হলদে_প্রজাপতি পর্ব-১৯

0
200

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

উনিশ

( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

এখন সেপ্টেম্বর মাস । ভাদ্র মাস শেষ হয়ে এই সবে আশ্বিন পড়ল। কাজকর্ম বেশ কিছুটা গুছিয়ে নিয়েছি । সামনের মাসের প্রথমের দিকে ছুটির জন্য অ্যাপ্লিকেশনও করে রেখেছি। পুজোর চারদিন তো বটেই, তার আগু পিছু মিলিয়ে প্রায় দিন আষ্টেকের ছুটি নিয়ে পুজোর সময় বাড়ি যাবো। পাঁচ মাস হয়ে গেল এখানে কাজ করা । তবে ছুটি আমি শুধুমাত্র দুটো সিএল ছাড়া আর কিছুই নিই নি। মাঝে দুবার শুধু বাড়ি গেছিলাম । তাও একটা দিনের জন্য । যেদিন পৌঁছেছি তারপরের দিনটা থেকে, তারপরের দিন ব্যাক করেছি। এবারে টানা ছুটিতে বাবা-মায়ের কাছে থাকবো। বাবার শরীরটা ক’দিন ধরে আবার একটু বেগড়বাই করছে। যদিও বাড়াবাড়ি কিছু নয়। তবুও এত দূরে থাকি তো, ইচ্ছা হলেই সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া যায় না । মন খারাপ করে ।

বৃষ্টি বাদলের মাসগুলো শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম । এখন তো আকাশে আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের সমাগম । যদিও আমার চারপাশে শুধুই চা বাগান । সেখানে কাশফুল দেখার বিশেষ সুবিধা হয় না । তবে মনটা মাঝে মাঝেই উড়ে যায় নদীর ধারে, রাস্তার দু’পাশে, যেখানে এখন ভর্তি হয়ে ফুটে রয়েছে কাশফুল , আনন্দে মাথা দোলাচ্ছে । খুব ভোরে উঠলে মাঝে মাঝে দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসে শিউলি ফুলের গন্ধ। কোথাও গাছ রয়েছে । তবে আশেপাশে নয়। তাহলে নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে ভোরবেলা গিয়ে আঁজলা ভর্তি করে টুপটুপ করে খসে পড়া শিউলি ফুলগুলো তুলে আনতাম। মনটা খুব পালাই পালাই করে দূরে কোথাও । এমনিতে সারা বছর এই সবুজ চা বাগানে চোখ রেখেও কোন ক্লান্তি আসে না । তবে , এই প্রথম আশ্বিনের শারদপ্রাতে মনে হয় যেন এই চা বাগান পেরিয়ে, কাশফুলের রাজ্যে, শিউলি ফুলের রাজ্যে , হারিয়ে গেলে বেশ হয় । টগরের গ্রামটা এখান থেকে প্রায় ঘন্টা খানেক কি ঘন্টা দেড়েকের রাস্তা । তার কাছে অনেক গল্প শুনেছিও বটে । ও অনেক বার যেতেও বলেছে । ওর দাদা মাঝখানে একবার ওর সাথে দেখা করতে এসেছিল , আমাকে অনেকবার ওদের বাড়িতে যেতে বলে গেছে । একেবারে যাকে বলে নিখাদ গ্রাম্য এসেন্স পাওয়া যাবে ওদের গ্রামে গেলে । সেটা আমি টগরের মুখে গল্প শুনে বুঝতেই পারি। তাই জন্য একটা ছুটির দিনে ওদের গ্রামে যাওয়ার প্রোগ্রাম ঠিক করেই ফেললাম । আমরা থ্রি মাস্কেটিয়ার্স তো আছিই- পাতা, পাতার মনি, আর টগর । আর তার সাথে থাকবে জগন্নাথ দা। ও’ই আমাদের ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে । প্রোগ্রামটা করতে চাইছিলাম বেশ কিছুদিন ধরেই। কিন্তু বৃষ্টি, তার সাথে ভাদ্র মাসের গুমোট ব্যাপারটা কাটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম । যদিও দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় এখানে ভাদ্রমাসের গুমোট গরম কিছুই নয়। গায়ে লাগেনা । তবে আশ্বিন মাসের ওয়েদার একেবারেই আলাদা। আশ্বিন মাস তো আসেই পুজোর গন্ধ গায়ে মেখে। তার সাথে থাকে শিশিরের গন্ধ , হিমেল হাওয়ার গন্ধ, আসন্ন শীতের উত্তুরে হাওয়ার গন্ধ । তাই আশ্বিনের জন্যই অপেক্ষা করে বসেছিলাম ।

