হলদে_প্রজাপতি পর্ব-১৮

0
237

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

আঠারো

( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

আজকে প্রায় চার মাস হতে চলল আমি এই টী এস্টেটের ম্যানেজার হিসেবে জয়েন করেছি । এখন ভরা শ্রাবণ । চতুর্দিকে চা বাগানগুলো শ্রাবণের ধারাপাতে যেন সবুজে সবুজ হয়ে উঠেছে । এমনিতেই সবুজ । সারাবছরই সবুজ । কিন্তু বৃষ্টিস্নাত শ্যামলিমা একটা অন্য ব্যাপার । যে কোন গাছের দিকে তাকালেই যেন মনে হয় , এই সবেমাত্র গাছটা স্নান করে উঠলো । জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন লতাপাতা । তাতে ছোট ছোট অজানা ফুল গজিয়েছে। আমার লনের বাগানে হারানদা প্রচুর গোলাপি রঙের রেন লিলি লাগিয়েছে । কিছুটা দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন গোলাপি চাদরে কিছুটা জায়গা মোড়া। মাঝের এই তিনটে মাসে আমার জীবনধারাটা মোটামুটি একই রকম থাকলেও , কিছু কিছু জায়গায় ছোট ছোট পরিবর্তন হয়েছে। যেমন , প্রথম মাসের প্রজেক্ট রিপোর্ট পাঠানোর পরে মালিকপক্ষ আমাকে যে ধরনের রিপ্লাই পাঠিয়েছিল ইমেইলে , তাতে করে আমি যথেষ্ট হতাশ হয়েছিলাম এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে আমাকে কিছু স্টেপ নিতে হয়েছে । যেমন চা বাগানের শ্রমিকদের সঙ্গে অনেক স্ট্রিক্ট বিহেভ করতে হয় আমায় আজকাল বাধ্য হয়েই । ওরা আমার সাথে সবে একটু সহজ হতে আরম্ভ করেছিল আর তখনই এটা আমাকে করতে হচ্ছে। আমার নিজের ঘোরতর অপছন্দের কাজটা করতে হচ্ছে, ওরা যাতে ওদের সর্বোচ্চ এফিশিয়েন্সি কাজে লাগিয়ে প্রোডাকশন বাড়াতে সাহায্য করে । সেইজন্য ওদের কাজের সিডিউলটা অনেক বেশি টাইট আর কম্প্যাক্ট করতে হয়েছে । ওরা আজকাল আমাকে আর পছন্দ করে না । একেবারেই করে না। আমি জয়েন করার পরেও করত না । মাঝখানে ওদের মনোভাবের একটু পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়া মাত্রই আবার আমার ব্যবহারের জন্যই এখন আর পছন্দ করে না । ম্যানেজার-লেবার সম্পর্ক ছাড়া এখন আর আমি ওদের সাথে মেলামেশা করার কোন চেষ্টাই করি না ।

