হলদে_প্রজাপতি পর্ব-১৭

0
198

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

সতেরো

( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

অরুনিমার কৌতুহলী চোখে ভুরু নাচিয়ে করা প্রশ্নের আমতা-আমতা জবাব দিলাম, ইয়ে –
গলা ঝেড়ে বললাম , শৌণক দা! উনি রিসার্চ করছেন।
অরুনিমা ছোট্ট একটা ‘ও’ বলে মুখ নিচু করে হাসতে লাগলো ।
সোনু দা গলাটা একটু বাড়িয়ে আমার পিছন থেকে ওকে দেখে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল , বান্ধবী নাকি ? ইউর বেস্ট ফ্রেন্ড ?
— হ্যাঁ , ও অরুনিমা ।
ও বললো , ওকে অরুনিমা! আর একদিন না হয় তোমার সাথে ভালো করে পরিচয় করা যাবে । আজকে একটু তাড়া আছে । চললাম, বাই ।
বলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, উঠে এসো গাড়িতে ।
আমি ড্রাইভার কাকুর পাশের সিটে বসেই বাড়িতে ফিরতাম প্রতিদিন । বান্টি তো এখন আর আমার সাথে থাকে না । তাই পেছনের সিটে আমি বসি না । ড্রাইভার এর পাশের সিটে বসে অনেক ভাল দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু , সোনুদাকে ড্রাইভারের সিটে দেখার পর থেকেই আমার মাথা গুলিয়ে গেছিল । এমন অপ্রত্যাশিত কিছু আমি আমার কল্পনাতেও কোনোদিন ভাবি নি ।
সোনু দা আমার ড্রাইভার !
আমি ঘাড় হেঁট করে পিছনের দরজাটা খুলে বসতে যাচ্ছিলাম ।
সোনুদা ঘাড়টা বাঁ পাশে ঘুরিয়ে আমাকে একটা ছোট ধমক দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল , ওখানে কোথায় বসছ ? সামনে এসে বসো !
আমি বাধ্য মেয়ের মত ড্রাইভারের পাশের সিটে গিয়ে বসলাম , কোলের ওপর ব্যাগটা নিয়ে জড়োসড়ো ভঙ্গিতে । ও একবার আড়চোখে আমাকে জরিপ করে নিয়ে আমার কোলের উপর থেকে ব্যাগটা বাঁ হাতে তুলে নিয়ে সেটাকে পেছনের সিটে ছুঁড়ে দিল। মুখে কিছু বলল না । শুধু ঠোঁটটা বেঁকিয়ে একটা শব্দ করলো, হুঁহ্।
বলে, গাড়ি স্টার্ট দিল ও ।
আমি ঘাড়টাকে আরষ্ঠ করে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলেও, আড়চোখে মাঝে মাঝেই ওর গাড়ি চালানোর ভঙ্গিমাটি দেখে নিচ্ছিলাম। একজন মানুষকে ভালবাসলে, তাকে নতুন নতুন ভঙ্গিমায় এবং কাজের মধ্যে দেখতে যে কোনো মেয়ের খুব ভালোলাগে । আমারও একটা অদ্ভুত গা’ শিরশিরে অনুভূতিতে সমস্ত শরীরটা ভরে উঠছিল । তার সাথে মনে হচ্ছিল- ইস্! বড্ড সাদামাটাভাবে আজকে কলেজে চলে এসেছি । ও আসবে জানলে, হয়তো কলেজ থেকে বেরোনোর আগে মুখটা একবার ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতাম । ব্যাগের মধ্যে একটা চিরুনি থাকে, চুলটা একটু পরিপাটি করে আঁচড়ে নিতাম। একটা ছোট্ট টিপের পাতা নিয়ে আসতাম, একটা টিপ পরে নিতাম কপালে । একটা কাজল পেন্সিল নিয়ে আসতাম, একটু কাজলের ছোঁয়া লাগাতাম চোখে। কীভাবে না জানি চলে এসেছি ! সারাদিনের ক্লাস, ধকল , ভূতের মত লাগছে না তো আমায়?

শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা চলে আসার পর যখন দুদিকে শুধুই চা বাগানের স্নিগ্ধতা, তখন সেই সমস্ত দৃশ্যপট আমার মনের ভেতর অদ্ভুত মুগ্ধতা সৃষ্টি করলো। শুধুমাত্র প্রকৃতির সৌন্দর্য একভাবে মুগ্ধ করে, আর প্রকৃতির সঙ্গে প্রেম , দু’য়ে মিলে সম্মিলিত যে মুগ্ধতা সৃষ্টি করে, তা একেবারে অনবদ্য । প্রতিদিনের যাওয়া-আসার চেনা পথ আমার কাছে এক নতুন রূপে ধরা দিলো । বেশ কিছুটা চা বাগানের পথ চিরে গাড়ি চালানোর পর, ও মেইন রোড থেকে সাইডের একটা রাস্তা ধরল।
জিজ্ঞাসা করবো , কি করবো না , এরকম একটা দ্বন্দ্ব মনের মধ্যে রেখেই একসময় জিজ্ঞাসা করে ফেললাম,
— আমরা কোথায় যাচ্ছি?
উত্তরে ওর মুখে শুধুমাত্র একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল । সেই প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে ও আমায় বলল,
— তোমার বান্ধবী মনে হয় আমার তোমাকে কলেজ থেকে নিতে আসা দেখে বেশ মজা পেয়েছে ।
আমি মুখ নিচু করে নখ খুঁটতে খুঁটতে বললাম, না মানে .. প্রতিদিন ওই ড্রাইভার কাকুকে দেখে তো । তাই-
ও বলল, তুমি একবারও জানতে চাইলে না তো, আজকে আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি কেন।
আমি বললাম, ড্রাইভার কাকু কি কোন কারনে আসতে পারলেন না ?
ও এবারেও সেই অন্য প্রসঙ্গে কথা বললো, দেখো আবার ! আমি এসেছি, তোমাকে হয়তো এমন জায়গায় নিয়ে চলে গেলাম, তুমি হারিয়ে গেলে !
বলে ওর স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা হাসলো ।
আমি আর কিছু বললাম না । কিছুটা ভেতরে ঢোকার পর মেঠো রাস্তার ওপরে ও গাড়িটা ব্রেক কষে দাঁড় করিয়ে দিল। নিজে ড্রাইভারের সিট থেকে নেমে পড়ল ।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, নেমে এসো আমি গাড়ি থেকে-
নেমে পায়ে পায়ে এগিয়ে ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম । যদিও মনে তখন পুলকের জোয়ার লেগেছে , তবুও জিজ্ঞাসা করলাম , এখানে .. না.. মানে , এখানে কেন –
ও বলল, সব সময় কি বাড়ির চারপাশের চা বাগানগুলো দেখতেই ভালো লাগে ? এখানটা কি সুন্দর অন্যরকম । তাই না ?
আমি যেন ওর কথায় আবিষ্ট হয়ে চারিদিকে নতুন করে চোখ বুলোলাম। এই সমস্ত চাবাগান, আশেপাশের প্রকৃতি, সবকিছুর রূপ-রস-গন্ধ তখন পরিবর্তন হয়ে গেছে আমার কাছে । সমস্ত কিছুর নতুন অর্থ আমি দেখতে পেলাম । চা গাছের পাতার যে শ্যামলিমা , তা স্বর্গীয় । আমি দেখতে পেলাম , যে সমস্ত পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে আশেপাশে, তাদের গলার স্বর যেন স্বর্গের বীণা। আমি দেখতে পেলাম , চা বাগানের ফাঁকে ফাঁকে হলুদ রঙের ছোট ছোট যে প্রজাপতিগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে, সেগুলো যেনো হলুদের কোন অপার্থিব প্রকাশ। এত প্রজাপতি ওড়ে চা বাগানে, কই আগে তো চোখে পড়েনি ? সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে হলুদ প্রজাপতিগুলো যেনো কোন অদৃশ্য রংয়ের জাল বুনে চলেছে। অনন্ত তার বিস্তৃতি ।