সেদিন সকালে , একেবারে সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়লাম । আজকে আমি একটু হলেও সেজেছি । শাড়ি পরেছি একটা, কচি কলাপাতা রঙের তাঁতের শাড়ি । কপালে শাড়ির রঙের সঙ্গে ম্যাচ করে একটা ছোট টিপ। চোখে কাজল দিয়েছি । ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। শাড়ির কালার এর সাথে কনট্রাস্ট ম্যাচিং মাটির তৈরি নেকপিস আর ইয়ার রিং। গায়ে হালকা সুগন্ধি দিয়েছি। বেড়াতে যাচ্ছি বলে কথা , এটুকু সাজবো না বুঝি?

যাওয়ার পথে পাতাকে তুলে নিলাম তার বাড়ি থেকে।
ইন্দ্রাশিষ বাবু তাকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার সময় দেখলাম তিনি আমার এই সাজপোশাকের পরিবর্তনটুকু লক্ষ্য করেছেন । ভালো লাগলো বেশ । কোথাও যেন সাজার পর পুরুষ চোখের অ্যাপ্রিশিয়েসনটা বেশ ভালো লাগে।
তিনি বললেন , দেখবেন আবার , মেয়ে যে বিশেষ সুবিধের নয়, সে তো নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন এই কটা মাসে। এখানে আপনার বাড়িতেই থাকে সেটা অন্য রকম , এখন আবার একটা অন্য জায়গায় যাচ্ছে তো –

আমি মুখ বাড়িয়ে বললাম, আপনি একেবারেই চিন্তা করবেন না । আমি যদি তাও দুটো মিনিটের জন্য ওর খেয়াল রাখতে ভুলে যাই, টগর কখনোই ভুলবে না । সে সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতে পারেন ।
উনি হেসে বললেন , সে আর বলতে? আমার মেয়ে একচুয়ালি আপনাদের কাছেই সবচেয়ে ভালো থাকে। আমার বাবা হয়ে এসব কথা বলার আর মুখ কোথায় ? আমি ওকে আর সারাদিনে কতক্ষণ সময় দিই , বলুন ?
হাত নেড়ে বললাম, আজ চললাম । তবে , নেক্সট টাইম আপনাকে একদিন হাইজ্যাক করে নিয়ে যাব বেড়াতে । সেদিন যেতে হবে কিন্তু-
উনিও হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ । আজকেই যেতে ইচ্ছে করছিল বটে , তবে লোভ সামলে নিলুম । নেক্সট টাইম আর সামলাতে পারবো না-
— আচ্ছা !
হাসি মুখে হাত নাড়লাম। জগন্নাথদা গাড়ি চালিয়ে দিলো ।
সবুজের বুক চিরে এগিয়ে চলল গাড়ি । পাতা সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে । অনর্গল বকে চলেছে জগন্নাথদার সঙ্গে । ওর উত্তেজনা চোখে পড়ার মতো । আধঘন্টা মত মেঠো রাস্তার ওপর দিয়ে গাড়ি চলার পর পিচের রাস্তায় এসে পড়ল । তারপর উত্তর মুখে চলল গাড়ি। মোট ঘণ্টা দেড়েকর কিছু বেশি সময় লাগল টগরদের গ্রামে পৌঁছতে ।

