন মেহরকে দেখে ফালাক মেহেরকে টেনে এনে সোজা বিছানার ওপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।

চলবে…..

Story: হিংস্রপ্রেম
পর্বঃ ১৩
লেখাঃ Israt Jahan

মেহের এর উপর ঝাপিয়ে পড়ার মত ফালাক ওর কাছে গেল।ওর সাথে অনেক কর্কশ কন্ঠে কথা বলছে।

ফালাকঃ মেহের! তোমাকে কি আমি রাজসভাতে আমার পাশে বসিয়ে রাখি আমার বিচারকার্যের ভুল ত্রুটি সংশোধন করার জন্য?
মেহেরঃ আপনি যে বিচারকার্যে ভুল বিচার করেন সেখানে নিরাপরাধ কিছু মানুষ অপরাধ না করেও শাস্তি পেতে থাকে আর সেটা আমার চোখের সামনে ঘটতে থাকে।তাহলে আমি তো চুপ থাকতে পারিনা।
ফালাকঃ আমি ভুল বিচার করি?এতগুলো বছর ধরে আমার বিচারকার্যে কেউ কখনো ভুল ত্রুটি ধরেনি আর তুমি কি আমার পূর্বে থেকেই রাজত্ব শাসন করছো?আমার থেকেও কি তোমার বেশি দক্ষতা?
মেহেরঃ আপনার থেকে বেশি দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি না হলেও আপনার থেকে সঠিক ও যুক্তিসম্মত বিচার করার ক্ষমতা আমি রাখি।আপনি চাইলে আপনাকে আমি বিচারকার্য শিখিয়ে দিতে পারি।

ফালাক চোখ মুখ কটকট করছিল।মেহেরের দু’হাত বিছানার সাথে চেঁপে ধরে রেখেছে।তারপর মেহেরের একদম কাছে এসে বলল, ” আসলে আমার ভুল তোমাকে আমার পাশে রাজসভাতে জায়গা দেওয়া।তোমার স্থানটা ঠিক এখানে কক্ষে এবং বিছানাতে, সিংহাসনে নয়।নিজেকে খুব তত্বজ্ঞ, অভিজ্ঞ মনে করো তাইনা?তোমার এসব শাস্ত্রজ্ঞ আজ থেকে কক্ষের মাঝেই আটকা থাকবে।”
কথাগুলো শেষ করে ফালাক মেহেরকে পুরষত্বের জোর দেখাতে গেল।তখন মেহের বলল, “আপনার ক্ষমতা শুধু শয্যার মাঝেই।দয়া করে কক্ষের দরজা বন্ধ করে আসুন।” মেহেরের এই কথা শুনে ফালাক ওর থেকে দূরে সরে আসল।কিছুসময় শুধু ওর দিকে চেয়ে থেকে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।দুপুরের পর ফালাক কক্ষে আসল।তখন মেহের কক্ষে নেই। দাসীদের ডেকে খবর নিল মেহের পাকঘরে।আজ ও নিজে খাওয়ার পাক করছে।রাজপ্রাসাদের সকলকে ও আজ একসাথে বসিয়ে খাওয়াবে।সেখানে ফালাককেও থাকতে বলেছে।আজকাল মেহেরের কোনোকিছুই ফালাক বুঝতে পারেনা।মেহের ওকে আগের মত সবসময় তিক্ত কথা শোনায়না, ফালাকের সেবাযত্ন করে, ওর গোসলের সময় ও মেহের নিজে গিয়ে ওকে গোসল করিয়ে দেয়, ফালাক কাছে আসতে চাইলেও মেহের বাঁধা দেয়না বরং নিজে যেচে আসার চেষ্টা করে ফালাকের কাছে।যা ফালাক মেহেরের কাছ থেকে স্বপ্নেও আশা করেনি।জোর করে কাছে আসার চেষ্টা করলেও মেহের কোনো বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখায়না।অনায়াসে মুখ বুজে সহ্য করে।মেহেরের এমন পরিবর্তন ফালাককে খুব ভাবায়।আজকে আবার দুপুরের খাওয়ার নিজে হাতে পাক করে খাওয়াতে চাইছে।একসাথে সবাইকে প্রাণে মেরে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে নাকি? এমন কিছু চিন্তাভাবনা ফালাকের মাথাতে ঘুরছে এখন। মেহের দুপুরে সবাইকে খাওয়ার জন্য নিচে এক আসরে বসতে আসন পেতে দিল।সেখানে সবাই এসে বসেছে শুধু ফালাক এখন পর্যন্ত আসেনি। আর পিতা অতি বৃদ্ধ তাই তার খাওয়ার মেহের কক্ষে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এসেছে।পিতার খাওয়া সবার পূর্বে হয়ে গেছে আর ফালাক জানার পূর্বে।পিতা এখনো সুস্থ আছে জেনে কিছুটা নিশ্চিত আছে ফালাক।কিন্তু এখন প্রাসাদের বাকিসবার আর নিজের কথা চিন্তা করছে।মেহের ফালাককে ডাকতে পাঠিয়েছে এক দাসীকে দিয়ে।তখন ফালাক বিছানাতে বসে অনেক কিছু চিন্তাভাবনা করছে।