ও বলল , হঠাৎই বলে উঠল , আবার যথারীতি এক বিটকেল প্রশ্ন,
— তুমি কি চা খাও ?
— কি চা ?
ওর করা প্রশ্নটাই আবার স্খলিত গলায় করে ফেললাম আমি ।
ও বললো , হ্যাঁ, কি চা খাও ?
— এমনি দুধ চা।
বেশ গলা ছেড়ে হেসে উঠল ও। হাসিতে উপহাসের সুস্পষ্ট ছাপ।
বলল , তুমি দুধ চা খাও ! ও মাই গড !
আমার অল্প রাগ হলো । এই এত সুন্দর পরিবেশের মধ্যে গাড়ি এনে থামিয়েছে , কোথায় ভেবেছিলাম , দু একটা ভাল ভাল কথা অন্তত বলবে। তা নয় , সেই আবার যদি ঠুকেই কথা বলতে হয় , তাহলে এখানে নিয়ে এসেছে কেন আমায় ?
বললাম, হ্যাঁ দুধ চা’ই খাই । তাতে হাসার কি হয়েছে ? সবাই তো তাই খায়।
— তুমি এই নর্থ বেঙ্গলের চা বাগানের মধ্যে বসে দুধ চা খাও? দুধ চা’য় তো চায়ের ফ্লেভারটাই পাওয়া যায় না ।
ব্যাজার মুখে বললাম, তাহলে কি চা খাব ?
— র’চা খাবে । ব্ল্যাক টি । আ্যটলিস্ট চা পাতার ফ্লেভারটা তো পাবে ।
— ছি ! আমার ওই তেঁতো মার্কা কষাটে র’চা একদম ভালো লাগে না খেতে ।
ও বলল , সেই জন্যই তুমি এরকম ।
নিজে থেকেই ভুরুটা অল্প কুঁচকে গেল আমার । ওর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললাম, এরকম বলতে ?
বলল , তোমার বডিতে ফ্যাট জমার টেন্ডেন্সি রয়েছে। তুমি বুঝতে পারো না ?
লজ্জায় বিরক্তিতে আমার কানের লতিগুলো লাল হয়ে উঠল । একদম ভালো লাগলো না কথাটা ।
আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম , তার সঙ্গে চা খাওয়ার সম্পর্ক কি ?
— অবশ্যই চা খাওয়ার সঙ্গে যোগাযোগ আছে । গ্রিন টি খাবে সকাল-বিকেল । অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট । যোগা করবে । দেখবে , শরীরে ফ্যাট জমতে পাবে না ।
আমি কিছু বললাম না । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম । ও-ও চুপ করে রইলো । ঠোঁটের ডগায় চলে এসেছিল একটা কথা – ‘আমি একদম ভালো নই, না ? দেখতে ?’ কিন্তু সেটা আর বলে উঠতে পারলাম না । কারণ সেটা বলে ফেললেই অভিমানের অবরুদ্ধ বাষ্পচাপ ঠেলে ভেতর থেকে কথাটা বেরিয়ে আসবে । যেটা বাঞ্ছিত নয় ।
ও আবার ঝট্ করে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ফেললো । বললো , নট অনলি গ্রিন টি । কত টাইপের চা-পাতার প্রসেসিং হয় জানো তুমি? ডু ইউ নো অ্যাবাউট হোয়াইট টি ?
কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।
তেঁতো মুখে জবাব দিলাম, না ।
— এগুলো জানতে হবে তো । তুমি চা বাগানের মধ্যে থাকো । বাট ইউ আর লিস্ট ইন্টারেস্টেড আ্যবাউট দা প্রসেসিং অফ টী লীভস্। র’চা বা দুধ’চা করার জন্য আমরা নরমালি যে ধরনের চাপাতা ইউজ করে থাকি, তার থেকে অনেক মিনিমাম প্রসেসিং করা হয় গ্রীণ টি’ বানানোর জন্য। আর হোয়াইট টি বানানোর জন্য, প্রায় কোন প্রসেসিং করাই হয় না । অনলি ড্রায়েড লীভস্।