গ্রামটি বড় সুন্দর । একেবারে ছবির মতই । খুব বেশি হলে পঞ্চাশ ঘর মানুষের বাস হবে । প্রতিটা ঘর মাটির সুন্দর করে নিকানো , চকচকে তকতকে । প্রতিটা বাড়ির মধ্যে বেশ কিছুটা দূরত্ব রয়েছে এবং প্রতিটা বাড়িতেই প্রয়োজনীয় ফল, সবজি , কিছু ফুল গাছ রয়েছে। টগরদের বাড়িটা টালির ছাউনি দেওয়া সুন্দর করে নেকানো, একটা এল প্যাটার্ন এর মাটির বাড়ি। মাঝখানটা মাটির উঠোন । তার তিন ভাই তার মধ্যে একজন তার থেকে বড়, দাদা । আরো দুজন টগর এর চেয়ে বয়সে ছোট, তার ভাই। প্রত্যেকেই বিয়ে থা’ করে সংসারী মানুষ । তার বড় ভাইয়ের যে ছেলের কথা সে বলেছিল, তার কথা অনুসারে ইন্দ্রাশিষ বাবুর কাছে চিকিৎসা করিয়ে যে সুস্থ হয়, সে এখন রীতিমত জোয়ান । তিন ভাইয়ের মোট আট ছেলেমেয়ে । বড় দাদার দুই মেয়ে, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে । এখন মোট ছ’টি ছেলেমেয়ে সেই বাড়িতেই থাকে। অর্থাৎ তাদের বাড়ির এখন মোট সদস্য সংখ্যা টগরের তিন ভাই, তিন ভাইয়ের বউ , ছয় ছেলেমেয়ে – এক ডজন সদস্য । তারা ভেতর ঘরগুলো সব নিজেদের মতো ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে। এখানকার বাড়িঘর প্রায় সবই বাস্তুশাস্ত্র মেনে তৈরি করা । বেশিরভাগ বাড়িতেই পশ্চিমদিকে কিছু সুপারি গাছ এবং সুপারি গাছ লতিয়ে ওঠা কিছু পান গাছ রয়েছে । পান-সুপারি এদের জন্য শুভ ।