তাতে করে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট শিশির খুব খুশি হয়ে বলেছে, ম্যাডাম আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম এই সমস্ত ছোটলোক লেবারের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে আপনাকে চলতেই হবে । ক’ পয়সা মাইনে পায় ওরা ? ক’ টাকায় সংসার টানে বলুনতো? আপনি যত ওদের সঙ্গে মেলামেশা করবেন, ততই আপনাকে অভাব-অভিযোগের কথা শুনতে হবে । তাতে আপনার কোন লাভ নেই বরং ক্ষতি ।
আমার কথাগুলো শুনতে মোটেও ভাল না লাগলেও শ্রমিকদের সঙ্গে শুধুমাত্র একটা মেকানিক্যাল সম্পর্ক রাখা ছাড়া এই মুহূর্তে আমার আর কিছু করার ছিল না । চাকরির দায় বড় দায় । প্রোডাকশন আমায় বাড়াতেই হবে । আরো কতগুলো স্ট্রীক্ট নিয়মকানুন বহাল করতে হয়েছে আমায় । লেবাররা সঠিক সিডিউল মেনে কাজকর্ম করছে কিনা সেটা দেখার জন্য আমি নিজেও দিনের বেশ কিছুটা সময় ওদের সুপারভাইজ করি । শিশিরকেও অনেকটা সময় ধরে ওদের সুপারভাইজ করার কাজ দিয়েছি । তাছাড়া আমাদের চা পাতার প্রসেসিং যেখানে হয়, সেই টি ফার্মে সমস্ত সময় ধরে তদারকি করার জন্য হয় আমি থাকি, না হলে শিশিরকে পাঠাই ।
তাছাড়া বিভিন্ন ভ্যারাইটির চা গাছের ওপরে একটা ছোট নার্সারি মত করেছি। আমার বাংলোর পিছন দিকের কিছুটা জায়গা জুড়ে । সেটার দেখাশুনো অবশ্য হারানদা’ই করে । সেখানে বিভিন্ন ভ্যারাইটির ছোট চারাগাছ, তার সাথে চা গাছের বীজ সংরক্ষণের জন্য বড় বেশ কিছু চা’গাছ করব ঠিক করেছি । প্রজেক্টটা সবে শুরু করেছি । বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে আমার । এই প্রজেক্টর ব্যাপারে মালিকপক্ষ যথেষ্ট ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে ।
কর্মক্ষেত্রে এই সমস্ত কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা ছাড়া, আমার দৈনন্দিন জীবনেও ছোট একটা পরিবর্তন এসেছে। আজকাল মাঝেমাঝেই উপমা চলে আসে আমার বাংলোয়। কখনো কখনো জগন্নাথকে পাঠিয়ে দিই ওকে আনার জন্য । কখনো আবার আমি নিজেও যাই। সপ্তাহে দু-তিন দিন তো হবেই । দুপুরের দিকে চলে আসে ও আমার বাংলোয়। বিকেলবেলাটা থাকে। সন্ধ্যাবেলা আবার ওকে পৌঁছ দেওয়ার ব্যবস্থা করি । ও যে আমাকে পছন্দ করে, আমার কাছে থাকতে চায়, সেটা বুঝতে পারি । আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত টগর ওকে দেখে রাখে। টগর যথেষ্ট দায়িত্বশীল, চিন্তা করার কোনো কারণ নেই । তবে আমি ফিরে এলে উপমা একগাল হাসে। কখনো আমায় জড়িয়ে ধরে । আজকাল আবার দু-একটা বইপত্র নিয়ে আসে । ওর ঠাকুমা ব্যাগে ভরে পাঠিয়ে দেয় ।
ইন্দ্রাশিষ বাবুর সঙ্গে মাঝে বারকয়েক দেখা হয়েছে । উনি এসেছেন আমার বাংলোয় । আমিও বার দুয়েক ওনাদের বাড়িতে গেছি । ওনার বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে । বাতের ব্যথায় তিনি প্রায় পঙ্গু । হাঁটাচলা করতে ভীষণ অসুবিধা । উপমার আমার কাছে পড়াশুনা করার ব্যাপারে অবশ্য ইন্দ্রাশিষ বাবু সরাসরি আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, প্রপার একটা রেমুনেরেশন নিয়েই ওকে পড়াতে । বলাই বাহুল্য, এই ধরনের প্রস্তাবে রাজি হওয়া যায়না । উপমা আমাকে ভালোবাসে । ও আমার কাছে থাকতে চায়। ওর ঠাকুমা ওকে নতুন ক্লাসে ওঠার পর পড়াশোনার ব্যাপারে আর খুব একটা সাহায্য করতে পারেন না । আমি দেখিয়ে দিই। যতটুকু সময় আমার কাছে থাকে তার মধ্যে যতটা সম্ভব । এই সমস্ত ভালোবাসাবাসির সম্পর্কে টাকা পয়সা এনে ফেললে সম্পর্কটাই মাটি ।
ওকে অবশ্য আমি আজকাল ‘পাতা’ বলেই ডাকি । এই নামটা আমার ভারী পছন্দ হয়েছে । ও আমাকে মাসীমণি বলছিল । আমি ওকে বলে ওটা কেটেছেঁটে শুধু ‘মনি’ করে নিয়েছি । আমাকে ও ‘মনি’ বলেই ডাকে ।