আমি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললাম , আমার প্রয়োজন নেই ওসব জানার । আপনি নিজের নলেজ নিজের কাছে রাখুন।
ও হেসে বলল, ওকে লিভ দেন । আই থিঙ্ক ইউ আর গেটিং এম্বারাসড ।
আমি পায়ে পায়ে চা বাগানে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে ওর থেকে কিছুটা দূরে চলে এসেছিলাম । অভিমান জমা হয়েছিল প্রচুর । জমা হওয়াই স্বাভাবিক । আমি তখন অষ্টাদশী তরুণী । শরীর জুড়ে মেদের আধিক্য না থাকলেও , আমাকে কোন কালেই স্লিম বলা চলে না । বুকদুটো বয়ঃসন্ধির পর থেকেই একটু বেশি ভারী । তবে তখন ততটা ছিল না । কোমরের খাঁজে কোন চর্বি ছিল না তখন। হাত-পা সুডোল, নিটোল । কন্ঠার হাড় বেরোনো না হলেও , ঘাড়ে-গর্দানে মোটেই ছিল না। বা ভবিষ্যতে এমনটা হতে পারে , সেরকম কোন ইন্ডিকেশন-ও ছিল না । কাজেই ওর চেহারা নিয়ে বলা কথাগুলো বড় কষ্ট দিয়েছিল আমায় । ও কি তবে আমার চেহারাটা পছন্দ করে না ? কোন কিছু অপছন্দ হলেও কি ভালোবাসা যায় ? পছন্দ, ভাললাগা , এগুলো কি ? আর ভালোবাসা কি ? ভালোলাগা থেকেই কি ভালোবাসা জন্ম নেয়? এই রকম নানাবিধ প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগলো । আমি আনমনে কিছুটা এগিয়ে গেলাম ওর থেকে। ইচ্ছে করেই ওর থেকে একটু দূরে সরে যেতে চাইলাম । ও সেদিন নিজে ড্রাইভ করে আমায় কলেজ থেকে আনতে গিয়েছিল । কারণ আমার জানা নেই , তবে মনের মধ্যে পুলকের কোন অন্ত ছিল না । ও আমাকে ড্রাইভ করে কিছুটা অন্য রাস্তায় নিয়ে এসে একটা চা বাগানের মধ্যে ফেলেছে। হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম আমি ওর সঙ্গে । দুচোখ বাষ্পাকুল হয়ে উঠল । জল জমা হলো না ঠিকই , তবে সংশয়ের বাষ্প জমা হলো । মিনিট দশ-পনেরো হবে , আমি চুপচাপ কোন কথা না বলে নিজের মনের জগতে ডুব দিয়ে ওর থেকে কিছুটা দূরে চলে এসেছি ।
হঠাৎ করে পেছন থেকে ওর গলা পেলাম, কি সত্যি করেই হারিয়ে যাবে নাকি ? এরপর তো আমি আর তোমায় খুঁজে পাবো না ।
আমি ওর প্রশ্নের কোন উত্তর দিলাম না বটে , তবে দাঁড়িয়ে পড়লাম । ও কিছু একটা বললে, সরাসরি সেটা অমান্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। পাশেই একটা শেড ট্রি ছিল । সেটার গায়ে হেলান দিয়ে ওড়নার খুঁটটা টেনে নিয়ে ডান হাতে করে বাঁ হাতের তর্জনীতে পেঁচাচ্ছিলাম মুখ নিচু করে । ও এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো ।
আমার নত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ওহো, ম্যাডাম মনে হচ্ছে এম্বারাসড্ নয় , রাগ করেছে ।
আমি চকিতে একবার চোখ তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নিলাম । ওর মুখে লেগে রয়েছে সেই রহস্যময় হাসিটা ।
আমি চোখ নামিয়ে নেওয়ার পরক্ষণেই ও বললো , কই দেখি তাকাও আমার দিকে । কতটা রাগ হয়েছে তাহলে বুঝতে পারবো।
কিন্তু আমি ওর দিকে তাকাবো না এখন ।
কিছুতেই তাকাবো না ।
তাকাবো না, তাকাবো না !
ও বলল , বাব্বাহ্, অনেকটাই রাগ হয়েছে মনে হচ্ছে । তা , রাগের কারণটা শুনি।
আমি এবার কথা বললাম । মুখ নিচু করেই বললাম , যদিও আসল কারণটা বললাম না ।
বললাম , আচ্ছা আপনি কি ভাবেন বলুন তো ? আপনার রিসার্চ এরিয়াটাই কি সব ? তার বাইরে আর পড়াশোনা করেন না আপনি ? লিটারেচার পড়েন না ?
ও ঠোঁট টিপে হাসলো । বলল , বা রে ! পড়বো না কেন? শুনবে তুমি ?