আমরা পৌঁছলাম যখন, তখন প্রায় নটা বাজে। বাড়ির প্রত্যেকের সাথে আলাপ হল প্রথমে, উঠোনে জলচৌকিতে বসে । একটা বেশ বড়সড় রসগোল্লার হাঁড়ি নিয়ে এসেছিলাম , সেটা টগরের বড়বৌদির হাতে দিলাম । ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গুলো বেশ লাজুক । তারা দালানের খুঁটি ধরে দূর থেকে জুলজুল করে তাকিয়ে দেখছে, কিন্তু সামনে এসে আলাপ করার বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না । আমি বুঝতে পারছিলাম টগরের বৌদিরা আমাকে বেশ কৌতুহলী ভঙ্গিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আমার মত বয়সের একজন অবিবাহিতা, কর্মরতা মহিলা – সেই বস্তুটা যে ঠিক কি হতে পারে, সেই সম্পর্কে একটু ধ্যান-ধারণা করার চেষ্টা করছিলো মনে হয়। যাইহোক, প্রাথমিক আলাপ শেষে তারা যে যার কাজে চলে গেল । বড় বৌদিটি মনে হয় হেঁশেলের দায়িত্বে রয়েছে । বাকিরা কেউ গৃহস্থালির কাজে, গোয়ালের কাজে ,এসব নানাবিধ কাজে চলে গেল ।
মোটামুটি আধঘণ্টার মধ্যেই আমাদের জন্য জলখাবার এলো। জলখাবারের মধ্যে যেটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় সেটা হল, ঝকঝকে কাঁসার বাটি আর থালা । দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায় । আজকালকার দিনে আর দেখা যায় কোথায় ? কাঁসার থালাতে করে এলো ঘরে ভাজা মুড়ি, তার সাথে ক্ষেতের বেগুনের ফুলকো বেগুনি । বাটিতে এল আলুর তরকারি , ক্ষেতের আলু নিশ্চয়ই। তার সাথে গুড়ের নারকেল নাড়ু ।
এই অঞ্চলের গ্রামগুলোর পরিবেশ বেশ অন্যরকম । গ্রামের মধ্যে এবং তার আশেপাশের কিছুটা অঞ্চল জুড়ে ক্ষেতে বিভিন্ন শাক সবজি চাষ হলেও, কিছুটা দূর থেকেই শুরু হয়ে যায় দিগন্তবিস্তৃত সেই চা বাগান । আমরা আসছি শুনে সেদিন টগরের তিন ভাই সকাল থেকে বেরোয়নি । তাদের সাথে গল্প করতে করতে খাওয়া-দাওয়া চলল। খাওয়া-দাওয়া সারা হতে আমি আর পাতা বেরোলাম । টগর অনেকদিন বাড়ির লোকজনের সাথে গল্পগাছা করতে পারেনি। সে বৌদিদের সঙ্গে হেঁসেলে ঢুকে গল্প জুড়ে বসল । আমাদের সঙ্গে তার দুই ভাইপো ভাইঝি হারু আর লক্ষ্মীকে পাঠালো । লক্ষী তার ছোট ভাইয়ের মেয়ে । সে প্রায় পাতার সমবয়সি । হারু তার থেকে কিছুটা বড়। পাতা আর লক্ষীর ইতিমধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেছে । পাতা এখানে এসে পড়ে খুবই আপ্লুত । সে খোলামেলা পরিবেশ পায়, খেলার অনন্ত জায়গা পায় , তবে তার খেলার সাথীর বড় অভাব । এখানে এসে তার সমবয়সী প্রায় দু-তিনজন সাথী পেয়ে সে রীতিমত উত্তেজিত । আমরা গ্রামের মধ্য দিয়ে ক্ষেতের দিকে চললাম । এখানে গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটলে মনে হয় যেন সেটা বাড়ির উঠোন । বাচ্চা ছেলেরা খেলছে । ইতস্তত ফুল গাছ লাগানো । মেয়েরা কাজ করছে । মুরগি চরছে । প্রাত্যহিক কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে প্রতিটা মহিলা-পুরুষ-শিশু আমাদের দিকে দেখে নিচ্ছিল। প্রতিটা বাড়ি থেকে গ্রাম্য ভাষায় কথাবার্তার শব্দ, গোয়াল ঘরে গরুর ‘হাম্বা’ ডাক , কোথাও কোথাও আবার দুধ দোয়ানোর চ্যাঁচোঁ শব্দ , সাথে বালতির টুং টাং , কোথাও আবার মাটির উনুনে আঁচ দেওয়া হচ্ছে, তার ধোঁয়া । এখনো এখানে বেশিরভাগ বাড়িতেই মাটির উনুনে রান্না হয়।