এখন ভরা শ্রাবণ মাস । মাঝে মাঝে এক-আধটা দিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার থাকে । অঝোর ধারায় বর্ষণ হয় । সেই দিনগুলোতে কাজকর্ম মোটামুটি সব বন্ধ থাকে । বিশেষত ফিল্ড ওয়ার্ক । টি ফার্মে যাই । শিশিরকেও পাঠাই। সেখানে যেটুকু যা তদারকির কাজকর্ম থাকে । বাদবাকি অফিশিয়াল কাজকর্ম বাড়িতেই ল্যাপটপে করে নিই। ফাইলপত্রগুলো অফিস থেকে বেশিরভাগ নিয়ে এসে এখন বাড়িতেই রেখেছি ।

গতকাল থেকে নিম্নচাপ প্লাস মৌসুমী বায়ু দু’য়ের প্রভাবে অঝোর বর্ষণ আরম্ভ হয়েছে । চারিদিক ধোঁয়াটে, জলের ঝাপটায় । কিছু দেখা যায় না । দরজা-জানলা প্রায় সব বন্ধ করে রেখে দিতে হচ্ছে । বৃষ্টির ঝাপটা খুব । বারান্দা আর সামনের লন তো জলে থৈথৈ করছে ।
অফিসে যাইনি আজ। ঘরে বসে বসে কাগজে কলমে কাজগুলো সব সকাল-সকাল সেরে নিয়েছি আমি । তারপরে একবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পাতাকে নিয়ে এসেছি । পাতা দুদিন ধরে স্কুলে যাচ্ছে না । এই বৃষ্টির মধ্যে যাওয়া সম্ভব নয় । ও আমার বাড়িতে স্নান খাওয়া দাওয়া করেছে আজকে । এই বাদলা দিনে গরম গরম খিচুড়ি, আলু ভাজা, ডিম ভাজা, পোস্তর বড়া । আহা ! যেন অমৃত ।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সারা হতে আমি আর পাতা দুজনে গা ঘেঁষে বসে টগরের কাছে গল্প শুনছিলাম । ওর গ্রামের গল্প , বাড়ির গল্প, মানুষজন, পূজা-পার্বণের গল্প। নানা রকম গল্প। সময়-সুযোগ পেলেই ও গল্প শোনায় আমদের। টগরের গল্প বলার ভঙ্গীটি ভারী সুন্দর । একবার গল্প বলতে আরম্ভ করলে হাঁ করে শুনতে হয়। সুর চড়িয়ে নামিয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে এমন করে বলবে, মনে হয় যেন সত্যি করেই সে সমস্ত ঘটনা ঘটে চলেছে চোখের সামনে। নানারকম গল্প করতে করতে শেষমেষ এসে ঠেকেছে ভুতের গল্পে। ওর মত ভাষা প্রয়োগ, সুর ওঠানামা তো আমার পক্ষে সঠিক ব্যাখ্যা করা অসম্ভব । তবে ওর বাচনভঙ্গিমা , অঙ্গভঙ্গি, বাইরের অন্ধকার বাদল, সাথে মেঘ গুরুগুরু, সব মিলিয়ে পাতা দুচোখ বিস্ফারিত করে হাঁ করে ওর গল্প গিলছিল প্রায় । কিছুক্ষণ পরপর আমার কোলের কাছে ঘেঁষে আসতে আসতে এখন মোটামুটি আমার কোলের ওপর উঠে পড়েছে ।
টগর আমাদের যে গল্প শোনাচ্ছে তা মোটামুটি এইরকম –
ওদের গ্রামে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ভূত-প্রেত-পিশাচ বা অপদেবতাদের দর্শন মেলে । ওদের গ্রামে মাশান ঠাকুরের থান আছে । মাশান ঠাকুর নাকি বিভিন্ন রূপে বিরাজ করতে পারেন। তিনি শ্মশানে থাকেন বটে, তবে বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন জায়গায় বিরাজ করতে পারেন। বিভিন্ন রূপে স্বপ্নে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে নানা জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাদের উপর ভর করতে পারেন মাশান ঠাকুর । থানে নিয়ে গিয়ে পুজো দিলে অনেক সময় নাকি সুফল পাওয়া যায় । তাঁর মূর্তিটিও বড় বিকট। দশাসই পেশীবহুল চেহারা । অনেক সময় আবার মূর্তিতে কোন মাথা থাকে না । চোখ মুখ সমস্ত কিছু বুকের উপরে থাকে। গলার কাছে গিয়ে মূর্তির কাঠামো শেষ হয়ে যায়। পায়ের নিচে বাহন থাকে এই আ্যত্তো বড় একখানা শোলমাছ । এই রকমই এক মাশান ঠাকুরের থান রয়েছে টগরের গ্রামে । কোনো মানুষের মধ্যে বেচাল কিছু দেখলেই যখন বোঝা যায় তার শরীরে অপদেবতা ভর করেছেন, তখন তাকে মাশান ঠাকুরের থানে নিয়ে যাওয়া হয় । মাশান ঠাকুর ভর করলে বোঝা যায় দেখে। ঠিক করে পুজো দিতে পারলে নাকি সব ঠিক হয়ে যায়।