আমি জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিকে তাকালাম । ও যে ঠিক কি শোনাতে চাইছে বুঝতে পারলাম না ।
ও আমার চোখের দিকে চোখ রেখে কেটে কেটে আবৃত্তি করার ভঙ্গিতে বলল , পাবলো নেরুদা কি বলেছেন জানো? –
‘ You start dying slowly
If you avoid to feel passion
And their turbulent emotions;
Those which make your eyes glisten
And your heart beat fast.’
তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করল , ক্যান ইউ ফিল ?
আমার অসহায় লাগছে । ভীষণ অসহায় লাগছে । ওকে লিটারেচারের কথা বলতে হঠাৎ করে যে ইংরেজি কবিতা আওড়াতে আরম্ভ করে দেবে ভাবতে পারিনি ।
আমি ঢোঁক গিলে বললাম, কি ?
ও বলল, ইমোশন অফ দোজ লাইনস্?
আমি কোন উত্তর দিলাম না । বুঝতে পারলাম আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে । কবিতার লাইনগুলো আমার খুবই ভালো লেগেছে। তবে ও যে ঠিক কোন অ্যাঙ্গেল থেকে কি কি প্রশ্ন করতে আরম্ভ করবে সেটাই ভাবার চেষ্টা করছিলাম ।
ও বলল , কি , পড়ি তো নাকি লিটারেচার ?
কি যে মনের মধ্যে হচ্ছে ঠিক বোঝাতে পারবো না। কিরকম যেন একটা তীক্ষ্ণ রোমান্টিসিজম্ মিশে রয়েছে ওর গলায় । তা যেন আমার রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে রোমান্টিসিজম্ ছড়িয়ে দিতে লাগল।
অস্ফুট গলায় বললাম, হ্যাঁ ।
ও বলল , কি বুঝলে বলো ?
ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। এবারে এই লাইন কটাকে নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন আরম্ভ করে দেবে । যদিও লাইনগুলোর অর্থ বুঝতে পেরেছিলাম এবং তার বাংলা একটা তর্জমা করতেও পারতাম । তবুও , ওই যে ! ও জিজ্ঞাসা করেছে । হয়ে গেছে আমার ! ওখানেই সব জারিজুরি শেষ।
মুখ নিচু করে ওড়নাটাকে আঙ্গুলের ওপরে আরও একটা লেয়ারে পেঁচাতে লাগলাম।
ও বলল, কি হল ? বল কি বুঝলে ?
আমি মুখ নিচু করে প্রায় অস্ফূট গলায় বললাম , আপনি বলুন –
— বলতে পারি । তবে , ওই আপনি’টা বাদ দিতে হবে। অন্যভাবে বলতে বলো । আমি বলব ।
সেদিনের সেই দুটো শর্ত মনে রেখে আমি ওকে বার কয়েক অতি কষ্টে ‘তুমি’ বলার চেষ্টা করেছি । কিন্তু কাজটা যে কি কঠিন ! কিছুতেই পারি না ।
ও হঠাৎ করে বাঁহাতটা বাড়িয়ে আমার মাথার ওপর দিকে গাছের গুঁড়ির ওপর রেখে, ডান হাতে আমার চিবুকে আঙ্গুল দিয়ে আমার মুখটাকে তুলে ধরে বলল , কি হলো ? আপনি’টা বাদ দিয়ে ‘তুমি’ করে বলো । বুঝতে পারলে কি বলছি আমি ?
ওর এই আবদারে, চিবুকে ওর ছোঁয়ায় , তখন আমি তিরতির করে কাঁপছি । কিছু বলবো কি ! আমি তখন আর আমাতে নেই ।
ও বলল , এই লাইন কটার মানে আমি এক্ষুনি তোমায় বুঝিয়ে দিতে পারি । দেব ?
আমি শুকনো গলায় বললাম , হ্যাঁ ।
ও আবারও সেই দিনের সন্ধ্যাবেলার মতো বাঁ হাতের তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে ছুঁয়ে দিল আমার দুটো চোখের পাতা । সেই দুটো সঙ্গে সঙ্গে টুপ্ করে বন্ধ হয়ে পড়ে যেন কোন স্বপ্নের জগতে ডুব দিল ।
আর তখনই..
ঠিক তখনই..!
তখনই কি যে ঘটে গেল আমার জীবনে ! কেমন যে সে অনুভূতি , কিভাবে যে তা প্রকাশ করা যায়, আমি জানি না । বুকের মধ্যে যেন সমস্ত রক্ত দেহের সমস্ত অনুভূতি নিয়ে চলকে উঠলো ।