আমরা কাছাকাছি কয়েকটা বাড়ি পেরিয়ে একটা ক্ষেতে এসে পড়লাম ।
হারু হাত তুলে দেখিয়ে বলল, হুই যে , হোইই যে আমাদের ক্ষেতি , বুঝলা ?
এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সেখানে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ হয়েছে । কিছুটা কিছুটা অংশ এক একটা সবজির জন্য বরাদ্দ । যেমন আলু , বেগুন, উচ্ছে , কলাই , এইরকম বিভিন্ন । আবার মাচা বানিয়ে কিছু লতানে গাছ লাগানো হয়েছে- লাউ, কুমড়ো, মাচার নিচের দিকে ঝুলছে কয়েকটা । পাতা পরম মমতায় সবজিগুলোর গায়ে হাত বোলাতে লাগলো চোখ বড় বড় করে ।
মাঝে মাঝে পাতাকে ফিসফিস করে বলা লক্ষ্মীর দু-একটা কথা আমি শুনতে পাচ্ছিলাম — হুই যে লাউটা, ওইটা মা কাল রান্ধবে, বুঝলা ? … আমি একন একেন থিকে শাক তুলব , বড়মা চেয়েচে যে..
সে উবু হয়ে বসে লালশাক তুলতে লাগলো ।
আমি হারুর দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমাদের বাড়ি থেকে যে এতটা দূরে এসে সমস্ত চাষ হয় , পাখি হনুমান এসব খেয়ে যায় না?
— বা রে ! হুই হুইটা আচে কিনা-
হাত তুলে সে একটা কোন বস্তুর দিকে নির্দেশ করল । তবে সেরকম কিছু দেখতে পেলাম না সেখানে। নিমেষের মধ্যে সে ছুটে গিয়ে ক্ষেতের ওপর কাৎ হয়ে পড়া একটা বাঁশের লাঠি ধরে একটা কিছুকে তুলে দাঁড় করালো । দেখলাম সেটা একটা কাকতাড়ুয়া । হয়তো সেটা হাওয়ায় কাত হয়ে পড়ে গেছিল।
সেটাকে তুলে নিয়ে হারু মাটির মধ্যে গেঁথে বসাতে বসাতে বলল,
-জাগি জাগি জাগি
যে কামের কাম
সেই কামেতে নাগিস-
এই একই ছড়া সে মন্ত্র আওড়ানোর মতো বারবার আওড়াতে লাগলো।
আমি হেসে বললাম, ও কি বলছো হারু?
সে কাকতাড়ুয়াটা জমির মাটিতে বসানোর কাজ শেষ করে ছুটে এসে বলল, এইটে কইতে হয় যে ! নাইলে কাক পক্ষীতে সব খেয়ে নিবে !
লক্ষীর কোঁচর ভরে শাক তোলা হতে সে তার ফ্রকের কোঁচোর উঁচু করে তুলে ধরে শাকগুলোকে নিয়ে ছুট দিল বাড়ির দিকে । মিনিট খানেকের মধ্যেই অবশ্য ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হলো । আমরা চারপাশের আরো কয়েকটা চাষের ক্ষেত ঘুরে দেখলাম । সেগুলো অবশ্য টগরের দাদাদের নয় । অন্যান্য বাড়ির । তাদের মধ্যে কিছু কিছু পুরুষ মহিলা তখন গাছগাছালি তদারকি করতে সে অঞ্চলে এসেছিল। তারা হাঁ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল । বোধহয় আমার আসার খবর গোটা গ্রামটায় চাউর হতে সময় লাগে নি । ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে ফিরে গেলাম টগরদের বাড়িতে । ফিরে যাওয়ার আগে হারু আর লক্ষ্মী অবশ্য আমাদের সেই মাশান ঠাকুরের থান দেখিয়ে আনলো। প্রকাণ্ড একটা বটগাছের নিচে ছোট মত একটা মন্দির । বটের ঝুরিগুলো মাটিতে নেমেছে । গ্রামের একেবারে প্রান্তে সে জায়গা । দু’তিনটে গরুর খুঁটি বাধা রয়েছে । তাছাড়া সেখানটা জনমানব শূন্য । আমি অবশ্য কাটরা-পুকুরটাও দেখতে চেয়েছিলাম । শুনে হারু আর লক্ষ্মী দুজনেই দু’ ইঞ্চি করে জিভ বার করে, দু’কানের মধ্যে আঙ্গুল গুঁজে দিল। আর বিশেষ ভরসা পেলাম না।