এই সময়টায়, এই আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে তাদের গ্রামের খাল-বিল সব জলে টইটুম্বুর থাকে। আশেপাশের পুকুর, নদী, জলে ভরে গিয়ে জল উপচে পড়ে। অনেক ধরনের মাছ তখন চাষের ক্ষেতে এসে পড়ে। ক্ষেতের অনেক ফসল নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকলেও মাছ ধরার হিড়িক পড়ে যায়। আকাশ কালো করে বৃষ্টি , তার মাঝে গ্রামবাসীরা বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার ফাঁদ তৈরি করে মাছ ধরতে নেমে পড়ে । আকাশে কালো মেঘ, ঝড়-বৃষ্টি , চারিদিক জলে থইথই । তার মধ্যে চাষের ক্ষেতে বা নিচু জায়গায় জমে থাকা জল থেকে মাছ ধরার আনন্দ নাকি আলাদা! ছেলে বুড়ো সবাই গামছা বেঁধে নেমে পড়ে ।

এ হল দু’ বছর আগের ঘটনা। সেবছর এরকম সময়ে ঠিক একইভাবে মাঠ-ঘাট জল থইথই হয়ে গেছিল । বিভিন্ন মাছ চলে এসেছিল আশেপাশের পুকুর উপচে। টগরদের বাড়ির ঠিক দুটো বাড়ি পর বিনোদ বাউরীর বাড়ি । বিনোদ বাউরী নামটা উচ্চারণ করার সময় টগর একবার কপালে হাত ঠেকাল। তারপর বলল, তার বয়স নাকি পঞ্চাশের কোঠায়। তিন ছেলেমেয়ে, বউ , মা-বাবা দুজনেই জীবিত , ভরা সংসার। শ্রাবণের একুশ তারিখ ছিল সেটা। ঠিক তার দুদিন আগে থেকে নিম্নচাপের বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে । চারিদিকে, যেদিকে চোখ যায় শুধুই জল থৈ থৈ ! সেকি কাণ্ড ! বৃষ্টি আর কিছুতেই থামতে চায় না । তিনদিন পরেও বৃষ্টির বেগ যেন বেড়েই চলেছে । কমার নাম নেই । বাড়ি থেকে বেরোতে গেলে রাস্তায় জল । একটু নিচু জমি হলে তো কথাই নেই । প্রায় কোমর পর্যন্ত জল। অনেকের বাড়িতে জল ঢুকে গেছে । ছেলেপুলেরা সব সারাদিনে যখন-তখন সেই জলের মধ্যে নাইতে ছোটে । সেদিন সারাদিন বৃষ্টি হওয়ার পরেও সন্ধ্যেবেলা থেকে বৃষ্টির বেগ বাড়লো বই কমলো না। ইলেকট্রিসিটি তাদের গ্রামে আছে বটে , তবে অবস্থা খুব বেহাল । একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই টানা একআধ দিন কারেন্ট থাকে না। সেদিনও সেই বিকেল থেকে কারেন্ট গেছে , আর আসার নাম নেই । হ্যারিকেনের আলোয় বাড়িগুলোর মধ্যে ওই একটা ঘরের কিছুটা অংশ আলোকিত হওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু আর হয় না। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার । তার সাথে জলে ভর্তি।