দাসীঃ সম্রাট! মহারানী আপনাকে খাওয়ার খেতে ডাকছেন।
ফালাকঃ সবাই উপস্থিত?
দাসীঃ জ্বী।
ফালাকঃ ঠিক আছে যাও আমি আসছি। আমি গিয়ে সবার সাথে এক আসনে বসলাম।তখন মেহের এক এক করে চৌত্রিশ পদের খাওয়ার পাক করে তা এনে সামনে রাখল।তারপর সবার পাত্রে খাওয়ার তুলে দিচ্ছে।আজ সবাই অনেক খুশি যে মহারানী স্বয়ং নিজে তাদের পাক করে খাওয়াচ্ছে।
আমি এখনো খাওয়ার মুখে তুলিনি আর আমার জন্য বাকিরা কেও খাওয়ার খেতে পারছেনা।
মেহেরঃ সম্রাট আপনি কি খুশি হননি আমি আজ পাক করেছি বলে?
ফালাকঃ (……….)
সেনাপতিঃ কোনো অসুবিধা সম্রাট?
ফালাকঃ না।
সেনাপতিঃ তাহলে খাওয়ার মুখে দিচ্ছেননা যে?
মেহেরঃ বুঝতে পেরেছি।আপনারা কিছু মনে করবেন না।সবার পূর্বে আমি প্রতিটা খাওয়ার থেকে একটু একটু করে গ্রহণ করব।তারপর আপনারা গ্রহণ করবেন।মহারাজ আপনি আমার সাথে আসুন একটু।

মেহের খাওয়ারগুলো থেকে কিছু অংশ একটি পাত্রে নিয়ে অন্য একটি কক্ষে গিয়ে ফালাকের সামনে তা গ্রহণ করল।ফালাক কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলোনা।সবার সাথে বসে গিয়ে খেতে শুরু করেছে।সকলের খাওয়া শেষ হলে তবেই মেহের নিজে খেলো।

মেহেরঃ একি উনি কোথায় গেলেন? মধ্যাহ্নভোজন এর পর তো উনি বাহিরে কোথাও যান না।

মেহের পেছন থেকে তার কোমড়ে কারো হাতের স্পর্শ পেল।এ স্পর্শ কারো নয় ফালাকের।
একয়দিনে মেহের ফালাকের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, স্পর্শ সব চিনে নিয়েছে।অন্ধকারের মাঝেও ফালাককে সে খুঁজে নিতে পারে।দূর থেকে দাঁড়িয়েও সে ফালাকের নিঃশ্বাসের গতি টের পায়।এতটা অনুভব শুধু তাকেই করা যায় যাকে অন্তরের আপনের থেকেও আপন কাউকে ভাবা যায়।কিন্তু মেহের নিজেও জানেনা সে এভাবে ফালাককে চিনে নিতে পারে।হয়তো এখনো বুঝে উঠতে পারেনি ও এই হিংস্রমানবকে -ই ভালোবেসে ফেলেছে তাও হৃদয়ের গভীর থেকে।ফালাক পেছন থেকে মেহেরের কোমড় জড়িয়ে ধরে আছে।হাতদুটো মেহেরের পেটের ওপর এসে পড়েছে।মেহের একদম চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ফালাক মেহেরের কানে ফিসফিস করে বলছে, “খাওয়ারগুলো খুব সুস্বাদু ছিল।”