বাড়িতে ফিরে এসে কিছুক্ষণ গল্পগাছা করলাম টগরের বৌদিদের সাথে । তারা ততক্ষণে গৃহস্থালির কাজকর্ম মোটামুটি সেরে ফেলেছে। দাওয়ায় বসে কথাবার্তা হচ্ছিল। গ্রামের কথা, পাড়া-প্রতিবেশীর কথা, তাদের সন্তানদের কথা, সব রকম কথা ।
উঠোনের কোণের দিকে একটা বাঁশের লাঠির মত কি একটা রয়েছে । তার গায়ে চৌকোনা জালের মত একটা গঠন ।
জিজ্ঞাসা করলাম, ওইটা কি ?
টগরের মেজবৌদি উত্তর দিল, ওইটে যে টঙ্গী জাল । ভরা বাদলে এইসব নিয়ে বেরিয়ে ছেলেপুলেরা সব মাছ ধরে আনতো।
মনে পরল টগরের সেই মাছ ধরার গল্প ।
টগরের বড়বৌদি বেশ উত্তেজিত গলায় আমাকে বলল , আপনে আইজ রেতে থাইবেন নে ?
হেসে বললাম, না, রাতে তো থাকা হবে না।
সে গালে হাত দিয়ে ভীষণ অবাক হয়ে বলল, ওমা ! তাইলে কি করে হবে ? আইজ যে বৈকাল থিকে পালাগান আচে। পালটিয়া গান হয় যে ভাদর শেষে আশিন মাসে। আইজ মোদের বাড়ির দুয়ারে বইবে কিনা –
— তাই নাকি ? সেটা কিরকম?
— আপনে তো রেতে থাইবেন নেকো । তাইলে আর কিভাবে দেখবা ?
তার ছোট যা বলল, অবশ্যি বৈকাল থিকে শুরুটা হই যাবা । রেতে যদি কিছুতেই না থাকা হয় কিনা, শুরুর খানটা দেখতে পাবা-
টগর কোথা থেকে ঘুরে এসে আলোচনা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল , দিদি তোমাকে তো কতবার বললাম কিনা, এই একটা রেতে থেকে যাও । তা, তুমি তো শুনবা না কতা।
মাঝের এই কটা মাসে ওর আমাকে ‘মেম’ বলা আর ‘আপনি আজ্ঞে’ করাটা ছাড়িয়েছি। প্রথম প্রথম দিদিমণি বলছিল । এখন অবশ্য শুধু ‘দিদি’ বলে ।
আমি বললাম, না গো টগর । তুমি তো জানোই । আজকে ছুটির দিন ছিল বলে আসতে পারলাম । কালকে সাত সকালে উঠে বাড়িতে ফিরে গিয়ে আবার সেই সারাদিন দৌড়ঝাঁপ আর পারি না গো । রাত্রেবেলাটা একটু রেস্ট নিলে সকাল থেকে ফ্রেশ লাগবে ।
আরো কিছুক্ষণ গল্পগাছা চললো ।
তারপর টগর বললো, আমাদের পাতা তো খুব জোর করছিল পুকুর ঘাটে নাইতে যাবে বলে ।
শুনে আমার চোখ কপালে উঠলো , বললাম , সেকি ! ও তো তোমার সাথেই ছিল-
অল্প হেসে সে বলল , আরে চিন্তা করেন না দিদি । ওকে আমি ওমনি ঝোঁক করলেই কি পুকুরে নাইতে পাঠিয়ে দেবো নাকি? জোর করে চানঘরে নাইতে পাঠিয়েচি। এমনি হয়তো এতক্ষণে তার নাওয়া হলো । তুমি নেয়ে নাও যাও-