রাত্রিবেলা তখন কটা হবে ? রাত প্রায় দশটা । ওই অত বৃষ্টি, অন্ধকারের মধ্যে রাত দশটা মানে তখন নিশুতি রাত । গ্রামের সকলেই মোটামুটি ঘুমিয়ে পড়েছে । অনেকের কাঁচা বাড়িতে জল ঢুকেছে । যদিও ততখানি নয় যে , বাড়ি ধসে পড়বে । তক্তার উপরে তক্তা বসিয়ে কোনরকমে খাটিয়ার ব্যবস্থা করে সকলেই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। এমন সময় হঠাৎ করে বিনোদ বাউরী বিছানার উপর উঠে বসে বলে, সে মাছ ধরতে যাবে ! সে’ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘন্টাখানেক ঘুম দেওয়ার পর হঠাৎ করে ঘুম থেকে উঠে সে ঘরের কোণ থেকে মশারি বাঁধা ছোট জালটা তুলে নিয়ে কাঁধে ফেলে সটান বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়ল । তার কান্ড দেখে তার বউ আর তার জোয়ান দুই ছেলে আছাড়ি-পিছাড়ি করে তার পিছু পিছু ছুটল । তাকে ধরে ঘরে ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক সাধ্যসাধনা করল । কিন্তু তার শরীরে তখন দশজন মানুষের বল ! তিনজনে মিলে তার সঙ্গে পারবে কেন ? সে এক হুংকার দিয়ে তিনজনকে এক ঝটকায় ফেলে দিয়ে জমির ওপর দিয়ে এক হাঁটু জলে ছপাৎ ছপাৎ শব্দ তুলে এগিয়ে চলল । তার বউ ব্যাপার বুঝে মরা কান্না জুড়ে বসল । রাতবিরেতে তার স্বামীর ঘাড়ে অপদেবতা ভর করেছেন। তার চিৎকার , কান্নাকাটি শুনে আশেপাশের আরো পাঁচটা বাড়ির লোকজন দুয়ার খুলে বাইরে বেরিয়ে এল ; ছাতা, হ্যারিকেন, যার যা ছিল তাই নিয়ে । কয়েকজন সঙ্গে লাঠিসোঁটাও নিল । সবাই মিলে ধরেবেঁধে তাকে ঘরে ফেরানোর অনেক চেষ্টা করল । কিন্তু বিনোদ বাউরীর তখন শরীরে যত ক্ষমতা, গলার স্বর তত চড়েছে ! বুক কাঁপানো চিৎকার করছে সে । কেউ তার আশেপাশে যেতেই ভয় পাচ্ছে।