মেহেরঃ আচ্ছা?আপনার ভালো লেগেছে শুনে খুব আনন্দিত হলাম।
ফালাকঃ কিন্তু……
মেহেরঃ কিন্তু?
ফালাকঃ আমি ওকে আমার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ওর গোলাপ বর্ণের অধরদ্বয়ের স্বাদ কিছুক্ষণ গ্রহণ করে বললাম, এই স্বাদের থেকে বেশি সুস্বাদু নয়।

মেহের মাথা নিচু করে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের সাথে গালের মধ্যভাগ কেমন লাল হয়ে গেছে।ফালাক বুঝতে পেরেছে যে মেহের লজ্জা পেয়েছে।আসলে ফালাক যেমনভাবেই মেহেরের সংস্পর্শে আসে মেহেরের লজ্জাটা ঠিক এমনরূপেই থাকে।কিন্তু তখন তার সাথে অনেকটা ঘৃণার অংশ ও সংযুক্ত থাকত।আজকে হঠাৎ ফালাকের থেকে এমনভাবে সোহাগ আর প্রশংসা পেয়ে কিছুটা লজ্জা ও পেয়েছে।এখনের লজ্জা আর পূর্বের লজ্জার মধ্যে ফালাক অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে।পরপুরুষ এর সামনে থাকলে যেমন লজ্জাবোধ হয় ঠিক তেমন লজ্জাবোধ হতো পূর্বে।আর আজ ফালাক যে লজ্জা দেখেছে মেহেরের মাঝে তা ছিল স্বামীর আহ্লাদভরা সোহাগ পাওয়ার লজ্জা।এমন লজ্জারাঙা মুখটা দেখে ফালাকের হৃদয়ের মাঝে কেমন খুশির জোয়ার বইছে।এটুকু বোঝার ক্ষমতা ফালাকের আছে যে একজন নারী কখন আর কেমন অনুভূতি হলে সে এমনভাবে লজ্জা পেতে পারে।ফালাক শুধু চেয়ে রইল মেহেরের মুখের দিকে।

ফালাকঃ আজ প্রথম আমি অনুভব করছি তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার খুব কাছের একজন মানুষ।
মেহেরঃ কেন?
ফালাকঃ উত্তরটা আজ রাত্রে দেব।সেদিন যেমন করে সেজেছিলে আজ রাত্রেও ঠিক তেমন করেই সাজবে।আর কক্ষটাও আঁধার করে রাখবে।
মেহেরঃ কেন?
ফালাকঃ উহহু……।তোমার প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই জানো।আসছি।
মেহেরঃ কোথায়?

ফালাক যেতে গিয়ে মেহেরের উদ্বেগজনক কন্ঠ শুনে ওর চোখের দিকে তাকাল।সে চোখে ফালাক সত্যিই দুশ্চিন্তা দেখতে পাচ্ছে।ফালাকের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠল।মেহেরের প্রশ্নের উত্তরটা শুধু ওই হাসিই ছিল।কিছু না বলে বেরিয়ে গেল ফালাক।যেতে যেতে ফালাক কত শত চিন্তা করছে।