স্নান সেরে দুপুরে খেতে বসলাম । ভাতের পাতে ছিল- অল্প মোটা চালের ভাত , তার সাথে জমির লালশাক ভাজা, লক্ষ্মী যেগুলো কোঁচর ভর্তি করে তুলে এনেছিল ; উচ্ছে ভাজা , ডাল , লাউ ঘন্ট, ডালের বড়া দিয়ে মোচার তরকারি, দেশী মাগুরের ঝোল , সরপুঁটি দিয়ে তেঁতুলের টক, তার সাথে দই , মিষ্টি । প্রতিটাই কাঁসার পাত্রে , একেবারে যেন সোনার মতো ঝকঝক করছে । একটা রেকাবিতে আবার সাজা পান কয়েকটা । এটা নাকি তাদের শুভ । অতিথি আপ্যায়নের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । অনেক কিছু আয়োজন করেছে তারা । মোটামুটি সবই খেলাম । তবে মিষ্টিটা আর খেতে পারিনি ।
খেয়েদেয়ে উঠে মাটির ঠাণ্ডা ঘরে একটু গড়াতে ইচ্ছে করলো । পাতা তো মোটেই শোবে না । সে তার নতুন পাওয়া সঙ্গীদের সাথে খেলায় মত্ত । টগরকে বলে দিলাম পাতাকে চোখে চোখে রাখতে । অবশ্য তাকে এসব ব্যাপারে কিছু বলতে হয় না । সে আমাকে তাদের বাড়ির মধ্যে যেটা সবচেয়ে বড় শোবার ঘর , দক্ষিণ খোলা , সেই ঘরটাতে মেঝের ওপরে একটা চাটাই বিছিয়ে দিল । শুয়ে পড়লাম সটান । মাটির ঠান্ডা ঘরে , মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে যেভাবে ঘুমটা হবে , সেটা একেবারে স্বর্গীয় । কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়লাম ।
ঘুম ভাঙলো যখন, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল । বাড়ির উঠোনের দিকে সম্মিলিত কিছু মহিলা মহলের গলার আওয়াজ পেলাম । ঘরের দরজা খুলে তাকিয়ে দেখলাম বেশ কিছু প্রতিবেশী মহিলার সমাগম হয়েছে বটে । বাইরের দালানে বেরিয়ে এলাম গুটি গুটি পায় । হ্যাঁ , বেশ কিছু জনের জমায়েত হয়েছে । দু একজন অচেনা পুরুষও রয়েছে সেখানে । তারপরেই মনে পড়ে গেল, ওহো ! একটা পালাগান না কি যেন হওয়ার কথা বলছিল টগরের বৌদিরা । ধীরে ধীরে কিছুক্ষণের মধ্যে উঠোনটা বেশ ভরে উঠলো । মহিলার সংখ্যাই বেশি, তবে পুরুষও রয়েছে। টগর পাতাকে নিয়ে এসে আমাদের দুজনের হাত ধরে একেবারে সামনের সারিতে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো পালটিয়া গান পাবন । উর্বর ফসলের কামনায় আশ্বিন মাসে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে এই পালাগান হয় । ভাওয়াইয়া গান আর ছড়ার তালে তালে পৌরাণিক কোন উপকথার সূত্র ধরে নাচ । বিভিন্ন পালাগান, এই ধরনের আসর, এখনো উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে দেখা যায় । ভাওয়াইয়া কথাটা হয়ত ‘ভাব’ থেকে এসেছে । পালাগান , সাথে সাথে আবার কিছু গ্রামবাসী বিভিন্ন প্রাণীর আদলে গড়া মুখোশ পরে তালে তালে ঘুরে ঘুরে নেচে থাকে। এই মুখোশের চল ভুটান সান্নিধ্য থেকে এ অঞ্চলে এসে থাকতে পারে, কিংবা পুরুলিয়া মেদিনীপুর থেকে চা বাগানের ব্যবসার একেবারে আরম্ভের দিকে বেশ কিছু শ্রমিক এনে উত্তরবঙ্গে কাজ করানো হতো, তাদের থেকেও পুরুলিয়ার ছৌ নাচের আদলে এখানে প্রচলিত হয়ে থাকতে পারে । পৌরাণিক বিভিন্ন চরিত্র, হিন্দু ঠাকুর দেবতা , শিব পার্বতী, রাধা কৃষ্ণ , এই সব গানের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে। ভাওয়াইয়া আর চটকা গান এই দুই লোকগীতি মূলত উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে এই সমস্ত পালাগানে গাওয়া হয়ে থাকে। যে সমস্ত স্ত্রী-পুরুষরা গান গাইবে , তারা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে মাথায় ফুল গুঁজে সেজেগুজে এসেছে, আবার পুরুষরা পরেছে কোঁচা মেরে ধুতি পাঞ্জাবি । দোতারা রেখেছে সঙ্গে ।

আমি বেশিক্ষণ সেসব শুনতে পারলাম না। সময় নেই যে । তবে তার মধ্যে একটা গান বেশ কানে বাজতে লাগল। গানের কথাগুলো এইরকম, কিছুটা বৈষ্ণব পদাবলীর ছোঁয়া-
“কিসের মোর রাঁধন , কিসের মোর বাড়ন
কিসের মোর হলুদী বাঁটা
মোর প্রাণনাথ অন্যের বাড়ি যায়
মোর আঙিনা দিয়া ঘাটা -”
কল্পনায় দেখতে পেলাম একটি বিরহী মেয়েকে ছেড়ে তার প্রেমাস্পদ চলে যাচ্ছে । তার হৃদয়ের সবটুকু উথাল পাথাল করে দিয়ে। ঠিক যেমন রাধাকে ছেড়ে কানাই চলে গেছিল । সেই মেয়েটির কাছে সংসারের সমস্ত কাজ অর্থহীন লাগছে তাই । উদাস হয়ে গেল মনটা।