যাইহোক, কোনরকমে তাকে সেই অবস্থার মধ্যেই জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হল গ্রামের সীমানার বাইরে বটগাছের তলায়, যেখানে মাশান ঠাকুরের থান রয়েছে । অতখানি রাস্তা সেই অন্ধকারের মধ্যে জল ডিঙিয়ে যাওয়া নেহাত চাট্টিখানি কথা ছিল না । কিন্তু সেখানে নিয়ে যাওয়ার পরেও শেষ রক্ষা হল না । সেখানে ঢোকার মুখেই একটু আলগা পেল কি, সে একেবারে সমস্ত শক্তিতে ছুটে এক নিমেষে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল । শুধু মাঠের মধ্যে তার দ্রুতপায়ে জল ঠ্যাঙ্গানোর ঝপাৎ ঝপাৎ ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ ! যেদিকে সে ছুটে যাচ্ছে, সেই দিকে তাকে ধরতে যাওয়ার কথা কেউ ভাবতেও পারে না । গ্রামের লোকেরা তো কোন দূর , তার বউ, দুই ছেলেরও সেদিকে যাওয়ার সাধ্য ছিল না। কেউ আর এগোনোর বিশেষ ভরসা পেল না। যেদিকে বিনোদ বাউরী গেছে, সেদিকে যে কাটরা-পুকুর ! ওই ভয়ানক পুকুরের দিকে দিনে-দুপুরেই কেউ যাওয়ার ভরসা পায় না, তা এই নিশুতি রাতে, চারিদিক জল থৈ থৈ করছে, তার মাঝে ওইদিকে ওই কাটরা-পুকুরে কে যাবে ? সকলে শুধু ঢিপঢিপ বুকে সেই চাপ চাপ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল । বিনোদ বাউরীর পদশব্দ ক্রমশ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে – ছপ্ ছপ্ ছপ্ ছপ্ শব্দ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে বটে , তবে যেদিকে সে শব্দ যাচ্ছে , সেসম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে প্রত্যেকেরই বুক ভয়ে কেঁপে উঠলো । ওই পুকুর যে সর্বনাশা ! ও যে যকের পুকুর । কি ভয়ানক ! একখানা পাথরের মূর্তি পাওয়া গেছিল সেই পুকুরের ডানপাশের নরম মাটি থেকে । পাথরে খোদাই করা মূর্তি । এই ভাঁটার মতো দুটো চোখ, কষের কাছে লম্বা দাঁত । এই পুকুর একেবারে সাক্ষাৎ যকের পুকুর । সেই মূর্তি পাওয়ার আগে বা পরে সেই পুকুরে কত ছেলেপিলে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি । গ্রামের সকলেই জানে ওই পুকুরে ‘পানভূত’ থাকেন । অপদেবতা । ভয়ঙ্কর অপদেবতা । এই বৃষ্টি বাদলের মাঝে তার শক্তি হাজার গুণ বেড়ে যায় । তখন বিভিন্ন রূপে ভর করে মানুষকে ছলচাতুরি সেই পুকুরের দিকে টেনে নিয়ে যায় । সেই মানুষের আর কোন ক্ষমতাই থাকে না । বোধ বুদ্ধি সব হারিয়ে যায় । নিশি পাওয়ার মতো সে ছুটে চলে । ঠিক যেমনটা বিনোদ বাউরীর সঙ্গে হলো ।

সব আশা ছেড়ে দিয়ে, সকলে মিলে তাও প্রায় জনা বারো-পনেরো তো হবেই , রামনাম জপ করতে করতে লন্ঠন ধরে কোনরকমে জল ঠেলে যে যার বাড়িতে ফিরে এসে দরজায় আগল তুলে দিল । সেই রাতে আর কেউ ঘুমোতে পারল না । কখন কি হয়ে যায়, কার বাড়িতে কোন অপদেবতা ভর করে বলা যায় কি? ঘুমের ঘোরে তাদের আরও সুবিধা কিনা ! বলা যায়না । সকলে সারারাত জেগে থেকে রামনাম করেই কাটিয়ে দিল । পরের দিন সকালে বৃষ্টির তেজও অনেকটা কমলো । দিনের আলোয় গ্রামবাসীর বেশ বড়সড় একটা দল, বুকে কোনমতে সাহস জোগাড় করে সকলে গেল সেই কাটরা-পুকুরে । তবে বিশেষ কিছু খোঁজাখুঁজি করতে হলো না । পুকুরের জল বেড়ে চারিদিক জলে থৈথৈ হয়ে রয়েছে । সেখানে কোনখান থেকে যে পুকুরের খাদ নামছে ঠিকঠাক ঠাহর করা খুবই মুস্কিল । তবে একখানা পাকুড় গাছের পশ্চিম দিকে গুনে গুনে দশ’পা গেলে পুকুরের একখানা ঘাট পড়ে । আর সেই পাকুড় গাছের গোড়াতেই দেখা গেল বীভৎস দৃশ্য ! বিনোদ বাউরীর দেহটা পাওয়া গেল বটে, তবে সে একেবারে ভয়ানক অবস্থা । তার চোখ নেই, একটা কান নেই , জায়গায় জায়গায় মাংস খোবলানো। নেহাত সৎকার করতেই হবে, তাই সকলে মিলে কোনরকমে হরিনাম জপ করতে করতে বিনোদ বাউরী দেহটা নিয়ে এসে তার বাড়ির আঙিনায় ফেলল ।