আমি বুঝলাম , আমার ভয়ে আড়ষ্ট ভিজে ভিজে দু’টো ঠোঁটের ওপর নেমে এসেছে ওর আঙুলের স্পর্শ। তারপরে , আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুঝলাম, এবারে আর আঙ্গুল নয় , ওর উষ্ণ দু’টো ঠোঁটের ছোঁয়া লেগে রয়েছে আমার ঠোঁটে।
চুম্বন !
প্রথম চুম্বন !
আমার ঠোঁটের ওপর ওর ঠোঁটের স্পর্শ ! অনির্বচনীয় সে স্বাদ ! আজও চোখ বন্ধ করলে যেন অনুভব করতে পারি ।
একটা .. দুটো.. তিনটে ..
কেটে চলেছে মুহূর্ত! সমগ্র পৃথিবী থমকে গেছে । পাখিরা উড়ছে না । প্রজাপতিরা ডানা মেলছে না। চা গাছের পাতার ওপর দিয়ে বাতাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে । সমগ্র পৃথিবী একটা মুহূর্তের মধ্যে যেন লীন হয়ে গেছে । সমস্ত রকম চলাচল বন্ধ ।
তারপরেই, সেই স্পর্শ , সেই প্রথম চুম্বন স্পর্শ, আমার বুকের খাঁচা ছেড়ে উঠে এলো মাথায়। মাথা বুঝলো – একটা নির্জন চা-বাগানে সোনু দা আর আমি , আমি আর সোনু দা! আমার বয়স আঠারো, ওর বয়স আঠাশ। দুজনেই যুবক-যুবতী। অবিবাহিত । বাড়ি থেকে দূরে এভাবে দুজনে একটা নির্জন চা-বাগানে ও আমার ঠোঁটে ডুবিয়েছে নিজের ঠোঁট ।
আমি আবার..! আবারও সেই একই ভুল করলাম। শর্ত ভুলে গেলাম । ও যে আমার ওপর অভিমান করেছিল, আমাকে সে অভিমান ভাঙাতে হয়েছিল- সব ভুলে গেলাম । হঠাৎ করে স্বপ্নের জগৎ থেকে উঠে এসে বুঝতে পারলাম , আমি ছুটছি। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছি গাড়ি লক্ষ্য করে । যেন বাতাসের আগে ছুটে চলেছি। হাপরের মতো বুক উঠছে, নামছে। আমি এক ছুটে গিয়ে গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে , সীটে বসে পড়ে , দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিয়ে , কোলের ওপর তুলে নিয়েছি নিজের কলেজের ব্যাগটা । দু’ হাতে ব্যাগটা চেপে ধরেছি বুকের ওপরে।
হাঁপাচ্ছি ।
হাঁপাচ্ছি।
কিছুক্ষণ পরে ও ফিরে এল গম্ভীরমুখে । ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো । গাড়ি স্টার্ট দিল । আমি চোখ বন্ধ করে আছি । সর্বশক্তি দিয়ে বুজে রয়েছি দু’চোখের পাতা ।
খুলবো না ।
আমি কিছুতেই চোখ খুলবো না ।
কি যে হচ্ছে আমার মনের মধ্যে! কত যে অশান্ত ঝড় বয়ে চলেছে! চোখ খুলে ফেললেই যেন সমস্ত পৃথিবী তা জেনে যাবে । তাই আমি চোখ বন্ধ করে থাকবো । কিছুতেই খুলবো না –

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/

পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/

ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/

সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/

আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/

নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/

দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/

এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/

বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/

তেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1000733104050087/

চোদ্দো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1002718000518264/

পনেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1004549847001746/

ষোল-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1009015169888547/

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here