হঠাৎ করে আমার হাতের ওপর কারো আঙ্গুলের স্পর্শ পেলাম । কেউ যেন আমায় ডাকছে । মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম একটি গ্রাম্য বধূ , সে একটু দূর থেকে হাত বাড়িয়ে আমার হাতের ওপর চাপ দিয়ে আমাকে ডাকছে ,
— অ দিদিমুণি –
আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম তার দিকে , আমাকে কিছু বলছো?
ওপর নীচে ঘাড় নাড়লো সে ।
বললাম, কি বলছ?
সে বলল, আপনে মানিজার দিদিমুণি কিনা ?
— হ্যাঁ বল-
খুব উত্তেজিত হয়ে সে বলল, মোর ভাইটু আচে না ? আপনের ওকেনে কাম করে যে । গোপাল, গোপালকে চিনেন কিনা ?
অল্প হাসলাম । কত লেবার, তার মধ্যে কে গোপাল, কেইবা সুবল। চেনা সম্ভব নয় ।
মুখে বললাম, আমার চা বাগানে ? তুমি বুঝি তোমার ভাইয়ের মুখে আমার কথা শুনেছ ?
— হিঁ গা । সে তো খুউব কয় আপনের কতা। এই পেত্তম তুমি মে’ছেলে হই কিনা মানিজার হই এলা! বাপ্পাহ্!

গালে হাত দিয়ে প্রায় চোখ কপালে তুলে সে বললো,
— আমি কই কিনা, মোর কত্তারে সব্যক্ষণ কই । মোদের দিয়া তো সারাটা জেবন রান্ধাবাড়া , উঠোন নিকেন বই আর কিচ্চুটি করতে দিলা না । মোদেরও বুজি নেকাপড়া করাইলে মোরা ওরম চারটে নিকে-যুকে কাম-কাজ কত্তে পাইতাম নেকো? যকনই ভাই ফোন করে কিনা, আমি আপনের কতা শুদাই । আপনের কথা শুনতে কি ভালোই যে নাগে –

কী ভাল যে লাগলো তার কথাগুলো শুনে ! এই প্রথম আজ এক অজ পাড়াগাঁয় এসে পালাগান শুনতে শুনতে একটি গ্রাম্য বধূ আমাকে মন খুলে বলল , তার আমাকে খুব ভালোলাগে । আমার গল্প শুনে নাকি আমাকে তার ভারী পছন্দ । আমি চা বাগানের ম্যানেজার হয়েছি, পড়াশোনা করে চাকরি করছি, এটি তার ভারী পছন্দের । তারও জীবনে সাধ ছিল, সেও লেখাপড়া করে চাকরি করে। চা বাগানে মহিলা হয়ে ম্যানেজার পোস্টে জয়েন করার পর থেকে এটি আমার প্রথম অ্যাপ্রিসিয়েশন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে।

সন্ধ্যার মুখে মুখে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম । বেরোনোর আগে টগরের সবকটা ভাইপো ভাইঝিকে দুশো’টা করে টাকা দিয়ে এলাম । সামনে পুজো । তারা তাদের মনের মতো করে খরচ করবে । ওরা খুব খুশি হলো। গাড়িতে উঠে বসলাম । টগরের বাড়ির প্রত্যেকে তো বটেই , অন্যান্য বাড়ির অনেকেও আমাদের গাড়ির সামনে এসে আমাদেরকে বিদায় জানালো । বারবার করে আবার আসতে বলল ।
জগন্নাথ দা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিল । এগিয়ে চলল গাড়ি । তখনো পর্যন্ত জানতাম না , সেদিন কি সাংঘাতিক এক ঘটনা ঘটতে চলেছে-

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/

পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/

ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/

সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/

আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/

নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/

দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/

এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/

বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/

তেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1000733104050087/

চোদ্দো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1002718000518264/

পনেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1004549847001746/

ষোল-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1009015169888547/

সতেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1009015169888547/

আঠারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1011129543010443/

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here