এই গেল বিনোদ বাউরী আর পানভুতের গল্প । টগর তার গল্প শেষ করতে দেখলাম পাতা একেবারে আমার বুকের মধ্যে তার মুখখানাকে গুঁজে দিয়েছে প্রায় । শৈশবে এইসব ভূতের গল্পগাছা সবাই বিশ্বাস করে , ভয় পায় । সেটা তো স্বাভাবিক , যে পাতা ভয় পাবে । পাতার মণিই ভয় পাচ্ছে ! সত্যি কথা বলতে কি, কলকাতার লম্বা-চওড়া ফ্ল্যাটের মধ্যে আর ট্রাফিক জ্যামে, গাড়ির হর্ন, বিবিধ শব্দ, কোলাহলের মাঝে যে সমস্ত চিন্তা মনে দানা বাঁধতে পায় না, আজকে এই চারিদিক ধূধূ করা চা বাগানের মধ্যে যখন প্রবল বৃষ্টিতে কোথাও আর কিছু দেখা যাচ্ছে না, আশেপাশে কোন বসতবাটি নেই , ঘরের মধ্যে প্রাণী বলতে আমরা তিনজন , যদু এই বৃষ্টির মধ্যে খাটিয়া পেতে শিশিরের ঘরেই শোয়, তবে বৃষ্টির মধ্যে এখন আমরা চাইলেও শিশিরের ঘরে যে ছুটে যাব তাও বোধহয় ক্ষমতায় কুলোবে না, এইরকম গা ছমছমে নিঝুম পরিবেশে সত্যি যেন কোথাও আমিও বিশ্বাস করলাম- বিনোদ বাউরীকে অপদেবতা ভর করে তার অদৃষ্টের দিকে টেনে নিয়ে গেছিল । সে ওই নিশুতি রাতে নিশির ডাকের মতো ছুটে গেছিল সেই ভয়ানক কাটরা পুকুরে । তারপর, অদৃষ্টের টানে তার সেই ভয়ানক পরিসমাপ্তি ।

টগরের গ্রাম , গ্রামের মানুষজন , বর্ষাকালে জল থইথই করা চারিদিক , গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের সেই জলের মধ্যে খেলা করে বেড়ানো, সন্ধ্যে হতেই চারিদিক অন্ধকারে ডুবে যাওয়া, বাড়ির মধ্যে হ্যারিকেনের বা ল্যাম্পের মিটমিটে আলো- সবকিছুই যেন আমি আমার মানস চক্ষুতে দেখতে পেলাম । কলকাতায় বা ব্যস্ত শহরে বা শহরতলীতে যা অসম্ভব , তা যেন টগরদের সেই গ্রামে এই ভরা বাদলায় খুবই সম্ভব । কোন কিছুই অসম্ভব নয় । অপদেবতার ভর করা, যকের পুকুর , সেখানে আস্ত জ্যান্ত মানুষকে নিশির ডাকের মতো টেনে নিয়ে যাওয়া , পরদিন সকালে ওইভাবে সেখান থেকে তার মৃতদেহ আবিষ্কার- ঘটনা যে সম্পূর্ণ অন্যরকম কিছু, গ্রামের মানুষদের মুখে ঘুরে ঘুরে আসল ঘটনা এই হয়ে দাঁড়িয়েছে, সবই বুঝি। তবু সেই গা ছমছমে ভূতের গল্পটাই আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করলো । পাতার মতই । ঠিক করলাম মানস চোখে নয় , চর্মচক্ষুতে একবার তাদের গ্রামে গিয়ে দেখে আসতে হবে । টগর, তার বাড়ি, তার গ্রামের গল্প শোনায়, আর বলে তাদের গ্রামে যেতে । আজকে ঠিক করলাম, বৃষ্টি-বাদলা থামলে ছুটির একটা দিন দেখে আমরা সবাই তার গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসবো।

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/

পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/

ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/

সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/

আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/

নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/

দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/

এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/

বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/

তেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1000733104050087/

চোদ্দো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1002718000518264/

পনেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1004549847001746/

ষোল-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1009015169888547/

সতেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1009015169888547/

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here