ফালাকঃ আমি আমার কথা রাখব মেহের।আমি যা চেয়েছিলাম তা আমি পেয়েছি।
মেহেরঃ আজ কাল ওনার জন্য ও আমার মনের মাঝে আলাদাভাবে একটা দুশ্চিন্তার জায়গা তৈরি হয়েছে।বিধাতা মানুষের মন কত বিচিত্ররূপে তৈরি করেছে।একজন ঘৃণিত মানুষের সাথে থাকতে থাকতে তার প্রতিও একটা মায়ার সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে।সে একবেলা না খেয়ে থাকলে আমার মুখে অন্ন তুলতে বিবেকে বাঁধে।এভাবেই বুঝি দুটো মানুষের মাঝে একটা মায়ার বাঁধন সৃষ্টি হয়। আজ কাল সে ও আমার প্রতি জোর জুলুম কম করে। আমার মনের ভাষা আমার কথাগুলো সে বোঝার চেষ্টা করে।শুধু রেগে গেলেই তার রাগটা চরমে পৌঁছে যায়।তখনই তার ভয়ংকর রূপটা আবার দেখতে পাই।নিজের অপরাধ, ভুল, অন্যায় কখনো স্বীকার করতে চাইনা।এটাই সব থেকে বড় সমস্যা ওর।তাছাড়া আমি ওর মাঝে অনেক পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি।

রাতে ফালাক কক্ষে ফিরে মেহেরকে যেমনভাবে দেখতে চেয়েছিল তার থেকে আরো সুন্দরভাবে মেহের ওর সামনে উপস্থিত হয়েছে।আজ চুলগুলো মেহের ভিজিয়ে রেখেছে।আজ স্বামীর সামনে নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করেনি। স্বাভাবিক ভাবে যতটুকু খোলামেলা থাকা যায় ঠিক ততটুকু খোলামেলাভাবেই নিজেকে দাঁড় করিয়েছে ফালাকের সামনে।আজ পূর্ণিমার চাঁদটা আকাশে না থাকলেও অজস্র তারার মেলা বসেছে আকাশে।
ফালাক মেহেরের কাছে গিয়ে মেহরের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে দূর থেকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখছে ওকে।আঁধার ভরা কক্ষতেও সে মেহেরের মুখটা স্পষ্ট দেখছে তার মনের চোখ দিয়ে।

ফালাকঃ সরোবরের পাশে যাবে?
মেহেরঃ আপনার ইচ্ছা।
ফালাকঃ আমি ওর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। ও আমার হাতের উপর ওর হাত রাখতেই হাতটা আমার হাতের মুঠোর মাঝে আটকে নিলাম।
মেহেরঃ সম্রাট?
ফালাকঃ বলো।
মেহেরঃ আমি সকলের সামনে নিজেকে এভাবে প্রদর্শন করে সরোবরে যেতে পারবনা।

ফালাক মুখে কিছুটা হাসি রেখে মেহেরের কথার উত্তর না দিয়ে ওর সুবিধার ব্যবস্থা করল।প্রহরী আর রক্ষী যত ছিল রাজপ্রাসাদে সকলকে বলল, ” কিছুসময়ের জন্য প্রাসাদের বাতি নিভিয়ে দাও। আর সরোবরের আশেপাশে কাউকে থাকতে হবেনা।শুধু বাগানের বিশেষ কিছু জায়গায় বাতি জ্বালিয়ে রাখবে।যার আবছা আলো সরোবরে এসে পড়ে।”

মেহেরঃ বাতি নিভিয়ে রাখলে সবাই চলাচল করবে কি করে?
ফালাকঃ সরোবরের পাশে পৌঁছানোর পর বাতি জ্বালিয়ে নেবে।আমিও চাইনা আমার প্রিয়তমার সৌন্দর্য অন্য কেউ দেখে তার চোক্ষুদ্বয় ধন্য হোক।

সারা প্রাসাদ অন্ধকার।প্রাসাদের জানালাগুলো খোলা।বাগানে থাকা আলোর আবছা আলো জানালা দিয়ে প্রবেশ করেছে।সেই আলোতেই ফালাক চোখে দেখছে।তার প্রিয়তমা তার পাশে নয় তার কোলে এখন।ফালাক মেহরকে কোলে তুলে সরোবরের পারে নিয়ে এল।দুজনে সবুজ ঘাসের উপর বসে আছে।মেহের একদম ফালাকের কাছে।মেহেরের পিঠ ফালাকের বুকের সাথে মেশানো।মেহেরের কোমড় আর পেট জাপটে ধরে আছে ফালাক।ভেজা চুল গুলো কাঁধের এক পাশে সরিয়ে রাখা।পিঠের অর্ধেক অংশ উন্মুক্ত হয়ে আছে মেহেরের।নিরাবতার পালা চলছে দুজনের মাঝে।
মেহের আজ নিশ্চুপ এ কারণে সে আজ অন্য এক ফালাককে দেখছে।দিন দিন ফালাকের মায়ার জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে ও।মুখে কিছু না বলতে পারলেও মন থেকে সাঁয় দিচ্ছে ফালাকের হৃদমাঝারে আটকে পড়তে।নিরাবতার পালা ফালাক-ই আগে ভাঙ্গল।

ফালাকঃ সরোবরের পানি কত স্বচ্ছ দেখাচ্ছে।
মেহেরঃ হুম।
ফালাকঃ পূর্ণিমার চাঁদটা আজ আকাশে নেই। এমন সময়ে চাঁদটার থাকা জরুরি ছিল।
মেহেরঃ কেন?
ফালাকঃ সেদিন যে বললাম পৃথিবীর প্রাকৃতিক আলোর সৌন্দর্য অন্য এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপরে শোভা পায়।
মেহেরঃ অন্ধকারে বুঝি শোভা পায়না?
ফালাকঃ আমার কথা শেষ হয়নি।
মেহেরঃ দুঃখিত।
ফালাকঃ আমি এই দুই সৌন্দর্যের মাঝে যাচাই করে দেখতে চায় যে আমার বাহুডোরে থাকা সৌন্দর্যের বাহারটুকু বেশি আকর্ষণীয় নাকি ওই চাঁদের?
মেহেরঃ নিছক-ই কল্পনা।বাস্তবে বিধাতার সৃষ্ট আকাশের ওই অপরূপ সৌন্দর্যের কাছে এই সামান্য মানবেরা যে তুচ্ছ।
ফালাকঃ কেন?আমার প্রিয়তমা কি তার সৃষ্টি নয়?
মেহেরঃ আমরা প্রত্যেকেই তার সৃষ্টি।তবুও……
ফালাকঃ তবুও আমার প্রিয়তমা-ই আমার দেখা পৃথিবীর সর্বাধিক সুন্দর।হোক না সেটা কল্পনাতেই।

হঠাৎ দুজনেই আবার চুপ হয়ে গেল।ফালাকের দৃষ্টি এবার না আকাশের তারা মেলার দিকে না সরোবরের স্বচ্ছ পানির দিকে।সে পলকহীন দৃষ্টিতে এক পাশ থেকে মেহেরের মুখটা দেখছে।কিন্তু মেহের তা বুঝতে পারছেনা।ওর দৃষ্টি যে আকাশের তারাগুলোর দিকে।আচমকা পিঠে ফালাকের নরম ঠোঁটের ছোঁয়া আর তার গরম নিঃশ্বাস মেহেরকে চমকে দিল।শিউরে উঠেছে ওর শরীর।ফালাকের হাতের উপর ওর হাত ছিল।শিহরিত হয়ে ফালাকের হাতদুটো চেঁপে ধরল মেহের।এমন কিছু ঘটবে এই মুহূর্তে সে তা বুঝতে পারেনি।আর ওদিকে ফালাক মেহেরের হাতটা তার হাতের ওপর থেকে সরিয়ে সে নিজে চেঁপে ধরল ওর হাতদুটো। তখন ওদের দুজনের হাত মেহেরের পেটের উপর।
মেহেরের ঘাড়ে অনেক গভীর ভাবে স্পর্শ করছে ফালাকের ঠোঁট।অজস্র পরিমাণ ছোঁয়া পড়ছে মেহেরের পিঠে আরে ঘাড়ে।হঠাৎ মেহের কম্পিত কন্ঠে ফালাককে ডাকল।

মেহেরঃ সম্রাট…….।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here